নূরীর চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কিন্তু একেবারে আশ্বস্ত হয় না সে, যতক্ষণ বনহুর ফিরে না আসছে ততক্ষণ নিশ্চিন্ত নয় নূরী।
একদিন দু’দিন কুরে পাঁচটা দিন চলে গেছে। যে নূরী একটি দিন বনহুরকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে, সে নূরী আজ কদিন বনহুরকে কাছে। পায়নি।
শুধু নূরীই নয়, বনহুরের অন্তর্ধানে তার সমস্ত অনুচরবর্গ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ঝিমিয়ে পড়েছে গোটা বনভূমি।
সবচেয়ে তাজের অবস্থা দুঃখজনক। বনহুর বন্দী হবার পর তাজ কেমন যেন হয়ে গেছে। ঘাস ছোলা কিছু সে মুখে নেয় না। বনহুর তাজকে নিজ হাতে ঘাস ছোলা খাওয়াতো। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতো। বনহুরের অনুপস্থিতিতে সে অবিরত সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করত। কথা বলতে পারে না তাজ, মনের অবস্থা সে এমনি করে ব্যক্ত করত।
বনহুরের অনুচরগণ তাজের জন্য চিন্তিত হয়ে ছিল। না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে তাজ। এই অশ্বই হচ্ছে বনহুরের সবচেয়ে প্রিয়।
সেদিন নুরী অনেক চেষ্টায় গলায় পিঠে হাত বুলিয়ে একটু ছোলা আর ঘাস খাইয়েছে তাজকে, কিন্তু এমনি করে আর ক’দিন ওকে বাঁচানো যাবে।
সর্দারের বিনা অনুমতিতে দস্যুগণ কিছুই করতে পারবে না। তাই তারা নীরব হয়েছে।
নূরী ঝরনার ধারে বসে গান গায়। বনে বনে ঘুরে ঘুরে চোখের পানি ফেলে। যেদিকে তাকায় শূন্য বনভূমি খা খা করেছ। বনহুরকে নূরী নিজের প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসে। বনহুর ছাড়া আর কেউ যেন নেই ওর। অবশ্য সে কথা মিথ্যে নয়, এ বনে বনহুরই একমাত্র সঙ্গী—একমাত্র সম্বল।
বনহুরকে কেন্দ্র করে নূরী কত আকাশ-কুসুম গড়ে আর ভাঙে বনহুর তার স্বপ্ন–তার সব।
সেদিন নূরী তার নিজের কক্ষে বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল। কই আজও তো বনহুর ফিরে এলো না। রহমান নিশ্চয়ই কোন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বনহুরকে না জানি হাঙ্গেরী কারাগারে কি কঠিন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে! নূরীর চিন্তার অন্ত নেই। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে নূরী।
ঠিক এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর, নূরীকে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ব্যথিত কণ্ঠে ডাকে—নূরী।
মুহূর্তে নূরী চোখ তুলে তাকায়। আনন্দে উজ্জল হয়ে ওঠে তার। মুখমণ্ডল। ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে সে বনহুরের বুকে হুর!
বনহুর নূরীর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে-নূরী, খুব কেঁদেছো বুঝি এ কদিন?
হুর, আমার মন বলেছে কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না, তোমাকে বন্দী করে রাখতে কেউ সক্ষম হবে না।
তোমার বিশ্বাস মিথ্যা নয় নূরী। বনহুকে আটকে রাখে কার সাধ্য। সামান্য পুলিশ বাহিনী বন্দী করে রাখবে আমাকে! হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে বনহুরহাঃ হাঃ হাঃ, হাঙ্গেরী কারগারও বনহুরকে আটকে রাখতে সক্ষম হলো না, নূরী।
নূরী দীপ্ত প্রফুল্ল মুখে বনহুরের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার মধ্যে দেখতে পায় এক নতুন রূপ।
চৌধুরী সাহেব, মরিয়ম বেগম এবং মনিরা চায়ের টেবিলের পাশে এসে বসে, সকলের মুখেই বিষণ্ণতার ছাপ।
বাবুর্চি চা-নাস্তা পরিবেশন করছিল, এমন সময় বয় খবরের কাগজ এনে টেবিলে রাখে।
একসংগে চৌধুরী সাহেবের এবং মনিরার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে পত্রিকা খানার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়মাখা আনন্দ ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করেন চৌধুরী সাহেব-হাঙ্গেরী কারাগার হতে দস্যু বনহুরের পলায়ন। শত শত পুলিশ বাহিনী তাকে আটকিয়ে রাখতে অক্ষম।
আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বলে উঠলেন মরিয়ম বেগম-সত্যি আমার মনির কারাগার থেকে পালিয়েছে? সত্যি বলছো?
হ্যাঁ গো, এই দেখ? চৌধুরী সাহেব পত্রিকার উপরের পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে লেখাগুলো দেখিয়ে দেন।
মরিয়ম বেগম ইংরেজি জানতেন না, তিনি স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন—সমস্তটা পড়ে আমায় বুঝিয়ে বল না গো। আমার মনির কারাগার থেকে পালিয়েছে। না জানি বাছা আমার কোথায় আছে কেমন আছে।
মনিরার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। মনির কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে। ইস কি আনন্দ–কি শান্তি। নিশ্চয় সে আসবে। যেমন করে হউক সে আসবে তার কাছে। মনিরা আনন্দের আবেগে আর স্থির হয়ে বসতে পারে না, ছুটে বেরিয়ে যায় সে। নিজের ঘরে গিয়ে বনহুরের ছোটবেলার ফটোখানা খুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে–ওগো তুমি মুক্ত হয়েছ। জানি কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না। কেউ না…
চৌধুরী সাহেব নিজেই সমস্তটা পড়ে নিয়ে স্ত্রীকে মানে করে বুঝিয়ে বলেন। পুত্র-কন্যা যত দোষে দোষীই হউক না কেন, পিতা-মাতার নিকটে তারা স্নেহের পাত্র। কোন পিতামাতাই পুত্র কন্যার অমঙ্গল কামনা করতে পারে না। মনির আজ দস্যু জেনেও চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম তাকে ঘৃণা করতে পারে না। কারাগার থেকে পালিয়েছে জেনে মনে মনে খুশি হলেন তারা। কিন্তু একেবারে আনন্দ লাভ করতে পারলেন না। কারণ, কারাগার থেকে মনির পালিয়েছে সত্য কিন্তু সে নিরাপদ নয়। অহরহ তাকে পুলিশ বাহিনী খুঁজে ফিরছে। পুলিশ সুপার ঘোষণা করে দিয়েছে, যে দস্যু বনহুরকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় এনে দিতে পারবে তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তাছাড়াও তাকে একটা বীরত্বপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত করা হবে।
মরিয়ম বেগম বার বার খোদার নিকট বনহুরের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। চোর হউক, ডাকু হউক সে সন্তান। হে খোদা তুমি আমার মনিকে রক্ষা কর। মরিয়ম বেগমের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে ওঠেন—যে সন্তান মানুষ নামে কলঙ্ক, তার জন্য ভেবে কি হবে বল। মনে কর মনির বেঁচে নেই।