হাতখানা সরিয়ে নিয়ে বলেন বনহুর-উছ ওটা আংটি নয়।
তবে কী?
ওটা প্রীতির দান।
প্রীতির দান। কে দিয়েছে? কেন দিয়েছে?
নূরী, সব জানতে চেয়ো না।
আমাকে বলতে তোমার এত আপত্তি কেন হুর। বল ও আংটি তুমি কোথায় পেলে?
হেসে বলে বনহুর রাগ করবে না তো?
রাগ। মোটেই না! বল তুমি ঐ আংটি কার নিকট থেকে কেড়ে নিয়েছ?
কেড়ে নেইনি পরিয়ে দিয়েছে।
মিথ্যা কথা, দস্যু বনহুরের আংগুলে কেউ আংটি পরিয়ে দেবে এত বড় সাহস কার আছে। সত্যি করে বল এ আংটি কোথায় পেলে?
একটি মেয়ে আমাকে উপহার দিয়েছে। ঠাট্টা কর না হুর।
ঠাট্টা নয় নূরী। উঠে বসলো বনহুর। আংগুলের আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।
নূরীর মুখমণ্ডল পরিবর্তন দেখা দেয়। গম্ভীর গলায় বলে—হুর কে সে। রানী যে তোমার আংগুলো আংটি পরিয়ে দিতে পারে?
বনহুর উঠে দাঁড়ায়—সব কথা বলা যায় না নুরী।
নূরী আর কোন প্রশ্ন করে না। ধীরে ধীরে উঠে নিজের কক্ষের দিকে চলে যায়। অভিমানে ভরে ওঠে তার মন…একথা কি সত্য? বনহুরকে অন্য কোন নারী আংটি পরিয়ে দিতে পারে? না না, সে সবই সইতে পারে কিন্তু নতুন একঠক করে বল, ঘাবড়ে গেলে সইতে পারিনি বনহুরকে অন্য কোন মেয়ে ভালবাসবে, এ সহ্য করতে পারবে না। বনহুর যে তার, ওকে ছাড়া নূরী কাউকে বুঝে না। সে জীবনে এ একটিমাত্র পুরুষকেই চিনে এসেছে। সে হচ্ছে তার জীবনের একমাত্র সাথী। আর ভাবতে পারে না নুরী। বনহুর মিথ্যে কথা বলেছে না-না কোন নারী দস্যু বনহুরকে ভালবাসতে পারে না। সবাই তার নামে আঁতকে ওঠে। হৃদকম্প শুরু হয় তাদের কিন্তু বনহুরকে যদি একবার কোন নারী স্বচক্ষে দেখে সে কিছুতেই ভালো না বেসে পারবে না। ওর মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ আছে যার কাছে সবাই পরাজিত হবে। সত্য কি তবে ওকে কোন নারী….না না, তা হতে পারে না। বনহুর তার। তাকে কোন নারী তার কাঝ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না…ছুটে যায় নূরী বনহুরের কক্ষে।
বনহুর নতুন একড্রেসে সজ্জিত হচ্ছিল। নূরী ছুটে গিয়ে চেপে ধরে ওর জামার আস্তিন-বনহুর ঠিক করে বল, তুমি যা বললে তা সত্যি? হেসে ওঠে বনহুর-এরই মধ্যে এত ঘাবড়ে গেলে নূরী?
না না, আমাকে তুমি সত্যি করে বল? হুর, আমি সব সইতে পারি কিন্তু তোমাকে হারাতে পারি না… বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে নূরীর কষ্ঠ ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা।
বনহুর আংগুল দিয়ে নূরীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে অয়ধা মন খারাপ কর না নূরী।
বনহুর, বল তুমি যা বললে, সব মিথ্যে?
নূরী, তুমি আমার ওপর বিশ্বাস হারিও না? আমার কাছে তোমার কোন অমর্যাদা হবে না।
বনহুরের বুকে মাথা রেখে বলে নূরী–হুর, তুমি আমার!
