হাঁ রাণী মা। শুনেছি পৃথিবীর সর্বস্থানে তার বিচরণ বিশ্ববিখ্যাত দস্যু নাকি সে? কিন্তু রানীমা আপনার কথায় মনে হচ্ছে বনহুরকে আপনি চেনেন।
সত্যি কিংকরী এমন ব্যক্তি হয়না। দস্য হলেও এক মহৎ হৃদয় মানুষ সে! ঐ ব্যক্তিই আমার কঠিন পাপময় জীবনকে করেছে আলোময় পবিত্র। হেমাঙ্গিনীর মুখে ফুটে উঠে একটা হাস্যজ্জল দীপ্তময় আভা।
কিংকরী মৃদু হাসলো। তার মনে উদয় হলো হরমোহন এর মুখ। তার সলাপরামর্শ সব ভেসে উঠছে হৃদয়াকাশে। কানের কাছে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো হরমোহনের কুপরামর্শগুলোর শব্দগুলো।
কিংকরীর কথা মত হেমাঙ্গিনী তৈরি হয়ে নিলো নৌকাবিহারে যাবে সে, সঙ্গে কিংকরী যাবে ঠিক হলো। কয়েকজন প্রহরী যাবে তাদের সঙ্গে। বিজয় সিংহের যাওয়া হলো না। বিমাতা হেমাঙ্গিনী বললো–বাছা তোমার যাওয়ার দরকার নাই। কারণ কিংকরী সঙ্গে রয়েছে আর রয়েছে চারজন প্রহরী।
বিজয় সিংহ বললো–যা ভাল মনে করেন তাই হোক।
*
নৌবিহারে গেলো হেমাঙ্গিনী।
কিংকরী ছাড়াও আরও দু’জন সহচরীকে রাজা মঙ্গল সিংহ দিলেন রাজরাণীর সঙ্গে।
মহারাজ রানীর জন্য বজরাখানাকে নতুন সাজে সাজিয়েছিলেন। মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে মনোরম করে বজরা সাজিয়ে দিলেন রানী যেন খুশি হয়।
রানী হেমাঙ্গিনী সহচরীদের নিয়ে রওয়ানা দিলেন।
নহবৎ আর সানাই ধ্বনিতে ভরে উঠলো রাজপ্রাসাদ থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত সমস্ত হাজার হাজার প্রজাগণ পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে রানীজীকে অভিনন্দন জানাতে লাগলো।
বজরায় পৌঁছতেই রানীজী ও সহচরীদের সানন্দে অভিনন্দন জানালো বজরার লোকজন। এরা সবাই বজরা রক্ষক এবং পরিচালক।
ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় বজরাখানা দোল খেয়ে খেয়ে ভেসে চললো। রানী হেমাঙ্গিনী সহচরীদের নিয়ে বজরার ছাদে এসে বসলো। সুন্দর ফুর ফুরে হাওয়ায় হাসি গল্পে মাতোয়ারা হলো রাণী ও রানীর সহচরীগণ।
সম্মুখে টেবিলে পরিচারিকা নানাবিধ খাদ্য সম্ভার দিয়ে গেলো। প্রাতঃভোজন সমাধা করলো রানী হেমাঙ্গিনী।
সমস্ত দিনটা কাটালো হাসি গল্প ও আনন্দের মধ্যে।
এক সময় বেলা ডুবে এলো।
অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মী মিশে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গিনী সহচরীদের নিয়ে বজরার মধ্যে প্রবেশ করলো।
কিংকরী ভাল গাইতে পারতো, গান গাইলো সে।
অনেক রাত।
হিন্দ্রল রাজ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে বজরা নোঙ্গর করেছে। চারদিকে শুধু ধুধু প্রান্তর।
বজরার অভ্যন্তরে সুসজ্জিত কামড়ায় দুগ্ধফেনিল শয্যায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে হেমাঙ্গিনী। পাশের কামরায় সহচরীগণ নিদ্রামগ্ন, অনেক রাত্র পর্যন্ত জেগে থাকার দরুণ সবাই গভীর ঘুমে অচেতন।
