কি কথা? লীলাবতীর আগ্রহী স্বর শোনা যায়।
আপনি বলুন, যদি সুসংবাদ প্রেরণ করতে পারি, তাহলে আমার জন্য কী পুরস্কার আছে?
না, কৌতুক নয় ভ্রাতঃ, মায়াবতী জানায়। বলে, সখী লীলাবতী সত্যিই উদ্বিগ্না। তার পিতা দীর্ঘদিন রোগশয্যায় শায়ী।
মায়াবতীর স্বরে বিলক্ষণ আকুলতা ছিলো। শ্যামাঙ্গ সেটা উপলব্ধি করে বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, অভিমন্যু দাসের সন্ধান আমি অবশ্যই করবো।
ক্ষণেক পরে সে পুনরায় জানতে চাইলো, তার পূর্বে আমার জানা প্রয়োজন, অভিমন্যু দাস স্বগ্রামে অবস্থান করছেন কিনা। তিনি অন্য কোথাও চলে গেলে তাঁর সন্ধান করা কঠিন হবে।
না, সে সংবাদ এখানে আমরা পাইনি, মায়াবতী জানায়, অতঃপর বলে, তবু আপনি সন্ধান করে দেখবেন–যদি কোথাও গমন করে থাকেন, তাহলে সে সংবাদটিও তো আমাদের জানা প্রয়োজন।
অবশ্যই, শ্যামাঙ্গকে স্বীকার করতে হয়। বলে, আম্রপট্টলীতে নিজের প্রয়োজনেই আমাকে যেতে হবে, যদি অভিমন্যু দাসের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তাহলে তাকে আমি উজুবটে নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করি–কারণ আমার মাতুলালয় ঐ গ্রামেই।
ঐ আলাপের ক্ষণকাল পরই মায়াবতী এবং তার সখী চলে গেলো, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো, তেমনি নিঃশব্দেই।
আরও কি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে? শ্যামাঙ্গ নিজের কাছে প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ শয্যায় বসে রইলো। বাইরে কদলীপত্রে বায়ু তাড়নার শব্দ তখনও হয়ে চলেছে–এবং দীর্ঘক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন আর কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো না, তখন, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ দাস শয্যায় শয়ান হলো। এবার সে নিদ্রা যাবে।
০৪. যোগমায়ার শোক আজ
যোগমায়ার শোক আজ পুনরায় জেগে উঠেছিলো। পথিকের মুখপানে একবার দৃষ্টিপাত করেই তার বক্ষে তুমুল আলোড়ন উপস্থিত হয়। মানুষে মানুষে কি এমনই সাদৃশ্য থাকে?
সেই থেকে যে কতোবার গোপনে অশ্রু মোচন করেছেন গণনা করা যাবে না। আজ চন্দ্রদাস জীবিত থাকলে কি সংসার তার এমন হতশ্রী হয়? একটি পুত্রবধূ গৃহে আনতেন তিনি। মনোহরদাসের কন্যাটির কথা স্মরণ হলে প্রাণ তার ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হায় ভগবান, কি কুক্ষণেই না চন্দ্রদাসকে তিনি মেলায় যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। যাত্রার প্রাক্কালে বারে বারেই সে বলছিলো, মা, চিন্তার কোনো কারণ নেই। দুই পক্ষকাল এমন কিছু দীর্ঘ সময় নয়। আমি বস্ত্রগুলি বিক্রয় করে মাত্র কয়েকদিন অবস্থান করবো, লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত যদি যাই, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা, পক্ষকালের অধিক বিলম্ব হতে পারে।
কী মায়াময় কথা তার! বলেছিলো, মা তোমার বড় পরিশ্রম হয়–আমি ফিরে এলে তোমরা পুত্রবধূ ঘরে এনো। আহা! ঐ কথা কটি বলবার সময় ঈষৎ লজ্জা হয়েছিলো বাছার। তারপর বলেছিলো,–পিতাকে বলো, চৈত্রের পূর্বেই যেন গৃহ সংস্কারের কার্যাদি সম্পন্ন করে ফেলেন। আর শোনো, কৃষ্ণা গাভীটি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছে, যদি সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে ভালো একটি দুগ্ধদা গাভী ক্রয় করো। পিতাকে বলো, তিনি যেন কায়স্থ পল্লীর লোকদের সঙ্গে বিবাদে না যান। পথিমধ্যে আমি মাতুলালয়ে যাবো, মাতুলকে বলবো, তিনি যেন এখানে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন।
নানান প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা বলছিলো সে। বড় দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে উঠেছিলো বাছা–অথচ কি বা বয়স তার! তবু দেহটি হয়ে উঠেছিলো বলিষ্ঠ এবং মনটি মায়াময়। গৃহাঙ্গন ত্যাগের মুহূর্তে ভগিনীর অশ্রু ভারাক্রান্ত মুখ দেখে তার বেণীটি মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিলো, অরে বান্দরি, তুইও কাঁদছিস? এ যাত্রা আমার শ্মশান যাত্রা নাকি?