বনহুর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন হয়তো তার মনে আর একটি মুখ ভেসে উঠেছে।
বনহুর নূরীকে লক্ষ্য করে বলেও নূরী, বল তাজকে প্রস্তুত করতে।
নূরী বেরিয়ে যায়।
একটু পরে ফিরে আসে—তাজ তৈরি আছে হুর।
বনহুর নূরীর রক্তিম গণ্ডে আংগুল দিয়ে মৃদু আঘাত করে হেসে বলে–চললাম নূরী।
নূরী শুধু ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানাল।
টানা বারান্দা বেয়ে এগিয়ে যায় বনহুর। তারপর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বিকট আকার ব্যাঘ্র মূর্তির মুখগহ্বরে পা দিয়ে চাপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটা দরজা বেরিয়ে আসে তার সম্মুখে। বনহুর বাইরে বেরিয়ে আসতেই দুজন লোক তাজকে এনে হাজির করে বনহুর একলাফে চড়ে বসে তাজের পিঠে। তাজ উলকাবেগে ছুটতে শুরু করে।
বনের শেষ প্রান্তে গিয়ে তাজের পিঠ থেকে নেমে পড়ে বনহুর। তারপর তাজের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে বাড়ি ফিরে যা তাজ।
এবার বনহুর কিছুটা এগিয়ে যায়।
ওপাশে রাস্তার উপরে একটি মোটরকার অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার বনহুরকে দেখতে পেয়েই গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরে।
বনহুর ড্রাইভ আসনে উঠে বসতেই ড্রাইভার তার পাশে বসে। বনহুর এবার গাড়িতে স্টার্ট দেয়।
অতি দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিল বনহুর। চোখে আজ তার এক নতুন উন্মাদনা।
ঘাটের অদূরে পাশাপাশি কয়েকখানা ছোট বড় নৌকা বাধা রয়েছে। ওদিকের একখানা বড় নৌকা বেশ পরিপাটি করে সাজানো, কয়েকজন মাঝি। বৈঠা হাতে বসে রয়েছে। একজন বলিষ্ঠ মাঝি দাঁড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মাথায় পাগড়ী দিয়ে তার মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা। চোখেমুখে একটা শয়তানী ভাব উপচে পড়ছে। কিন্তু লোকটা পাগড়ী দিয়ে নিজের মুখটাকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছে, যাতে কেউ তার মুখ সহজে দেখতে না পায়। অন্যান্য মাঝির মাথাতেও এক একটা গামছা বাঁধা। কারও বা মাথায় একখণ্ড কাপড় জড়ানো, যেমন মাঝিদের হয়।
এই নৌকাখানাই মনিরাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে, দাড়ীর বেশে যে লোকটা পাগড়ীর আড়ালে মুখটা লুকাতে চেষ্টা করছে, তবে সে ব্যক্তি অন্য কেউ নয়—শয়তান নাথুরাম এবং অন্যান্য মাঝির বেশে তারাই অনুচরবর্গ।
অল্পক্ষণেই একদল বান্ধবীসহ মনিরার গাড়ি এসে দাঁড়ালো ঘাটের অদূরে। গাড়ি রেখে নেমে ছিল সবাই। চৌধুরী সাহেব এবং সরকার সাহেব উভয়ে এসেছেন তাদের সঙ্গে। সরকার সাহেব আংগুল দিয়ে বড় নৌকাখানা দেখিয়ে দিয়ে বলেন—চৌধুরী সাহেব, ঐ নৌকাখানা আমি মা মণিদের জন্য ভাড়া করেছি।
চৌধুরী সাহেব নৌকা দেখে খুশি হলেন হেসে বলেন—বেশ, বেশ সুন্দর নৌকাখানা তো! বেশ বড়সড়ও সরকার সাহেব। আপনি কিন্তু ওদের সঙ্গেই থাকবেন।