উঠে দাঁড়ায় মনিরা সত্যি আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
বনহুর একটু হাসলো।
মনিরা আর বনহুর গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। মনিরা বলেনজামান সাহেব, আপনি আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন তো?
আমি ড্রাইভার দিচ্ছি, সে আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে।
না, তা হবে না! আমি কোন ড্রাইভারকে বিশ্বাস করি না।
হো হো করে হেসে ওঠে বনহুর খুব ভয় পেয়ে গেছেন দেখছি। কিন্তু আমাকেই বা আপনার এত বিশ্বাস কেন? আমি যদি আপনাকে নিয়ে পালাই?
পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস না করলেও আপনার ওপর আমার অবিশ্বাস হবে না। সত্যি জামান সাহেব, আপনি কত মহৎ!
বুঝেছি, আপনি আমাকে আজই আপনার মামুজানের নিকটে হাজির করতে চান।
তাহলে আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার মনোভাব, চলুন।
বনহুর আর বিলম্ব না করে ড্রাইভ আসনে উঠে বসে।
১৯.
চৌধুরীবাড়ি।
চৌধুরী সাহেব, পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হারুন, মিঃ শঙ্কর রাও ও গোপাল বাবু মিলে আলোচনা চলছিল। কয়েকদিন পূর্বে মনিরার সে আক্রমণ ব্যাপার নিয়েই আলোচনা চলছিল। দস্যু বনহুর যে হঠাৎ ওভাবে মনিরার ওপর হামলা করে বসবে, এ যেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার। চৌধুরী সাহেব কন্যা-সমতুল্যা ভাগনীকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল। দস্যু বনহুরের দৃষ্টি যে তার ওপর পড়েছে, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। কি করে এ দস্যুর কবল থেকে মনিরাকে রক্ষা করা যাবে, এ নিয়ে আজ কদিন হলো পুলিশ অফিসে ঘোরাফেরা করছেন। আজ নিজে যেতে না পারায় ফোনে মিঃ হারুন সাহেবকে চৌধুরীবাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। যখন চৌধুরী সাহেব পুলিশ অফিসে ফোন করেন, তখন মিঃ হারুনের পাশে রাও এবং গোপাল বাবু উপস্থিত ছিল।
শঙ্কর রাও মিঃ হারুনের নিকট ঘটনাটা শুনে থাকতে পারলেন না, তিনিও’গোপাল বাবুকে নিয়ে মিঃ হারুনের সঙ্গে চৌধুরীরাড়িতে উপস্থিত হলেন।
সবাই মিলে আলোচনা চলছে, এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে মনিরা আর বনহুর। মনিরা আনন্দভরা কণ্ঠে বলে ওঠে–মামুজান, ইনিই সেদিন আমাকে দস্যু বনহুরের কবল থেকে রক্ষা করেছিল।
সকলেই একসঙ্গে বনহুরের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
চৌধুরী সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বনহুরকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। তারপর আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন–আপনাকে কি বলে যে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো ভেবে পাচ্ছিনে। আপনি আমার মান-ইজ্জত রক্ষা করেছেন, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।
পিতা-পুত্রের অপূর্ব মিলন। বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কেউ না জানলেও সে জানে চৌধুরী সাহেবই তার পিতা। মনে মনে পিতাকে হাজার সালাম জানায় বনহুর।
চৌধুরী সাহেবও হৃদয়ে একটা আলোড়ন অনুভব করেন, বনহুরকে কিছুতেই বুক থেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না তার।
মামুজান আর জামান সাহেবের মিলনে মনিরার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, খুশির আবেগে বেরিয়ে যায় সে।
এবার চৌধুরী সাহেব বনহুরকে পাশের সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়েন।
বনহুরের অপূর্ব সৌন্দর্য সকলকে মুগ্ধ করে ফেলে। মনিরা বয়ের হাতে চায়ের সরঞ্জাম দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। চৌধুরী সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন বনহুরকে, কিন্তু মনিরাই সকলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল।
বনহুর সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে আসন গ্রহণ করলো।
মনিরা হেসে বলেন–মামুজান, উনি কিন্তু মস্ত বড়লোক।
বনহুর লজ্জিতকণ্ঠে বলেন–মিছেমিছে বাড়িয়ে বলছেন মিস মনিরা।
না মামুজান, আমি এতটুকু বাড়িয়ে বলিনি।
হাসিগল্পের মধ্য দিয়ে চা-নাস্তা চলে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন শঙ্কর রাওমিঃ মনিরুজ্জামান, আমি আপনাকে একটু বিরক্ত করবো। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো।
স্বচ্ছন্দে করুন।
শঙ্কর রাও একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন–আচ্ছা মিঃ জামান, আপনি মিস মনিরাকে উদ্ধারের জন্য যখননজের গাড়ি থেকে দস্যুদলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাদের দলে কত, জন ছিল বলে আপনার মনে হয়?
বনহুর ভূকুঞ্চিত করে একটু চিন্তা করলো, তারপর বলেন-—পাঁচ ছ’জন হবে।
ওরা কি সকলেই আপনাকে আক্রমণ করেছিল?
না, আমাকে দেখামাত্র সবাই সরে পড়ে। শুধু একজন, দলের সর্দার হবে হয়তো, সে আমাকে আক্রমণ করেছিল।
মিঃ হারুন বলে ওঠেন–মিঃ জামান, আপনার কি মনে হয়, সে লোকটাই দস্যু বনহুর?
বনহুর একটা চিন্তার ভান করে বলে আমি তো আর দস্যু বনহুরকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করিনি, তবে অনুমানে এবং তার ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে মনে হলো বনহুর ছাড়া আর কেউ সে নয়। ইস, কি শক্তিই না তার শরীরে!
চৌধুরী সাহেব হেসে বলেন আপনার কাছে হার মানাতে সে বাধ্য হলো। পরাজিত হলো আপনার নিকট।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মিঃ জামান, দস্যু বনহুরকে পরাজিত করে মিস মনিরাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। কথাটা বলে বনহুরের পিঠ চাপড়ে দেন মিঃ হারুন। একটু থেমে পুনরায় বলেন–আশা করি দস্যু বনহুরের গ্রেপ্তারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, প্রয়োজন মত আমাকে পাবেন।
মিঃ শঙ্কর রাও বলেন–হ্যাঁ মিঃ জামান, আপনি যদি দ্য বনহুরকে গ্রেপ্তারে আমাদের সাহায্য করেন, তবে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
মনিরা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর সকলের অলক্ষ্যে একবার তাকালো মনিরার মুখে। দৃষ্টি বিনিময় হলো। দু’জনের অন্তর যেন দু’জনকে দেখতে পেল। অভূতপূর্ব আকর্ষণ অনুভব করলো মনে তারা।