বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন মরিয়ম বেগম-বাপ হয়ে তুমি এ কথা বলতে পারলে?
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে বলেন চৌধুরী সাহেব—সবই আমাদের অদৃষ্ট, নইলে অমন ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে। পেয়েও আমরা সে রত্নকে পাইনি।
মরিয়ম বেগম বলেন—সত্যি আমার মনিরের মত কই কাউকে তো দেখিনি। ওগো আমি কেন এ শোক বইবার জন্য বেঁচে রইলাম। আমার হৃদয় যে চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে। একটিবার ওকে দেখার জন্য মন যে আমার আকুলি বিকুলি করছে।
চৌধুরী সাহেব উঠে পায়চারী শুরু করলেন, হয়তো তার চোখ দুটি ও ঝাপসা হয়ে আসছিল।
গোটা দিনটা মনিরার উদগ্রীবভাবে কাটলো। কতবার আনন্দে অধীর। হয়েছে সে, কতবার চোখের পানিতে বুক ভাসলো। তার মনির আজ মুক্ত। তাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না নিশ্চয়ই সে আসবে। মন বলছে সে আসবে।
কিন্তু সন্ধ্যা গিয়ে রাত এলো। ক্রমে রাত বেড়ে চললো। কই সে তো এলো না। তবে কি মনির আসবে না। হয়তো সে অভিমান করেছে, পিতার ওপর রাগ করেই সে আর এ বাড়িতে আসবে না।
দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মনিরা।
এমন সময় তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। চারদিক ঘন অন্ধকার। বনহুর সম্মুখস্থ জলের পাইপ বেয়ে দ্রুত উপরের দিকে এগিয়ে চললো।
শরীরে কালো ড্রেস, মুখে কালো রুমাল বাঁধা, মাথায় কালো পাগড়ী, পেছনে মুক্ত জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে লাফিয়ে ছিল সে।
চমকে মুখ তুলে মনিরা। বনহুরকে সে কোনদিন দস্যুর ড্রেসে দেখেনি। বিস্ময়ভরা গলায় বলে ওঠে-কে তুমি?
বনহুর এগিয়ে এসে নিজের মুখের বাধা পাগড়ী পরে আচল খুলে সঙ্গে সঙ্গে মনিরা আনন্দধ্বনি করে ওঠে-মনির!
উহু মনির নই, দস্যু বনহুর।
না, আমার কাছে তুমি দস্যু নও। তুমি আমার মনির..মনিরা ছুটে গিয়ে বনহুরের কণ্ঠবেষ্টন করে ধরে।
বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে, আবেগভরা গলায় ডাকে–মনিরা।
মনিরা বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে–মনির তুমি আমার।
কিন্তু আমি যে দস্যু?
না, আমি সে কথা মানব না। তুমি যে আমার সব।
বনহুর মনিরাসহ খাটে গিয়ে বসে। পাশাপাশি বসলো ওরা দুজনে। মনিরার হাতের মুঠায় বনহুরের একখানা হাত। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা তার মুখের দিকে। কালো ড্রেসে অপূর্ব সুন্দর লাগছে বনহুরকে। মনিরা তন্ময় হয়ে দেখছে। সে দেখার যেন শেষ নেই।
মনিরার বিস্ময়ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে বনহুর। তারপর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে বলে—মনিরা, তুমি কেন আমায় মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেলছ বল তো?
মনিরার গণ্ড বেরিয়ে পড়ে ফোটা ফোটা অশ্রু। স্থির কণ্ঠে বলে সে দস্যু বনহুরকে যদি মায়ার বন্ধনে বাঁধতে পারি, তবে সে হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব।
বনহুর ওকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নেয়, তারপর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে–মনিরা।
মনিরা নিজেকে বিলিয়ে দেয় বনহুরের বাহুবন্ধনে।
বানহুর শান্তকণ্ঠে বলে–মনিরা, তুমিই একদিন বলেছিলে দস্যু বনহুর মানুষ নয়, সে মানুষ নামে কলঙ্ক। সে কথা তুমি অস্বীকার করতে পার?
মনির, তুমিও সেদিন বলেছিলে মনে পড়ে—দস্যু বলে সে কি মানুষ নয়। তার মধ্যে কি মানুষের হৃদয় নেই।
মনিরা, আমি জানি দস্যু বলে সবাই আমাকে ঘৃণা করলেও তুমি আমাকে ঘৃণা করতে পারবে না।
তুমি জানো না, তোমার আব্বা-আম্মার মনেও আজ কি ব্যথা গুমরে। কেঁদে মরছে। তুমি যে তাদের নয়নের মণি ছিলে, তোমাকে হারিয়ে তাদের প্রাণে যে কত আঘাত লেগেছিল, তা তুমি জানো না। আজও তারা তোমার সে শিশুকালের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। আজও তারা ভুলতে পারেননি তোমাকে। মামীমা প্রায়ই তোমার কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করেন। মামুজানের প্রাণেও কম ব্যথা নেই। তারপর তোমাকে আবার অভাবনীয়ভাবে ফিরে পেয়ে তখনই নির্মমভাবে হারালেন। মনির, তাদের অবস্থা অবর্ণীয়।
বনহুরের চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। ব্যথাভরা সুরে বলে—সব জানি মনিরা, সব বুঝি। কিন্তু আমি যে তাঁদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি। মনিরা আমি বড়ই হতভাগ্য, তাই অমন দেবতুল্য পিতা-মাতা পেয়েও পাইনি।
মনির, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না। তা হয় না মনিরা।’
তুমি আমার গা ছুঁয়ে শপথ করেছিলে আর দস্যুতা করবে না। এরি মধ্যে তুমি ভুলে গেলে সব?
না ভুলে যে কোন উপায় নেই, মনিরা। একটা উম্মত্ত নেশা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি নিজের জন্য আর দস্যুতা করবো না। কিন্তু শয়তানের শাস্তি, কৃপণের ধন, অহংকারীর দর্প চূর্ণ আমি করবোই। মনিরা শপথ আমি রক্ষা করতে পারলাম না বলে তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
মনির।
না, আমি দস্যু বনহুর। আমি দস্যু—এক লাফে বনহুর মুক্ত জানালা . দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
স্তব্ধ মনিরা পাথরের মূর্তির মত থ’মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, তার কণ্ঠ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো-মনির।
০৬.
মুরাদের পিতা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে মুরাদকে জেল থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। কিন্তু মুরাদ মুক্ত হয়ে আবার দুর্দান্ত শয়তান হয়ে উঠলো। মনিরাই হলো তার একমাত্র লক্ষ্য। মনিরাকে তার চাই।
তার দলবল যারা একদিন হোটেল থেকে পালিয়েছিল আবার তারা ফিরে এসে যোগ দিল মুরাদের সঙ্গে। এবার তারা অন্য একটি গোপন স্থানে আস্তানা তৈরি করলো। শয়তান নাথুরাম হলো এই দলের নেতা।