কোন ফাংশনে যাবার সখ আমার নেই।
মুরাদ যখন বলছে তখন যা না বাছা।
তা হয় না মামীমা, সে আমার কে যে তার সঙ্গে যাব?
পাগলী মেয়ে! দুদিন পর সে তোর স্বামী……
মামীমা…চিৎকার করে মরিয়ম বেগমকে থামিয়ে দেয় মনিরা।
মরিয়ম বেগম থ’ মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মনিরার মুখের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান!
চৌধুরী সাহেব উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করছিল, স্ত্রীকে বিষণ্ণ মুখে। ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন-কি হলো? মনিরা….
ও কথা আমাকে আর বলো না।
সেকি! মুরাদ যে দাঁড়িয়ে আছে।
তাকে যেতে বলো, মনিরা যাবে না।
কি মুস্কিল! হঠাৎ আবার কি হলো তার?
মাথাটা নাকি বডড় ধরেছে, কয়েকবার বমিও হয়েছে।
তাই নাকি, তাহলে তো ডাক্তার ডাকতে হয়!
ডাক্তার ডাকার আগে মুরাদকে বিদায় করে দাও।
আচ্ছা বলছি। নিচে নেমে যান চৌধুরী সাহেব।
মুরাদ ঘন ঘন পায়চারী করছিল, চৌধুরী সাহেবকে দেখে এগিয়ে আসে—মনিরা কই?
বড় দুঃখের কথা বাবা, মনিরার ভয়ানক জ্বর এসেছে। যেমন বমি তেমনি নাকি মাথাধরা…
হঠাৎ কেমন জ্বর তার?
খুব বেশি।
আমি তাকে একটু দেখতে পারি কি?
হ্যাঁ…না না, তুমি আবার কষ্ট করে…
এতে আর কষ্টের কি আছে, কই চলুন তো একবার দেখে আসি।
তোমার ফাংশনের বিলম্ব হয়ে যাবে।
তা হউক।
চৌধুরী সাহেব কিছু বলার পূর্বেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে চললো মুরাদ।
মরিয়ম বেগম আড়ালে থেকে সব শুনছিল। তিনি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন-কাল ভোরে এসে দেখে যেও বাবা, এখন একটু ঘুমাচ্ছে।
তা হউক, আমি ওকে জাগাবো না। উপরে উঠে মরিয়ম বেগমকে জিজ্ঞেস করলো মুরাদ-মনিরা কোথায়?
একটা ঢোক গিলে বলেন মরিয়ম বেগম—ঐ যে ঐ ঘরে।
কক্ষে প্রবেশ করে এগিয়ে যায় মুরাদ মনিরার বিছানার দিকে—মনিরা, তোমার নাকি অসুখ? মাথায় হাত দিতে যায় মুরাদ। আজকাল মুরাদ মনিরাকে তুমি বলে সম্বোধন করে।
মনিরা চট করে সরে বসে বলে—খবরদার, গায়ে হাত দেব না।
তোমার নাকি অসুখ?
কে বলেন আমার অসুখ?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেব আর মরিয়ম বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
মুরাদের গলা শোনা যায়—তোমার মামুজান আর মামীমা বলেন।
মিছে কথা! আমার কোন অসুখ করেনি!
থ্যাঙ্ক ইউ, ভেরী গুড। তাহলে তৈরি হয়ে নাওনি কেন?
আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না।
মনিরা!
আমি না গেলে আপনি কি করতে পারবেন?
তোমার মামুজান আর মামীমা এর জবাব দেব।
মামুজান আর মামীমার মতে আমার মত নয়—একথা ভুলে যাব না মিঃ মুরাদ।
মনিরা, এত সাহস তোমার?
হ্যাঁ, আমি…কিছু বলতে যাচ্ছিলো মনিরা। সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করেন চৌধুরী সাহেব—মনিরা কি হচ্ছে, এসব পাগলামি..
মুরাদ রাগতভাবে বলে ওঠে—চৌধুরী সাহেব, আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের চালাকি। এত মিথ্যাবাদী আপনারা!
মুরাদের অশালীন কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল চৌধুরী সাহেব, বলেন—মুরাদ, বিয়ে দেব বলে কথা দিয়েছিলাম, বিয়ে তো আর দেইনি। এখানে তোমার কোন অধিকার নেই। তুমি যেতে পারো।
বেশ, আমিও দেখে নেব, কথা দিয়ে কি করে কথা পাল্টান। বলেই খট খট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল মুরাদ।
তখনকার মত মুরাদ চলে গেলেও বাইরে থেকে বিষধর সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। গুণ্ডাদের আস্তানা হলো তার সম্বল। শয়তানদের সঙ্গে চললো তার গোপন আলোচনা। হাজার হাজার টাকা সে ছড়িয়ে দিতে লাগলো গুণ্ডাদের মধ্যে, যেমন করে হউক মনিরাকে তার চাই।
সেদিন মনিরা কোন এক ফাংশন থেকে ফিরছিল। নিজেদের গাড়ির বিলম্ব দেখে অন্য একটা ভাড়াটিয়া গাড়ি নিয়ে রওনা দিল সে।
গাড়ি ছুটে চলেছে, মনিরা জনমুখর রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। ভাবছিল মুরাদের কথা, জীবন থাকতে অমন অভদ্র লোককে সে স্বামী বলে গ্রহণ করতে পারবে না। এজন্য মামুজান আর মামীমা খুশি নন, তবু কি করবে মনিরা? নিজেকে তো আর বলি দিতে পারে না! ঐশ্বর্যের কাঙ্গাল সে নয়! হঠাৎ মনিরার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়। গাড়িখানা থেমে পড়েছে।
মনিরা বাইরের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়, এ তো শহরের পথ নয়। কখন যে গাড়িখানা তাকে নিয়ে এক নির্জন গলির মধ্যে এসে পড়েছে, সে খোয়াল নেই মনিরার।
মনিরা জিজ্ঞেস করলো—ড্রাইভার, এ তুমি কোথায় আনলে?
ড্রাইভার কেমন ধরনের একটা বিদঘুটে হাসি হেসে বলেন—ঠিক জায়গায় এসে গেছি, এখন নেমে পড়ন দেখি।
ড্রাইভারের কণ্ঠস্বর এবং মুখের ভাব লক্ষ্য করে শিউরে উঠলো মনিরা। বিবর্ণ মুখে সে কিছু বলতে গেল, কিন্তু বাইরে নজর পড়তেই আড়ষ্ট হয়ে গেল তার কণ্ঠ। ভয়ঙ্কর চেহারার কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়ে। কেমন যেন দুষ্টমির হাসি.তাদের সকলের মুখে।
একজন লোক এগিয়ে এলো গাড়ির পাশে। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন সেনেমে আসুন চট করে।
মনিরার দেহে তখন প্রাণ আছে কি না সন্দেহ। কি করবে এখন সে? এদের হাত থেকে পরিত্রাণের তো কোন উপায় নেই। তবু কন্ঠে সাহস সঞ্চার করে নিয়ে বলেন—তোমরা আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন? কি তোমাদের উদ্দেশ্য?
তোমার বদলে টাকা চাই। নেমে এসো।
নামবো না, কিছুতেই আমি নামবো না। আমাকে তোমরা বাড়িতে পৌঁছে দাও, যত টাকা চাও দেব।
হা-হা করে হেসে উঠলো লোকটি—আমরা অত বোকা নই, টাকা আমরা তোমার মামুজানের নিকট হতে চাই না। তোমাকে পেলে টাকার অভাব হবে না।