ভাল করে লক্ষ করলো কিংকরী। তার পাশের বিছানায় কিংকরী শুয়ে ছিলো। কিন্তু এটাতো সে বজরা নয়, কিংকরী বা তার শয্যাও নেই। তবে কোথায় সে।
এমন সময় একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো-লড়া রাণীজির জ্ঞান ফিরেছে কি?
লড়া! কে এই লড়া! কণ্ঠস্বরটি হেমাঙ্গিনী কোথাও যেন শুনেছে, কেমন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।
লড়া! তবে ঐ ব্যক্তি যাকে সে ছায়ায় বসে বসে ঝিমুতে দেখেছে।
লড়া কোন জবাব দেবার পূর্বেই হেমাঙ্গিনী দু’চোখ বন্ধ করে শয্যায় পড়ে রইল। লড়া আসন ছেড়ে উঠে এলো, লণ্ঠনের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে বললো–মালিক রাণীজীর, জ্ঞান এখনও ফেরেনি। ফিরলে জানাবো…কথাটা বলে লড়া আবার তার আসনে এসে বসলো এবং আবার সে ঝিমুতে শুরু করলো।
হেমাঙ্গিনী চোখ খুলে একবার দেখে নিলো তাকে।
কান পেতে শুনতে লাগলো, সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে তার কানে। কাউকে বলছে-আমাদের নৌকা এসে গেছে কিন্তু রাণীর সংজ্ঞা ফিরে আসছে না এখনও। ভোর হবার পূর্বে আমাদের জঙ্গল বাড়িতে পৌঁছতে হবে।
অপর একটি কণ্ঠমালিক, এত ভাবনার কি আছে। হুকুম করুন রাণীকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে আমরা জঙ্গল বাড়িতে পৌঁছতে পারবো।
কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে।
আরও একটি কণ্ঠস্বর-এই গহীন জঙ্গলে লোক কোথায় মালিক। এ রাজ্য তো আপনার।
হাঁ, আর বিলম্ব করোনা, যাও রানীকে তুলে নিয়ে নৌকা বিদায় করে দাও। বললো হরমোহন।
হেমাঙ্গিনী সব শুনলো সে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো।
হঠাৎ একটু শব্দ হলো।
হরমোহন বললো–দেখো তো রানীর জ্ঞান ফিরলো কিনা?
লোকটা নৌকার ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে বললো–মালিক রাণীজীতে বিছানায় নেই।
বলো কি লড়া।
হাঁ মালিক।
হরমোহন দ্রুত প্রবেশ করলো নৌকার ভিতরে। বিছানা শূন্য পড়ে আছে।
তাড়াতাড়ি নৌকার বাইরে এসে খোঁজাখুজি করতে লাগলো হরমোহন।
ওদিকে রানী হেমাঙ্গিনী হামাগুড়ি দিয়ে নৌকার ওপাশের খিরকী দিয়ে বেরিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
সঙ্গে সঙ্গে ঝপাং করে শব্দ হলো।
হরমোহন বুঝতে পারলো রানী হেমাঙ্গিনী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাহলে সে জ্ঞান লাভ করে সব কিছু অনুধাবন করে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। মুহূর্তে বিলম্ব না করে হরমোহনও ঝাঁপিয়ে পড়লো নদী বক্ষে। অন্ধকারে প্রথমে নজরে না পড়লেও ঝুপ ঝাঁপ শব্দে হরমোহন অন্ধকারেও রাণী হেমাঙ্গিনীকে ধরে ফেললো। হরমোহন তাড়াতাড়ি রশি নামিয়ে দেবার জন্য নিজ অনুচরদের চিৎকার করে বললো।
হরমোহনের তিনজন সহকারী এ নৌকায় ছিলো। তারা দ্রুত নৌকা থেকে মোটা রশি নামিয়ে দিলো।
এদিকে ততক্ষণে ভোরের আলো সমস্ত পৃথিবীটাকে ধুসর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ভোরের আলোতে কিছু কিছু নজরে আসছে। হরমোহনের সঙ্গী তিন জন রশি ধরে চেষ্টা করছে হরমোহনের হাতের কাছে।
হেমাঙ্গিনী হরমোহনের সঙ্গে পানির মধ্যেই ধস্তাধস্তি করছে। কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না হরমোহন তাকে।
হেমাঙ্গিনী ক্রমেই হাঁপিয়ে পড়লো।
হরমোহন তুলে আনলো হেমাঙ্গিনীকে।
সহচর তিনজন সাহায্য করলো হরমোহনকে। তার হাত থেকে রাণী হেমাঙ্গিনীকে নৌকায় তুলে নিয়ে শুইয়ে দিল। রাণী হেমাঙ্গিনীকে শুইয়ে দিতেই সে চোখ মেললো।
ভোরের আলো তখন দীপ্ত হয়ে উঠেছে।
হরমোহনের উপর এবার দৃষ্টি পড়তেই বিস্ময় ভরা গলায় বললো হেমাঙ্গিনী-হরমোহন তুমি!
