রানীজী আপনি বনহুরকে হৃদয় আসনে স্থান দিয়েছেন, আমি তা হতে দেবোনা। সে স্বর্ণসিংহাসনের লোভে আপনাকে হাত করে স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।
না, তোমার কথা মোটেই সত্য নয়।
কোন কথা শুনতে চাই না, সঙ্গীদের ইঙ্গি করলো হরমোহন। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন পালোয়ান তুলে নিলো রাণী হেমাঙ্গিনীকে কাঁধে।
হেমাঙ্গিনী হাত পা আছড়ে নিজকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। হেমাঙ্গিনী একেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কাহিল হয়ে পড়েছিলো তারপর সে হরমোহনের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে আরও কাহিল হয়ে পড়েছিলো, কাজেই সে বড় ক্লান্ত অবসন্ন। হরমোহনের অনুচর তিনজন অতি সহজেই তাকে নৌকা থেকে নামিয়ে বহন করে চললো তাদের মহিসাখুর জঙ্গলের গোপন গোড়ো বাড়িটার উদ্দেশ্যে।
*
অনেক দিন পর বনহুরকে পাশে পেয়ে মনিরার দু’চোখে অশ্রু ঝরে পড়লো। অনেক কথা জমা হয়ে থাকলেও কণ্ঠ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছিল না তার।
বনহুর মনিরাকে কাছে টেনে নিলো, মৃদু হেসে বললো–মনিরা তোমার চোখে পানি। কত দিন পর এসেছি তোমার হাসি মুখ দেখবো বলে আর তুমি অশ্রু বিসর্জন করছো। কেন মনিরা লক্ষ্মিটি কেনো কাঁদছো তুমি?
এতদিন পর তোমাকে কাছে পেয়েছি এ যে আমার পরম সৌভাগ্য। তাই বড় আনন্দ হচ্ছে আমার……আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো মনিরা।
তাই বুঝি! মনিরা তোমার চোখে পানি দেখলে আমি ধৈর্যচ্যুত হই। সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলি। জানো তোমার নুর-এর সহায়তায় আমি আমাদের নতুন বাহন চালিয়ে সেই দেশে গিয়েছিলাম, সেখানে হিরোইন প্রস্তুতকারী দল সহ তাদের কারখানা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছি।
বললো মনিরা-সবই শুনেছি নূরের মুখে। কি ঝুঁকি নিয়েই না তোমরা ইহোল মাংলতে গিয়েছিলে। আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই তোমরা জয়ী হয়ে ফিরে এসেছে।
হাঁ মনিরা, সে কথা সত্য। আল্লাহর নিকটে লাখো লাখো শুকরিয়া। বৈজ্ঞানিক লর্ডের কন্যা মিস মেরীকে ঐ নরপশুদের কবল থেকে উদ্ধার করে এনে দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা, এ জন্য অনেক খুশি হয়েছেন মিঃ লর্ড।
মেরী কি ওর বাবার কাছেই আছে?
হাঁ।
শুনেছি আজকাল নূর প্রায়ই মিঃ লর্ডের ওখানে যায়।
হয়তো যায়।
শুধু যায় না, মিস মেরীও আসে নূরের বাংলোতে।
তাতে কি, এলোইবা।
তুমি বুঝবে না।
যা ভাবছো মনিরা, তা নয়, মেরীকে তুমি দেখোনি। সত্যি মেয়েটা সৎ চরিত্রা।
মনিরা বললো–অমন কত মেয়েই তো দেখেছি। যার পাল্লায় তুমি পড়েছে সেই তোমাকে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। তোমারইতো ছেলে নূর।
একটা মেয়ে যদি কাউকে পাবার জন্য উন্মুখ বা কাউকে ভালবাসে বলল তাতে দোষ কি। ভালবাসা ভাললাগা এটা তো পবিত্র একটা সম্পদ। বলো তুমিও কি একদিন আমাকে ভালবাসোনি?
বেসে ভুলই করেছিলাম। সেদিন বুঝিনি তুমি…
বল, থামলে কেনো?
তুমি বড় নিষ্ঠুর।
সত্যি আমি কি নিষ্ঠুর! যদিও আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজ করে বসি কিন্তু সত্যি আমারও ইচ্ছার বিরুদ্ধেই করি।
তুমি কি এখনও ছেলে মানুষ। তুমি বোঝনা যা তুমি করো তা অন্যায়।
আমার কাজকে তুমি অন্যায় মনে করো মনিরা?
হাঁ, করি।
মনিরা!
তুমি মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করো। অপরের ধন সম্পদ তুমি হরণ করো একটু থেমে বললো–দস্যু নামটা তোমার সার্থক হয়েছে।
মনিরা তুমি যা বলছে তা আমার কাছে অন্যায় নয়। কোন মানুষকে আমি হত্যা করিনি, যাদের হত্যা করেছি তারা অমানুষ হিংস্র জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র। আর অপরের সম্পদ লুটে বা হরণ করে নেবার কথা বললে, তাও সেই কথা, সভাবে যারা অর্থ উপার্জন করে তাদের এক কপর্দক সম্পদও আমি বা আমার অনুচরগণ লুণ্ঠন করবে না বা করেনি কোন দিন। যা লুণ্ঠন করেছি ঐ অমানুষ যারা তাদের এবং তা বিলিয়ে দিয়েছি মানুষ যারা তাদের মধ্যে। মনিরা সবই তো জানো তুমি। একটু থেমে বললো বনহুর, যারা মানুষ, তারা সমস্ত দিন পরিশ্রম করেও এক মুষ্টি অন্ন জোটেনা তাদের মুখে। অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়, রাত্রিকালে যাদের পথ ঘাট মাঠ আশ্রয় স্থল জীবন যাদের দুঃখে ভরা, তারাই তো আসল মানুষ। আমি তাদেরে ভালবাসি, তাই আমি অমানুষদের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে দেই তাদের মধ্যে। তাতে আমি আনন্দ পাই।
কিন্তু তোমার জন্য তো কারো মন কাঁদেনা, কেউ তো তোমার দুঃখ বোঝেনা বা বুঝতে চেষ্টা করেনা। সবাই জানে তুমি পিশাচ, তুমি নিষ্ঠুর হৃদয়হীন,
তোমাকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ মহল হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তোমাকে আটক করা হলে সবার মুখে হাসি ফোটে। তোমাকে হত্যা করলে তাকে কোটি কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
তাতে আমার কিছু যায় আসে না মনিরা! ওরা আমার বন্ধু যারা আমাকে হত্যা করতে চায়…কথাটা বলে হাসে বনহুর।
কি মানুষ তুমি!
অমানুষ তো নই। যাক ওসব কথা, এবার আমি একটা নূতন গল্প বলবো তোমাকে।
নূতন গল্প কি? তোমার গল্প বলো।
মহেন্দ্র আর হিন্দ্রল পাশাপাশি দুটি রাজ্য। হিন্দ্রল এর রাজা মঙ্গল সিংহের স্ত্রী রাণী হেমাঙ্গিনী। রাজা মঙ্গল সিংহকে হত্যা করে সে স্বর্ণ সিংহাসনের একচ্ছত্রী সমাঙ্গী হয়েছিলো। রাজার কিছু কর্মচারীর সহায়তায় সে স্বামীকে হিংস্র ব্যাঘ্রের দ্বারা হত্যা করে।
নারী না পিশাচী সে? বলো তারপর? বললো মনিরা দু’চোখে তার বিস্ময়।