মনিরা চমকে ফিরে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ আপত কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো-মনির।
হাসলো বনহুর, কোন জবাব দিল না।
মনিরা আনন্দের আবেগে বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে—তুমি! এ যে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মনির, কি করে আমি তোমার পাশে এলাম। বল, বল মনির?
হেসে বলেন বনহুর—সে মাঝি তোমাকে আমার নিকটে পৌঁছে দিয়েছে, যে নাবিককে তুমি মনে মনে অভিসম্পাত করেছিলে।
মনিরার চোখে একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে, অবাক হয়ে বলে–মনির তুমি কি করে জানলে আমি সে মাঝিকে গালমন্দ দিয়েছিলাম সে মাঝিই বলেছে।
মনিরা আরও অবাক হয়ে বলে–সে কি করে আমার মনের কথা বলবে? জান মনির, সত্যি আমি তাকে অসভ্য বলে মনে মনে গালমন্দ দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না হলে হায় কি যে হত। শয়তান দস্যু দল আমাকে হত্যা করতো।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে বনহুর হত্যা করতো না একথা সত্য তোমাকে তারা . হরণ করে এক শয়তানের হাতে সমর্পণ করতো–
উঃ কি সর্বনেশে কথা! মনির, সে মাঝি তোমার কে?
কি তার পরিচয়?
সে আমার বন্ধু।
বন্ধু? মনির আমার হয়ে তুমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। বেচারা আমাকে কত কষ্ট করে বাঁচিয়েছে।
নাহলে তুমি এখন শয়তান মুরাদের হাতে গিয়ে…
অস্ফুট ধ্বনি করে ওঠে মনিরা–মুরাদ।
হ্যাঁ, সে মুরাদ তোমাকে হস্তগত করার জন্য অবিরত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার টাকা সে পানির মত খরচ করেছে।
দাঁতে দাঁত পিষে বলে মনিরা—পাষণ্ড শয়তান….মনির, তোমার মাঝি বন্ধু কত মহৎ।
হ্যাঁ মনিরা, গরীব বলে কখনও কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা উচিত নয়, বা অবহেলা করা ঠিক নয়। তাই বলে সবাইকে বিশ্বাস করাও ঠিক নয়।
মনিরা বনহুরের জামার বোতাম নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বলে–আমি কি জানতাম ওটা ডাকাতের নৌকা। ভাগ্যিস মাঝিটা ছিল, সত্যি তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এক্ষণি তাকে যদি পেতাম…
কি করতে?
হাত ধরে মাফ চেয়ে নিতাম।
বনহুর মনিরার হাতের কাছে হাতখানা বাড়িয়ে দেয়—সে মাঝি তোমার সামনে উপস্থিত মনিরা নাও মাফ চেয়ে নাও।
মনিরার চোখে বিস্ময়, মুখে ফুটে ওঠে স্মিত হাসির রেখা, বলে ওঠে সে—তাই বল। হ্যাঁ, এবার বুঝেছি সব। তাই তো বলি, কোন সে মাঝি যার এত বীরত্ব।
কই মাফ চেয়ে নিলে না আমার কাছে।
মনিরা বনহুরের বুকে মাথা রেখে চিবুকে মৃদু টোকা দিয়ে বলে–তুমিই এবার আমার নিকটে মাফ চেয়ে নাও। কারণ, একটি যুবতীর হাতে চাপ দেওয়া কম দোষণীয় নয়।
বনহুর আর মনিরা মিলে হাসতে থাকে। বনহুর বলেন—মনিরা, এখানে বেশিক্ষণ থাকা তোমার পক্ষে ঠিক নয়। বল এবার তোমাকে কিভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়?
মনিরা চারদিকে তাকিয়ে বলে—এখন আমি কোথায় মনির?
বনহুর সোজা হয়ে বসে বলে—তুমি এখন আমার গুপ্তকক্ষে বন্দী রয়েছ।
কি বললে এটা তোমার গুপ্তকক্ষ?
হ্যাঁ, গভীর মাটির তলায় রয়েছ এখন তুমি।
এ তুমি কি বলছ!
কেন, ভয় হচ্ছে নাকি?
না।
জান মনিরা, এখানে যদি তোমাকে চিরদিন আটকে রাখি কেউ তোমার সন্ধান পাবে না। এখানে শুধু তুমি আর আমি। মনির, তোমার জন্য আমি সব ত্যাগ করতে পারবো।
বনহুর অন্যমনস্ক হয়ে যায়, কি যেন চিন্তা করতে থাকে।
মনিরা বলে—কি ভাবছো!
জবাব দেয় বনহুর—ভাবছি, তোমার মামাজান-মামীমার কথা। তারা এতক্ষণে হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন।
কি বললে, আমার মামুজান আর মামীমা? তোমার কেউ নন তারা? বলেন, আব্বা আর আম্মা।
সত্য মনিরা, আব্বা আর আম্মা খুব বুঝি ভাবছেন তোমার জন্য। একদিন ঐ ঝিনাইদার বুকে হারিয়েছিল তাঁর প্রিয় পুত্র মনিরকে। আর আজ সে ঝিনাইদা হরণ করলো তাদের একমাত্র কন্যা সমতুল্যা ভাগ্নী মনিরাকে
না, আর বিলম্ব করা উচিৎ হবে না মনিরা, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। বনহুর উঠে দাঁড়ালো।
মনিরাও উঠতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বসে ছিল সে।
বনহুর পুনরায় পাশে বসে বলল—এখনও অসুস্থ বোধ করছো মনিরা?
হ্যাঁ, মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে।
তবে চুপ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি।
কোথায় যাবে মনির?
বিশেষ একটা দরকার আছে।
যাও! মনিরা, বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
বনহুর বেরিয়ে যায়।
বনহুর বেরিয়ে যেতেই মনিরা উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো সব। যে কক্ষে সে শুয়েছিল সেটা একটা মাঝারি রকমের ঘর। কক্ষের দেয়াল কঠিন পাথর দিয়ে তৈরি। কোন আড়ম্বর নেই সে। কক্ষে। মেঝের এক পাশে পাথর দিয়ে তৈরি একটা খাট। খাটে দুগ্ধ ফেননিভ কোমল বিছানা, যে বিছানায় সে এতক্ষণ শুয়েছিল। মনিরা বুঝতে পারল ঐ বিছানা দস্যু বনহুরের। কক্ষের একপাশে একটা পাথরের টেবিল। ‘ টেবিলে ছোটবড় কয়েকখানা রিভলবার। ওপাশের দেয়ালে ঠেস দেওয়া রয়েছে বড় বড় ভারী গোছের দুটো রাইফেল। আর একটা টেবিলে কতকগুলো সুতীক্ষ্ণধার হোরা, অবশ্য সেগুলো সব খাপের মধ্যে আটকানো। মনিরা ধীরে ধীরে সে অস্ত্রগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। এগুলো বনহুরের ব্যবহার্য অস্ত্র। সবগুলোতে যেন তার হাতের স্পর্শ লেগে রয়েছে।
মনিরা এগুতে লাগলো, দেখতে পেল সামনে একটি দরজা তার ওপাশেই একটা সিড়ির মত আরও নিচে নেমে গেছে। মনিরা এক পা দু’পা করে এগুতে লাগলো। সিড়ির মুখে গিয়ে অবাক হলো সে, নিচে ঠিক তার পায়ের তলায় একটা হলঘরের মত প্রকাণ্ড একটা ঘর। ঘরের মধ্যে উজ্জল আলো জ্বলছে। মনিরা অবাক হয়ে দেখলো বনহুর একটি উচ্চ আসনে বসে আছে। তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো বলিষ্ঠ লোক, প্রত্যেকের হাতেই এক একটা রাইফেল। মাথায় পাগড়ী কানে বালা, হাতে বালা, গায়ে ফতুয়ার মত আটসাট জামা।