আর ভাবতে পারে না নূরী, সমস্ত ভাবনা যেন তার খই হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে চলে যায় সে নিজের ঘরে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে নূরী কত কথা, সে ছোট্ট হতে এত বড় পর্যন্ত। সব সময় সে বনহুরকে দেখে আসছে। এক সঙ্গে খেলা করেছে, এক সঙ্গে খেয়েছে, ঝর্ণায় সাঁতার কেটেছে, কিন্তু কৈ, বনহুরকে সে তো কোনদিন নিজের করে পায়নি। ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে ওঠে নূরীর মন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে। বিশেষ করে আজকের কথাটা তার হৃদয়ে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নূরী, হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেংগে যায় তার, দেখতে পায় তার কক্ষের জানালার শিক বাঁকিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে একটা হিংস্র বাঘ। অন্ধকারে বাঘের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাত্র আর একটা শিক বাঁকাতে পারলেই বাঘটা তার কক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
নূরী ভয়ার্ত কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো।
পাশের কক্ষে ঘুম ভেংগে গেল বনহুরের। নূরীর কক্ষ লক্ষ্য করে ছুটে চললো সে। কিন্তু পূর্বেই বাঘটা জানালার শিক ভেংগে কক্ষে প্রবেশ করলো।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই বাঘটা লাফিয়ে ছিল তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর পড়ে গেল মাটিতে। নূরী আর্তনাদ করে দু’হাতে চোখ টাকলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে নিজের কোমর থেকে ছোরা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল বনহুরের দিকে। বনহুর ছোরাখানা লুফে নিয়ে বসিয়ে দিল বাঘটার বুকে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি চললো বাঘ আর বনহুরের মধ্যে।
ততক্ষণে কক্ষে আরও বহু দস্যু এসে জড়ো হয়েছে। বাঘটা তখন ঢলে পড়লো মেঝেতে। বনহুর গায়ের. ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু তার শরীরে কয়েকটা স্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছে দরদর করে।
নূরী এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না, ছুটে এসে দু’হাতে নিজের ওড়নার কাপড় ছিড়ে বেঁধে দিতে লাগলো ওর ক্ষত স্থানগুলো। অন্যান্য দস্যু বনহুরের এই বীরত্বে আশ্চর্য হয়ে যায়। তারা ভাবতেও পারেনি তাদের সর্দার এত বড় একটা বাঘকে একাই সাবাড় করতে পারবে। সবাই বনহুরের জয়ধ্বনি করে ওঠে।
ভোরে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে তাকালো মনিরা। মুক্ত জানালা দিয়ে ভোরের মিষ্টি হাওয়া তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। হাই তুলে উঠে বসলো সে। হঠাৎ তার নজর ছিল হাতের আংগুলে। একি! হীরার আংটি তার আংগুলে এলো কি করে? সে যে আলমারীতে উঠিয়ে রেখেছিল আংটিটা! তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় হাত দিয়ে চাবি গোছা নিতে যায়, কিন্তু কোথায় চাবির গোছা! আলমারীর কপাটে চাবির গোছা ঝুলছে!
মনিরার বেশ স্মরণ আছে, শোবার পূর্বেও সে বালিশের তলায় চাবির গোছা হাত দিয়ে অনুভব করে নিয়ে তবেই শুয়েছে। তবে কি ঘরে কেউ এসেছিল? দরজার দিকে তাকালো সে। দরজা যেমন খিল দিয়ে আটকানো ছিল, ঠিক তেমনি আছে। ঘরে তাহলে কেউ আসেনি। মনিরা ধড়মড় করে শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, অমনি তার নজর গিয়ে পড়ে বিছানার পাশে একটা কাগজের টুকরা পড়ে আছে। কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে এলোদস্যু বনহুর এসেছিল!
ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে পুনরায় তাকালো সে নিজের আংগুলে। দস্যু বনহুর তাহলে হীরার আংটি গ্রহণ না করে তার আংগুলে পরিয়ে দিয়ে গেছে। এর উদ্দেশ্য কি? অপমান, ঘৃণায় রি রি করে উঠলো মনিরার শরীর। কেন সে হীরার আংটি নিয়ে গেল না, কেন সে তাকে স্পর্শ করলো? এতই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কি করে সে এক কথা মামুজান আর মামীমার কাছে বলবে। একটা দস্যু তার আংগুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবে–!
মনিরা দরজা খুলে মামীমার কক্ষে প্রবেশ করলো।
মরিয়ম বেগম কন্যা-সমতুল্যা ভাগ্নীকে হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—কি হয়েছে মনিরা?
মনিরা ব্যস্তসমস্ত কণ্ঠে বলেন—এই দেখ মামীমা, আমার হীরার আংটি আলমারীতে রেখেছিলাম, কিন্তু রাতে আমার হাতের আংগুলে এসে পড়েছে।
কি আশ্চর্য কথা, এসব কি বলছিস তুই?
সত্যি মামীমা আলমারীতে হীরার আংটি বন্ধ করে রেখে ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু ভোরে দেখি হীরার আংটি আঙ্গুলে, আর চাবির গোছাও বালিশের তলায় নেই, আলমারীর গায়ে ঝুলছে।
সর্বনাশ, এ যে অদ্ভুত কথা!
এই দেখ-বনহুরের লেখা কাগজখানা মরিয়ম বেগমের হাতে দেয় মনিরা—এটা পড়ে দেখ।
কাগজখানা হাতে নিয়ে দৃষ্টি বুলাতেই অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন মরিয়ম বেগম—একি, দস্যু বনহুর এসেছিল।
ততক্ষণে মরিয়ম বেগমের আর্তচিৎকার শুনে ছুটে আসেন চৌধুরী সাহেব-কি হলো, কি হলো?
ওগো, দ্য হানা দিয়েছিল।
দস্যু!
হ্যাঁ, দস্যু বনহুর মনিরার কক্ষে হানা দিয়েছিল।
হীরার আংটি নিয়ে গেছে?
না গো, না।
তাহলে সে হীরার আংটি নিতে পারেনি?
নিয়েও নেয়নি। তার মানে?
এবার বলে মনিরা—মামুজান, রাতে শোবার পূর্বে আংটি খুলে আলমারীতে বন্ধ করে চাবির গোছাটা বালিশের তলায় রেখেছিলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আংটিটা আমার হাতের আংগুলে এসে গেছে, চাবির গোছা যেখানে রেখেছিলাম সেখানে নেই, আলমারীর গায়ে ঝুলছে। বিছানায় পড়ে আছে এই কাগজের টুকরাটা, পড়ে দেখ মামুজান।
কাগজের টুকরাখানায় নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়েন চৌধুরী সাহেব। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর বলেন–এত সতর্কতার মধ্যেও সে আসতে পারলো! হলঘরে আমি, বাড়ির ভিতরে বন্দুকধারী পাহারাদার, সদর গেটে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। এর মধ্যেও দস্যু বনহুর হানা দিতে পারলো? হীরার আংটি নেয়নি সে, কিন্তু এমন কিছু নিয়ে গেছে, যা