মনিরা স্তব্ধ হয়ে দেখছে লোকগুলো বনহুরের কোন আদেশের প্রতীক্ষা করছে।
কি যেন বলেন বনহুর স্পষ্ট বুঝা গেল না, ভীষণকায় লোকগুলো কুর্নিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর সারিবদ্ধভাবে অন্ধকার অদৃশ্য হয়ে গেল।
লোকগুলোর চেহারা দেখে মনিরার কণ্ঠনালী শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেন একদল রাক্ষসের মধ্যে বনহুর একটি দেবমূর্তি। আশ্চর্য হলো মনিরা, এত ভয়ঙ্কর লোকগুলো বনহুরকে সিংহের মত ভয় করে।
মনিরা এই কথা ভাবছে হঠাৎ শুনতে পেল সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ।
সম্বিৎ ফিরে এলো মনিরার, সে দ্রুত নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে ছিল।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে মনিরার পাশে গিয়ে বসলো। মনিরা নির্বাক নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে এই সে দস্যু বনহুর যার ভয়ে গোটা দেশ প্রকম্পমান। যার নাম স্মরণ করে সবাই আতঙ্কে শিউরে ওঠে। পুলিশমহল যাকে গ্রেপ্তারের জন্য লাখ টাকা ঘোষণা করেছে সেই দস্যু বনহুর তার পাশে। তার অতি প্রিয়জন।
বনহুর হেসে বলল অমন করে কি দেখছো মনিরা?
তোমার আসল রূপ।
কেমন দেখছো?
অনেক সুন্দর-মনির, সত্যি তুমি আমাকে ভালবাস?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন মনিরা?
বল আমার মন শুনতে চাচ্ছে।
বাসি। মনিরা… অস্ফুট শব্দ করে বনহুরের বুকে মাথা রাখে মনিরা।
চলো মনিরা, এবার তোমাকে রেখে আসি।
যদি না যাই তোমার খুব অসুবিধা হবে, না।
আমার নয়, তোমার হবে।
কেন? কি করে আমার অসুবিধা হবে?
মনিরা, তুমি শিশু নও। তোমার নিরুদ্দেশ লোকনিন্দার কারণ হবে। আব্বা আম্মা তোমার জন্য লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। বল তো তখন তাদের কত কষ্ট হবে?
মনিরা উঠে দাঁড়ায়, তারপর বনহুরের হাত ধরে বলে–চলো।
চলতে চলতে কথা হয় দুজনের মধ্যে। মনিরা বলে—তুমি না আমার গা ছুঁয়ে শপথ করেছিলে আর দস্যুতা করবে না। পারলাম না আমার কথা রাখতে মনিরা। শয়তান নাথুরাম ভয়ঙ্কর শয়তানী শুরু করেছে।
নাথুরাম—সে আবার কে?
মাঝির ছদ্মবেশে যে তোমাকে হরণ করতে যাচ্ছিলো।
শয়তান নাথুরাম!
হ্যাঁ, সে শুধু শয়তান নয় মনিরা, সে নরপিশাচ। দেখে নিতে চাই শয়তান নাথুরামের কত বাহাদুরি! আজই খবর পেলাম জম্বুরা পর্বতের এক গুহায় তার গোপন আস্তানা রয়েছে। সেখানে নাথুরামের একটি কালি মন্দিরও আছে। মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় একটি কুমারী কন্যাকে বলি দেওয়া হয়।
মনিরা আর্তনাদ করে ওঠে—উঃ কি ভীষণ কাণ্ড!
শুধু তাই নয় মনিরা, সে আরও অনেক কিছু দুষ্কর্মের সঙ্গে লিপ্ত আছে। আমি ওকে দেখে নেব।
বনহুরের মনোভাব আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল না মনিরা। কিন্তু অনুভব করলো সে মনিরার হাতের মধ্যে বনহুরের বলিষ্ট হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে।
তারপর কিছুদূর নীরবে এগুলো তারা।
এবার এক সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করলো মনিরা আর বনহুর। বেশ অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ। বনহুর মনিরাকে এঁটে ধরলো-মনিরা, সাবধানে আমার হাত ধরে চলবে। পা ফসকে গেলেই মৃত্যু।
মনিরা বনহুরের হাত এটে ধরে চলতে লাগলো।
চলতে চলতে হেসে বলল বনহুর-মাঝি বেচারা তোমার হাতে মৃদু চাপ দিয়েছিল বলে সে তোমার অসংখ্য অভিসম্পাত কুড়িয়েছে, আর এখন…
যাও ঠাট্টা রাখ। মনিরা বনহুরের হাতে হাত রেখে পায়ের দিকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুরকে জাপটে ধরলো সে। সুড়ঙ্গ পথের আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল, সরু একটা পথ, তার নিচেই হাত দেড়েক দূরে গভীর খাদ। শিউরে উঠলো মনিরা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল—আমি কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না মনির, আমাকে তুমি নিয়ে চলো।
বনহুর হেসে বলেন—বেশ, তুমি চোখ বন্ধ করো, ওয়ান, টু, থ্রীবনহুর মনিরাকে ছোট বালিকার মত দু’হাতের উপর উঠিয়ে নিল। এবার দ্রুত চলতে লাগলো সে। মনিরা দুহাতে নিজের চোখ ঢেকে চুপ করে রইলো।
সুড়ঙ্গের বাইরে এসে মনিরাকে নামিয়ে দিয়ে বলল বনহুর, চোখ যেন খুলে না, পড়ে যাবে।
মনিরা বুঝতে পারলো, এখন সে বেশ প্রশস্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মেলে আনন্দসূচক শব্দ করে উঠলো-ইস, কি সুন্দর আলো-বাতাস।
একটা মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে বনহুর আর মনিরা। একি, দিন যে। তবে যে ওখানে অত আলো জ্বলছিল! বুঝতে পারলো মনিরা ওটা মটির নিচে তাই আলোর ব্যবস্থা।
মনিরা সামনে তাকাতে দেখতে পেল অদূরে একটি জমকালো অস্ত্র নিয়ে। দটি লোক দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুর লোক দুটিকে ইংগিত করতেই অশ্ব নিয়ে এগিয়ে এলো। বনহুর এবার মনিরাকে অশ্বে উঠিয়ে নিয়ে নিজেও চড়ে বসলো। হেসে বল-এর নাম কি জান?
না।
এর নাম তাজ।
বহুদিন নিশীথ রাতে অশ্বখুরধ্বনি কর্ণগোচর হয়েছে। আজ স্বচক্ষে দেখলাম এবং তার পৃষ্ঠে আরোহণ করার সৌভাগ্য লাভ করলাম। সত্যি আজ আমি গর্বিত।
তাজ এবার উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো। বনহুর মনিরাকে বা হাতে এঁটে ধরে দক্ষিণ হাতে লাগাম চেপে ধরলো।
তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। তারপর মনিরাকে নামিয়ে বলেন—এবার কিছুটা হাঁটতে হবে, পারবে?
পারবো।
কিন্তু আমি আর যাচ্ছিনে তোমার সঙ্গে ঐ যে গাড়িখানা পথের ওপরে দেখছো ওটা আমার গাড়ি। ড্রাইভার তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে!
মনিরা।
বল?
আবার কখন তোমার দেখা পাব?
যখন তোমার মন আমাকে ডাকবে, দেখবে ঠিক আমি তোমার পাশে পৌঁছে গেছি। আচ্ছা এবার যাও, আল্লাহ হাফেজ।
মনিরা এগুতে লাগলো, আর বারবার ফিরে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বনহুর তাজের লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে।