কক্ষে একটা নীলাভ ডিমলাইট জুলছিল, সে আলোতে বনহুরের হাতে হীরার আংটিটা ঝকঝক করে উঠে। আংটিটা প্যান্টের পকেটে রেখে এগিয়ে যায় সে মনিরার বিছানার পাশে। ছিন্নলতার ন্যায় মনিরার সুকোমল দেহখানা বিছানায় লুটিয়ে আছে। এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে ললাটের চারপাশে। অপূর্ব দেখাচ্ছিল মনিরাকে। বনহুর নির্নিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর চলে যাবার জন্য যেমনি সে ফিরে দাঁড়াতে যায়, অমনি নজর গিয়ে পড়ে তার দেয়ালের ওপর। বিস্ময়ে চমকে ওঠে বনহুর। একি! এ তারই লকেটের ছবি। পাশাপাশি দুটি মুখ, সে আর মনিরা। আশ্বর্য! এ ছবি এখানে এলো কি করে? বনহুর নিজের গলার মালাছড়া জামার নিচে হতে টেনে বের করলো, তারপর লকেটের ঢাকনা খুলে ফেললো। একবার তাকালো সে দেয়ালের ছবিখানার দিকে তারপর পকেটে। এ যে একই ছবি! না, কোন ভুল নেই। তবে কি এই তার সে মনিরা, যে মনিরা শিশুকালে তার হৃদয় জয় করে নিয়েছিল? বনহুর ঝুঁকে ছিল মনিরার মুখের ওপর। এইতো সে তিলটা এখনও রয়েছে তার চিবুকের একপাশে। লকেটের ছবিখানার দিকে লক্ষ্য করে আশ্বস্ত হলো সে, এই তার সে মনিরা। আনন্দে বনহুরের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফিরে পেয়েছে সে, তার মনিরাকে তাহলে ফিরে পেয়েছে। বনহুর বসে ছিল মনিরার পাশে, সযতে মনিরার ললাট থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ভাল করে দেখতে লাগলো। কতদিন, কত যুগ পরে সে যেন ফিরে পেল তার মনিরাকে। বনহুরের ঠোট দু’খানা মনিরার ললাট স্পর্শ করলো।
এবার বনহুর মনিরার সুকোমল হাতখানা তুলে নিল হাতে, তারপর প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলো হীরার আংটিটা, অতি যত্নে পরিয়ে দিল সে মনিরার আঙ্গুলে।
একটুকরা কাগজ বের করে তাতে লিখল–
“আমি এসেছিলাম” –দস্যু বনহুর।
কাগজখানা মনিরার বিছানার পাশে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে।
১০.
বনহুরের অশ্ব গিয়ে থামতেই ছুটে এলো নূরী। বনহুরকে হাত ধরে নামিয়ে নিল সে। তারপর হেসে বলেন–এনেছো আমার হীরার আংটি?
চলতে চলতে বলে বনহুর–আনতে পারলাম না, একজন কেড়ে নিল।
মিথ্যা কথা। দস্যু বনহুরের কাছ হতে কেউ যে কিছু কেড়ে নিতে পারবে–এ আমি বিশ্বাস করতে পারিনে।
কেন? আমার চেয়ে কেউ কি বীরপুরুষ নেই?
না, আমার কাছে সব পুরুষের চেয়ে তুমিই শক্তিমান।
নূরীর কথায় হাসলো বনহুর। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেন–তোমার এ বিশ্বাস অটুট রইলো কই! হীরার আংটি হাতে পেয়েও তোমার নিকট পৌঁছাতে পারলাম না।
নূরী বনহুরের দক্ষিণ হাত চেপে ধরলো সত্যি তুমি হীরার আংটি হাতে পেয়েও–
হ্যাঁ নূরী, আমি পরাজিত হয়েছি।
না, এ আমি বিশ্বাস করি না হুর, এ আমি বিশ্বাস করি না—
নূরী, সামান্য একটা হীরার আংটি তোমাকে এতখানি মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে?
