হীরার আংটির চেয়েও মূল্যবান। দেখ দেখি, আমার ঘরের সিন্দুকটা।
সকলে ছুটলো চৌধুরী সাহেবের শোবার ঘরে। সে ঘরের জিনিসপত্র যেটা যেখানে সে রকমই আছে, সিন্দুকের পাশেও কেউ যায়নি। আশ্বস্ত হলেন চৌধুরী সাহেব।
মরিয়ম বেগম বলেন—দস্যু বনহুর হানা দিয়ে কিছু না নিয়েই চলে গেল, সত্যি বড় আশ্চর্যের কথা।
হ্যাঁ, অদ্ভুত ব্যাপার, যাক পুলিশ অফিসে ফোন করছি–বলেন চৌধুরী সাহেব।
মনিরা বলে ওঠে—কি দরকার মামুজান, সে যখন কোন অন্যায় করেনি, তখন অযথা এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে আর লাভ কি?
মরিয়ম বেগম বলে ওঠেন—না মনিরা, তা হয় না। বাড়িতে আরও কড়া পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। শয়তানটা সুযোগ বুঝে আবার সর্বনাশ করে বসবে। হায় একি হলো, দস্যু বনহুরের নজর শেষ পর্যন্ত আমাদের ওপর এসে পড়ল। ওগো, তুমি পুলিশকে সব জানিয়ে আরও পাহারার ব্যবস্থা করো। আমি যে আর ভাবতে পারছি না। মরিয়ম বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
১২.
স্বামীকে খেতে দিয়ে বলেন মরিয়ম বেগম—ওগো, সেদিন মনিরার জন্ম-উৎসবে খানবাহাদুর সাহেব আর তার ছেলে মুরাদ ঠিকভাবে যোগ দিতে পারেননি, হঠাৎ এ দস্যুটা কি কাণ্ডই না করেছিল, আর একদিন ওদের দাওয়াত করে এসো না?
খেতে খেতে বলেন চৌধুরী সাহেব ঠিক বলছ। সে কথা আমার মনেই ছিল না। আজই আমি ফোন করে দেব, কাল বিকেলে তাঁরা যেন আসেন।
হ্যাঁ, তাই কর। কিন্তু কেবল ফোন করলে হবে না, তুমি নিজে গিয়ে দাওয়াত করে এসো। যা হউক দু’দিন পর মনিরাকে যখন মুরাদের হাতে স’পে দিতে হবে, তখন আগে থেকে ওদের মধ্যে একটা আলাপ-পরিচয় হওয়া ভাল।
তাহলে আমিই যাব?
আড়ালে দাঁড়িয়ে মনিরা মামুজান আর মামীমার কথা শুনে। কি জানি কেন যেন ভালো লাগে না মনিরার। সেদিন সে মুরাদকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে, কিন্তু কৈ তার মনের কোণে ওর ছবি তো রেখাপাত করেনি? কোন আকর্ষণ অনুভব করেনি মনিরা হৃদয়ে। ধীরে ধীরে মনিরা চলে যায় নিজের কক্ষে। বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, তাকায় সে ছবিখানার দিকে। নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে মনিরা। কি সুন্দর দুটি চোখ, অপূর্ব অদ্ভুত! মনিরার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, সত্যই কি মনির নদীর স্রোতে ভেসে গেছে, মারা গেছে সে? না না, সে হয়তো বেঁচে আছে, মস্ত বড় যুবক হয়েছে সে, আরও সুন্দর হয়েছে হয়তো কিন্তু কি করে তা হতে পারে। গভীর পানিতে ক্ষুদ্র একটা বালক কি করে বাঁচতে পারে? মনিরার মন যেন ডেকে বলে সে বেঁচে আছে, নইলে তার লাশ পাওয়া যেত। গভীর চিন্তার অতলে তলিয়ে যায় মনিরা।
১৩.
খানবাহাদূর সাহেব আর মুরাদকে দাওয়াত করে এসেছেন চৌধুরী সাহেব। আজ বিকেলে আসবেন তাঁরা। মরিয়ম বেগম স্বহস্তে পাকশাক করছেন। চৌধুরী সাহেবের ব্যস্ততার সীমা নেই।
মরিয়ম বেগমের পাক শেষ হতে বেলা গড়িয়ে এলো। তিনি ছুটলেন মনিরার কক্ষে। তার চুল বাঁধা, কাপড় পরা শেষ হলো কিনা দেখতে, কিন্তু মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হলেন তিনি। মনিরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বালিশের উপরে! একখানা অপরিপাটি কাপড় পরনে। মরিয়ম বেগম রাগতকণ্ঠে বলেন—মনিরা, একি, এখনও তুমি শুয়ে আছ? ওঁদের যে আসার সময় হলো? বই থেকে মুখ না তুলেই বলে মনিরা—কাদের আসার সময় হলো মামীমা?
সে কি, খানবাহাদূর সাহেব আর তার ছেলে মুরাদ আসবে যে!
তাতে আমার কি?
আশ্চর্য করলি মনি, তাতে তোর কি, তা জানিসনে?
না তো? বই রেখে উঠে বসে মনিরা।
মুরাদের মত এত, উচ্চশিক্ষিত ছেলেকে কেন আমরা এত সমাদর করছি, এ কথা খুলে বলতে হবে তোকে?
বুঝেছি, আমি তোমাদের গলগ্রহ হয়েছি।
ছিঃ ছিঃ,! ওসব কি বলছিস মনি।
হ্যাঁ মামীমা, আমি তোমাদের চোখের বালি হয়ে পড়েছি। নইলে তোমরা আমাকে তাড়ানোর জন্য এত উঠে পড়ে লেগেছো কেন?
মরিয়ম বেগম মনিরার পাশে এসে বসে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন—আমরা তোমাকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছি, এসব কি বলছো মনিরা? লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ছাড়া আর কে আছে এই বুড়ো-বুড়ীর?
তবে যে সব সময় বিয়ে আর বিয়ে করে ব্যস্ত হচ্ছো?
পাগলী মেয়ে! এখন বড় হয়েছে, বিয়ে করতে হবে না?
না, আমি বিয়ে করবো না।
তা হয় না মনি, মেয়েছেলে কোনদিন বাপ-মার ঘর আগলে থাকতে পারে না। কথাটা একটু কঠিন কণ্ঠেই বলেন মরিয়ম বেগম।
মনিরাও অভিমানভরা গলায় বলে—মামীমা, তোমাদের ঘর আগলে থাকতে চাইনে। আমি বিয়েও করতে চাইনে।
মনিরা তুমি কচি খুকি নও। বয়সও তোমার কম হয়নি। সব বুঝতে শিখেছ, মুরাদের মত একটা সর্বগুণে গুণবান ছেলেকে হেলায় হারাতে পারি না। তুমি কাপড়-চোপড় পরে নিচে নেমে এসো।
এমন সময় চৌধুরী সাহেব কক্ষে প্রবেশ করেন—একি মা মনি এখনও তোমার হয়নি। লক্ষী মা আমার, চট করে জামাকাপড় পরে নাও।
মরিয়ম বেগম বেরিয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব কন্যা-সমতুল্য ভাগনীকে আদর করে আরও বলেন—তারপর নেমে গেল নিচে।
মামুজান আর মামীমা বেরিয়ে যেতেই পুনরায় বইখানা মেলে ধরে মনিরা চোখের সামনে। কিন্তু মন আর বসে না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে। বই রেখে উঠে পড়ে, কিছুক্ষণ মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নীল আকাশের দিকে। শুভ্র বলাকার মত ডানা মেলে সাদা সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, সে দিকে তাকিয়ে কত কথা ভাবে সে।