বনহুরের কঠিন কণ্ঠস্বরে হৃদপিন্ড কেঁপে উঠলেও সে দাঁতে দাঁত পিষে বললো–ওঃ তুমিই বনহুর–সর্বনেষে দস্যু, হাজার হাজার মানুষকে তুমি হত্যা করেছো…
বললো বনহুর–মানুষকে নয় তোমার মত হিংস্র জন্তুদের আমি হত্যা করেছি, তোমাকেও এখনি ওদের সঙ্গী করবো।
হরনাথ জানতো বনহুর অত্যন্ত ভয়ংকর, কাউকে হত্যা করতে তার বুক একটুও কাঁপেনা। ঐ হাতের রিভলভারখানা এই মুহূর্তে গর্জে উঠতে পারে। তার হাতে এখন কোন অস্ত্র নাই, সে জানতো না, তার এই গোপন আস্তানায় বনহুর কোনক্রমে প্রবেশ করতে পারবে। যমদুতের মত বনহুর তার সম্মুখে দন্ডায়মান। হরনাথ হেমাঙ্গিনীকে দ্রুত টেনে নিলো সামনে। হরনাথ জানে হেমাঙ্গিনীকে বনহুর হত্যা করবে না। আর সেই কারণেই হরনাথ হেমাঙ্গিনীকে সামনে চেপে ধরলো।
বনহুর এ কারণেই গুলি ছুঁড়তে পারলো না।
হরনাথ পিছু হটছে।
বনহুর দ্রুত সরে এলো, হরনাথকে পিছু হটার সুযোগ না দিয়ে, বাম হস্তে টেনে নিলো হরনাথকে, তারপর তলপেটে মারলো একটি প্রচন্ড লাথী।
হরনাথ পেট চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়লো কক্ষটির মেঝেতে।
সে উঠে দাঁড়াবার পূর্বেই বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে হরনাথের মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, মুহর্তে মুখ থুবড়ে উবু হয়ে পড়ে গেলো। হরনাথের বুকের মাঝামাঝি গুলি বিদ্ধ হয়ে ছিলো। রক্তের স্রোত নেমে এলো।
লালে লাল হয়ে গেলো মেঝেটা।
হেমাঙ্গিনী হরনাথের প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে বললো, বনহুর তুমি ওকে উপযুক্ত সাজা দিলে। কেমন করে ঠিক সময় মত এসেছো? ঈশ্বর তোমাকে পাঠিয়েছেন। তার দয়ায় আমি আমার ইজ্জৎ রক্ষা করতে পেরেছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই নাও বনহুর আমার হীরক অংগুরী, এটা আমার ইজ্জত রক্ষার উপহার।
বনহুর বললো–চল তোমাকে তোমার প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসি।
চলো বনহুর। সত্যি তোমার উপকারের কথা কোন দিন ভুলবোনা।
হরনাথের কয়েকটি অশ্ব বাইরে ছিলো প্রয়োজন বোধে সে এই অশ্বগুলি ব্যবহার করতো। বনহুর আর হেমাঙ্গিনী দুটি অশ্বপৃষ্ঠে দু’জন চেপে বসলো।
দুটি অশ্ব ছুটে চললো উলকা বেগে।
হেমাঙ্গিনীর মনে আনন্দ উচ্ছ্বাস। হরনাথের মত নরপশুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে সে, বনহুর তার ইজ্জৎ রক্ষা করেছে, নইলে হেমাঙ্গিনী ও মুখ কোনদিন কাউকে দেখাতে পারতো না। হেমাঙ্গিনীর জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে, তবু তার জীবন পবিত্রময়। নারীর ইজ্জৎ সব চেয়ে বড় জিনিস। তাই সে আজ উচ্ছল আনন্দে ভরপুর। হরনাথ আর আসবেনা কোন দিন, তার সর্বনাশ সে করতে পারবে না।
বনহুর হেমাঙ্গিনীকে পৌঁছে দিলো তার প্রাসাদে। তারপর সে ফিরে এলো নিজ গুহায়। গুহার দেয়ালে মশালের আলো গুলো দপ দপ করে জ্বলছে।
আংগুল থেকে হেমাঙ্গিনীর দেওয়া হীরক আংটিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো গুহার বাইরে। একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো বনহুরের মুখে, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো সে দুহাত তুলে।
এমন সময় রহমান এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে, কুর্নিশ জানিয়ে একটি চিঠি বাড়িয়ে ধরলো বনহুরের দিকে, রহমানের মুখে বিস্ময় বললো সে-সর্দার এ চিঠি পুলিশ প্রবীণের তরফ থেকে এসেছে,
বনহুর চিঠিখানা হাতে নিয়ে মেলে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো–রহমান পুলিশ মহলের আমন্ত্রণ পত্র…..
অস্ফুট কণ্ঠে বললো রহমান–সর্দার।
হাঁ পুলিশ মহল আমাকে নিয়ে জোর তদন্ত চালিয়ে চলেছিলো তুমি নিশ্চয়ই জানো।
জানি সর্দার! একটু থেমে বললো রহমান–পুলিশমহল হন্তদন্ত হয়ে গবেষণা চালিয়ে আপনার……থেমে গেলো রহমান।
বনহুর বললো–হা তুমি যা ভাবছো তাই!
কান্দাই পুলিশ অফিসের সম্মুখস্থ মাঠে আজ জন সমুদ্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে বহু লোক। তারা সবাই নিজ নিজ দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন দেশের পুলিশ কর্মকর্তাগণ। কান্দাই এর পুলিশ মহলের সকল কর্মকর্তা ছাড়াও এসেছেন সেনা অধিনায়কগণ।
সবাই নিজ নিজ পোশাকে সজ্জিত।
মঞ্চের সম্মুখস্থ সোফায় এবং চেয়ারে তারা উপবিষ্ট। অন্যান্য সবাই বিভিন্ন আসনে বসে উন্মুখ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সম্মুখস্থ মঞ্চের দিকে।
সকলেই বাকহীন নিঃস্তব্ধ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সম্মুখে আসবে বিশ্বখ্যাত দস্যু বনহুর।
কান্দাই পুলিশ সুপার মিঃ রুশদী বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বস্থানে জানিয়ে দিয়েছে দস্যুরাজ বনহুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কান্দাই পুলিশ অফিসের সম্মুখস্থ বিরাট বিস্তৃত খোলা মাঠে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে, তাকে এক নজর দেখার বা জানার স্বাদ যাদের আছে তারা যেন উক্ত তারিখে কান্দাই উপস্থিত হয়ে উক্ত পুলিশ অফিস সম্মুখ মাঠে হাজির হন।
সংবাদটা শোনার পর হতেই পৃথিবীর সর্বস্থানের জনগণের মনে প্রবল বাসনা তারা বনহুরকে এক নজর দেখতে চায়। প্রবল বাসনা নিয়ে সবাই উক্ত তারিখের পূর্বেই রওয়ানা দেয় কান্দাই অভিমুখে। সত্যি কি তারা বনহুরকে দেখতে পাবে এটা কি সম্ভব।
আজ সেই উক্ত তারিখ, উনুখ দৃষ্টি নিয়ে সবাই প্রহর গুণছে।
মিঃ রুশদী মিঃ আহম্মদ এবং বিভিন্ন দেশের পুলিশ হর্তাকর্তা নিজ নিজ ড্রেসে সজ্জিত হয়ে মঞ্চে বসে আছেন।
পুলিশ মহলের সকলের কোমরের বেল্টে দেখা যাচ্ছে জমকালো রিভলভার।
বনহুরের গাড়ি এখনও এসে পৌঁছায় নাই।