এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ হাসনাত প্রবেশ করলেন তার সঙ্গে পুলিশগণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ইন্সপেক্টরের সংগে সরকার সাহেব, মনিরাকে কুর্ণিশ জানিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর-আমরা আপনার কক্ষে তল্লাশি চালাতে চাই…….
মনিরা শান্ত কণ্ঠে বললো–আসুন, দেখুন যা দেখবার আছে।
ইন্সপেক্টর হাসনাত ঘরের ভিতরে এবং পাশের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে দেখলেন তারপর বেরিয়ে গেলেন তিনি।
বাইরে পুলিশগণ আগ্নেয় অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করছিলো তারাও মিঃ হাসনাতের সঙ্গে বিদায় গ্রহণ করলো। মনিরা কক্ষে বসে শুনতে পেলো কয়েক খানা জিপ গাড়ির শব্দ। পুলিশ মহল কেমন করে জানতে পেরেছিলো বনহুর আজ রাতে মনিরার কাছে আসবে। নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে তাদের বাড়িতে অথবা পাশের বাড়ির কেউ হবে।
অনেক কিছু ভাবে মনিরা, বিদায় মহর্তে স্বামীর ম্লান মুখ খানা বার বার ভেসে উঠে চোখের সামনে। নির্ভীক স্বামীকে আজ যেন সে নতুন রূপে দেখলো। সমস্ত রাত ঘুমাতে পারেনা মনিরা।
এক সময় ভোর হয়ে আসে।
ভোরের দিকে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো মনিরা। তখন মোটর থামার শব্দে তন্দ্রা কেটে যায় তার। শয্যায় উঠে বসে, তাকায় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। ভোরের সূর্য উদয় হচ্ছে সবে মাত্র।
জানালার পাশে একটি দেবদারু গাছ ছিলো, এই গাছটি সে এ বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখে আসছে। বনহুর প্রথম এই দেবদারু গাছ বেয়েই এসেছিলো তার ঘরে। তারপর কতবার বনহুর এই দেবদারু গাছের সাহায্য গ্রহণ করে তবেই না তার সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম হয়েছে। সেই দেবদারু গাছ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।
ততক্ষণে নর কক্ষে প্রবেশে করে ডাকে-মা মনি।
কে, বাবা নূর! মনিরার চোখে পানি এসেছিলো স্বামীর কথা ভাবতে ভাবতে। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়, বেশ কিছু দিন নূর আসতে পারেনি ব্যস্ততার জন্য। আজ সন্তানকে পেয়ে দুচোখ বেয়ে পানি আসছিলো তার।
নূর বললো–আম্মু আমি সব শুনেছি। আব্বু এসেছিলেন অথচ তাকে পুলিশ……
হাঁ বাবা, তোর আব্বুকে পুলিশ একটু স্বস্তি পেতে দেয়নি। কথাটা বলতে গিয়ে মনিরার গন্ড বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
নূর রুমাল দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে, কেঁদোনা মা মনি, তোমার চোখে পানি আমি সহ্য করতে পারিনা।
নূর!
বলো আম্মু!
তোর আব্বুকে আজও সংসারী করতে পারলাম না। এটাই আমার বড় দুঃখ। ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়ছে তবু তার স্বভাব পাল্টালো না।
আম্মু আমি জানি, আব্বু কোন অন্যায় কাজ করেন না তবু তিনি অপরাধী, আর তিনি যে অপরাধ করেন তা দেশের অসহায় মানুষদের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্যই করেন।
তাতে কি লাভ তার বুঝিনা।
তুমি তা বুঝবে না আম্মু? লাভ আত্ন তৃপ্তি……আব্বু ফিরে গেছেন তার আস্তানায় এবং নিরাপদেই আছেন। তুমি কিছু ভেবোনা আম্মু।
ভাবিনা, কিন্তু ভাবনা যে আসে আপনা আপনি।
আম্মু চলো আমার বাংলায় চলো। ভাল লাগবে…
না নূর, আজ আমি কোথাও যাবো না।
কেন আম্মু?
ও তুই বুঝবি না নূর।
থাক, তা হলে কাল তোমাকে নিতে আসবো। কদিন আমার ওখানে থেকে আসবে।
তা কাল হোক, তখন হবে।
তবে এখন চলি আম্মু?
একটু বস বাবা, নাস্তা দিতে বলি।
আজ দেরী করবো না আম্মু। একজন আসার কথা আছে।
কে বল না বাবা?
তুমি চিনবে না।
সেই বৈজ্ঞানিক মিঃ বার্ডের মেয়ে মিস মেরী?
হাঁ আম্মু, তুমি কি করে বুঝলে?
আমি সব জানিরে সব জানি।
আব্বু বুঝি বলেছেন?
তিনি বলবার আগেই আমি শুনেছি কিন্তু…
বল আম্মু থামলে কেন? কিন্তু কি।
আমার যেন কেমন মনে হয়। হাজার হলেও তারা বিদেশী মেয়ে। সে কেন বার বার তোর বাংলোয় আসে?
ও বড় একা এ দেশে, একমাত্র ওর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। হিরাঝিলের গহ্বরে ওর বন্দী হয়ে থাকতে ভাল লাগেনা, তাই আমার এখানে আসে। ওকে দেখলে তোমারও ভাল লাগবে, বড় মিষ্টি মেয়ে। তাছাড়া মিস মেরীর সহযোগীতায় আমরা হিরোইন প্রস্তুত ঘাটি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছি। অবশ্য প্রথমে সে বাধা স্বরূপ হয়েছিলো, তারপর যখন তাকে বোঝানো হলো, হিরোইন শুধু দেশ ও জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছেনা, সমস্ত পৃথিবীর যুব শক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তখন সে আমাদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসে।
এমন সময় হোসেন বাবুর্চি এসে বললো–আম্মা ছোট সাহেব এর নাস্তা টেবিলে দিয়েছি।
নূর বললো–হোসেন তুমি বড় খেয়ালী। সত্যি আম্মু আমার কিন্তু বড় পিপাসা বোধ হচ্ছিলো। এসো আম্মু, তুমিও চা নাস্তা খাবে, এসো।
তুমি যাও বাছা, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।
নূর চলে গেলো। খাবার টেবিলে বসে বললো–সর্বনাশ এত কিছু তৈরি করলে কখন!
ছোট সাহেব, মা মনি রোজ কত নাস্তা তৈরি করে ফিরিজে রাখেন, শুধু তার জন্য।
তাই নাকি?
হাঁ, ছোট সাহেব আপনি জানেন না এসব কিছু তিনি মুখে দেন না, বললে বলেন, আমার নুর আসবে তার জন্য এ সব করে রাখি। আপনার জন্য প্রতিদিন তিনি প্রতিক্ষা করেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে হোসেন মিয়া।
এমন সময় মনিরা আসে-নূর আমার জন্য অপেক্ষা করছিস বুঝি?
বসো আম্মু। এতো সব তৈরি করে কেন রেখে দাও বলো তো।
তুই তো বলে কয়ে আসিস না বাবা, তাই হঠাৎ যদি এসে পড়িস তাই রোজ আমি…
এখানে যখন মা এবং সন্তানে কথা হচ্ছিলো তখন বনহুর আর রহমানের কথা হচ্ছিলো, রহমান বললো–সর্দার হেমাঙ্গিনীকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। রাজা মঙ্গল সিংহ অনেক সন্ধান করেও তার কোন খোঁজ খবর পাননি।