অপর পুলিশ পুনরার রাইফেল তুলে গুলি ছুঁড়তে যায়, কিন্তু বনহুর তার পূর্বেই রিভলভারের এক গুলিতে পাহারাদার পুলিশকে তার সঙ্গীর সঙ্গে পরপারে পাঠিয়ে দেয়।
তারপর ছুটতে থাকে সম্মুখের দিকে।
অল্পক্ষণের মধ্যে ফটক খুলে পুলিশ ফোর্স বেরিয়ে এলো, সবাই ছুটতে লাগলো এদিকে সেদিকে। কোন দিকে গেছে বনহুর কেউ জানে না।
হাঙ্গেরী কারাগারে বিপদ সংকেত ঘণ্টা অবিরাম গতিতে বেজে চলেছে।
বনহুর ছুটতে ছুটতে রাস্তার ধারে একটা ডাস্টবিনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল।
তার পাশ কেটে চলে গেল একটা পুলিশ ভ্যান। ভ্যানে বিশ-পঁচিশজন পুলিশ রাইফেল উদ্যত করে দাঁড়িয়ে আছে। কারখানা চলে গেলে বনহুর সোজা হয়ে বসলো।
অল্পক্ষণেই সমস্ত শহরে হাঙ্গেরী কারাগারের বিপদ-সংকেত ধ্বনি ছড়িয়ে ছিল। সবাই আন্দাজ করে নিল নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর পালিয়েছে।
বনহুর বন্দী হওয়ার গোটা শহরে একটা শান্তি ফিরে এসেছিল। আবার নগরবাসীদের মুখমণ্ডল ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে পড়লো।
বনহুর ডাস্টবিনের আড়ালে লুকিয়ে কোন গাড়ির প্রতীক্ষা করতে লাগলো। ইতোমধ্যে আর একটি পুলিশ ভ্যান সে রাস্তা দিয়ে চলে গেল। বনহুর হামাগুড়ি দিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ যদি কোন পুলিশ তাকে দেখে ফেলে, তাহলে আবার তাকে ফিরে যেতে হবে হাঙ্গেরী কারাগারকক্ষে।
বনহুর এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে দেখছে। হঠাৎ দেখতে পেল স্টেশনের দিকে থেকে একখানা ঘোড়ার গাড়ি সে পথে এগিয়ে আসছে। হয়তো বা কোন ট্রেনযাত্রী হবে। গাড়ির সামনে বেডিংপত্র রয়েছে।
বনহুর এ সুযোগ নষ্ট করলো না। পথের একপাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িখানা দ্রুত এগিয়ে আসছে। লাইটপোস্টের ক্ষীণালোকে দেখল কোচোয়ান গাড়ির ওপরে বসে লাগামটা শক্ত করে ধরে আছে। তার দক্ষিণ হাতে চাবুক। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পিঠে চাবুকখানা সপাং করে গিয়ে পড়ছে।
গাড়িখানা বনহুরের পাশে আসতেই সে ক্ষিপ্র হস্তে গাড়ির দরজা ধরে পাদানীতে উঠে দাঁড়ায় এবং এক মুহূর্তে বিলম্ব না করে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
গাড়ির ভেতরে একটি যুবক বসে বসে ঝিমাচ্ছিল। বনহুর তাকে কিছু বুঝার সময় না দিয়ে তার মুখটা শক্ত করে চেপে ধরলো। সে লক্ষ্য করলো যুবকটা হিন্দু, কারণ তার শরীরে ধুতি আর পায়জামা। এতে বনহুরের সুবিধা হলো, ধুতির আঁচল দিয়ে অতি সহজেই যুবকটিকে মজবুত করে বেঁধে ফেললো। পূর্বেই যুবকের পকেট থেকে রুমালখানা বের করে গুঁজে দিয়েছিল সে তার মুখের মধ্যে, কাজেই যুবক একটু শব্দও করতে পারল না। যুবকের হাত-পা মজবুত করে বেঁধে গাড়ির মেঝেতে ফেলে দেয় বনহুর।
কোচোয়ান একবার চিৎকার করে বলে-বাবু, অত নড়াচড়া করছেন কেন?
বনহুর একটু কেশে জবাব দেয়-বড় ঠাণ্ডা লাগছে, তাই দরজা, জানালার শার্শী লাগিয়ে দিচ্ছি।
কোচোয়ান আর কোন কথা বলে না।
বনহুর অতি সহজেই কাজ সমাধা করে ফেললো। এবার বনহুর দেখতে পেল, গাড়ির মধ্যে একটি সুটকেস রয়েছে। বনহুর যুবকের পকেট থেকে চাবি নিয়ে সুটকেসটা খুলে ফেললো। যুবকের পকেটেই একটা ম্যাচ ছিল, বনহুর ম্যাচ জ্বেলে দেখলো তার মধ্যে যুবকের প্যান্ট-শার্ট-কোট রয়েছে। আরও অনেক কিছু রয়েছে সুটকেসে। বনহুর চটপট প্যান্ট-শাট আর কোট গায়ে পরে নিল। ভাগ্য ভাল বলতে হবে, বনহুরের মতই ছিল যুবকটির শরীরের মাপজোক, তাই কোন অসুবিধা হলো না। কিন্তু এবার বিপদে ছিল সে। প্যান্ট-সার্ট-কোটতো হলো, কিন্তু জুতো যে নেই তার পায়ে। হঠাৎ খেয়াল হলো যুবকের পায়ে নিশ্চয়ই জুতো আছে। মুহূর্ত বিলম্ব না করে যুবকের পা থেকে জুতো খুলে নিল, মনে মনে খোদার নাম স্মরণ করতে লাগলো, জুতো জোড়া যদি তার পায়ে না হয়, তবে মহা মুশকিল হবে। বরাত ভালো তাই জুতো জোড়াও তার পায়ে মাপমত হয়ে গেল।
আসনে বসে হাফ ছেড়ে বাঁচলো বনহুর। তাদের গাড়ির পাশ কেটে আরও কয়েকখানা পুলিশ ভ্যান চলে গেল। হাসলো বনহুর। গাড়িতে বেডিংপত্র দেখে ফোর্স কোনরূপ সন্দেহ করেনি।
তখনও দূর থেকে ভেসে আসছে হাঙ্গেরী কারাগারের বিপদ সংকেত ধ্বনি।
বনহুরকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।
শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে গাড়িখানা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলেন এক পৌঢ় ভদ্রলোক। ব্যস্তকণ্ঠে তিনি ডাকাডাকি শুরু করলেন—ওরে মহেন্দ্র! ওরে মাধু। জামাইবাবুর গাড়ি এসেছে। ওরে জামাইবাবুর গাড়ি এসেছে।
বনহুর চমকে উঠলো সর্বনাশ, সে তাহলে জামাই বনে গেল। কিন্তু এখন কোন উপায় নেই, তাকে জামাই সেজেই চালিয়ে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি যুবকের গলায় জড়ানো মাফলারটা খুলে নিয়ে বেশ করে জড়িয়ে নিল নিজের গলায়। তারপর একটু কেশে বলেন—অত চেঁচামেচি করবেননা, ঠাণ্ডা লেগে মাথাটা বড় ধরেছে। তারপর কোচোয়ানকে লক্ষ্য করে বলে—এই! তুমি বেডিং পত্ৰনামিয়ে একটু ভেতরে পৌঁছে দাও।
কোচোয়ান তার আসন থেকে নেমে বেডিংপত্র নামাতে শুরু করে। বনহুর নিজের হাতে সুটকেসটা নামিয়ে নেয়। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলে ওঠেন—আহ, থাক থাক। ওরে মহেন্দ্র! এদিকে আয় না, জামাই বাবু নিজেই তো জিনিসপত্র নামিয়ে নিচ্ছেন।
মহেন্দ্র নামে যে লোকটি এসে হাজির হল, সে তখন দ্রিার ঘোরে চোখ রগড়াচ্ছে। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বনহুরের হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে মহেন্দ্রের হাতে দিয়ে বলেন–যা, ভেতরে নিয়ে যা, আর শুন, কোচোয়ানকে দেখিয়ে দে বেডিংপত্র কোথায় রাখবে। তারপর বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে—এসো বাবা এসো।