মায়াবতী পিত্রালয়ে থাকে এবং সে যে বিবাহিতা তা বোঝা গেলো। কিন্তু লীলাবতী? তার সংবাদ তো জানা গেলো না কিছুই, সে কি সত্যিই স্বামী পরিত্যক্তা?
০৩. বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চল
বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চলটি বৎসরে একবার মাত্র শস্যময় হয়ে ওঠে। ধানক্ষেত্রগুলিতে হল স্পর্শ এখনও ঘটেনি। খরায় বরীন্দ্রের মৃত্তিকা লৌহপ্রায়, তৃণখণ্ডও গোচরে আসে না। চারণভূমি সম্ভবত দূরে কোথাও। সন্ধ্যাগমে তখন গৃহপালিত গবাদি সদলে গৃহে ফিরছে, তাদের খুরোৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি পশ্চিমাকাশে একটি ধূসর গৈরিক আবরণ বিস্তৃত করে দিয়েছে। ঐ সময় আবার খেয়ালী একটি রাখাল বালক বংশীতে শেষবারের মতো তার সুরটি বাজিয়ে নিচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গের মন ঐ সুর শুনে উদাস হয়ে উঠলো।
দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ বুঝলো, যেদিকে মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে সম্ভবত সেদিকে ব্রাহ্মণদের বাস। গবাদি পশুর দল ঐ দিকেই চলেছে। শ্যামাঙ্গ বাম দিকের পথ ধরলো। পথ সংকীর্ণ, কখনও আম্রকাননের মধ্য দিয়ে, কখনও বা বেনুবীথিকার মধ্য দিয়ে। কিছু দূর অগ্রসর হতেই দেখলো কয়েকটি কুটির, ভয়ানক জীর্ণ দশা কুটিরগুলির। শ্যামাঙ্গ অনুমান করে, সম্ভবত এখানে ডোম শ্রেণীর বাস। এক প্রৌঢ়াকে দেখা গেলো সন্ধ্যার ম্লান আলোতেও চাঙাড়ি নির্মাণে ব্যস্ত। নিকটেই কর্দমাক্ত নালিকায় শূকর পাল। একটি উলঙ্গ বালক কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে মা মা ডাকে কেঁদে যাচ্ছে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো, বালকটির পঞ্জরাস্থিগুলি ভারী প্রকট। নিকটে গেলে নির্ভুলভাবে গণনা করা যাবে।
অধিক দূর যেতে হলো না। ডোমপল্লী অতিক্রম করে সামান্য অগ্রসর হয়েছে–ঐ সময় দেখলো একটি সপ্তপর্ণ বৃক্ষের নিচে দুই প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গেলে তারাই জানতে চাইলেন, মহাশয়ের নিবাস কি আত্রেয়ী তীরে?
শ্যামাঙ্গ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, আপাতত দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো। সে বুঝলো, মায়াবতী যথার্থই মায়াবতী। বয়োজ্যেষ্ঠ প্রৌঢ়টি বললেন, আমার কন্যা মায়াবতী আপনার আগমনের কথা আমাকে জানিয়েছে। আপনি নাকি মন্দিরে আর গ্রামপতির গৃহে আশ্রয় সন্ধান করছিলেন?
