গ্রাম এখনও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেনি। সূর্যোদয়ের এখনও কিছু দেরি, বাতাসে ঈষৎ শৈত্যভাব। কোথাও কোথাও গবাদি পশু গোশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে পেছনে কিশোর রক্ষপাল।
পথের দুধারে আম্রবৃক্ষ, নবাম্রভারে কোনো কোনো শাখা আভূমি বিনত। পনসবৃক্ষের কাণ্ডগুলি ফলপিণ্ডে আকীর্ণ। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে সে গ্রাম সংলগ্ন কাননে প্রবেশ করলো। মনে হলো, কুসুমিত মধুক বৃক্ষবীথির সুগন্ধ তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মধুপ গুঞ্জরণের ধ্বনিও শ্রবণে এলো। একটি কুক্কুরকে ভূমিনত মস্তকে ইতস্তত ভ্রমণ করতে দেখে সে অবাক হয়। কুক্কুরও কি মধুক পুষ্প ভক্ষণ করে? কিন্তু অচিরেই সন্দেহ নিরসন হয়। ওটি কুক্কুর নয়–নিতান্তই শৃগাল। সে ভূমি থেকে লোষ্ট্ৰখণ্ড হাতে নিয়ে শৃগাল লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে।
আর তখনই একটি হাসির শব্দ তাকে সচকিত করে দেয়। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখে, লীলাবতী অঞ্চল মুখলগ্ন করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিব্রত বোধ করে–লোষ্ট্র নিক্ষেপের ঐ বালসুলভ কাণ্ডটি না করলেও পারতো। লীলাবতী নিশ্চয়ই তাকে বালকের মতো চপল–স্বভাব বলে ধারণা করছে। চোখে চোখ পড়লে তাকে হাসতে হলো। বললো, এতো প্রত্যুষে এখানে আপনি?
আমার মেষ শাবকটির সন্ধানে এসেছি, লীলাবতী জানায়। বলে, আর বলবেন না, এই মাতৃহীন শাবকটি বড় জ্বালাতন করে–তা আপনি কি যাত্রা করলেন?
হ্যাঁ, আজ বহুদিন আমি গৃহত্যাগী, গৃহে প্রয়োজনীয় কর্মাদি রয়েছে।
বিগত রাত্রির কথা স্মরণ হওয়ায় শ্যামাঙ্গ পুনরায় বলে, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আম্রপট্টলীতে নিশ্চয়ই যাবো।
তার ঐ কথায় কী ছিলো ঈশ্বর জানেন, লীলাবতীর হাস্যালোকিত আননে যেন ছায়া পড়ে একটি–কুঞ্চিত হতে দেখা গেলো তার ভ্রূযুগল। মুখের ঐ ভাব গোপন না করেই সে বললো, গত রাত্রির কথা স্মরণ রেখেছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু একটা কথা জানবেন, গত রাতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহাতিশয্য ছিলো মায়াবতীর, আমার নয়, যা শুনেছেন, ঐসব কথাও আমার নয়।
আপনার নয়? শ্যামাঙ্গ হতচকিত বোধ করে–এ কী কথা শুনছে সে পুনর্ভবা তীরের। প্রোষিতভর্তৃকা এই যুবতীর মুখে?
আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমি বিরহ কাতরা?
শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে, সত্যিই তো, প্রোষিতভর্তৃকা বিরহ কাতরা রমণীর বেশবাস ও আচরণ কি এই প্রকার হয় কখনও?
সে প্রশ্ন না করে পারে না। বলে, আপনার স্বামীকে কিছুই জানাবার নেই আপনার?
