কিন্তু এসবই স্বপ্ন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। কোথায় চাকরি? চাকরির ধারেকাছে নেই সোমনাথ।
সকালবেলা বউদি চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন, “কখন যাবে? টাকাটা বার করে রেখেছি!”
টাকাটা পকেটে পরে যথাসময়ে সোমনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
সোমনাথ ফিরতে দেরি করছে কেন? কমলা অধীর আগ্রহে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো। এখনও সোমনাথের দেখা নেই।
সাতটা নাগাদ সোমনাথ বাড়ি ফিরলো। ওর ক্লান্ত কালো মুখ দেখেই কমলার কেমন সন্দেহ হলো।
চিবুকে হাত দিয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসে রইলো। বউদির দেওয়া টাকা নিয়ে সোমনাথ এম-এল-এ কোয়ার্টারে লোকটার সঙ্গে দেখা করেছিল। মিস্টার চৌধুরী নোটগুলো পকেটে পরে সোমনাথকে ট্যাক্সিতে চড়িয়ে ক্যামাক স্ট্রীটের একটা বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন। “আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থাটা পাকা করে আসি,” এই বলে লোকটা সেই যে বেপাত্তা হলো আর দেখা নেই। আরও পনেরো মিনিট ওয়েটিং ট্যাক্সিতে বসে থেকে তবে সোমনাথের চৈতন্য হলো, হয়তো লোকটা পালিয়েছে। ভাগ্যে পকেটে আরও একখানা দশ টাকার নোট ছিল। না হলে ট্যাক্সির ভাড়াই মেটাতে পারতো না সোমনাথ।
বড় আশা করে বউদি টাকাটা দিয়েছিলেন। সব শুনে বললেন, “তুমি এবং আমি ছাড়া কৈউ যেন না জানতে পারে।”
খুব লজ্জা পেয়েছিল সোমনাথ। সব জেনেশুনেও একেবারে ঠকে গেলো সোমনাথ। বউদি বললেন, “ওসব নিয়ে ভেবো না। ভালো সময় যখন আসবে তখন অনেক আড়াইশ’ টাকা উসল হয়ে যাবে।
তবু অস্বস্তি কাটেনি সোমনাথের। বউদিকে একা পেয়ে কাছে গিয়ে বলেছিল, “খুব খারাপ লাগছে বউদি। আড়াইশ’ টাকার হিসেব কী করে মেলাবেন আপনি?”
বউদি ফিসফিস করে বললেন, “তুমি ভেবো না। তোমার দাদার পকেট কাটায় আমি ওস্তাদ! কেউ ধরতে পারবে না।”
জানাজানি হলে ওরা দুজনেই অনেকের হাসির খোরাক হতো। এই কলকাতা শহরে এমন বোকা কেউ আছে নাকি যে চাকরির লোভে অজানা লোকের হাতে অতগুলো টাকা তুলে দেয়?
নিজের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে সোমনাথের। পরের দিন দুপুরবেলায় বউদিকে একলা পেয়ে সোমনাথ আবার প্রসঙ্গটা তুলেছিল। “বউদি, কেমন করে অত বোকা হলাম বলুন তো?”
“বোকা নয়, তুমি আমি সরল মানুষ। তাই কিছু গচ্চা গেলো। তা যাক। মা বলতেন বিশ্বাস করে ঠকা ভালো।”
বউদির কথাগুলো ভারি ভালো লাগছিল সোমনাথে। কৃতজ্ঞতায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল। বউদির এই স্নেহের দাম সে কীভাবে দেবে? বউদি কিন্তু স্নেহ দেখাচ্ছেন এমন ভাবও করেন না।
কিন্তু ঠকে যাবার অপমানটা ঘরে-ফিরে সোমনাথের মনের মধ্যে এসেছে। এই কলকাতা শহরে এত বেকার রয়েছে, তাদের মধ্যে সোমনাথই-বা ঠকতে গেলো কেন?
এই ভাবনাতে সোমনাথ আরও দুর্বল হয়ে পড়তো, যদি-না দুদিন পরেই বেকারঠকানো এই জোচ্চোরটাকে গ্রেপ্তারের সংবাদ খবরের কাগজে বেরতো। কীড, স্ট্রীটে এম-এল-এ হোস্টেলের সামনেই লোকটা ধরা পড়েছিল। সোমনাথের লোভ হয়েছিল একবার পুলিশে গিয়ে জলঘোলা করে আসে, লোকটার আর-একটা কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়। কিন্তু বউদি সাহস পেলেন না। দুজনে গোপন আলোচনার পরে, ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
মোমনাথের আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরে এসেছে। সোমনাথ একাই তাহলে ঠকেনি, আরও অনেকেই এই ফাঁদে পা দিয়েছে এবং সোমনাথের থেকে বেশি টাকা খুইয়েছে।
০৭. মেঘ কাটতে শুরু করেছে
এবার বোধহয় মেঘ কাটতে শুরু করেছে। একখানা দরখাস্তের জবাব এসেছে। লিখিত পরীক্ষা হবে। নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা-ফি বাবদ দশ টাকা নগদ সহ চাকুরি-প্রার্থীকে হল-এ দেখা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরের দিন ভোরবেলাতেই সুকুমার খবর নিতে এলো। সুকুমারের আর তর সয় না। বউদিকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, “সোমটা কোথায়?” সুকুমারও পরীক্ষার চিঠি পেয়েছে। সে বেজায় খুশী।
ঠোঁট উল্টে সুকুমার বললো, “দেখলি তো তদ্বিরে ফল হয় কি না? আমাদের পাড়ার অনেকেই অ্যাপ্লাই করেছিল, কিন্তু কেউ চিঠি পায়নি। সাধে কি আর মিনিস্টারের সি-একে পাকড়েছি! কেন মিথ্যে কথা বলবো, সি-এ বলেছিলেন, আমরা দুজনেই যাতে চান্স পাই তাঁর ব্যবস্থা করবেন।”
আবার বউদির খোঁজ করলো সুকুমার। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে কমলাকে বললো, “সি-এ তাঁর কাজ করেছেন, এখন আশীর্বাদ করুন আমরা যেন ভালো করতে পারি।”
“নিশ্চয় ভালো পারবে,” বউদি আশীর্বাদ করলেন।
সুকুমারের একটা বদ অভ্যাস আছে। উত্তেজিত হলেই দুটো হাত এক সঙ্গে দ্রুত ঘষতে থাকে। ঐভাবে হাত ঘষতে ঘষতে সুকুমার বললো, “বউদি, এক ঢিলে যদি দুই পাখী মারা যায়, গ্র্যান্ড হয়। একই অফিসে দুজনে চাকরিতে বেরবো।”
সুকুমার বললো, “বিরাট পরীক্ষা। ইংরেজি, অঙ্ক, জেনারেল নলেজ সব বাজিয়ে নেবে। সুতরাং আজ থেকে পরীক্ষার দিন পর্যন্ত আমার টিকিটি দেখতে পাবেন না। মিনিস্টারের সি-এ আমাদের চান্স দিতে পারেন। কিন্তু পরীক্ষায় পাসটা আমাদেরই করতে হবে।”
সুকুমার সত্যিই সোমনাথকে ভালোবাসে। যাবার আগে বললো, “মন দিয়ে পড় এই ক’দিন। তোর তো আবার পরীক্ষাতেই বিশ্বাস নেই। শেষে আমার সিকে ছিড়লো আর তুই চান্স পেলি না, তখন খুব খারাপ লাগবে।”
নির্দিষ্ট দিনে কপালে বিরাট দই-এর ফোঁটা লাগিয়ে সুকুমার এগজামিনেশন হল-এ হাজির হয়েছিল। সোমনাথ ওসব বাড়াবাড়ি করেনি। তবে বউদি জোর করে ওর পকেটে কালীঘাটের জবাফল গুঁজে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “রাখো সঙ্গে। মায়ের ফল থাকলে পথে-ঘাটে বিপদ আসবে না।”