কেন, গৃহলক্ষ্মী কি গৃহে নেই আপনার? লীলাবতী বিস্ময় মানে।
যে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিতাই হলেন না গৃহে, তাঁকে গৃহলক্ষ্মী কেমন করে বলি।
লীলাবতীর কৌতুক অন্তর্হিত হয়। সে ভেবে পায় না, এই সুপুরুষ কান্তিমান যুবক কেন এখনও অবিবাহিত। সে অধিকতর কৌতূহলী হলো। বললো, আত্রেয়ী তীরের গ্রামগুলিতে রমণী যথার্থই কি মহার্ঘ?।
শ্যামাঙ্গ দেখছিলো, সূর্যোদয় হয়েছে তার বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, এই বাক্য ব্যয় অহেতুক। প্রত্যুষের এই বিজন কানন পথে লীলাবতীর মতো যুবতী রমণী যতোই আকর্ষণীয়া হোক, চৈত্র দ্বিপ্রহরের মার্তণ্ড প্রতাপ তার চেয়েও অধিক সর্বগ্রাসী। সে বললো, ভদ্রে, অনুমতি করুন, যাত্রারম্ভ করি–বিলম্ব হলে পথে কষ্ট হবে, আমি আবার আসবো, তখন কথা হবে।
লীলাবতী গম্ভীর হয়। কিন্তু সরে যায় না। শুধু বলে, বিদায়কালে মিথ্যা ভাষণ করতে নেই।
মিথ্যা ভাষণ? শ্যামাঙ্গের এবার বিলক্ষণ উন্মা হয়। বলে, কোথায় দেখলেন যে আমি মিথ্যা ভাষণ করেছি?
মিথ্যা নয়? বলুন, কোন প্রয়োজনে আবার আপনি এ পথে আসবেন?
লীলাবতীর দুচোখে এবং কণ্ঠস্বরে বিচিত্র একটি ভাব তখন জেগে উঠেছে। দেখে শ্যামাঙ্গের মনে হলো, সম্মুখের এই যুবতী রমণী অহেতুক তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে নেই। যদি আরও বিলম্ব করে, তাহলে অন্য কিছু একটা ঘটে যাবে।
সে বললো, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু আমার কথা শুনে রাখুন, যাত্রাকালে আমি মিথ্যা ভাষণ করবো না। আমার গুরু বসুদেব বিল্বমূল গ্রামে রয়েছেন–তাঁর সঙ্গে আমার বাদানুবাদ হলেও তাঁর কাছে আমাকে যেতেই হবে আর দ্বিতীয় কথাটি এই যে, আমি বাল্যকাল থেকে মাতৃহীন, আপনাদের গ্রামে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছি, কথাটা মায়াবতী জানে না, তার জননীও জানেন না। ওই মাতমুখ দর্শনের জন্য আপনাদের গ্রামে সত্যিই আমি আবার আসবো।
লীলাবতীর মুখের কুঞ্চিত ভ্রূ সরল হয়, ওষ্ঠের কোণে হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, চপল স্বভাব বালিকার মতো অনেক কথা বলে ফেলেছি, মনে কিছু নেবেন না–তবে যদি কখনও এ পথে আসেন, তাহলে সেই ভবিষ্যতের জন্য উজুবট গ্রাম পূর্বাহেই আপনাকে স্বাগত জানিয়ে রাখলো, আপনি নিশ্চয়ই আসবেন।
লীলাবতী চলে গেলে, পথ অতিক্রম করতে করতে শ্যামাঙ্গের মনে নানান চিন্তার উদয় হয়। সমস্তই লীলাবতী প্রসঙ্গ। বারবার মনে হলো, ঐ যুবতী দুর্বোধ্য বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। বারবার তার ঐ শ্লোকটির কথা মনে হলো, যাতে বলা হয়েছে যে, দেবতারাও স্ত্রী চরিত্র বিষয়ে অজ্ঞ। তার অনুমান হলো সম্ভবত লীলাবতীর মতো নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো বলেই শ্লোককার শ্লোকটি রচনা করেছেন।
লীলাবতী গৃহে প্রত্যাগমনকালে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলো। বলছিলো, ছি ছি দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা হলো না, এতো কথা বলতে গেলি কেন? তুই না গতকালের ধারণা নিরসন করতে এসেছিলি? এ যে গতকালের চাইতেও অধিক হয়ে গেলোতোর যে অনেক কিছু জেনে গেলো লোকটা। ছি ছি
তার মেষ শাবকটিকে ঐ সময় সে দেখলো, দূরে একটি গোধুম ক্ষেত্রে বিচরণে ব্যস্ত। তার ইচ্ছে হলো না যে, শাবকটিকে গিয়ে ধরে। বরং তার মনে হলো, পিতা হয়তো এতোক্ষণে জেগে উঠে চিৎকার আরম্ভ করে দিয়েছেন। সে দ্রুতপদে গৃহাভিমুখী হলো। পথিমধ্যে হঠাৎ এক কোকিল চিৎকার করে উঠলে সে গালি দিলো, দগ্ধমুখ, তোর মরণ হয় না! মধুক বৃক্ষ তলে দেখলো, একটি প্রকাণ্ড প্রজাপতি উড়ে এসে তার উচ্চ করবীতে বসতে চাইছে–সে ছি ছি করে উঠলো পুনরায়–ধিক তোকে, আমার কাছে কেন, চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস? অন্ধ কোথাকার, যে লোকটি আত্রেয়ী তীরাভিমুখে চলেছে, তাকে দেখতে পাসনি?
