বনহুর ভদ্রলোকটিকে অনুসরণ করে।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেন—আচ্ছা বাবা, গণেশ বলে কাউকে স্টেশনে দেখনি। সে কই?
বনহুর খানিকটা কেশে নিয়ে বলে কই, কাউকেই তো স্টেশনে দেখলাম না।
তবে নিশ্চয়ই বেটা কোথাও শুয়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ভাগ্যিস বাসার ঠিকানাটা তোমাকে ভালভাবে জানিয়ে এসেছিলাম।
হ্যাঁ, সেজন্যই বেশি বেগ পেতে হলো না!
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলে উঠেন-ট্রেনে বুঝি খুব ঠাণ্ডা লেগেছে।
হ্যাঁ।
তাই তো গলাটা যেন কেমন শুনা যাচ্ছে।
বনহুর আঁতকে উঠে বারবার কাশতে শুরু করে। তারপর কাশি থামিয়ে বলে—উঃ গলাটা বড় ব্যথা করছে।
উঠানে পৌঁছতেই কয়েকজন মহিলা ঘিরে ধরলো বনহুরকে, প্রৌঢ় ভদ্রলোক একজন অর্ধবয়সী মহিলাকে দেখিয়ে বলেন—উনি তোমার শাশুড়ী মাতা।
বনহুর থতমত খেয়ে কি করবে ভাবছে, হঠাৎ মনে ছিল হিন্দুরা গুরুজনকে প্রণাম করে। বনহুর নত হয়ে বয়স্ক মহিলার পদধূলি গ্রহণ করলো।
মহিলা বনহুরের মাথায় হাত রেখে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতে লাগলেন।
মহিলাগণ কানাকানি শুরু করেছে, শুনতে পেল বনহুর—মাধুরীর বর তো খুব সুন্দর হয়েছে। চমৎকার ছেলে, যেন কার্তিক।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন—”আমি আগেই বলেছিলাম, আমার পছন্দ আছে।
বনহুর ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করতে লাগলো। সে জীবনে অনেক কঠিন বিপদ হাসিমুখে জয় করেছে, কিন্তু কোনদিন এমন বিপদে পড়েনি। একেবারে জামাই বনে গেছে। যাক তবু এতক্ষণ ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পেরেছে এই যথেষ্ট। কিন্তু এরপর আরও যদি কিছু সমস্যা এসে যায়, তখন তার উপায় কি হবে? এক্ষুণি ইচ্ছা করলে পালাতে পারে সে। শত শত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে যে অদৃশ্য হতে পারে, তার কাছে সামান্য ক’জন নিরীহ প্রাণী এ কিছু নয়, কিন্তু হঠাৎ এদের কাছে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারে না। কাজেই নিশ্চুপ থেকে যায়।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলে ওঠেন–মাধুরী কই? ঘুমিয়েছে বুঝি। মহিলাদের একজন বলে ওঠেন—জামাইবাবু আসবেন বলে এতক্ষণ সে জেগেই ছিল। এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ওকে ডাকছি।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেন—তাই ডাকো বৌমা, ঘুম ভাঙ্গলে দেখবে কে . এসেছে।
মহিলা ডাকতে ডাকতে কক্ষের দিকে চলে যান—মাধুরী দি মাধুরী দি, দেখো গিয়ে কে এসেছে। বনহুর ঢোক গিললো। এইবার তার চরম পরীক্ষা। মাধুরী তবে ঐ যুবকের স্ত্রী। এবার তার সবকিছু ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু এতক্ষণেও তাকে এ বাড়ির কেউ চিনতে পারছে না। ব্যাপার কি? আশ্চর্য লাগে বনহুরের কাছে।
প্রৌঢ় দ্রমহিলা বলেন-পথে কোন কষ্ট হয়নি তো বাবা?
না, শুধু ঠাণ্ডা লেগে গলাটা যা বসে গেছে। কথাটা বলেন বনহুর।
ভদ্রলোক ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন-—এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়েই কথা বলবে, না ঘরে নিয়ে বসাবে?
