মিঃ হারুন গম্ভীরকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–হুঁ।
মিঃ শঙ্কর রাও বলে ওঠেন–আপনার ভাগ্নির বিয়েতে মতামত সম্বন্ধে দস্যু বনহুরের কি স্বার্থ থাকতে পারে?
চৌধুরী সাহেব বলেন–নিশ্চয়ই বনহুরের দৃষ্টি আমার মনিরার উপর পড়েছে।
সে কথা মিথ্যে নয়, চৌধুরী সাহেব। এ না হলে সে এখানে আসতে যাবে কেন? সত্যি আমি বড় দুঃখিত, নিজে থেকেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলাম না। কথাগুলো বলেন দস্যু বনহুর।
না, না, এতে দুঃখ করার কিছু নেই বাবা! তুমিই বা এ অবস্থায় কি করবে। চৌধুরী সাহেব বনহুরকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন।
মিঃ হারুন হঠাৎ গম্ভীরকণ্ঠে বলে ওঠেন চৌধুরী সাহেব, বনহুরকে আজ আমি গ্রেপ্তার করবোই।
সকলেই বিস্ময়ভরা নয়নে তাকালেন মিঃ হারুনের মুখে।
মিঃ হারুন তেমনিভাবেই বলেন সে এ কক্ষেই বিদ্যমান। একসংগে বলে ওঠেন–বলেন কি!
মনিরা ভয়ার্ত চোখে তাকালো কক্ষের চারিদিকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে। সবচেয়ে নিরাপদ স্থান যেন ওর ওটা।
মিঃ হারুন ঠিক সে মুহূর্তে রিভলবার বের করে উদ্যত করে ধরলেন বনহুরের দিকে এবং পুলিশদেরকে বলেন–ঐ ভদ্র যুবককে গ্রেপ্তার কর।
মনিরা স্তব্ধ নিঃশ্বাসে তাকালো বনহুরের মুখে। বনহুরও একবার তাকিয়ে নিল মনিরার মুখের দিকে। তারপর চোখের পলক মাত্র; আচমকা এক ঝটকায় মিঃ হারুনের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লাফিয়ে ছিল মুক্ত জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে।
পুলিশ ফোর্স একসঙ্গে গুলি ছুঁড়লো—গুডুম গুড়ুম। কতকগুলো পুলিশ। ছুটলো অন্ধকারে।
মনিরার মনে তখন ঝড়ের তাণ্ডব বইতে শুরু করেছে। কম্পিত প্রাণে সে আল্লাহকে স্মরণ করলো–হে আল্লাহ, ওকে তুমি বাঁচিয়ে নাও। ওকে বাঁচিয়ে নাও!
চৌধুরী সাহেব মেরে গেছেন। তাঁর শুষ্ক কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো–এ কি করে সম্ভব হয়? মনে মনে একটা গভীর ব্যথা অনুভব করেন। চোখ দুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে।
মিঃ হারুন হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে ছিল। এর জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এত দ্রুত তার হাত থেকে বনহুর রিভলবার ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল যে, কিসে কি হলো মিঃ হারুন বুঝতেই পারলেন না। চেহারা তার বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। দস্যু বনহুরকে এত নিকটে পেয়েও হারালেন!
মিঃ শংকর রাও হেসে বলেন–ইন্সপেক্টার সাহেব, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করা যত সহজ মনে করা যায়, তত সহজ নয়।
মিঃ হারুন বলে ওঠেন–কিন্তু আমি দেখে নেবো দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে পারি কিনা! কথাটা বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান মিঃ হারুন। অন্যান্য পুলিশ অফিসার এবং পুলিশগণ তাকে অনুসরণ করে।
২৩.
গোটারাত মনিরার অদ্রিায় কাটলো। পরদিন ভোরে চায়ের টেবিলে বসে কন্যা সমতুল্যা ভাগনীর চেহারা লক্ষ্য করে চৌধুরী সাহেব বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল। তিনি জানেন, মনিরা জামানকে কত ভালবাসতো। চৌধুরী সাহেব নিজেও কম ভালবাসেন কি! অমন চেহারা; অমন ব্যবহার, কে না তাকে ভালবেসে পারে! কিন্তু সে যে সে ডাকাত শুধু। ডাকাত নয়, দুর্দান্ত দস্যু বনহুর যার ভয়ে আজ গোটা দেশবাসী কম্পমান। না না, তাকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেন না চৌধুরী সাহেব। যতই সে ভাল হউক, যতই সে মহৎ হউক তবু সে দস্যু। শাস্তি তার পাওয়া উচিত।
চৌধুরী সাহেব মনিরার মনকে প্রফুল্ল করার জন্য হেসে বলেন–মনি, চল মা সকাল বেলাটা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আজ ক’দিন থেকে তোমার মামীমাও বেড়াতে যাব বলছেন।
মনিরা চায়ের খালি কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলেনমামুজান, আজ আমার যে এক বান্ধবীর বাড়ি যাবার কথা আছে। হাতঘড়ির দিকে তাকায় মনিরা, তারপর উঠে দাঁড়ায়।
চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, মনিরা নিশ্চয়ই সে দস্যু বনহুরের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। একদিন কথায় কথায় তিনি মনিরার নিকটে শুনেছিল শহরের শেষ প্রান্তে জামানের বাড়ি। রাস্তার নাম এবং নম্বরটাও তার স্পষ্ট মনে আছে। মনে মনে হাসলেন চৌধুরী সাহেব। এমন একজন দস্যুকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারলে শুধু তার সুনাম হবে না, এতে কৃতিত্ব আছে অনেক।
মনিরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেন–জানো মরিয়ম, মনি এখন কোথায় গেল?
মরিয়ম বেগম বলেন—মনি তো বলেই গেল তার কোন বান্ধবীর বাড়ি যাবে সে।
না গো না, মনি গেল সে দটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
তুমি জানলে, অথচ বাধা দিলে না?
না, আমি বাধা দেব না; বরং তার সাক্ষাতে আমি দস্যু বনহুরকে পুলিশের হাতে তুলে দেব!
এসব তুমি কি বলছো?
হ্যাঁ মরিয়ম, মনিরা ছদ্মবেশী দ্ৰযুবক দস্যু বনহুরকে ভালবেসে ফেলেছে। শুধু ভালবেসেছে নয়, তাকে সে গোটা অন্তর দিয়ে কামনা করে আসছে।
দেখ শুধু কি মনিরাই তাকে ভালবেসেছিল। কি জানি, আমার গোটা মনটাও যেন সে অধিকার করে বসেছিল। সত্যি সে যে দস্যু, একথা আমি এখনও ভাবতে পারিনে। আমার মনটা কেমন যেন ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে উঠছে। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে মরিয়ম বেগমের কণ্ঠ।
চৌধুরী সাহেবের হদয়ে ব্যথার আঁচ লাগে। তিনি গম্ভীর গলায় বলেন–কি যাদু জানে সে, কে জানে। কেন যে ওকে এত ভালো লাগতো আমি নিজেও বুঝি না। যাক শুনো মরিয়ম, আমি এক্ষুণি পুলিশ অফিসে যাব।