মোটরের পাশ কেটে চলে যায় তাজ, বনহুর লাফিয়ে পড়ে ড্রাইভ আসনে। সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের গুলিতে ড্রাইভারের রক্তাক্ত দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় গাড়ির মধ্যে। পুলিশরাও অন্ধকারে গুলি ছুঁড়তে থাকে, কিন্তু নিজেদের গুলিতে নিজেরাই মরতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয় পেয়ে সমস্ত পুলিশ এদিকে ওদিকে পালিয়ে গেল।
বনহুর রহমতের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে তুলে নিলো তাজের পিঠে। তারপর ছুটে চললো হাওয়ার বেগে।
পরের দিন এই ঘটুনা নিয়ে সারা দেশে হুলস্থুল পড়ে গেল। পুলিশমহলে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। মাত্র একজন দস্যু এতগুলো পুলিশকে পরাজিত করে বন্দীকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হলো, অথচ কেউ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলো না।
মিঃ হারুন এবং আরও অন্যান্য পুলিশ অফিসার মিলে শংকর রাওয়ের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালাতে লাগলেন, কি করে এ দস্যুকে পাকড়াও করা যায়।
শংকর রাও ছদ্মবেশে বেরিয়ে ছিল, সঙ্গে গোপাল বাবুও চললেন। শংকর রাও গ্রাম্য বৃদ্ধের বেশে, গোপাল বাবুর শরীরে ছেড়া জামা-কাপড়, ঠিক একজন গ্রাম্য যুবক যেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগলেন তাঁরা।
সারাটা দিন ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে ছিল। সম্মুখে একটা হোটেল দেখে উঠে ছিল তারা সে হোটেলে।
হোটেলে প্রবেশ করতেই একজন চিৎকার করে উঠলো—ভাগো। হিয়াসে।
শংকর রাও বৃদ্ধের অনুকরণে গলার স্বরকে বদলে নিয়ে বলেন–দু’কাপ চা খাব বাবু সাব।
অন্য হোটেল দেখো গে, ভাগো এখান থেকে।
শংকর রাও মনে মনে ভীষণ রেগে গেল। গোপাল বাবুকে সঙ্গে করে হোটেল থেকে বেরুতে যাব, ঠিক সে মুহূর্তে কয়েকজন লোক প্রবেশ করলো হোটেলে।
শঙ্কর রাও থমকে দাঁড়ালেন, লোকগুলোর চেহারা যেন সন্দেহজনক বলে মনে হলো তার কাছে।
শঙ্কর রাও গোপাল বাবুর গা টিপে দিল। তারপর পকেট হাতড়ে দশ টাকার একখানা নোট বের করে এগিয়ে দিল হোটেলের, ম্যানেজারের দিকে—শুধু দুকাপ চা।
ঐ চেয়ারে বসো। হোটেলের ম্যানেজার এক কোণের দুটি চেয়ার দেখিয়ে বলল।
শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু বসে ছিল এক পাশের দুটো চেয়ারে।
যে লোকগুলো কিছু পূর্বে হোটেলে প্রবেশ করেছিল, তারা ওদিকে কয়েকখানা চেয়ারে গোলাকার হয়ে বসে পড়ে।
বয় তাদের সম্মুখে কয়েকখানা মদের বোতল আর পেয়ালা রেখে যায়। মদ পান করতে করতে কি যেন সব আলাপ চলে তাদের মধ্যে। শঙ্কর রাও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কান পাতেন। কে একজন বলছে—কাজ হাসিল করতে পারলে বহুৎ টাকা মিলবে। এরপর আরও কি কি যেন কথাবার্তা চললো, বুঝা গেল না।
শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু সেদিনের মত পথে নেমে ছিল। সে হোটেল সম্বন্ধে সন্দেহ তাদের ঘনীভূত হলো।
পরদিন দু’জনে ভিখারীর বেশে এসে বসলেন, হোটেলের অদূরে বটতলায় একটা কম্বল বিছিয়ে ভিক্ষে শুরু করলেন শঙ্কর রাও ও গোপাল বাবু কিন্তু দৃষ্টি তাদের রইলো সে হোটেলের দিকে।
সন্ধ্যে হয় প্রায়। চারদিক ঝাপসা হয়ে এসেছে। লাইটপোস্টগুলো জুলে উঠবে একটু পরে, ঠিক সে সময় একটা কালো রঙের মোটর এসে থামলো হোটেলের সম্মুখে।
গাড়ি থেকে নেমে এলো এক কাবুলিওয়ালা। হোটেলে প্রবেশ করতেই হোটেলের ম্যানেজার লোকটাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। আরও কয়েকজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক তাকে কুর্ণিশ জানিয়ে হোটেলের ভিতরে নিয়ে গেল।
শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু বটতলা থেকে সব দেখলেন। গোপাল বাবু চোখ টিপে বলেন–শঙ্কর, তুমি যাই বলল, ঐ বেটাই দস্যু বনহুরের লোক।
সত্যি?
আমার সে রকমই মনে হচ্ছে।
আজকাল মুরাদকে আর দাওয়াত করতে হয় না। প্রতিদিন একবার করে চৌধুরীবাড়িতে আসা চাই-ই। যদিও মনিরা তাকে বেশ এড়িয়ে চলে, তবু মুরাদ মনে কিছু করে না, বরং কিসে মনিরা তাকে ভালবাসবে তাই করে। মুরাদ এলে অত্যন্ত খুশি হন চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম। মনিরাকে মিশার সুযোগ দিয়ে সরে থাকেন তাঁরা, কিন্তু মনিরা সে সুযোগ চায় না, মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয় সে।
মনিরাকে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে যাবার প্রস্তাব করে মুরাদ। চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম খুশিভরা কণ্ঠে সম্মতি জানান, কিন্তু মনিরাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেন না তাঁরা।
একদিন মনিরা নিজের ঘরে শুয়ে আছে।
মুরাদের গাড়ি এসে থামলো বারান্দায়। চৌধুরী সাহেব তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। মুরাদ জিজ্ঞেস করলো—মনিরা কোথায়?
ব্যস্তকণ্ঠে বলেন চৌধুরী সাহেব—দেখি উপরে আছে বুঝি? তুমি বসো।
আজ বসবো না চৌধুরী সাহেব। কাল আমি বলে গেছি মনিরাকে একটা ফাংশনে নিয়ে যাব। দেখুনতো ওর কাপড়-চোপড় পরা হয়েছে কিনা?
আচ্ছা বাবা—আমি দেখছি। চৌধুরী সাহেব ব্যস্ততার সঙ্গে উপরে উঠে যান। সম্মুখে স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে বলেন—মনি কই? মুরাদ এসেছে, ওকে নাকি কোন ফাংশনে নিয়ে যাবে, কালই বলে গেছে বেচারা, দেখতো তৈরি হয়েছে কিনা!
তাই নাকি, সে কথা তো তুমি আমাকে বলেনি, কি যে মেয়ে বাবা মরিয়ম বেগম মনিরার কক্ষের দিকে চলে যান, কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হন, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন—এ ভরসন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে আছিস কেন মনিরা?
কেন, শুতে দোষ আছে নাকি?
মুরাদ এসেছে!
তাতে আমার কি মামীমা?
সেকি, কাল নাকি সে তোকে বলে গেছে, আজ কোন ফাংশনে যাবে।