বনহুর থমকে দাঁড়ায়, কেশে নিয়ে বলে—আজ না হয় রাতের মত অন্য ঘরে।
কথা শেষ করতে দেয় না যুবতী রাগ দেখছি আপনার পড়েনি। বিয়ের রাতেই মাধুরী চলে এসেছিল বলে এখনও অভিমান। যান যান, ভেতরে যান।
বনহুর দেখলো বেশি আপত্তি করা ঠিক হবে না। ধীরে পদক্ষেপে মাধুরীর কক্ষে প্রবেশ করে। দেখতে পায় লজ্জায় জড়োসড়ো একটি যুবতী মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে খাটের একপাশে।
বনহুর বিব্রত বোধ করে। একি অদ্ভুত পরীক্ষায় ছিল সে। নিজেকে সংযত করে একটু কেশে নিয়ে বলেন—মাধুরী।
ঘোমটার ফাঁকে লজ্জা ভরা দৃষ্টি তোলে একবার তাকালো মাধুরী তার দিকে।
বনহুর আরও এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলেন—ভালো আছেতো মাধুরী?
মাধুরী মৃদু মধুর কণ্ঠে বলেন—আছি।
বনহুরের মত বীরপুরুষও ঘেমে নেয়ে উঠতে লাগলো। এবার কি কথা বলবে সে? একটা বিষয়ে আশ্বস্ত হলো, মাধুরী তাকে এখনও চিনতে পারেনি। নইলে সে এতক্ষণ অমনভাবে নিশুপ থাকতো না।
বনহুর খাটে না বসে একটা সোফায় বসে পড়ে বলেন–হঠাৎ ভয়ানক সর্দি-কাশি হওয়ায় গলাটা কেমন বসে গেছে।
মাধুরী আড়নয়নে একবার বনহুরকে দেখে নিল, তারপর এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তার পাশে—ওগো তোমার রাগ পড়েছে?
বনহুর চটপট কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। কাশতে শুরু করে, পরে
কাশি থামিয়ে বলে রাগ করে আর কতদিন থাকা যায় বল।
মাধুরী ঘোমটা অনেকটা সরিয়ে ফেলেছে। আরও ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দভরা কণ্ঠে বলে—সত্যি আমি ভাবতেই পারিনি এত অল্প সময়ে তুমি এতটা বদলে যাবে। বিয়ের রাতের কথাটা আজও আমার মনে আছে। বাসর ঘরে যাবার পূর্বেই মায়ের চিঠি বাবার হাতে এসে পৌঁছলো-ঠাকুর মার অসুখটা ভয়ানকভাবে বেড়েছে, দেখা করতে হলে রাতের ট্রেনে আসবে। তুমি তো রেগে অস্থির, বিয়ের রাতে কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না। দেখ দেখি সেদিন যদি বাবার সঙ্গে আমি না আসতাম, ঠাকুরমার সঙ্গে আর জীবনে দেখা হত না।
বনহুর অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। এবার সে বুঝতে পারলো এখানে ঠাকুরমার অসুস্থতার জন্য মাধুরীকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ঠাকুরমার অসুস্থতার জন্যই বিয়েতে মেয়ের মা ও বাড়ির কেউ যেতে পারেনি। শুধু মেয়ের বাবা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে বিয়েটা দিয়ে এসেছেন। এমন কি বিয়ের রাতেই মাধুরীসহ তার পিতাকে চলে আসতে হয়েছিল, মাধুরী ভালো করে স্বামীকে দেখার সুযোগও পায়নি। মনে মনে খুশি হলো বনহুর।
বনহুর মাধুরীর কথায় দুঃখভরা কণ্ঠে বলেন-ঠাকুরমার মৃত্যতে আমিও ভীষণ দুঃখিত, মাধুরী।
সে কথা তোমার চিঠি পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম।
মাধুরী অলক্ষ্যে দেয়ালঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নেয় বনহুর। রাত ভোর হবার আর মাত্র ক’ঘণ্টা বাকী। হাই তোলে বনহুর মাধুরী, অনেক রাত হয়েছে। শরীরটাও ভালো লাগছে না, একটু ঘুমাবো।
বেশ তো শুয়ে পড়ো। মাধুরী নিজ হাতে বনহুরের জামার বোতাম খুলে দিতে থাকে। মাধুরীর মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে। বনহুর নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলো মাধুরীর মুখের দিকে। মাধুরী সুন্দরী বটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জামাটা খুলে মাধুরীর হাতে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে ছিল। ইস, আজ কদিন এমন নরম বিছানায় শোয়নি বনহুর। কারাগারের কঠিন মেঝেতে আজ তিন চারটা দিন কেটেছে। ভাগ্যিস রহমান বুদ্ধি করে কড়টা তার নিকটে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কর্ডটা তার অনেক উপকারে এসেছে। তাছাড়া বনহুরকে আটকে রাখে এ কার সাধ্য।
মাধুরী আলনায় জামাটা রেখে বিছানায় এসে বসে। বনহুর ঘেমে ওঠে ভয়ে নয় সঙ্কোচে, মিথ্যা অভিনয় তাকে করতে হচ্ছে।
মাধুরী বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।
উভয়ে নীরবে তাকিয়ে রইলো উভয়ের দিকে। মাধুরীর মনে কত আশা-আনন্দ, স্বামী তাকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নেবে কিন্তু একি, এমন তো সে আশা করেনি।
মাধুরী বলে ওঠে——অমন করে কি দেখছো?
বনহুর হেসে বলে—তোমাকে। সত্যি মাধুরী তুমি কত সুন্দর। কথাগুলো বলে নিজেই লজ্জাবোধ করে সে।
মাধুরী যতই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বনহুর ততই সরে যায়। নিজকে মাধুরীর নিকট থেকে কিছুটা সরিয়ে রাখে সে।
মাধুরী কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব ব্যথা অনুভব করলো। কই, এ পর্যন্ত তার স্বামী তো তাকে কোন সাদর সম্ভাষণ জানালো না। তবে কি এখনও তার মনে অভিমান দানা বেঁধে রয়েছে। মাধুরী বনহুরের বুকে মাথা রাখলো-ওগো এখনও তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারলে না।
বনহুর নিজকে সংযত করে রাখে। হাত দু’খানা দিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো এটে ধরে বলে—মাধুরী, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি, তাই….
বুঝেছি ঘুম পাচ্ছে তোমার।
হ্যাঁ মাধুরী।
কিন্তু আমার যে ঘুম পাচ্ছে না। কতদিন তোমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আছি।
আমি তা জানি মাধুরী। কিন্তু আমার মাথাটা এত ধরেছে তোমায় কি বলবো….
বেশ তুমি ঘুমোও; আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
বনহুর পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো।
মাধুরী বনহুরের চুলের ফাঁকে আংগুল বুলিয়ে চললো। কক্ষের স্বল্প আলোতে মাধুরী বনহুরের মুখের দিকে তম্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো। সেদিন স্বামীকে এমন করে দেখার সুযোগ ঘটেনি তার। এত কাছে—এত ঘনিষ্ঠ করেও পায়নি। তবে শুভদৃষ্টির সময় দেখেছিল একটু। কই, সেদিন তো তার স্বামীকে এত সুন্দর বলে মনে হয়নি। অপূর্ব অপরূপ তার স্বামী। আনন্দে মাধুরীর হৃদয় ভরে ওঠে। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে মাধুরী বনহুরের মুখে।