বনহুর মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো–আজ তাহলে চলি।
চৌধুরী সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যেন হৃদয়ে একটা ব্যথা অনুভব করলেন। শান্ত মিষ্টি গলায় বলেন–আবার কবে আসবেন কথা দিন?
ঠিক বলতে না পারলেও, আসবো। আর একবার তাকালো বনহুর মনিরার দিকে। মনিরা দৃষ্টির মাধ্যমে ওকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।
এরপর হতে প্রায়ই আসে বনহুর।
চৌধুরী সাহেব, মরিয়ম বেগম সবাই বনহুরকে ভালবেসে ফেলেছেন। বনহুর এলে তারা যেন মনে শান্তি অনুভব করেন, মনিরার তো আনন্দ ধরে না। যেদিন বনহুর আসার কথা থাকে, সেদিন মনিরা নিজেকে মনের মত করে সাজায়, সকাল থেকে গুন গুন করে গান গায়।
চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম বুঝতে পারেন ভাগ্নীর মনোভাব। তারা উভয়ে উভয়ের মুখে তাকিয়ে হাসেন, অজ্ঞাত এক বাসনা উঁকি দিয়ে যায় তাদের মনের কোণে।
মুরাদ সেদিন রাগ করে চলে যাবার পর থেকে চৌধুরী সাহেব ভিতরে ভিতরে ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছিল, বনহুরের আবির্ভাব আবার তার হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ এনে দেয়। চৌধুরী সাহেব ধীরে ধীরে ভুলে যান মুরাদকে।
একদিন বিকেলে বনহুরের সঙ্গে মনিরা বেড়াতে বেরুলো। সে লেকের ধারে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলো তারা। পাশাপাশি এগিয়ে চললো মনিরা আর বনহুর। কি নিয়ে যেন দু’জন বেশ হাসছিল।
মুরাদ দূর থেকে মনিরা আর বনহুরকে লক্ষ্য করলো। হিংসায় জ্বলে উঠলো তার অন্তরটা, কটমট করে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে।
বনহুর বলেন–মিস মনিরা, চেয়ে দেখুন ঐ অস্তগামী সূর্যের দিকে।
হেসে বলেন মনিরা—অপূর্ব!
ঠিক আপনার রক্তিম. গণ্ডের মত–তাই না?
যান!
মিস মনিরা, সত্যি আপনার মত মেয়েকে আমার বড় ভালো লাগে চোখে লজ্জা, মনে ম্রতা, মিষ্টিমধুর কণ্ঠস্বর—অপরূপ!
মনিরার মন তখন চলে গেছে পেছনের একটি দিনে। মুরাদ আর সে পাশাপাশি বসে আছে এমনি এক সন্ধ্যায়। মুরাদ বলছে, মনিরা তুমি বড্ড লাজুক, একদম সেকেলে ধরনের কি বিশ্রী, কি কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠস্বর মুরাদের।
কি ভাবছেন মিস মনিরা?
মিস নয়, শুধু মনিরা বলুন।
তুমি যদি খুশি হও তাহলে তাই হবে। এবার বলো কি ভাবছো?
বনহুর মনিরাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। মনিরাও বনহুরকে তুমি বলে সম্বোধন করে। কারণ ওরা দুজন দুজনের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছে।
নাই বা শুনলে সে কথা!
যদি না বলার মত হয়, তাহলে আমি শুনতে চাইনে মনিরা।
ঠিক সে মুহূর্তে মুরাদ মনিরার পেছনে এসে দাঁড়ালো, কঠিন কণ্ঠে বলেন–মিস মনিরা, কে এই যুবক?
মনিরা উঠে দাঁড়ালো, সেও কঠিন কণ্ঠে বলেন–আপনি সে কথা জিজ্ঞাসা করার কে?
তোমার আব্বা একদিন আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দেবেন কথা দিয়েছিল একথা এরই মধ্যে ভুলে গেলে? সেই অধিকারে–
খবরদার, আর কথা বলবেন না, চলে যান এখান থেকে।
ওঃ আজ দেখছি বড় সাহস বেড়েছে? চলো, তোমার আব্বার কাছে নিয়ে এর জবাব দেব–মনিরার হাত ধরতে যায় মুরাদ।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর প্রচণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দেয় মুরাদের নাকে। মুরাদ পড়ে যায়, নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের পিঠে নাকের রক্ত মুছে, তারপর বনহুর আর মনিরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে চলে যায়।
হেসে ওঠে মনিরা, বনহুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে তার মন।
বনহুর বসতে যায়। মনিরা বলে ওখানে বসে আর কাজ নেই, চলো এবার ফেরা যাক।
কেন, ভয় হচ্ছে?
না, তুমি পাশে থাকলে আমার কোন ভয় নেই। তবু চলো এখানে বসতে মন আর চাইছে না।
চলো তাহলে।
২০.
সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মনিরা সাজগোজ করে ড্রইং রুমে বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে আর বারবার তাকাচ্ছে দেয়াল ঘড়িটার দিকে।
আজ রাত সাড়ে আটটায় এক বান্ধবীর বাড়িতে তার দাওয়াত আছে। মনিরা বনহুরকে বলে দিয়েছে। অবশ্য অবশ্য সে যেন গাড়ি নিয়ে আসে, তার গাড়িতেই যাবে মনিরা। নইলে সন্ধ্যার পর বাইরে বেরুবার সাহস নেই তার। চৌধুরী সাহেবও বারণ করে দিয়েছেন।
মনিরা উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী শুরু করে, হাতঘড়ির দিকে তাকায়–আটটা বেজে গেছে।
এমন সময় গাড়ি-বারান্দায় মোটর থামার শব্দ হয়। পরক্ষণেই কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর, হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে বড় দেরী হয়ে গেছে, না?
মনিরা টেবিল থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে বলে–চলো।
অমনি মরিয়ম বেগম দু’জনের পাশে এসে দাঁড়ান। বনহুরকে লক্ষ্য করে বলেন–দেখ বাবা, তোমার ওপর ভরসা করেই ওকে বাইরে পাঠাচ্ছি। দস্যু বনহুরের ভয়ে আমার তো কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে, আবার না সে মনির ওপর হামলা করে বসে।
মরিয়ম বেগমের ব্যখাকাতর কণ্ঠস্বর বনহুরের হৃদয়ে আঘাত করলো। তার মা, তার গর্ভধারিণী জননী আজ তারই ভয়ে ভীত। আজ তার নিকটে পুত্র পরিচয় দেবার কোন অধিকার নেই। বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তার অবাধ্য কণ্ঠ দিয়ে হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো–মা।
মরিয়ম বেগম বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন বনহুরের মুখে। এই মা ডাক তাঁর প্রাণে এক অপূর্ব শিহরণ জাগালো। মাতৃহৃদয় আকুলি বাকুলি করে উঠলো। তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। জবাব দিল বল বাবা?
বনহুর ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। হেসে বলেন–দস্যু বনহুর আপনার কোন অন্যায় করবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।