শাশুড়ী বলে ওঠেন—দেখ বাবা, আমরা তো তোমাকে দেখিনি। এমন কি এ বাড়ির কেউ তোমাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেনি। মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে দিদি বিয়েটা দিয়ে দিল।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেন-কেন জামাই কি অপছন্দ হয়েছে?
বলো কি জামাই অপছন্দ হবে, এ যে সোনায় সোহাগা। যেমন মাধুরী তেমনি বাবা নিমাই।
এতক্ষণে জামাইয়ের নামটা জানতে পারে বনহু। সে যুবকের নাম তবে নিমাই। হ্যাঁ, তাকে কিছুক্ষণের জন্য নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। আর একটি কথা তাকে অনেকটা হালকা করে এনেছে, এ বাড়ির কেউ জামাইকে আজ পর্যন্ত চোখে দেখেনি। কিন্তু মাধুরী, সে তো নিশ্চয়ই তার স্বামীকে ভাল করে চেনে।
বনহুরকে ভাবতে দেখে বলেন ভদ্রমহিলা কি ভাবছো বাবা, দিদি যা করেছেন খুব ভালো করেছেন। আমি ভাবতেও পারিনি এমন জামাই পাবো।
ভদ্রলোক বলেন—তোমার দিদির পছন্দ তোমার চেয়ে অনেক বেশি। আমার মাধুরীর স্বামী যেন রাজপুত্র। দেখ বাবা, মনে কিছু করো না, মাধুরীকে বিয়ের দিনই নিয়ে না এলে ওর ঠাকুরমার সঙ্গে এ জীবনে আর দেখাই হত না।
বনহুর ব্যথিত-কষ্ঠে বলে ওঠে-ঠাকুরমা তাহলে….
হ্যাঁ বাবা, তিনি মারা গেছেন, কেন তুমি চিঠি পাওনি?
বনহুর একটু চিন্তা করার ভান করে বলে—চিঠি, কই না তো তিনি কি সে দিনই….
হ্যাঁ, মাধুরীকে নিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছলাম, তার ঘণ্টাকয়েক পরেই মা মারা যান। মাধুরীও বুঝি তোমাকে একথা লিখে জানায়নি?
না।
তবে তোমাকে সব গোপন করে গেছে দেখছি। হঠাৎ কথাটা জানালে ব্যথা পেতে পারো তাই বুঝি মাধুরী লেখেনি।
বনহুর লক্ষ্য করলো ওপাশের দরজায় একটা সুন্দর মুখ ভেসে উঠে আবার আড়ালে সরে গেল।
মহিলাটি বলে ওঠেন–মাধুরী জেগেছে, যাও বাবা, ও ঘরেই খাবার পাঠিয়ে দেব। সব ঠান্ডা হয়ে গেছে কিনা, একটু গরম করে দিন।
বনহুর বলে ওঠেনা না, রাতে আর কিছু খাব না। বড় অসুস্থ বোধ করছি।
তাহলে একটু গরম দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।
না, কিছু খাবো না। শ্বশুর মহাশয় বলে ওঠেন—সেকি হয় বাবা? রাত্রে উপোস দিতে নেই। তুমি যাও বাবা, ঠাণ্ডায় অসুখ বাড়বে।
বনহুর ইতস্ততঃ করছে বলে একটি যুবতী বনহুরকে লক্ষ্য করে বলেলজ্জা করছে, না? আসুন আপনাকে পৌঁছে দিই।
বনহুর যুবতীর পেছনে চলতে চলতে ভাবে—তাদের জামাইয়ের এই প্রথম শ্বশুরালয়ে পদার্পণ। এ বাড়ির এক শ্বশুর মহাশয় ছাড়া জামাইকে কেউ বুঝি দেখে নি। তবু শ্বশুর মহাশয়ের চোখেও পাওয়ার ওয়ালা চশমা। কিন্তু জামাইবাবুর স্ত্রী সে তো তার স্বামীকে সহজেই চিনে নেবে। তখন পেছন থেকে যুবতীটি বলেন—এবার যান, সোজা ভেতরে চলে যান….