যাও বাবা, ওদিকে মনিরার সময় হয়ে এলো।
চলো মনিরা।
বনহুর আর মনিরা পাশাপাশি ড্রাইভ আসনে ওঠে বসলো। জনমুখর রাজপথ ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে।
মনিরার শাড়ির আঁচলখানা বারবার বনহুরের গায়ে উড়ে উড়ে পড়ছিল। একটা সুমিষ্ট গন্ধ, বনহুরের প্রাণে দোলা লাগে।
বনহুর মৃদু হেসে বলে–মনিরা!
বলো?
এই নির্জন গাড়ির মধ্যে যদি মিঃ জামান না হয়ে দস্যু বনহুর থাকতো তোমার পাশে?
মনিরা দক্ষিণ হাতে বনহুরের মুখ চেপে ধরে ও নাম তুমি মুখে এনো, ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
মনিরা!
বলো?
দস্যু বনহুর কি মানুষ নয়?
মনিরা বনহুরের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে–ওসব আলোচনা না-ই বা করলে।
মনিরা, ধর বনহুর তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে, তার প্রতিদানে তাকে তুমি ভালবাসতে পারো না?
ছিঃ এসব কি বলছো? যে মানুষ নামের কলঙ্ক, তাকে নিয়ে তুমি ঠাট্টা করছো
মনিরা! অস্কুট ধ্বনি করে ওঠে বনহুর।
মনিরা চমকে উঠে বলে–কি হলো?
কিছু না। ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেলে এসে গেছি।
বনহুর আর মনিরা কক্ষ থেকে চলে যাবার পর মরিয়ম বেগম সোফায় বসতে যাবেন, হঠাৎ সোফার পাশে একখানা নীল রঙের কাগজ পড়ে আছে। দেখতে পান।
কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়েই চমকে ওঠেন। তাতে লেখা রয়েছে–
আজ রাতে আমি আসবো
–দস্যু বনহুর
মরিয়ম বেগমের কম্পিত হাত থেকে কাগজখানা পড়ে যায়। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যান তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চৌধুরী সাহেব এসে পড়েন। স্ত্রীকে বিবর্ণ মুখে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন–অমন গম্ভীর হয়ে বসে আছ কেন?
মরিয়ম বেগম আংগুল দিয়ে কাগজখানা দেখিয়ে দেন।
চৌধুরী সাহেব কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে দৃষ্টি বুলাতেই থ হয়ে গেছেন, ঢোক গিলে বলেন–তাহলে উপায়?
মরিয়ম বেগম বলেন–এক্ষুণি পুলিশে খবর দাও।
ঠিক বলেছ। চৌধুরীসাহেব কালবিলম্ব না করে পুলিশ অফিসে ফোন করলেন। এইমাত্র দস্যু বনহুরের চিঠি পেয়েছি আমরা তো ভীষণ ভয় পাচ্ছি, মনিরাকে নিয়ে আমাদের যত ভাবনা। মিঃ হারুন, আপনিই এখন আমাদের ভরসা।
মনিরাকে নিয়ে বনহুর যখন ফিরে এলো, তখন চৌধুরীবাড়ি পুলিশে ভরে গেছে। মিঃ হারুন উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী করছেন আর বলছেন–চৌধুরী সাহেব, এই ঘটনার পরও মনিরাকে সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠানো আপনার উচিত হয়নি।
চৌধুরী সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেন ইন্সপেক্টার সাহেব, মনিরার সঙ্গে জামান আছে, সে সঙ্গে থাকলে ইনশাআল্লাহ-আমাদের আশঙ্কা করার কিছু নেই।
এসব আলোচনা চলছে, ঠিক সে সময় বনহুর আর মনিরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে কক্ষে প্রবেশ করলো।
চৌধুরী সাহেব কলকণ্ঠে বলে ওঠেন–ঐ যে মনি এসে গেছে? দেখুন ইন্সপেক্টার সাহেব, আমি বললাম না আমাদের জামান থাকতে ওর কোন চিন্তা নেই।
একথা মিথ্যে নয় চৌধুরী সাহেব। জামান সাহেব সত্যই একজন বীর পুরুষ। কথাটা বলেন মিঃ হারুন।
মনিরা ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে মামুজান, হঠাৎ ইনারা? আমি কিছু বুঝতে পারছিনে?
চৌধুরী সাহেব ভয়ার্তকণ্ঠে বলেন–ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
বনহুর আশ্চর্য হবার ভান করে বলে–ভয়ঙ্কর ঘটনা! বলছেন কি? হঠাৎ কি ঘটলো?..
এই দেখ! চৌধুরী সাহেব নীল রঙের কাগজখানা পকেট থেকে বের করে বনহুরের হাতে দেন।
বনহুরের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। কাগজখানা চৌধুরী সাহেবের হাতে দিয়ে বলে ভয় পাবার কিছু নেই।
–তার মানে? বিস্ময়ভরা গলায় বলে ওঠেন মিঃ হারুন। দস্যু বনহুরের চিঠি, অথচ আপনি বলছেন ভয় পাবার কিছু নেই।
ওটা বনহুরের একটা খেয়াল, বিশেষ করে পুলিশ মহলকে সে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে
আপনি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেন না, তাই ও কথা বলতে পারলেন। দস্যু বনহুর যে কত ভয়ঙ্কর তা শুধুমাত্র একদিনের লড়াইয়ে অনুভব করতে পারেননি সেদিন কোন বেকায়দায় পড়ে আপনার হাতে–
সে কাবু হয়েছে, কি বলেন? কথাটা বলে হাসে বনহুর।
চৌধুরী সাহেব বলে ওঠেন—সে যাই হইক বাবা, আজ আমি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেব না, থাকতেই হবে আমাদের এখানে।
তা কি করে হয় বলুন, বাসায় একটা জরুরী কাজ আছে।
তা রাতের বেলা এমন আর কি কাজ। থেকেই যান মিঃ জামান। কথাটা বিনয়ের সঙ্গে বলেন মিঃ হারুন।
মনিরার মুখের দিকে তাকায় বনহুর। মনিরার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, করুণ দৃষ্টির মাধ্যমে বনহুরকে সে থাকার অনুরোধ জানায়।
অগ্যতা বনহুর থাকবে বলে কথা দেয়।
চৌধুরী সাহেব কতকটা আশ্বস্ত হন। মিঃ হারুনের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে, যাক তবু একজন শক্তিশালী সাহসী ব্যক্তি আজ তাদের সঙ্গী হলো–যদি দস্যু বনহুর এসেই পড়ে, কৌশলে তাকে বন্দী করার সুযোগ হলেও হয়ে যেতে পারে।
২২.
গভীর রাত।
সে হোটেল, হোটেলের সম্মুখে একটি গাড়ি এসে থেমে ছিল।
অমনি একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে ছিল দুটি ছায়ামূর্তি।
গাড়ি থেকে নামলো সে কাবুলীওয়ালা। অন্ধকারে চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলো, তারপর দ্রুত হোটেলে প্রবেশ করলো।
ছায়ামূর্তি দুটি অতি গোপনে কাবুলীওয়ালাকে অনুসরণ করলো, হোটেলের বাইরে অন্ধকারে লুকিয়ে রইলো পুলিশ ফোর্স। ছায়ামূর্তি দুটি অন্য কেউ নয়, একজন মিঃ শঙ্কর রাও, অন্যজন গোপালবাবু। তারা অতি সাবধানে এগিয়ে চলেন।
কিছুদূর এগুতেই শুনতে পেলেন তাঁরা একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর। মিঃ শঙ্কর রাও কান পেতে চেষ্টা করলেন, কোন এক গোপন কক্ষ থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে–একটা লোকের সঙ্গে তোমরা এতগুলো লোক পারলে না, তোমরা কাপুরুষ। যত টাকা লাগে লাগবে, মেয়েটাকে আমার চাই। নইলে মনে রেখ, তোমাদের প্রত্যেককে আমি গুলি করে হত্যা করবো।