কিন্তু মুরাদের বলিষ্ঠ হাতের মুঠা থেকে কিছুতেই নিজের হাতখানাকে মুক্ত করে নিতে পারে না মনিরা। ঠিক সে মুহূর্তে কোথা হতে একটা তীরফলক এসে বিধে গেল মুরাদের পায়ের কাছে মাটিতে।
মুরাদ মনিরার হাত ছেড়ে দিয়ে তাকালো চারদিকে, কিন্তু কোথাও কোন জনপ্রাণী নজরে পড়ে না।
মুরাদ তীরখানা হাতে উঠিয়ে নিতেই দেখতে পায়, সেটাতে এক টুকরা কাগজ আটকানো রয়েছে। তাড়াতাড়ি কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরে চোখের সম্মুখে। যদিও সন্ধ্যার অন্ধকার ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু বেশ নজরে পড়ে, কাগজখানায় লেখা আছেঃ
‘সাবধান’
–দস্যু বনহুর
১৪.
মুরাদের হাত থেকে কাগজখানা খসে পড়ল! ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল।
মনিরা বুঝতে পারে নিশ্চয়ই এই কাগজে এমন কিছু আছে, যা মুরাদের মত শয়তানকেও ভীত করে তুলেছে। মনিরার মুখখানাও বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। ভয়-জড়িত কণ্ঠে বলে মনিরা—চলুন এবার ফেরা যাক।
ঢোক গিলে বলে মুরাদ—চলুন।
গাড়িতে বসে ভাবে মনিরা, দস্যু বনহুর তাহলে তার পিছু নিয়েছে। কি ভয়ঙ্কর কথা! তবু মনে মনে বনহুরকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না সে, বনহুর যদি সে মুহূর্তে ঐ তীর ছুঁড়ে সাবধান করে না দিত তাহলে কি যে হত! মুরাদের কবল থেকে কিছুতেই নিজকে রক্ষা করতে পারতো না। মনে প্রাণে খোদাকে ধন্যবাদ জানায় মনিরা।
গাড়িতে বসে আর কোন কথা হয় না। কারণ ইতোপূবে মুরাদ একবার দস্যু বনহুরের কবলে পড়েছিল। কত ভয়ানক এ দস্যু বনহুর সে জানে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোন রকমে গাড়ি চালিয়ে চলে সে।
১৫.
দস্যু বনহুরের আস্তানা।
একটা সুউচ্চ আসনে দস্যু বনহুর উপবিষ্ট। সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান তার অনুচরবৃন্দ। মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, যেখানে পাকার করে রাখা হয়েছে সেদিনের লুষ্ঠিত দ্রব্যাদি।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন—আজ তোমরা যা লুট করে এনেছে তা গরীব-দুঃখীর মধ্যে বিতরণ করে দাও।
একজন বলে ওঠে—সর্দার, এসব বহুমূল্য দ্রব্য।
হুঙ্কার ছাড়ে বনহুর–আমি যা বললাম তাই করবে।
আচ্ছা সর্দার।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো নিয়ে যাও সব।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অনুচর এক একটা ঝোলা কাধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বনহুর সোজা চললো বিশ্রামকক্ষে।
কক্ষে প্রবেশ করতেই নূরী এসে দাঁড়ালো পাশে, অভিমানভরা কণ্ঠে বলেন—হুর, আজকাল সব সময় তুমি শহরেই পড়ে থাক কেন বলত?
যখন যেখানে কাজ, সেখানেই থাকি।
তা বলে তুমি আমাকে একা ছেড়ে—
তাছাড়া তো কোন উপায় নেই নূরী।
হুর, তুমি না থাকলে আমি বড় কষ্ট পাই।
মিছেমিছি কষ্ট পাও কেন বলতো? নাসরীন আছে, সায়রা আছে, রুখসানা আছে…..
হাজার জন থাক, তবু তোমার অদর্শন অসহনীয় হুর।
নূরী!
হুর তুমি আমার, বলল তুমি আমাকে ভালবাস? বলো, চুপ করে রইলে কেন, বলো?
বাসি।
সত্যি! আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে খুশির আবেগে উঠে দাঁড়ায় নূরী, তারপর হেসে বলেহর, অনেকদিন হলো তুমি আমার নাচ দেখতে চাওনা, আজ দেখবে?
যদি তোমার ইচ্ছে হয়, নাচো।
নূরী মনের আনন্দে নাচতে শুরু করলো।
বনহুর আনমনে তাকিয়ে রইলো নূরীর দিকে।
এমন সময় দরজার বাইরে থেকে ডাকলো একজন অনুচর–সর্দার।
কে রহমান? এসো।
নূরীর নাচ থেমে যায়, কক্ষে প্রবেশ করে রহমান-সর্দার!
বলো কি খবর?
সর্দার, পুলিশবাহিনী রহমতকে গ্রেপ্তার করেছে।
বলো কি!
হ্যাঁ সর্দার। আমরা যখন বন্ধনী সেতু পার হচ্ছিলাম, তখন পুলিশ ফোর্স আমাদের ঘেরাও করে ফেলে এবং তুমুল লড়াইয়ের পর আমাদের একজনকে নিহত আর রহমতকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশবাহিনীর দু’জন নিহত হয়েছে।
হুঁ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তোমরা যে ঐ পথে যাবে, একথা পুলিশবাহিনী জানতে পারলো কি করে?
সে কথা আমি জানি না সর্দার।
এবার গর্জে উঠলো বনহুর—তোমরা রহমতকে উদ্ধার না করে ফিরে এলে কেন?
সর্দার, প্রত্যেকটা পুলিশের হাতে গুলিভরা রাইফেল ছিল। তাছাড়া—
আমি কোন কথা শুনতে চাইনে, কেন তোমরা তাকে না নিয়ে ফিরে এলে, বলো?
সর্দার! ভীত কণ্ঠস্বর রহমানের।
এমনি কি তারা রহমতকে নিয়ে শহরে পৌঁছে গেছে?
সর্দার, এখনও তারা পৌঁছতে পারেনি, রহমত গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসেছি।
যাও তাজকে প্রস্তুত করো, আমি এক্ষণি যাব।
বেরিয়ে যায় রহমান।
নূরী ছলছল চোখে বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়—তুমি একাই যাবে?
মাথায় পাগড়ী জড়াতে জড়াতে বলে বনহুর-হ্যাঁ।
কিন্তু পুলিশ ফোর্স রয়েছে আর রয়েছে গুলিভরা রাইফেল–
বনহুর কাপুরুষ নয়।
হুর!
এমন সময় পুনরায় রহমান কক্ষে প্রবেশ করে—সর্দার, তাজ প্রস্তুত।
নূরী রিভলবারখানা বনহুরের হাতে তুলে দিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলে–খোদা হাফেজ।
পুলিশ ফোর্স রহমতকে বন্দী করে নিয়ে চলেছে। লাশগুলোও তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে। গাড়ি উল্কা-বেগে ছুটে চলেছে।
পেছনে ছুটে আসছে তাজের পিঠে দস্যু বনহুর।
একে অন্ধকার রাত, তার ওপর ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে, সে সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। বনহুরের অশ্বপদশব্দ পুলিশদের কানে পৌঁছে না।
অতি নিকটে পৌঁছে যায় বনহুর!
বনহুর মোটরের আলো লক্ষ্য করে এগুচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিট। বনহুরের অশ্ব খুব কাছে এসে গেছে। হাওয়ার বেগটাও যেন আরও বেড়েছে। সাঁ সাঁ করে শব্দ হচ্ছে। সে শব্দ ভেদ করে বনহুরের অশ্ব এগিয়ে আসছে।