বনহুর বললো–আসলে রাজার অনুচর যার উপরে রাজাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো সে রাজার জামা কাপড়ে হরিণের রক্ত মাখিয়ে মিথ্যা থোকা দিয়েছিলো রাণী হেমাঙ্গিনীর কাছে।
রাজার কর্মচারিটি মহৎ ব্যক্তি তাতে কোন সন্দেহ নাই বলো তারপর?
তারপর সে মানে হেমাঙ্গিনী উচ্ছল হয়ে উঠে। কিছু দলবল নিয়ে সে একটি পর্বতের গহ্বরে স্বর্ণ সিংহাসন তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। চোরাচালানী করে সে নানা দেশ থেকে খাঁটি সোনা আমদানি করে। যাকে ইচ্ছা তাকে সে বন্দী করে এবং নানা ভাবে তাদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার।
এ সংবাদ পেয়েই বুঝি তুমি ছুটে গিয়েছিলে হিন্দ্রল রাজ্যে।
হাঁ, এ কথা তোমাকে কে বলেছে?
তুমি না জানিয়ে চলে গেলেও আমি সবই জানি।
তবে আর শুনে কি লাভ বলো?
তোমার মুখে সব শুনতে চাই, কারণ তুমি হিন্দ্ৰল গেছো কেন তা জানিনা।
তবে শোন মহারাজ মঙ্গল সিংহকে হেমাঙ্গিনী হত্যা করার নির্দেশ দিলেও সেই নির্দেশ পালন করেনি তার কর্মচারী, রাজা মঙ্গল সিংহকে জীবিত রাখা হয় এক গোপন গুহায়। বনহুর সমস্ত ঘটনা মনিরার কাছে বলে যায়।
মনিরা সব শুনে অবাক হয়। তেমনি খুশিও হয় সে। বলে মনিরা, পিশাচী একটি নারীকে তুমি মহৎ করতে পেরেছো এ কথা আমাকেও আনন্দিত করেছে।
সত্যি মনিরা আমি নিজেও তৃপ্ত।
কিন্তু তুমি যে বললে এতোগুলো লোককে তুমি হত্যা করেছো?
হাঁ, একটি রাজ্য এবং রাজাকে বাঁচাতে গিয়ে আমি হেমাঙ্গিনীর সহকারী গণকে হত্যা করেছি।
বললো মনিরা-এখন কি হেমাঙ্গিনী তার স্বামী পুত্রকে মেনে নিতে পেরেছে?
হাজার হলেও সে নারী এরা বরাবর কোমল হৃদয়, স্নেহময়ী ধর্মশালী হয়। হয়তো এ গুণগুলো তাকে সৎ ও মহৎ করে তুলেছে।
থাক তোমার কাহিনী-এবার বলো সংসারী হবে না তুমি? চিরদিন তোমার নেশায় বিভোর থাকবে।
নেশা নয় পেশা, কিন্তু পেশা থেকে সরে এলেই কি পুলিশ মহল আমাকে আনন্দে গ্রহণ করতে পারবে মনিরা। যত মহৎ কাজই আমি করিনা কেনো, পুলিশ মহল তা মেনে নেবেনা।
আমি বলবো, এই যে দেশ ব্যাপী যুব মহলকে পঙ্গু করে দেবার চক্রান্ত চলছে, নানা ধরনের মাদকদ্রব্য ব্যবহারে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই হিরোইন প্রস্তুত কারখানা কি ভাবে কৌশলে তুমি সমূলে ধ্বংস করেছে। কি ভাবে তুমি হিরাঝিলের তলদেশে মাদক দ্রব্য ব্যবসায়ীদের গুদাম আবিষ্কার করে সমস্ত মাদকদ্রব্য এবং সর্ব নাশা হিরোইন বিনষ্ট করেছে। কি ভাবে হাজার হাজার চোরা চালানীদের সায়েস্তা করেছে…..
কিন্তু তাতে কি পুলিশ মহল তোমার কথা মেনে নেবে?
কেন নেবেনা, আমি বলবো, নূর বলবে, সবাই জানে তুমি দস্যু হলেও তুমি মহৎ সবার চেয়ে।
হাসলো বনহুর, তারপর বললো–মনিরা আমার কি ইচ্ছা হয়না তোমাদের পাশে সর্বক্ষণ থাকি। সংসারী হয়ে আমি সবার পাশে নিজকে প্রতিষ্ঠা করি, কিন্তু তা হবার নয়।
কেনো হবার নয়?
ও তুমি বুঝবে না। নেশা বা পেশা দুটোই সমান। এ ছাড়া আমি দস্যুতা করি কেন তুমি হয়তো তা জানোনা। আমার বাপুজী আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো, আমি যেন অন্যায় কোন কাজ না করি। জানি দম্যতা অন্যায়, তবু আমি দস্যতা করি আমার নেশা ও পেশা দুটোই। দস্যুতা করে আমি যে সম্পদ লুটে নেই তা আমি বিলিয়ে দেই অনাথ অসহায় দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে। এটা যদি অন্যায় হয় তবে আমি অন্যায় করছি, আর যদি মহৎ কাজ হয় তা হলে আমি নাচার। মনিরা তুমিই বলল, যারা নিরীহ অসহায় মানুষদের শোষণ করে ঐশ্বর্যের ইমার গড়ে তুলেছে যাদের টেবিলে নানাবিধ খাদ্যসম্ভার, দুগ্ধ ফেনিল শয্যায় শয়ন করেও যারা আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখে, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। আমার ধমনির রক্তে আগুন ধরে যায়। বলো মনিরা সেটা কি আমার অপরাধ?
জানিনা! আমি জানি না বনহুর, কেন তুমি সহ্য করতে পারোনা, তোমার মত শত সহস্র মানুষ আছে তাদের কি এমন হয় না। তারা কেমন করে সহ্য করে, দেখেও না দেখার মত নিশ্চিন্তে বসবাস করে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। সবাই যদি তোমার মত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো তা হলে দেশ আজ………
এ সব ভেবে কোন ফল হবে না মনিরা।
এমন সময় বৃদ্ধ সরকার সাহেব হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসেন উপরে। বলেন তিনি-ঘোট সাহেব-ছোট সাহেব-দরজা খুলুন।
সরকার সাহেবের কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় মনিরা এবং বনহুর, দরজা খুলে মনিরা বলে কি সংবাদ সরকার চাচা?
পুলিশ-পুলিশ বাড়ি ঘেড়াও করে ফেলেছে-হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলে সরকার সাহেব।
মুহূর্তে মনিরার মুখ কালো হয়ে যায়, সে তাড়াতাড়ি স্বামীর পাশে এসে বলে…..পুলিশ জানতে পেরেছে তুমি এসেছো। যাও, চলে যাও তুমি এতোটুকু সময় পাশে পেয়েছিলাম এতো সুখ আমার ভাগ্যে সইবে না।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে মনিরার কক্ষের সুড়ঙ্গ পথে নেমে গেলো। একটি কথাও সে বললোনা।
মনিরার কানে স্বামীর কিছু পূর্বের কথাগুলো বাজতে লাগলো। বলেছিলো বনহুর–পুলিশ আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেবেনা, পুলিশ আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেবেনা মনিরা…এ কথা মিথ্যা নয়, বনহুর সমাজে এসে সাধারণ মানুষের মত বসবাস করতে চাইলেই কি পারবে? তা হতে দেবেনা কেউ…একটু পূর্বেই সে স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ ছিলো, স্বামীর স্পর্শ এখনও তার সমস্ত শরীরে অনুভূত হচ্ছে।