ঐ কথার পর আহারে মনোযোগী হতে হলো। তবে প্রশ্নটি না তুলে পারলো না শ্যামাঙ্গ। দীনদাসের মুখপানে দৃষ্টি রেখে জানতে চাইলো, ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে বলে বোধ হয় আপনার?
দীনদাস তখন মুখ গহ্বরে মৎস্যপেটিকার তৈলাক্ত অংশটি নিয়ে ওষ্ঠদ্বয় সংবদ্ধ করে দক্ষিণ হস্তে কণ্টক গুচ্ছ টানতে ব্যস্ত। তিনি ঐ অবস্থাতেই মস্তক হেলন করলেন। তবে ঐ পর্যন্তই, তাকে আর বলতে হলো না। শুকদেব জানালেন, নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না–তবে বাল্যকাল থেকে শুনে আসছি, কাষায় বস্ত্রধারী মুণ্ডিতমস্তক ঐ ভিক্ষুরা নানাবিধ দুষ্কর্মের আকর। তারা এক সময় রাজদ্রোহী ছিলো, এ কারণে গৌড়াধিপতি ও তাঁর অনুচর রাজপুরুষেরা তাদের সমূলে উৎপাটিত করেন তাদের মন্দিরগুলিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এবং ঐ প্রজ্বলিত অগ্নিতে পুরোহিতদের নিক্ষেপ করা হয়। এতোকাল পরে যখন আবার তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, তখন সেটি একেবারেই তাৎপর্যবিহীন হতে পারে, বলুন?
বৌদ্ধ প্রসঙ্গটি শ্যামাঙ্গেরও কিঞ্চিৎ জানা আছে। সে জানে, সমগ্ৰ গৌড়বঙ্গে বৌদ্ধ নিগ্রহের ঘটনাটি ঘটে, কিন্তু সে তো প্রায় শতাধিক বর্ষ পূর্বের কথা। দুর্বল, বিতাড়িত এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন কাষায় বস্ত্রধারী ভিক্ষুদের এখন এমন কি শক্তি সঞ্চয় হয়েছে যে তারা মাণ্ডলিক ও সামন্ত মহাসামন্তদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে? সে বুঝে উঠতে পারে না।
দীনদাস, তুমি কি পশ্চিম দেশাগত যবনদের দেখোনি? হঠাৎ শুকদেব শ্যালককে প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, দেখেছি, অত্যন্ত নিকট থেকে দেখেছি–সে বড় আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আপনি দেখেছেন ধর্ম প্রচারকদের, কিন্তু আমি দেখেছি বণিকদের। আচ্ছা, আপনি কি ওদের উপাসনা করতে দেখেছেন? দীনদাস জানতে চান।
না তো? শুকদেব কৌতূহলী হলেন। বললেন, তুমি কোথায় দেখলে, বলোনি তো?
গোকুল হাটেই আমি দেখেছি–আমার সঙ্গে গৌরদাস ছিলো। বলতে বলতে দীনদাস দধি ভাণ্ডটি কাছে টেনে নিলেন। অতঃপর পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, সে এক বিরল অভিজ্ঞতা, এবং অভিনব দৃশ্য। গোকুল হাটে ওরা সেদিন তিনটি অশ্ব নিয়ে আসে–অশ্বারোহণেই তারা এসেছিলো। তাদের অশ্বগুলি দেখবার মতো। আহা! যেমন তাদের উচ্চতা, তেমনি তাদের দেহসৌষ্ঠব, মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় একেবারে।
বণিক দলটি ছিল ক্ষুদ্র, সংখ্যায় তারা মাত্রই চারিজন। দ্বিপ্রহরের পরে তারা হাটে উপনীত হয়। বলাই বাহুল্য, তাদের অশ্ব ক্রয় করার মতো লোক গোকুল হাটে ছিলো না। সম্ভবত ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলো তারা। তাই অপরাহ্নের শেষে তারা বিশ্রাম এবং আহারের আয়োজন করে। একজন প্রথমে একখানি বস্ত্র বিস্তৃত করে। তার মধ্যস্থলে রাখা হয় খাদ্যবস্তুগুলি, খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং কদলী। অতঃপর একে একে তারা হস্তমুখ প্রক্ষালন সম্পন্ন করে। ঐ প্রক্ষালন ক্রিয়াও সম্ভবত তাদের উপাসনার অঙ্গ। কারণ হস্তমুখ প্রক্ষালনের সময় তারা মন্ত্রপাঠ করছিলো, নিঃশব্দে।
হঠাৎ মনে হয়, গৃহদ্বারে কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। সে উৎকর্ণ হলো। কটিবন্ধে হস্তস্পর্শ করলো, চোর দস্যু নয় তো?
কিন্তু ক্ষণকাল পরই তার মনে হলো কেউ যেন তাকে ডাকছে। শুনতে পেলো, ভ্রাতঃ আপনি কি নিদ্রাগত?
স্পষ্ট এবং পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর। মায়াবতীর কথা স্মরণ হয়। এবং স্মরণ মাত্রই তার মনে এবং দেহে বিচিত্র একটি ভাবের জাগরণ ঘটে। ভাবে, তবে কি পুনর্ভবা তীরের রমণীরা সত্যিই শিথিলশাসনা? এবং স্বাধীন ভর্ত্তৃকা?
সে দ্বার অর্গলমোচন করে দাঁড়ায়–আর মুহূর্তের মধ্যে দুটি রমণীর ছায়ামূর্তি অন্ধকার কুটিরে প্রবেশ করে।
এ ঘটনায় উল্লসিত না হয়ে ঈষৎ শঙ্কিত হয় সে। এই দূর ভিন্ন দেশে অপরিচিতা নারী কি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কে জানে। সে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। আর তাতেই যেন অস্ফুট অথচ ক্ষুব্ধ স্বর শোনা গেলো। একজন বলছে, চল এখন যাই, উনি হয়তো বিরক্তি বোধ করছেন।
তার কথার উত্তরে মৃদু ভৎর্সনা উচ্চারিত হয়। মায়াবতী বলে, আহ্ চুপ কর তো তুই–আমার ভ্রাতাকে যদি আমি কিছু বলতে চাই, তাতে তিনি বিরক্ত কেন হতে যাবেন–এতদূর এসে ফিরে যাবো?
দুই সখীর মধ্যে ঐ প্রকার বাদানুবাদ আরম্ভ হলে শ্যামাঙ্গ আশ্বস্ত বোধ করে। তার স্বরে কৌতুকস্পর্শ পাওয়া যায়। সে বললো, কি সংবাদ মায়াবতী, রাত্রির এই মাধ্যমে হঠাৎ কি প্রয়োজন?
মায়াবতী বারেক ইতস্তত বোধ করে। তারপর বলে, ভ্রাতঃ আমাদের কিছু কথা আছে, সেই কারণে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি–অপরাধ নেবেন না–আপনি তো প্রভাতেই স্বগ্রামাভিমুখে যাত্রা করবেন–সময় হবে না বলেই রাতের এই মধ্যযামে আসতে হলো।
মায়াবতী ক্রমে সহজ হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আপনার যাত্রাপথেই আম্রপট্টলী গ্রাম পড়বে। আপনি যদি সেখানে দণ্ড পরিমাণ কাল অবস্থান করে ললিতদাসের পুত্র অভিমন্যু দাসের সংবাদ নেন তো বড় উপকার হয়। বৎসরাধিক কাল হয় সে স্ত্রীকে পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে–কিন্তু তারপর আর কোনো সংবাদের আদান–প্রদান নেই। বলবেন, তার স্ত্রী লীলাবতী ভারি উদ্বিগ্না। সে যেন সত্বর একবার উজুবটে আসে।
শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝে নেয় এবং কৌতুক বোধ করে। বলে, এই প্রকার কাজে আমার দক্ষতা কিরূপ তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। তবে একটা কথা—