শ্যামাঙ্গ শুকদেবকে আভূমি বিনত হয়ে প্রণাম জানায়। সৌম্যকান্তি এই বৃদ্ধটিকে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। দৃষ্টিমাত্র মনোহরণ করতে পারে এমন লোক শুকদেব। পার্শ্ববর্তী প্রৌঢ়টিকে দেখিয়ে বললেন, ইনি আমার পরমাত্মীয়, মায়াবতীর মাতুল দীনদাস নিবাস নিকটবর্তী গ্রাম উদয়পুর––বর্তমানে আমার গৃহে কিছুদিন অবস্থান করছেন।
বিনয়ে বিগলিত হওয়ার অবস্থা শ্যামাঙ্গের। কিছুক্ষণ পূর্বে সে পুনর্ভবা তীরবাসীর শীতল নিস্পৃহতা দেখে মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো, এখন সে মনে মনে লজ্জিত হলো। পথিককে যে এমন সম্মান দেখানো যেতে পারে, তার জানা ছিলো না।
পথক্রমণে আলাপ হচ্ছিলো। পিতৃপরিচয়, কি হেতু এই দূর–যাত্রা, পরিবারে কে কে বর্তমান, এইসব প্রসঙ্গ এবং সেই সঙ্গে আত্রেয়ী তীরের শস্য পরিস্থিতি, বস্ত্র–তৈজসাদির মূল্য, রাজপাদোপজীবীদের আচরণ–এই সকল বিষয়েও তারা নানান কথা জানতে চাইলেন।
সাংসারিক বিষয়াদি শ্যামাঙ্গের সম্যক জানা নেই। তবে যা সে জ্ঞাত ছিলো, জানালো। যেমন, তণ্ডুল বর্তমানে অধিক সুলভ নয়, গোধূম কদাচিৎ পাওয়া যায়–বস্ত্রাদি ক্রমেই মহার্ঘ হয়ে উঠছে, তৈজসাদির জন্য দক্ষিণের নৌযানগুলি আর আত্রেয়ী করতোয়া সঙ্গম পর্যন্ত আসছে না, রাজপুরুষদের হাতে প্রায়ই মানুষ অহেতুক লাঞ্ছিত হয়–এই সকল সংবাদ সে প্রৌঢ় দুটিকে জানাতে পারলো।
জলযোগ আগমন মাত্রই হয়েছে–সুতরাং তার ক্ষুধা ছিলো না। এবং ক্লান্তিও না। প্রায় সমগ্র অর্ধদিবস সে তো বিশ্রাম করেই কাটিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাকে ঘিরে ছিলো। তাদের সান্নিধ্য শ্যামাঙ্গের ভালো লাগছিলো না। সে মনে মনে এমন সমবয়সী যুবাপুরুষ খুঁজছিলো, যাদের সান্নিধ্যে সে সহজ হাসি এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে পারে। সে ভাবছিলো, কখন গৃহের বাইরে যাবে, সে ঘুরে ফিরে জিজ্ঞাসা করছিলো, নিকটে শিবমন্দির আছে কি না, ধর্মক্রিয়াদি তাহলে কোথায় সম্পন্ন হয়? ব্রাহ্মণপল্লীতে কি নাট্টমন্দির আছে? কায়স্থপল্লী কতদূর? এ স্থানের কায়স্থরা কি যথার্থই কায়স্থ, নাকি ভূম্যাধিকারী মাত্র?
তার প্রশ্নের উত্তর কেউ কেউ দিচ্ছিলো। সমবেত লোকদের মধ্যে তরুণ বয়স্ক কয়েকজন ছিলো, তবে তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতির কারণে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছিলো না। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরা স্থানটিকে মুখরিত করে রেখেছেন। তারা প্রত্যেকে যত না শুনছিলেন তদপেক্ষা বলছিলেন বেশি। একজন তার ভাগিনেয়ীর কথা বললে অন্যজন তাঁর পাটল রঙের গাভীটির কথা আরম্ভ করে দেন। ওদিকে একজন আবার তাঁর দৌহিত্রটি কেমন চতুর হয়ে উঠেছে সেই সংবাদ জানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
দুজন একজন করে আরও প্রতিবেশীর আগমন ঘটেছে ততক্ষণে। দূরদেশী পথিকের সাক্ষাৎ অহরহ ঘটে না। তদুপরি শোনা গেছে যে পথিক যেমন প্রাজ্ঞ তেমনি সুরসিক। ফলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন আরম্ভ হয়ে গেলো এক সময়। যেমন, পথিক যে গ্রাম থেকে আসছেন, সে গ্রামে দ্রব্যসামগ্রী সুলভ, না মহার্ঘ? রাজপুরুষের ব্যবহার কেমন? পথিক কি লক্ষ্মণাবতীর সংবাদ জানেন? মহাসামন্ত হরি সেনের অনুচরেরা নাকি হাটের বিপণীকারদের কাছ থেকে কর আদায় করছে? মহাসামন্ত যজ্ঞদত্ত কি সত্যই বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী?