কথাটা কানে যেতেই মুরাদের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠলো। আনন্দসূচক শব্দ ওঠে মুরাদ-মনিরা বেঁচে আছে।
হ্যাঁ হুজুর, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যেমন করে হউক তাকে আপনার হাতে পৌঁছে দেবই। নইলে আমার নাম নাথুরাম সিং নয়। কিন্তু হুজুর আরও কিছু-হাতে হাত কচলায় নাথুরাম।
মুরাদ গভীর কণ্ঠে বলে—পাবে, আরও পাবে। পাঁচ হাজার, দশ হাজার, পনের হাজার যা চাও তাই দেব, তবু ওকে চাই।
আচ্ছা হুজুর।
আর একটি কথা, তোমরা জেনে রাখ নাথু, যতদিন দস্যু বনহুরকে তোমরা নিঃশেষ করতে না পেরেছো, ততদিন তোমাদের কোন বাহাদুরি নেই। তাছাড়া তোমরা নিশ্চিন্ত নও। আমিও নই। কারণ, আমি জানি দস্যু বনহুর ভালবাসে মনিরাকে এবং সে কারণেই ওকে হত্যা করতে হবে। যতদিন দস্যু বনহুর জীবিত থাকবে ততদিন আমি মনিরাকে একান্তভাবে পাব না।
ঠিক বলেছেন, বনহুরকে হত্যা না করতে পারলে আমাদের কিছুই করা সম্ভব নয়। হুজুর আজ আর বিলম্ব করতে পারি না। এক্ষুণি আমরা আস্তানায় রওনা দেব, অনুচরগণ সেখানে অপেক্ষা করছে।
নতুন কোন খবর পেয়েছ বুঝি?
হ্যাঁ হুজুর, মনসাপুরের জমিদার কন্যা সুভাষিণী আজ পালকী যোগে দোল পূর্ণিমায় মেলা হতে মনসাপুরে ফিরছে। মেয়েটি অতি সুন্দরী।
মুরাদের চোখ দুটো ক্ষুধিত শার্দুলের মত জ্বলে ওঠে—তাই নাকি।
হ্যাঁ হুজুর।
তাহলে তো আর একটি নতুন শিকারের সন্ধান পেয়েছ। সাবাস নাথুরাম! সত্যি তুমি কাজের লোক।
১১.
পুলিশ অফিস।
ইন্সপেক্টার মিঃ হারুন পেছনে হাত রেখে চিন্তিতভাবে দাঁড়িয়েছিল। অদূরে কয়েকজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। সকলের মুখেই গভীর চিন্তার ছাপ।
দস্যু বনহুর হাঙ্গেরী কারাগার থেকে পালিয়ে যাবার পর পুলিশ মহলে এক বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ পরিবেষ্টিত এ হাঙ্গেরী কারাগার। এ কারাগার থেকে কোন দস্যু আজ পর্যন্ত পালাতে পারেনি। পাষাণ প্রাচীরে ঘেরা, লৌহ ইস্পাতে গড়া এই হাঙ্গেরী কারাগার। ছোটখাটো চোর ডাকুর জন্য এ কারাগার নয়। যে ডাকাত বা দস্যু অত্যন্ত দুর্দান্ত তাদের জন্যই এ কারাগার। শেষ পর্যন্ত সে কারাগার থেকেও পালাল দস্যু বনহুর। পুলিশমহলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ সুপার পর্যন্ত ঘাবড়ে গেছেন। এতকাল তিনি বহু দস দেখে এসেছেন, কিন্তু দস্যু বনহুরের মত দস্যু তিনি দেখেন নি। কারাগারের ভেন্টিলেটরের শিক বাঁকিয়ে পালানো কম কথা নয়–এ যে অদ্ভুত কাণ্ড।
পুলিশ মহল ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পড়েছে। শহরে বন্দরে, পথেঘাটে সকলের মুখেই এক কথা দস্যু বনহুর হাঙ্গেরী কারাগার হতে পালিয়েছে।
ইন্সপেকটার হারুন বলে ওঠেন, দেখুন আপনারা এ দস্যু বনহুরকে যাই মনে করুন, সে ভদ্রঘরের সন্তান। মিঃ চৌধুরীর মত মহৎ ব্যক্তির সন্তান সে, কিন্তু পরিবেশ তাকে এতখানি জঘন্য করে তুলেছে।
