আর জামাতাটিও যে কী, যোগমায়া বুঝতে পারেন না। নবীন যুবক–এই সময়ে তার স্ত্রী সান্নিধ্যের আকর্ষণটিই প্রধান হওয়া উচিত। কিন্তু দেখো, মূর্খ দেশে দেশে বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে। এদিকে বিবাহের পর মায়াবতীর চাঞ্চল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, মুখরা হয়েছে আরও অধিক। কিছু বলেন না তিনি। কিন্তু তাই বলে এতো দূর! রাত্রির মধ্যযামে অপরিচিত যুবাপুরুষের কক্ষে প্রবেশ করবে!
যোগমায়া কন্যার আচরণে ক্রুদ্ধা যেমন হলেন, তেমনি আবার ব্যথিতও হলেন।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছু করতে গেলেন না। ত্বরিত কিছু করেন না তিনি–সে স্বভাবই তাঁর নয়। বরং অপেক্ষা করলেন। অনতিবিলম্বে লীলাবতীসহ কন্যাকে পথিকের কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে দেখলেন। লীলাবতীকে দেখে তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস নির্গত হলো। যাক, মেয়ে তাহলে অঘটন কিছু ঘটায়নি।
তখনও কিন্তু মৃদুস্বরে উভয় সখীর মধ্যে বাদানুবাদ চলেছে। মায়াবতী বারবার বলছিলো, অন্যায় তো কিছু করিনি। একজনকে একটি সংবাদ নিতে বলার মধ্যে অন্যায়টা কোথায় হলো? মানুষের সংবাদ মানুষের নেওয়া কর্তব্য।
তুই যেভাবে দেখিস, অন্যে তো বিষয়টা সেভাবে না–ও দেখতে পারে। আমি স্বামী পরিত্যক্তা বলে যদি তাঁর করুণা হয়, তাহলে সেটা কি আমার জন্য লজ্জার বিষয় নয়? বল তুই?
রাখ তোর লজ্জা, ওটা শতবার ধৌত করে জলপান কর গিয়ে। যে লোকের সঙ্গে তোর জীবনে দ্বিতীয় বার সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই, তার কাছে আবার লজ্জা কি রে কুকুরি?
না সখী, এ তোর অন্যায় হয়েছে, লীলাবতী বুঝতে চায় না। বলে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঐকথা তোর বলতে যাওয়া উচিত হয়নি।
ঐকথা না বলতে যাবো তো আর কোন কথা বলতে যাবো? মায়াবতী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলে, অরে পামরি, তুই কি ভেবেছিলি আমি তোকে নিয়ে পথিকের সঙ্গে মিলনের জন্য অভিসারে যাবো? আর পথিকের সান্নিধ্যে গেলে প্রণয়লীলা অনুষ্ঠিত হবে?
না, তা নয়, লীলাবতীর স্বর তখনও আহত। বলে, সে কথা ভাবিনি, দূর দেশের পথিক, তার কতো অভিজ্ঞতা, কতো কাহিনী, ঐ সবই কিছু শুনবো বলে আশা করেছিলাম
এই পর্যন্ত উভয়ের কথা হয়েছে, ঐ সময় যোগমায়া ডাকলেন, মায়াবতী, এদিকে আয়।
দুজনই চমকিত হলো, কিঞ্চিৎ ভীতও। কিন্তু যোগমায়া কিছু বললেন না। শুধু আদেশ করলেন, লীলাবতী গৃহে যাও, রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।
লীলাবতী চলে গেলে কন্যার কাছে জানতে চাইলেন, পথিক কি অভিমন্যু দাসের পরিচিত?
না, কিন্তু আম্রপট্টলীতে তাঁর মাতুলালয়।
যোগমায়া আরও কিছু বলতেন, কিন্তু কে জানে কেন, ঐ প্রসঙ্গে আর গেলেন না। শুধু বললেন, ঐ কথা বলবার জন্য পথিকের কক্ষে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। তোমার মাতুলকে বললেই পারতে, তিনিই বলতেন।
পরদিবস প্রত্যুষে শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত, যাত্রা করবে। জলযোগ ইতোমধ্যে সমাপন হয়েছে। আহার্যাদি প্রস্তুত করেছেন মায়াবতীর মাতা অন্ধকার থাকতেই। গতরাতে সঙ্কোচবশ অতিথির সম্মুখবর্তী হননি, আজ হলেন। বললেন, বৎস, তোমার সমাদর হলো না, দুদিন থেকে গেলে পারতে।
ঐ কথা কটি শ্রবণমাত্র কী যেন ঘটে যায় শ্যামাঙ্গের মনে। মহিলার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অজানা এক চাঞ্চল্য অনুভব করে সে। কেমন মনে হয়, ঐ চক্ষু দুটি কোথায় যেন সে দেখেছে–ঐ কণ্ঠস্বরটিও তার চেনা, যেন বহুকাল পর সে ঐ স্বর। শুনতে পাচ্ছে। সে কিছু বলতে পারে না। মায়াবতী মায়ের পাশে ছিলো। সেও বললো, দুদিন থেকে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার?