এমন সময় বজরার অদূরে আর একটি নৌকা এসে থামলো। নৌকার ভিতর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো হরমোহন। হাতে তার একটি কালো রুমাল। কিংকরী তাকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো বজরায়। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও কিংকরী ঘুমায়নি। তার মনের গহনে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো রহমানের কথা গুলি। বজরা যেখানে নোঙ্গর করবে আমার নৌকা সেখানে পৌঁছবে। যখন শুনবে একটা বাঁশীর শব্দ তখন বুঝবে আমি পৌঁছে গেছি।
কিংকরী সজাগ ছিলো।
বাঁশীর শব্দ কানে যেতেই কিংকরী সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো বজরার বাহিরে।
হরমোহন কিংকরীর হাত ধরে বজরায় উঠে এলো, চাপা কণ্ঠে বলল-কিংকরী। সাবাস, তুমি আমার কথামতই কাজ করেছে। প্রহরীগণ ও মাঝিদের…।
হাঁ, আমি সবাইকে জলের সঙ্গে ঔষধটা মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কেউ আপনার কাজে বাধা দিতে আসবেনা।
হরমোহনের মুখে একটা কুৎসিত হাসি ফুটে উঠলো।
আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
শুধু তারার মালা টিপ টিপ করে জ্বলছে।
সেই সামান্য আলোর ছটায় কিংকরী হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে কামরায় হেমাঙ্গিনী ঘুমাচ্ছিলো।
হরমোহনের চোখ দুটো হিংস্র শার্দুলের মত জ্বলে উঠলো। সে কালো রুমালখানা হাতের মুঠায় শক্ত করে ধরে ঐ কামরায় প্রবেশ করলো যে কামরায় রানী হেমাঙ্গিনী ঘুমিয়েছিলো।
কিংকরী দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে।
রানী হেমাঙ্গিনী দুগ্ধফেনিল শয্যায় শয়ন করে অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো।
হরমোহন নিদ্রিত হেমাঙ্গিনীর মুখে কালো রুমালখানা চেপে ধরলো।
সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর দেহটা নড়ে উঠলো তারপর নীরব।
এবার হরমোহন রানী হেমাঙ্গিনীর সংজ্ঞহীন দেহটা তুলে নিলো কাঁধে। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো কামরা থেকে এবং সুকৌশলে হরমোহন পার হয়ে গেলো তার নিজ নৌকায়।
কিংকরী এবার ফিরে এলো নিজ শয্যায়।
নিজ শয্যায় শুইয়ে দিলো হরমোহন রাণী হেমাঙ্গিনীকে। তারপর সে নৌকার বাইরে বসে মাঝিদের নির্দেশ দিলো-মাঝি যত তাড়াতাড়ি পার নৌকা বাইয়ে চলো, আমার মহিসাখুর পৌঁছতে হবে রাত্রির অন্ধকারে।
মাঝিগণ হরমোহনের নির্দেশ মত নৌকা বাইয়ে চললো।
*
ভোর হবার পূর্বে হরমোহনের নৌকা পৌঁছে গেলো তার গন্তব্য স্থানে। ইতিমধ্যে সংজ্ঞা ফিরে এলো রানী হেমাঙ্গিনীর। চোখ মেলতেই দেখলো সে চারদিকে অন্ধকার। এক পাশে একটি লণ্ঠন জ্বলছে। লন্ঠনের আলোতে সে দেখলো একটি ছায়ামূর্তির মত কে একজন বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
হেমাঙ্গিনী শয্যায় উঠে বসলো।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো এটা তাদের বজরা নয়। নৌকা দোল খাচ্ছে তাতেই হেমাঙ্গিনী আঁচ করে নিলো, কোন একটা নৌকায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লোকটা কে? প্রশ্ন জাগলো তার মনে। আর তাকে কারাই বা নিয়ে এসেছে বজরা থেকে এ নৌকায়।