হ্যাঁ বাপু। এগিয়ে এলো সে কালু খাঁর পাশে।
কালু খাঁ হাত দিয়ে নিজের বিছানায় একটা অংশ দেখিয়ে বলেন—বস বাছা।
বনহুর বসে ছিল কালু তাঁর পাশে, বৃদ্ধের একখানা হাত মুঠায় চেপে ধরে বলেন-বাপ, এখন তোমার কেমন লাগছে?
বৃদ্ধ ঘোলাটে চোখে বনহুরকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করে বলেন–বনহুর, আমি আর বাঁচবো না।
বনহুরের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে–বাপু, আমি তোমার জন্য ভাল ডাক্তার নিয়ে আসব।
না বনহুর, ডাক্তারের আর প্রয়োজন হবে না। একটু থেমে পুনরায় ডাকে কালু খাঁ—বনহুর।
বল বাপু।
বৃদ্ধ কালু খাঁ ভয়ানক হাঁফাচ্ছিল! গেমে নেয়ে উঠেছে তার সমস্ত শরীর, অতি কষ্টে বলে সে-বনহুর, আজ বিদায়ের দিনে তোকে একটা কথা বলবো, যা এতদিন বলি বলি করেও বলা হয়নি।
বাপু, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি সব শুনবো।
না না, তা হবে না, আজ না বললে হয়ত আর কোনদিন বলা হবে না।
বনহুর কালু খাঁর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে-বাপু, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
না রে না, কোন কষ্ট হচ্ছে না। বনহুর, একটু পানি দে দেখি বাছা।
বনহুর পাশের সোরাহী থেকে এক গেলাস পানি এনে কিছুটা পানি ঢেলে দিল কালু খাঁর মুখে।
বৃদ্ধ পানি খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেনবনহুর, সরে আয়, আরও কাছে সরে আয়।
বনহুর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলেন—এই তো আমি তোমার পাশে বাপু।
বৃদ্ধ কালু খাঁ বলে ওঠে—বনহুর, আমি তোর বাপু নই। আমি তোর বাপু নই বনহুর। বৃদ্ধ কালু ঘা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে—তোকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সে প্রায় বিশ বছর আগে বালিশের তলা থেকে একটা মালা বের করে বনহুরের হাতে দেয়—বিশ বছর আগে যখন তোকে কুড়িয়ে পাই, তখন এই মালাছড়া ছিল তোর গলায়। দেখ বনহুর, এই মালা তুই চিনতে পারিস কিনা?
বনহুর মালাছড়া হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। হঠাৎ তার আংগুলের চাপে লকেটের ঢাকনা খুলে যায়। কি আশ্চর্য! লকেটের ভিতর তারই ছোটবেলার ছবি। পাশের ঢাকনায় আর একটা ফুটফুটে বালিকার ছবি, পাশাপাশি দু’খানা মুখ। বনহুর তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে লকেটের ছবি দু’খানার দিকে। ধীরে ধীরে তার মানসপটে ভেসে ওঠে বিশ বছর আগের একটা দৃশ্য…..
তরঙ্গায়িত নদীবক্ষে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে একটা নৌকা। দু’জন মাঝি দাঁড় টানছে, একজন মাঝি বসে আছে হাল ধরে। নৌকার সম্মুখ পাটাতনের ওপর পাশাপাশি বসে খেলা করছে একটা বালক আর একটা বালিকা। বালকের বয়স আট-নয় বছর, আর বালিকার বয়স ছয়সাত। বালক ছবি আঁকছিল। বালিকা রুল দিয়ে ছবির ওপর আঁচড় কেটে ছবিটা নষ্ট করে দেয়। বালক অমনি মুখটা গম্ভীর করে ফেলে। বালিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখিত হয়, বিনীত কণ্ঠে বলে রাগ করলে? ভুল হয়েছে, মাফ করে দাও মনির ভাই।
বালক খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন—দোষ করে মাফ চাইলেই বুঝি মাফ পাওয়া যায়.. বালক আর বালিকা মিলে এমনি ঝগড়া চলছে।
নৌকায় ছৈ-এর মধ্যে বসে রয়েছেন দু’জন মহিলা, তাদের অনতিদূরে একজন ভদ্রলোক বসে বসে বই পড়ছেন। ভদ্রলোক বালকের পিতা চৌধুরী মাহমুদ খান। আর দ্র মহিলাদের একজন বালকের আম্মা মরিয়ম বেগম, দ্বিতীয় মহিলা চৌধুরী মাহমুদ খানের বোন রওশন আরা বেগম। বালিকা রওশন আরা বেগমের কন্যা নাম মনিরা, আর বালকের নাম মনির।
ননদের কন্যার নাম সখ করে মরিয়ম বেগমই রেখেছিল–মনিরা বেগম। ভিতরে ভিতরে ছিল তার এক গোপন বাসনা। নিজের পুত্র মনিরের নামের সঙ্গে মনিরা নাম মিল করে রাখাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসে শিশু কন্যাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল মরিয়ম বেগম রওশন আপা, একটা কথা বলবো?
রওশন আরা বেগম বলেছিল—বলো।
মরিয়ম বেগম বলেছিল—আমার পুত্রকে তোমায় দিলাম, তোমার কন্যাটিকে আমি চাই কিন্তু।
আনন্দের কথা। আমার মেয়ে নিয়ে তুমি যদি সুখী হও এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।
তারপর মনিরার এক জন্ম উৎসবে মরিয়ম বেগম দু’ছড়া মালা তৈরি করে পুত্র এবং ননদের কন্যাকে উপহার দেন। সে দিন ভাবী আর ননদের মধ্যে কথা নেয়া-দেয়ার পালা শেষ হয়ে যায়। হেসে বলেছিল মরিয়ম বেগম—এই মালা পরিয়ে দিয়ে আমি কথা পাকা করলাম, মনিরের সঙ্গে বিয়ে দেব মনিরার। সে মালা ছড়াই আজ বনহুরের হাতে। নীরব নয়নে তাকিয়ে আছে সে সম্মুখের দিকে—একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে তার মনের কোণে। যদিও অস্পষ্ট তবু বেশ মনে আছে, মায়ের সে কথার পর কিছুদিন যেতে না যেতে একদিন মনিরার আব্বা মারা গেল। খবর পেয়ে তার আব্বা চৌধুরী মাহমুদ খান স্ত্রী মরিয়ম বেগম ও পুত্র মনিরকে নিয়ে দেশের বাড়ি গেল। ফিরে আসার সময় শোকাতুরা বোনকে নিয়ে চলেন সঙ্গে করে।
নৌকা চলছে… সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছে। মনির আর মনিরার ঝগড়া থেমে গেলেও রাগ পড়েনি। মনির উঠে গিয়ে পিতার পাশে বসলো। চৌধুরী মাহমুদ খান হেসে বলেন—এত গম্ভীর কেন মনির? মনিরার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে মনির–আমি ছবি আঁকছিলাম, মনিরা নষ্ট করে দিয়েছে।
হেসে বলেন চৌধুরী সাহেব-ও এই কথা। মা মনিরা, এদিকে এসো তো!
ভয়ে ভয়ে মনিরা গিয়ে দাঁড়ালো মামুর পাশে। চৌধুরী সাহেব তাকে আদর করে কোলে টেনে নিয়ে বলেন-তোমার মনির ভাইয়ের আঁকা ছবি নষ্ট করে দিয়েছ?