বালিকা মৃদুস্বরে বলে ভুল হয়েছে মামুজান। আমি মনির ভাইয়ের কাছে কত করে মাফ চাইলাম, মাফ করলো না।
সে কি মনির, ভুল করে মনিরা যদি একটু ক্ষতি করেই থাকে, তবে কি তা ধরতে হয়? এসো মনি, বলো তোমাকে আমি মাফ করে দিয়েছি।
মনির মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—দিলাম ওকে মাফ করে।
ঠিক সে মুহূর্তে নৌকাখানা দুলে উঠলো। মাঝিদের মধ্য থেকে একজনের গলা শুনা গেল-হুজুর ঝড় উঠেছে, ঝড় উঠেছে, হুশিয়ার হুশিয়ার….
চৌধুরী সাহেব ছৈ-এর ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখমণ্ডল তার ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।
গোটা আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তার সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া।
মনির এসে দাঁড়িয়েছে পিতার পাশে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। মনিরাকে বুকে চেপে ধরে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলেন রওশনআরা বেগম। মরিয়ম বেগম পুত্রের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন।
প্রচণ্ড ঝড়ের দাপটে নৌকাখানা মোচার খোলার মত দুলছে, চৌধুরী সাহেব চিৎকার করে মাঝিদের সাবধান হবার নির্দেশ দিচ্ছেন। অন্য কোনদিকে তার খেয়াল নেই।
একে অন্ধকার রাত। তার ওপর প্রচণ্ড দাপট। মাঝিরা মরিয়া হয়ে নৌকাখানা সামলাতে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৌকাখানাকে রক্ষা করতে পারলো না তারা। নদীবক্ষে নৌকাখানা তলিয়ে গেল।
খোদার হয়ত রহম ছিল। অল্পক্ষণেই ঝড়ের বেগ কমে এলো চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, তাঁদের নৌকা গভীর নদীতে ডুবে যায়নি। নদীর একেবারে কিনারে এসে ডুবেছিল।
মাঝিদের সাহায্যে চৌধুরী সাহেব সপরিবারে তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলেন। কিন্তু একি, মনির কোথায়। চৌধুরী সাহেব মরিয়ম বেগম, রওশন আরা বেগম, মনিরা সবাই আছে—শুধু নেই মনির।
মরিয়ম বেগম বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন। চৌধুরী সাহেব অন্ধকারেই পাগলের ন্যায় ছুটাছুটি করতে লাগলেন, আর পুত্রের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন।
এমন সময় ভোর হয়ে এলো। একমাত্র পুত্রের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম পাগল-পাগলিনী প্রায় হয়ে ছিল। রওশন আরা বেগমও কেঁদেকেটে আকুল হলেন।
ওদিকে স্রোতের টানে বহুদূর ভেসে গিয়েছিল মনির।
মদীর কিনারে বালির ওপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে সে। খোদার মহিমায় জীবন বেঁচে গেছে মনিরের।
এমন সময় নদীর কিনার ধরে এগিয়ে আসছিল দস্যু কাল খা। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মনিরের দিকে। দেখতে পায় সুন্দর ফুটফুটে একটা বালক পড়ে আছে বালির ওপরে। বালকটি মৃত না জীবিত দেখার জন্য কালু ঋ বসে পড়ে তার পাশে।বুকে কান লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখে। যখন বুঝতে পারে বালক মৃত নয় জীবিত, তখন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা নতুন আশার আলো উঁকি দিয়ে যায় কালু খাঁর মনে। অতি যত্নে কাঁধে উঠিয়ে গহন বনের দিকে পা বাড়ায় সে,…
কালু খাঁ অস্ফুট কন্ঠে ডেকে ওঠে—বনহুর!
সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর, কালু খাঁর মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে—বাপু!
কালু খাঁ বলতে আরম্ভ করে—বনহুর, তারপর তোকে নিয়ে এসে আমি নিজের ছেলের মতই লালন-পালন করতে লাগলাম। দিন দিন বড় হতে লাগলি তুই। ভুলে গেলি তোর পিতামাতার কথা। একদিন ফিরে এসে দেখি, তুই বনের মধ্যে একটা ঝোপের পাশে খেলা করতে করতে ঘুমিয়ে ১২
পড়েছিস। ভোরের সূর্যের আলো পড়েছে তোর মুখে। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল তোকে। যেন শিশিরমিগ্ধ একটা ফুল। কতক্ষণ যে আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম জানি না, হঠাৎ আমার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ
বনহুর’!
বনহুর অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠে—বাপু!
হ্যাঁ, তারপর ধীরে ধীরে মনির মুছে গিয়ে তৈরি হলো আমার বনহুর। আমি তোকে খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলাম। একদিন দস্যু কালু খাঁ পরাজিত হলো বনহুরের কাছে। জয়ী হলো সে। সেদিন আমার দস্যু—জীবন সার্থক হলো, নিঃসন্তান কালু খ্ৰী পুরত্ব লাভে সক্ষম হলো….. হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে কালু খাঁ—হাঃ হাঃ হাঃ আমার সাধনা সার্থক হয়েছে। আমার বাসনা পূর্ণ হয়েছে। দস্যু কালু খাঁ মরে গেছে…. দস্যু কালু খাঁ মরে গেছে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দস্যু বনহুর। হাঃ হাঃ হাঃ, একদিন কালু খাঁর ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পিত হয়ে পড়েছিল, আজ প্রকম্পিত হচ্ছে দস্যু বনহুরের ভয়ে। আমার সাধনা সার্থক হয়েছে, হাঃ হাঃ হাঃ হঠাৎ উঠে বসতে যায় কালু খাঁ, সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। বনহুর দু’হাতে তুলে ধরে ডাকে…. বাপু… বাপু….
কিন্তু কালু খাঁ তখন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বনহুর কালু খাঁর প্রাণহীন দেহল বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে–বাপু… বাপু….
অমনি ছুটে এলো নূরী।
নূরী দস্যু কালু খাঁর পালিতা কন্যা। অবশ্য নূরীর পিতা দস্যু কালু খাঁরই একজন অনুচর ছিল। দস্যুতা করতে গিয়ে নিহত হয় নূরীর বাবা। সে হতে নূরী রয়ে যায় কালু খাঁর নিকটে।
বনহুর এই বনে খেলার সাথী হিসেবে নূরীকেই পেয়েছিল পাশে। বনহুরকে ভালবাসতো নূরী। কিন্তু বনহুরের মনে নূরী তখনও দাগ কাটতে পারেনি। বনহুর নিজকে নিয়ে নিজেই ব্যস্ত থাকতো।
নূরী ছুটে এসে কালু খাঁকে বিছানায় ঢলে পড়ে থাকতে দেখে আর্তনাদ করে ওঠে বাপু! এ কি হয়েছে তোমার!