হায়, কে জানতো ঐ যাত্রাই তার শ্মশান যাত্রা হয়ে উঠবে!
প্রতিটি কথা তাঁর স্মরণ হচ্ছিলো। শয্যাগ্রহণের পরও তার চক্ষে ঘুম আসেনি। নীরবে অশ্রু মোচন করছিলেন। মায়াবতী পাশে নিদ্রামগ্না। হতভাগিনীর কথা ভেবেও তার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন জামাতা বসন্তদাস এখানে আসে না, কোথায় যে গেছে, কেউ জানে না। শুধু জানা গেছে যে, সে নাকি বাণিজ্যে গেছে। এ দিকে মায়াবতী যেমন চঞ্চলা, কী হয় বলা যায় না।
অকস্মাৎ তাঁর সম্বিৎ হলো যে শয্যায় মায়াবতী নেই। তাঁর মনে কোথায় যেন শঙ্কা দুলে ওঠে–এতো রাতে মায়াবতী শয্যায় নেই কেন? তিনি উঠলেন। কাউকে না ডেকে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে এলেন। অঙ্গন অতিক্রম করে বহির্বাটির দিকে শ্রবণ পাতলেন। এবং যা আশঙ্কা করছিলেন, অস্পষ্টভাবে, তা–ই ঘটেছে বলে তার সন্দেহ হলো। পথিককে দেখে মায়াবতীর চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। এখন বুঝলেন, কেন ঐরূপ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো কন্যাটি। মায়াবতীর স্বামী সন্দর্শন মাত্র একবারই হয়েছে। আজ সপ্তম মাস অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে, কিন্তু বসন্তদাসের কোনো সন্ধান নেই। এদিকে পথিক যুবাপুরুষ, তায় সুন্দরকান্তি। না জানি কী আছে তার মনে। নিজের কন্যাটিকে তো চেনেন–এমন চঞ্চল স্বভাব কেন যে ওর হলো, ভেবে পান না। তার পিতাই অত্যধিক স্নেহ দিয়ে কন্যার মস্তকটি চর্বণ করেছেন। অবশেষে তিনি পুনরায় কান পাতলেন। শুনতে পেলেন সত্যিই বহির্বাটির কক্ষ থেকে মায়াবতীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
ক্রোধ হলো তাঁর। মায়াবতী আর কিশোরী বালিকাটি নেই। কৈশোরে সে বড় জ্বালাতন করেছে। আহীর পল্লীর তরুণটিকে নিয়ে সে যা আরম্ভ করেছিলো তাতে কলঙ্ক রটতে বিলম্ব হতো না। সৌভাগ্য যে ভ্রাতা দীনদাস ঐ সময়ই বিবাহের সম্বন্ধটি এনেছিলেন। দূরের সম্বন্ধ, কিন্তু তখন আর বিলম্ব করতে সাহস হয়নি। সানন্দেই বিবাহে সম্মতি দান করেছেন।