না, আমার নিজের কিছুই জানাবার নেই। লীলাবতী বলে, শুধু জানাবেন, আমার পিতা রুগ্ন হয়ে পড়েছেন, তিনি জামাতাকে একবার দেখতে চান।
শ্যামাঙ্গের প্রত্যয় হয় না। লীলাবতীর কথার অর্থ সম্যক বোঝা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে ভালো করে দেখে, সোমপুরের মঞ্জুশ্রী মন্দিরে দেখা পীবরস্তনী যক্ষিণী মূর্তিটি যেন সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সম্মুখে। হ্যাঁ, ঐ প্রস্তর মূর্তিটির মতোই ঋজু শান্ত এবং কঠিন। সে মুখপানে চেয়ে বিভ্রান্ত বোধ করে। কিছু বলতে পারে না। যত্নে আঁকা, সীমান্তের ঐ উজ্জ্বল সিন্দুর রেখাটি তাহলে কেন? যদি সে স্বামীর জন্য উদ্বিগ্না না হবে?
লীলাবতী অপ্রতিভ হয় না। পথিকের ঐ প্রকার বিমূঢ় দৃষ্টি তাকে বিন্দুমাত্রও বিচলিত করে না। সে স্থির দৃষ্টিতে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চেয়ে থাকে। শ্যামাঙ্গকে তখন বলতে হয়, আমি পথিক মাত্র, পারিবারিক জটিল বিষয়াদি আমার জানবার কথা নয়। কিন্তু তবু বলছি, কোনো বার্তা থাকলে আপনি অসংকোচে আমাকে বলতে পারেন, আমি যথাস্থানে তা পৌঁছে দেবো।
লীলাবতীর ভাবান্তর হয় না ঐ কথার পরও। তখন শ্যামাঙ্গ আবার বলে, আপনার সংকোচের কোনো কারণ নেই, এ আমার নিজের দায়–যে গ্রামে রাত্রিযাপন করেছি, অন্ন গ্রহণ করেছি, সেই গ্রামের লোকের সামান্যতম উপকারে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।
শ্যামাঙ্গের কথায় অকৃত্রিমতা ছিলো। আর সেই জন্যই সম্ভবত লীলাবতীর দৃঢ়সংবদ্ধ ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা খেলে গেলো। বললো, অহেতুক এতো কথা বলছেন, এই মূখা গ্রাম্য রমণী আপনার ভাষা কিছুই বুঝছে না, আপনি নির্দ্বিধায় যাত্রা করুন–প্রেরণ করার মতো সত্যিই আমার নিজের কোনো বার্তা নেই।
শ্যামাঙ্গকে সপ্রতিভ হতে হয়। বলে, আপনার রোষ দেখছি গভীর–বোঝা যাচ্ছে, হতভাগ্য অভিমন্যু দাসের জন্য ভবিষ্যতে মহাদুর্বিপাক অপেক্ষা করছে।
কেন, এমন কথা কেন বলছেন?
কুপিতা স্ত্রী ভয়ঙ্কর বস্তু, শ্যামাঙ্গ জানায়।
ও, তাহলে ঐ কারণেই আপনি গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য অস্থির? লীলাবতীর স্বরে পুনরায় কৌতুক ধ্বনিত হয়।
আমি কোন ছার, দেবাদিদেব মহাদেব পর্যন্ত তটস্থ থাকেন।
শিব ঠাকুরের ঐ ভয় কিন্তু কপট ভয়, লীলাবতী স্মরণ করিয়ে দেয়।
কপট ভয়? শ্যামাঙ্গ বলে, সম্মার্জনী হস্তে দেবীর চামুণ্ডা মূর্তি কল্পনা করুন তো!
দেবীর মূর্তি যাই হোক, শিব তো জানেন, মানভঞ্জনের কলাকৌশল কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়। শিবের পথ অনুসরণ করুন–গৃহলক্ষ্মীর পদসেবা কেমন করে করতে হয়। জানেন তো?
না, তা তো অধমের জানা নেই, মুখে নির্বোধের ভাব আনে শ্যামাঙ্গ।
তাহলে তো দেখছি, আপনার ললাটে সম্মার্জনী প্রায় অবধারিত।
উপায় কি! শ্যামাঙ্গ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, অনুশীলনীর জন্যও তো পদযুগল প্রয়োজন–তা কোথায় পাবো?