গৃহে উপনীত হয়ে দেখে, পিতা সত্যিই জাগরিত হয়েছেন, তবে চিৎকার করছেন। সে অবাক হলো। কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে দেখে, একটি লোক পিতার শয্যাপার্শ্বে বসে আছেন এবং পিতা তাকে নিজ দুর্দশার কথা বলে যাচ্ছেন।
সে বাধা দিলো না, এটা আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অপরিচয়–পরিচয় নির্বিশেষে পিতা এই কাজটি আজকাল করেন।
আগন্তুক শ্মশ্রুধারী, প্রৌঢ়। তাঁর হাতের যষ্টিটি বঙ্কিম, সম্ভবত হেমতালের। গ্রীবায় প্রস্তরখণ্ডাবলীর মালা, পরিধেয় অত্যন্ত অপরিষ্কার, কাছে গেলে এক প্রকার দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসে। লীলাবতী ভাবছিলো, লোকটিকে বিদায় করে দেয়। কিন্তু হঠাৎ শুনলো, লোকটি ডাকছে, মা লীলা, এদিকে এসো।
নিকটে গেলে পিতা বললেন, ইনি তোমার মাতুল, যোগব্রত নিয়েছেন–সংসারে থাকেন না, এঁকে প্রণাম করো।
লীলা প্রণাম করলে বললেন, ভ্রাতঃ, একে স্বামীগৃহে পাঠিয়ে দাও–অনেক দিন তো রইলো তোমার কাছে। হরকান্ত পরমকুটুম্বের পরামর্শ শুনে কিছু বললেন না। লীলা গৃহকর্ম দেখবার জন্য বাইরে গেলো।
যোগী সিদ্ধপা এক সময় পুনরায় বললেন, ভ্রাতঃ, দিনকাল ভালো নয়–যুবতী মেয়েরা ক্রমেই অরক্ষণীয়া হয়ে পড়ছে–তোমার সৌভাগ্য যে রাজপুরুষদের দৃষ্টি তোমার কন্যাটির উপর পড়েনি।
আগন্তুক হরকান্তকে পূর্বদেশের, পশ্চিমদেশের, দক্ষিণদেশের নানান কথা জানালেন। যেমন পূর্বদেশে পুনরায় সদ্ধর্মীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে–পশ্চিমে রাষ্ট্রবিপ্লব সমুপস্থিত, ভয়ানক যবন জাতি শনৈঃ শনৈঃ পূর্বে অগ্রসর হচ্ছে–কখন কী হয়, বলা যায় না। এমত শোনা যায় যে, এই যবন রাজ মূর্তিমান যম একেবারে। খর্বদেহ, কিন্তু বাহু দুটি যেন ভূমিস্পর্শ করে। শ্মশুকেশ উভয়ই ঘন, চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ–এবং যখন নিজ ভাষায় ইয়া। আলী বলে হুঙ্কার দেয়, তখন মানুষের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। হাতের অস্ত্র ত্যাগ করে সৈনিক পুরুষেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে।