এসব প্রশ্নের উত্তর শ্যামাঙ্গ কেমন করে দেবে? সে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলো। তার সৌভাগ্য যে বৃদ্ধেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাই ঐ প্রশ্নগুলির সূত্রে নানান প্রসঙ্গের অবতারণা করে ফেললেন। ফল হলো এই যে শ্যামাঙ্গকে আর কেউ কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারলো না।
শ্যামাঙ্গ কতক শুনছিলো, কতক শুনছিলো না। কিন্তু এক সময় তাকে মনোযোগী হতে হলো। আলোচনা হচ্ছিলো সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সম্পর্কে। সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি অধিক সংখ্যায় আগমন ঘটছে এ অঞ্চলে। দীনদাস তার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের অঞ্চলেও কি ভিক্ষুদের আগমন ঘটেছে?
অবাক হয় শ্যামাঙ্গ। বলে, কেন এ অঞ্চলে কি ভিক্ষু নেই?
আছে, দীনদাস জানান, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য ছিলো, দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। ছিলো দুজন, এখন তারা সংখ্যায় পাঁচজন।
শ্যামাঙ্গ ঠিক বুঝতে পারে না। বিশ ক্রোশ কি দুরতিক্রম্য দূরত্ব? না হলে এখানে এমন ভিন্ন পরিস্থিতি কেন? নিজ গ্রাম রজতপটে কোনো মন্দির নেই, কিন্তু ভিক্ষুরা তো ঠিকই আছে–ক্রমে হয়তো সংখ্যা বৃদ্ধিও হয়েছে তাদের। আম্রপট্টলীর সংবাদও তার জানা আছে–সেখানেও ভিক্ষুদের সংখ্যা কম নয়–বিল্বমূল গ্রামেও তো সে দেখে এলো ভিক্ষুদের। ভিক্ষুরা এমন কি গুরুত্ব ধারণ করে যে তাদের সংখ্যার হ্রাস–বৃদ্ধি আলোচনার বস্তু হয়ে উঠবে?
সে বললো, আমাদের অঞ্চলে সর্বত্রই ভিক্ষুরা আছে, বহুকাল ধরেই আছে, তাদের সংখ্যা নিয়ে কখনও কোনো সমস্যা হয়েছে এমন শুনিনি।
দীনদাস হাসেন। বলেন, তাহলে বলতে হবে, আপনাদের অঞ্চলে ব্রাহ্মণাদি কুলীনের সংখ্যা কম, নাকি রাজপাদোপজীবীরা যথেষ্ট শক্তিমান নয়?
শ্যামাঙ্গ প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝলো। আত্রেয়ী তীরে ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি কুলীনের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়–এবং রাজপাদোপজীবীরাও বিলক্ষণ সেখানে উপস্থিত। তবে ভিক্ষু, শ্ৰমণ বা যোগীদের ব্যাপারে তাদের মারমুখী হতে কখনও দেখা যায় না। কে জানে, এ অঞ্চলে হয়তো এখনও প্রাচীনকালের বিধি–বিধানই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মাতামহের কাছে সে শুনেছিলো, এক সময় নাকি ভিক্ষুদের গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো, কোনো গৃহস্থ–দ্বারে এলে তাদের দূর দূর করে তাড়না করা হতো।
সে জানায়, আজ্ঞে না, আপনার অনুমান ঠিক নয়। আত্রেয়ী তীরেও ব্রাহ্মণ কায়স্থ আছে এবং রাজপুরুষেরাও আছে। মনে হয়, ভিক্ষু নিগ্রহে তারা আর যথেষ্ট উৎসাহী নয়। হলে, আমি সে সংবাদ পেতাম।
মুহূর্তেক পর সে আবার বললো, এ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে আপনাদের এ অঞ্চলে ভিক্ষুর সংখ্যা মাত্রই পাঁচজন।
অহেতুক তোমরা ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অস্থির হচ্ছো, মায়াবতীর পিতা শুকদেব বলেন, ভিক্ষুরা তো এদেশী, তোমরা কি পশ্চিম দেশাগত যবন জাতীয়দের কেউ দেখেছো?
ঐ কথায় সকলে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পথিক কি দেখেছেন? পথিক নিশ্চয়ই যবন জাতীয়দের কথা জানেন, উনি নিশ্চয়ই কিছু বলবেন–এই প্রকার গুঞ্জন উঠলো। শ্যামাঙ্গ শুনেছে যে পশ্চিম দেশ থেকে যবন জাতীয় অশ্ব ব্যবসায়ীরা মধ্যে মধ্যে এসে থাকে। কিন্তু সে কখনও তাদের দেখেনি। সে বললো, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, আমি তাদের দেখিনি।
তার কথায় সকলেই হতাশ হয়। তবে দীনদাস হলেন না। তিনি একটি যুবাপুরুষের দিকে ইঙ্গিত করলেন, গৌরদাস, তুমি তো যবনদের দেখেছো, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ, গোকুল হাটে তারা এসেছিলো। অধিকক্ষণ থাকেনি, অপরাহ্নে এসে সন্ধ্যা সমাগমে তারা আবার চলে গিয়েছিলো, বড় অদ্ভুত জাতি।
গোকুল হাট উজুবট থেকে তিন ক্রোশ দূরবর্তী। সাধারণত গো–মহিষাদি পশু ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সেখানে বহু দূরাগত ক্রেতা–বিক্রেতার সমাগম হয়। সকলেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলো গৌরদাসের অভিজ্ঞতার বিবরণ শোনার জন্য।
কিন্তু শোনা হলো না। তার পূর্বেই অন্তঃপুরের আহ্বান এসে গেলো। একটি বালক এসে জানালো, আহারের আসন দেওয়া হয়েছে, রাত্রি কম হয়নি, মাতামহী পথিককে নিয়ে অন্তঃপুরে যেতে বলেছেন।
সবাইকে উঠতে হলো। প্রতিবেশীরা বিদায় নিলো একে একে। শ্যামাঙ্গের মনে কিন্তু ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রশ্নটি তখনও রয়েই গেছে। কেন এরা ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে এতো চিন্তিত? এই সংখ্যাবৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে? না হলে দীনদাস কেন ঐ প্রসঙ্গ তুললেন? আর যবন জাতি? এরাই বা কেন এদেশে আসছে? তার মনে একের পর এক প্রশ্নগুলি আসতে লাগলো।
আহারে মনোনিবেশ করতে পারলো না। অথচ আয়োজন ছিলো ভালো। মৎস্যের ব্যঞ্জনই তিন প্রকার, ভর্জিত ইল্লিশখণ্ড, সন্তলিত চিতলপেটিকা এবং নবাম্রসহযোগে মৌরলা। অলাবুসহ মুগও ছিলো সঙ্গে। দেখা গেলো, একটি মাত্র পাত্রে মাংস–ব্যঞ্জন। তবে তার প্রায়–রক্তিম তৈলাক্ত রূপ রসনাকে ব্যাকুল করার জন্য যথেষ্ট। এতদতিরিক্ত দধি খণ্ড–মিষ্টান্ন ইত্যাদি তো ছিলোই।
দ্বারান্তরাল থেকে গৃহিণী অবলোকন করছিলেন। তরুণ পথিকটিকে দর্শনমাত্রই তাঁর পুত্রশোক উদ্বেল হয়ে উঠেছে। গত বৎসর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি দস্যুহস্তে নিহত হয়েছে। তার সঙ্গে পথিকের মুখাবয়বে অদ্ভুত সাদৃশ্য। তিনি বস্ত্রাঞ্চলে নয়নজল মুছেছেন বার দুই। শ্যামাঙ্গকে অমনোযোগী দেখে মায়াবতীকে ইঙ্গিত করলেন। সে বলে উঠলো, ভ্রাতঃ কিছুই যে নিচ্ছেন না, গৃহের জন্য কি চিন্তা হচ্ছে?