হাঁ, আমি আপনার পুরাতন হিতৈষী বন্ধু হরমোহন।
তুমি আমাকে আমার বজরা থেকে উঠিয়ে এনেছো? কথাগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো হেমাঙ্গিনী। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার পর পানিতে প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলো হেমাঙ্গিনী। তারপর হরমোহনের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য ধস্তাধস্তি করে ভীষণ ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো সে, কথা বলতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তবুও রাগে কঠিন কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলো হেমাঙ্গিনী।
তা দেখতেই পাচ্ছেন রাণীজী। আমি আপনাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি মাত্র। হরমোহন বললো।
উদ্ধার! আমাকে তুমি সর্বক্ষণ কুপরামর্শ দিয়ে তুমি যে অন্যায় করেছে তার জন্য আমি তোমাকে অভিশম্পাত করছি।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো হরমোহন।
হেমাঙ্গিনী কোন রকমে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো–হরমোহন তুমি যদি তোমার মঙ্গল চাও তবে আমাকে রাজ প্রাসাদে পৌঁছে দাও। নচেৎ…
হাসি থামিয়ে বললো হরমোহন-নচেৎ আপনি কি করবেন?
তোমাকে আমি হত্যা করবো।
পারবেন আমাকে হত্যা করতে? রাজা মঙ্গল সিংহকেই আপনি পারেননি হত্যা করতে। বনহুর আপনাকে দেখছি একটি সৎ নিষ্ঠাবান মহিলাতে পরিণত করেছে।
খবরদার, তুমি এ পাপ মুখে বনহুর নাম উচ্চারণ করবে না।
ওঃ বনহুর দেখছি তোমাকে দেবী নামে ভূষিত করেছে।
হাঁ, তার সংস্পর্শে আমি মহৎ নারী হিসাবে পরিণত হয়েছি। সত্যি বনহুর দেবতা।
হাঃ হাঃ হাঃ একটি নরপশু দস্যুকে তুমি দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে। যে ব্যক্তি বিশ্ববাসীর আতঙ্কের কারণ। যে ব্যক্তি মানুষকে অমানুষের মত হত্যা করে, যে ব্যক্তি মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়, যে ব্যক্তি নারীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়।
হরমোহন তুমি যা বলছে তা সত্য নয়। নারীর মর্যাদা সে কোনদিন ক্ষুণ্ণ করে না, নারী জাতাঁকে সে শ্রদ্ধা করে, সম্মান দেয়। মানুষ সে হত্যা করে, যারা তোমার মত পাপিষ্ঠ। তোমার মত অমানুষ যারা, তাদেরই আতঙ্কের কারণ সে, ধন সম্পদ লুটে নেয় সত্য তা ঐ ব্যক্তিদের যারা গরিব অসহায়দের সম্পদ লুটে নিয়ে ঐশ্বর্যের ইমার গড়ে তোলে। সেই সব অন্যায় অত্যাচারীদের ধন সম্পদ লুটে নিয়ে যারা নিঃস্ব রিক্ত অসহায় তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। তাদের মুখে হাসি ফোঁটানোই তার উদ্দেশ্য। নারীজাতীর উপর তার শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালবাসা, পবিত্র সে নিজেও একজন পবিত্র। মানুষ।