পুলিশ অফিসার মিঃ হোসেন বলেন একথা সত্য, শুনেছি দস্যু বনহুর নাকি অপূর্ব সুন্দর দেখতে।
জবাব দেন মিঃ হারুন শুধু অপূর্ব সুন্দর নয় মিঃ হোসেন, অপূর্ব সুন্দর . এমন চেহারার লোক এমন হতে পারে কল্পনার অতীত।
আর একজন অফিসার বলেন, দস্যু হবে দস্যুর মত ভয়ঙ্কর, কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে সুন্দর। আমি শুনেছি দস্যু বনহুরের ব্যবহারও নাকি অত্যন্ত ভদ্র।
সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ মিঃ কাওসার, তার ব্যবহার যদি দেখতেন কিছুতেই আপনি তাকে দস্যু বলে মেনে নিতে পারতেন না। কথাটা বলে আসন গ্রহণ করেন মিঃ হারুন। তারপর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলেন—হাজার সুন্দর হউক, হাজার ভদ্র হউক, তবু সে দস্যু-ডাকাত। আইনের চোখে সে অপরাধী।
শুধু অপরাধী নয়, সে পলাতক আসামী। কথাটা বলতে বলতে কক্ষে প্রবেশ করেন প্রখ্যাত ডিটেকটিভ মিঃ শঙ্কর রাও।
মিঃ হারুন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে বসান। তারপর বলেন—মিঃ রাও, কি করা যায় বলুন তো? সমস্ত শহরে-বন্দরে সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করেছি। যাকে সন্দেহ হবে তাকেই এরেস্ট করে হাজতে ভরবে।
শঙ্কর রাও হেসে বলেন—শেষ পর্যন্ত দস্যু বনহুরকে ধরতে গিয়ে কত যে ভদ্রলোক হাজতে বাস করবে, তার ঠিক নেই।
অগত্যা এ ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছি মিঃ রাও। আপনার মত অভিজ্ঞ ডিটেকটিভও দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে সক্ষম হলো না। কিন্তু মিঃ রাও, আবার আপনাকে নতুন করে বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য অবতীর্ণ হতে হবে।
ইয়েস, আমি এ ব্যাপারে সব সময় প্রস্তুত আছি।
থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ রাও। আপনাকে আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
এমন সময় একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেকটার একখানা টেলিগ্রাম এনে মিঃ হারুনের হাতে দেয়—স্যার টেলিগ্রাম।
মিঃ হারুন টেলিগ্রামখানা হাতে নিয়ে পড়ে দেখলেন। তারপর বলেন—আগামীকাল কমিশনার সাহেব স্বয়ং হাঙ্গেরী কারাগার দর্শনে আসছেন।
বলে ওঠেন মিঃ কাওসার, এবার তাহলে পুলিশ মহলকে নাচিয়ে ছাড়বে।
মিঃ নাসের বলে ওঠেন—দস্যু বনহুর শেষ পর্যন্ত কমিশনার সাহেবকেও ঘাবড়ে তুললো।
মিঃ খালেক এতক্ষণ নিচুপ হয়ে শুনছিল। তিনি বলেন, হাঙ্গেরী কারাগার থেকে দস পালানো সরকার বাহাদুরের চরম অপমানের কথা।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর সবাই বিভিন্ন কাজে উঠে পড়েন, সমস্ত থানায় এবং পুলিশ অফিসে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দিল। কারণ সবারই প্রস্তুত থাকতে হবে, তিনি যেন তাদের দোষ-ত্রুটি ধরতে না পারেন।