ঐ কথার পরও শ্যামাঙ্গের মুখে বাক্য নিঃসরণ হয় না। সে জানে, তার জানানো উচিত, গৃহে প্রত্যাবর্তন তার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়–নতুবা মাতৃস্নেহধারায় অভিষিক্ত হওয়ার এই অমূল্য সুযোগ সে ছাড়তো না, অল্প সময়ে সে যা পেয়েছে তা তার চিরদিন মনে থাকবে। এ পথে সে যতোবার আসবে, ততোবারই ও মাতৃপদে প্রণামের সুযোগ সে গ্রহণ করবে–এই সব বাক্য তার মনে আসছিলো। তবে এও আবার উপলব্ধি হচ্ছিলো যে ঐ প্রকার বাক্য শোনাবে নিতান্তই আনুষ্ঠানিক এবং কৃত্রিম। তাই সে নীরবে কালক্ষেপণ করে। কোন কথাটি যে বলবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।
একেবারে শেষ মুহূর্তটিতেও তার মুখে কথা আসে না। কেবলই মনে হয়, মায়ের কাছে সন্তানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কি সাজে? সে আভূমি নত হয়ে যায় এবং যোগমায়ার পদধূলি গ্রহণ করে।
আর ঐ পবিত্র মুহূর্তটিতেই ঈষৎ কম্পিত মাতৃস্নেহের পুণ্য স্পর্শ অনুভব করে সে তার শিরোদেশে। উদ্গত অশ্রুরোধ চেষ্টায় কাতর মায়ের মুখভাবটি দেখবার মতো যথেষ্ট সাহসী সে হতে পারে না। তার কেবলি মনে হতে থাকে যে, আর যদি সে বিলম্ব করে তাহলে সে ভেঙে পড়বে এবং ঐ মাতৃপদকমল দুটি জড়িয়ে ধরে সমস্ত জীবনকালের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা সে মিটিয়ে নেবে। তাই সে অত্যন্ত দ্রুত, প্রায় সজোরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন। করার মতই, গৃহদ্বার থেকে ছুটে পথে বেরিয়ে আসে এবং যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করতে থাকে। না, বড় মায়া পশ্চাতে। পুনর্ভবা তীরের মাতৃময়ী নারীর স্নেহ স্পর্শ তাকে যেন উদ্বাহু হয়ে ডাকছে। বাল্যকালে সে মাকে হারিয়েছে, সেই অবিকল মাকে সে আবার দেখতে পাবে–এ যে কল্পনাও করা যায় না। অনেকখানি পথ অতিক্রম করার পর সে পশ্চাতে মুখ ফেরালো। এবং তখনও দেখতে পেলো, তারই গমন পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অনিমেষ নয়নে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দুই নারী। একজন মাতা, অন্যজন ভগিনী। দুজনার স্নেহোদ্বেল চোখে মঙ্গল কামনার উদ্ভাস। শ্যামাঙ্গকে মুহূর্তেক দাঁড়াতে হলো– আর তাতে চিত্রটি তার অন্তরে চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেলো। দূরযাত্রায় নিষ্ক্রান্ত ভ্রাতা ও পুত্রকে এইভাবেই চিরকাল মাতা ও ভগিনীরা বিদায় জানিয়েছে। তার মনে পড়লো, ঠিক এই চিত্রটিই সে সোমপুর বিহারে প্রাচীর গাত্রের মৃঙ্কলকে উত্তীর্ণ দেখেছে। দ্বারদেশে দুই নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে, দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। সে তখন বোঝেনি, শিল্পী কোন বিষয় ঐ ফলকে উৎকীর্ণ করেছেন–এখন বুঝলো, মনে মনে সেই প্রাচীন শিল্পীকে সে প্রণাম জানালো।