না হুর, শত শত হীরার আংটি আমার কাছে তুচ্ছ। আমি কিছুতেই ভাবতে পারিনে দস্যু বনহুরকে কেউ পরাজিত করতে পারে। তুমি সত্যি করে বল, কারও কাছে তুমি হেরে যাওনি?
নূরী, তোমার বিশ্বাস যেন অটুট থাকে। ইনশাআল্লাহ বনহুর কারও কাছে শুক্তির দিক দিয়ে পরাজিত হবে না।
নূরী আনন্দে অস্ফুটধ্বনি করে ওঠে-হর!
নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। নূরী তার শরীর থেকে দস্যুর ড্রেস খুলে নেয়, তারপর উভয়ে বসে পড়ে পাশাপাশি। নূরী বনহুরের চুলে আংগুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তুমি সত্যি বীরপুরুষ। তোমার শক্তির কাছে সমস্ত লোক পরাজিত, তোমার বুদ্ধির কাছে সবাই হেয়! হাজার হাজার লোকের চোখে ধূলো দিয়ে তুমি তোমার সাধনা পূর্ণ করে চলেছে। শত শত পুলিশবাহিনী তোমাকে পাকড়াও করার জন্য অহরহ ক্ষিপ্তের ন্যায় ছুটাছুটি করছে। কেউ তোমাকে আজও পাকড়াও করতে সক্ষম হলো না। তোমার এই ভূতপূর্ব বীরত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি। খোদা তোমাকে চিরদিন এমনি করে জয়ী করুন।
নূরী, তুমিই শুধু আমার হিতাকাক্ষী। আর কেউ আমার মঙ্গল কামনা করে না। সবাই চায় দস্যু বনহুরের পতন!
ছিঃ! ও কথা মুখে এনো না হুর; আমার প্রাণে বড় ব্যথা লাগে, তোমার অমঙ্গল আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও কষ্টদায়ক।
বনহুর অবাক নয়নে তাকালো নূরীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটির দিকে। নূরী তাকে এত ভালবাসে কিন্তু ধীরে ধীরে নূরীর মুখ খানা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ভেসে ওঠে একটা সুন্দর ফুলের মত কোমল ঘুমন্ত মুখ। বনহুর দৃষ্টি নত করে কি যেন ভাবতে লাগলো।
নূরী বলেন—হুর, আজ তোমাকে যেন কেমন ভাবাপন্ন লাগছে। কি হয়েছে তোমার?
বললাম তো কিছু না। তুমি যাও নূরী, আমি এখন বিশ্রাম করবো।
কেন, আমি থাকলে তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? আমি যাই। অভিমান ভরে উঠে দাঁড়ায় নূরী।
অন্যদিন হলে বনহুর ওর হাত চেপে ধরে পুনরায় বসিয়ে দিত কিংবা নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলত—চললো আমিও যাই তোমার সঙ্গে, কিন্তু আজ বনহুর নীরব থেকে যায়।
নূরীর চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় সে।
বনহুর বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে বুজে আসে ওর চোখের পাতা।
আড়ালে দাঁড়িয়ে নারী তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখে। বনহুরকে নিয়ে সে রচনা করে চলেছে এক স্বপ্নসৌধ। নূরীর মন চলে যায় দূরে, অনেক দূরে–সেখানে শুধু সে আর বহুর। কিন্তু বনহুরকে সে যতই আঁকড়ে ধরতে চায়, ততই যেন সে সরে পড়ে দূরে। কিছুতেই নূরী বনহুরের নাগাল পায় না। বিগত দিনের স্মৃতি হাতড়ে চলে নূরী। কিন্তু সেখানেও ফাঁকা লাগে, বনহুরের নাগাল সে কোনদিন পায়নি। কোথায় যেন ব্যবধান আছে দু’জনের মধ্যে।