ভীষণভাবে শিউরে উঠলো মনিরা। এবার সে বুঝতে পারলো মাঝিদের মনোভাব। কিন্তু মুখে ভয়ের ভাব না এনে বলেন—খুবতো আস্পর্ধা তোমাদের দেখছি। মনিরাকে নেওয়া যত সহজ মনে করছে তত সহজ নয়। শিগগির নৌকা ফেরাও, নচেৎ আমরা সবাই মিলে চিৎকার করবো!
শয়তান নাথুরাম হেসে ওঠে হাঃ হাঃ হাঃ চিৎকার করবে? এই নির্জন নদীবক্ষে কে শুনবে তোমাদের কণ্ঠস্বর?
অন্য মেয়েরা সবাই পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারও মুখে কথা নেই। মনে-প্রাণে সবাই খোদাকে স্মরণ করতে থাকে। ভয়ে সকলের মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।
সরকার সাহেব বৃদ্ধ, তবু হার মানলেন না, চিৎকার করে বলেন–শয়তান, তোমাদের চক্রান্ত আগে বুঝতে পারলে তোমাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দিতাম।
হুঙ্কার ছাড়ে নাথুরাম—তা যখন পারনি তখন বুড়ো বয়সে পৈতি জানটা নষ্ট কর না। সুবোধ বালকের মত নিশ্চপ বসে থাক।
নিরস্ত্র সরকার সাহেব শুধু চিৎকার করে শাসাতে লাগলেন, তাছাড়া আর কিইবা করবেন তিনি! এতগুলো দস্যুর সঙ্গে পেরে ওঠা তার পক্ষে মুশকিল।
মেয়েদের মধ্যে একটা হুলস্থুল শুরু হয়েছে। কেউ কাঁদছে, কেউ-বা চিল্কার করছে। কেউ বা বলছে—এটা দস্যু বনহুরের নৌকা। সে মনিরাকে
চুরি করার জন্য এই ফন্দি এটেছে।
মেয়েরা তো বনহুরের নামে কাপতে শুরু করলো! সেকি ভীষণ অবস্থা।
ছিপ নৌকাখানা একেবারে নিকটে পৌঁছে গেছে।
দু’জন বলিষ্ঠ লোক মনিরাকে জাপটে ধরলো। বাধা দিতে গেল সরকার সাহেব, সঙ্গে সঙ্গে একটা বলিষ্ঠ লোক তার নাকে ঘুষি বসিয়ে দিল। সরকার সাহেব ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেল নৌকায়।
লোক দু’জন মনিরাকে শূন্যে উঠিয়ে নিল, তারপর লাফিয়ে ছিল ছিপ নৌকাখানায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্য মাঝিগণও ছিপ নৌকায় লাফিয়ে পড়তে লাগলো।
ওদিকে মনিরার বান্ধবীগণ ভীষণ আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। বাঁচাও! বাঁচাও! দস্যু বনহুর আমাদের সর্বনাশ করলো, আমাদের মেরে ফেললো। বাঁচাও বাঁচাও…..
মনিরাকে ছিপ নৌকায় উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললো দস্যুগণ বজরাখানার দিকে। মনিরাও তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করছে—বাঁচাও বাঁচাও…
মাঝি-বেশি শয়তানের অনুচরের দল ছিপ নৌকায় দাঁড় টেনে চলেছে। ওদিকে মনিরার বান্ধবীও আহত সরকার সাহেবকে নিয়ে বড় নৌকাখানা আপন মনে এদিকে ভেসে চললো।
ছিপ নৌকাখানা প্রায় বজরার নিকটবর্তী হয়েছে, এমন সময় সে মাঝি। যে মনিরাকে তক্তা পার করে নিতে গিয়ে তার হাতে মৃদু চাপ দিয়েছিল, সে হাতের বৈঠা নিয়ে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে। অন্য মাঝিদের ছিপ নৌকাখানা ভীষণ একটা ঘুরপাক খেয়ে গেল।
আচমকা এই বিপদের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না শয়তান নাথুরাম, সে রিভলভার উদ্যত করে গর্জে উঠলো কে তুই?
