পাগলী মেয়ে, তাই বুঝি তুই তাকে ছেড়ে দিলি? জিদ করলে নিশ্চয়ই সে না নেমে পারতো না।
ভুল হয়েছে মামীমা।
এবার চৌধুরী সাহেব বলেন–তার পরিচয়টা জেনে নেয়াও কি তোমার উচিত ছিল না? কি তার নাম, কোথায় থাকে–
মামুজান, আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম।
সত্যি, গো, দস্যু বনহুরের কবলে–এ যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার, ভাবলেও আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। মনিরা, কোনদিন তুই একা বাইরে যাবিনে।
হ্যাঁ মামীমা, আর অমন কাজ করবো না।
১৮.
সেদিন মনিরা একটা বইয়ের দোকানে প্রবেশ করলো কতকগুলো বইয়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় তার পাশে দাঁড়ালো এক যুবক, মনিরা মুখ তুলে তাকাতেই তার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, হেসে বলেন–আপনি?
বনহুর বলে ওঠে–আপনি দেখি আমাকে মনে রেখেছেন?
কি যে বলেন, কোনদিনই আপনাকে ভুলবো না। কি বাঁচাই না সেদিন পনি আমাকে বাঁচিয়েছেন! আজ কিন্তু আর আপনাকে ছাড়ছিনে।
তার মানে?
মানে অতি স্বচ্ছ। মামুজানের হুকুম, আপনাকে তার নিকটে ধরে নিয়ে যেতে হবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সেদিন আপনাকে বিদায় দিয়ে কি বকাটাই না খেলাম। যেমন বকলেন মামুজান, তেমনি মামীমা।
তাহলে তো এক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে আর এক বিপদে পড়েছিল?
মিথ্যে নয়। হ্যাঁ একটা কথা, মনে কিছু নেবেন না?
বলুন?
আপনার পরিচয়টা?
ওঃ হ্যাঁ, পরিচয়টা এখনও আপনাকে দেয়া হয়নি। আমার নাম মনিরুজ্জামান চৌধুরী, ঠিকানা ৩৬/৩, বাগবান রোড চলুন না আজ আমার বাড়িতে, এই তো এখান থেকে একটু দূরে।
না, তা হয় না। আপনিই আজ চলুন, পরে একদিন নিশ্চয়ই আপনার ওখানে যাব।
কিন্তু আমি তো আজ যেতে পারছিনে মিস মনিরা!
অবাক হয়ে তাকায় মনিরা বনহুরের মুখে। বিষ্ময়ভরা কণ্ঠে বলে–আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?
হেসে বলে বনহুর কারও নাম জানতে ইচ্ছে থাকলে অমনি জানা যায়। সেদিন আমি জেনে নিয়েছি।
বেশ লোক কিন্তু আপনি।
বনহুর আর মনিরা একসঙ্গে হাসতে থাকে।
বইগুলো প্যাক করে মনিরার সম্মুখে রাখে দোকানদার।
মনিরা ক্যাশমেমো দেখে টাকা মিটিয়ে দেয়, তারপর বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে আজ কথা দিতে হবে, কবে তাহলে আসছেন?
আমার বাড়ির এত নিকটে এসে যখন চলে যাচ্ছেন তখন আমার যাওয়া–তা যাব একদিন।
না, তা হবে না।
তাহলে—
আচ্ছা চলুন।
মনিরা বনহুরের গাড়িতে চেপে বসে।
ড্রাইভ আসনে ওঠে বনহুর। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলে–অজানা অচেনা একজনের সঙ্গে যেতে মনে ভয় হচ্ছে বুঝি?
কি যে বলেন–আপনার সঙ্গে ভয়, আপনি তো ডাকাতের বাবা!
তাহলে ভরসা আছে আমার ওপর?
খুব।
আরও অনেক হাসিগল্প চলে।
বিরাট একটা বাড়ির সম্মুখে এসে বনহুরের গাড়ি থেমে ছিল।
মনিরা বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো–এ যেন রাজ প্রাসাদ।
বনহুর ড্রাইভ আসন থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো–নেমে পড়ুন।
মনিরা নেমে দাঁড়ালো।
বনহুর মনিরাকে নিয়ে এগুতেই দারোয়ান সেলুট ঠুকে সরে দাঁড়ালো।
মনিরা অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে দেখতে এগুতে লাগলো। সেকি প্রকাণ্ড বাড়ি! গেটের পর গেট, ঘরের পর ঘর। প্রত্যেকটা ঘরে বেলওয়ারীর ঝাড় ঝুলছে। মূল্যবান সরঞ্জামে ঘরগুলো সাজানো, কিন্তু মনিরা আশ্চর্য হলো, এত বড় বাড়িটায় শুধুমাত্র ঐ একটা যুবক।
অনেকগুলো ব্যালকনি পেরিয়ে একটা সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করলো মনিরাকে নিয়ে বনহুর। মনিরা তখনও অবাক হয়ে চারদিকে দেখছে। তার মামুজানও মস্ত বড়লোক, কিন্তু এত বড় বাড়ি তো তাদের নয়। রাজ-রাজার বাড়ি যেমন হয়, এ বাড়িটাও ঠিক তেমনি।
বনহুর হেসে বলেন–বসুন।
মনিরা বসে পড়ে বলে–এত বড় বাড়ি অথচ লোকজন তো দেখছিনে? আপনার বাবা-মা?
কেউ নেই।
আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে?
ওসব ঝঞ্চাটও নেই আমার।
এত বড় বাড়িটায় আপনি একা থাকেন?
চিরদিন যে একা, সে কোথায় পাবে সঙ্গী, বলুন। আপনি বসুন, আমি একটু চা-নাস্তার ব্যবস্থা–
না না, ওসব কিছু লাগবে না, বরং আপনি বসুন।
তা হয় না মিস মনিরা, আপনি আমার অতিথি। বনহুর বেরিয়ে যায়।
মনিরা অবাক হয়ে ভাবে, অদ্ভুত এই যুবক। যার এত আছে, তার আবার সঙ্গীর ভাবনা? রূপ-গুণ-ঐশ্বর্য সর আছে এর কিন্তু কেন সে একা নিঃসঙ্গভাবে জীবন কাটায়? ইচ্ছে করলেই যে কোন মেয়েকে সে গ্রহণ করতে পারে। যে নারী ওকে স্বামীরূপে পাবে সে ধন্য হবে, সার্থক হবে তার জীবন কিন্তু কেন সে এতদিনও বিয়ে করেনি?
মনিরা আনমনে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। ওপাশে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াতেই আশ্চর্য হয়। কত রকমের ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে বাগানে। ফুরফুরে হাওয়া আর অজানা ফুলের সুরভি তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা।
কখন যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বনহুর, খেয়াল করতে পারেনি মনিরা। বনহুর হেসে বলে কি দেখছেন অমন করে?
কি সুন্দর অপূর্ব! আচ্ছা জামান সাহেব, আপনি ফুল বুঝি খুব পবাসেন?
হ্যাঁ চলুন, চা-ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
কেন আপনি ওসব ঝামেলা করতে গেল! পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে মনিরা আর বনহুর।
চা-নাস্তার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর আর মনিরার গল্প চলে। মনিরা এখন অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। বনহুরের দৃষ্টির মধ্যে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। বনহুরের হাসির মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে নিজকে। কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে আসে, সেদিকে খেয়াল নেই মনিরার। বনহুর স্মরণ করিয়ে দেয়–মিস মনিরা, আপনার ফেরার সময় হয়েছে, বিলম্ব হলে আপনার মামুজান নিশ্চয় চিন্তিত হবেন।