মনিরা জ্যোস্নার আলোতে লক্ষ্য করলো, এ সে মাঝি কিছু পূর্বেও যে মাঝিকে সে মনে মনে অভিসম্পাত করছিল। এক্ষণে মনিরার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে, কে এ মাঝি যার প্রাণে এত দয়া? নিশ্চয়ই তাকে বাঁচানোর জন্যেই মাঝিটির এত প্রচেষ্টা।
নাথুরাম মাঝিটার বক্ষ লক্ষ্য করে রিভলভার উদ্যত করে ধরতেই মাঝিটা চট করে সরে দাঁড়ালো, নাথুরামের রিভলভার নিস্তব্ধ নদীবক্ষে গর্জে উঠলো—শুড়ম।
মাঝিটা নাথুরামকে পুনরায় রিভলভার উদ্যত করতে না দিয়ে ভীষণভবে আক্রমণ করলো। নাথুরাম টাল সামলাতে না পেরে ছিপ নৌকাখানার মধ্যে পড়ে গেল। মাঝি তার হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল নদীবক্ষে।
ততক্ষণে অন্য শয়তানগুলো আক্রমণ করে মাঝিটাকে। চলে ভীষণ ধস্তাধস্তি।
ছোট্ট ছিপ নৌকাখানার উপরে সেকি তুমুল অবস্থা। ভয়ে মনিরার অবস্থা মরিয়া হয়ে উঠলো। এভাবে নৌকা ভ্রমণের জন্য নিজকে ধিক্কার দিতে লাগলো!
সামান্য একটি ছিপ নৌকা এভাবে কতক্ষণ টিকতে পারে। বিশাল নদীবক্ষে ছিপ নৌকাখানা মোচার খোলার মত দুলতে লাগলো। মনিরা ভয়কম্পিত বক্ষে দেখছে এই বুঝি ছিপ নৌকাখানা ডুবে যায়। মনে প্রাণে সে মাঝিটার কামনা করছে। কি আশ্চর্য ওর সঙ্গে এতগুলো শয়তান পেরে উঠছে না। মাঝিটা এক একটা প্রচণ্ড ঘুষিতে নাথুরামের অনুচরগণকে নদীবক্ষে নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিন্তু নাথুরাম হটার বান্দা নয়, সে প্রাণপণে মাঝিটাকে কাবু করার চেষ্টা করতে লাগলো।
হঠাৎ ছিপ নৌকাখানা একপাশে কাৎ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল নদীবক্ষে।
কোথায় গেল মনিরা কোথায় বা নাথুরাম আর শয়তান মাঝিদের দল। . যে যেদিকে পারলে সাঁতার কেটে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করলো।
মনিরা তলিয়ে যাচ্ছে। সে সাঁতার কাটতে পারে না। বাঁচার কোন উপায় নেই তার। ঢক ঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে ফেললো সে। এই ছিল তার অদৃষ্টে। হায় কেন সে আজ নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছিল। মৃত্যকালে একবার মনে ছিল মনিরের কথা। আর ওর মুখখানা দেখতে পেল না মনিরা। তবু বাঁচার জন্য মনিরা হাত-পা ছুঁড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।
হঠাৎ মনিরা অনুভব করলো কেউ যেন তাকে ধরে ফেলেছে। মনিরা তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। একটা একটা খড়-কুটোও তখন তার কাছে অতি বড় সম্পদ। সে কিছু না ভেবে আঁকড়ে ধরলো শত্রু কিংবা মিত্র ভাবার সময় তখন তার নেই।
মনিরা যখন চোখ মেলে তাকালো তখন একটা উজ্জ্বল আলো তার সামনে ছড়িয়ে ছিল। উঠে বসতে গেল অমনি একটা বলিষ্ঠ বাহ তাকে শুইয়ে দিল।