কিন্তু ফিরে এসে যখন সে সব শুনলো, জানলো, তখন সে বুঝতে পারলো তার সলাপরামর্শ কার্যকর হয়েও হয়নি। বনহুর তার বুদ্ধি-কৌশল খাটিয়ে হরমোহনের সব ষড়যন্ত্র বিফল করে দিয়েছে। তখন হরমোহন উম্মাদ হয়ে উঠলো কেমন করে বনহুরকে এর শাস্তি দেওয়া যায়।
হরমোহন রাজকার্যে যোগ না দিয়ে সে হিন্দ্রল রাজ্যের অদূরে মহিসাখুর জঙ্গলে একটি পোভড়া বাড়ির অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে। বনহুরকে হত্যার প্রচেষ্টা চালালো। দলে সে মাত্র সাতজন সঙ্গী বেছে নিলো তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য। আরও সংগ্রহ করলো মারাত্নক অস্ত্র যা দিয়ে সে অনায়াসে বনহুরকে কাহিল করতে পারে।
রাণী হেমাঙ্গিনীর জীবনের মোড় পাল্টে গেছে, সে স্বামীর সেবা যত্ন এবং বিজয় সিংহের প্রতি নিজ সন্তান সম দরদ আর স্নেহ দিয়ে রাজ পরিবারে ফিরিয়ে এনেছে নব জীবন।
রাজা মঙ্গলসিংহ নিজেও লাভ করেছে অনাবিল শান্তি। প্রজাদের মনেও অফুরন্তু আনন্দ উৎসাহ। কারণ রাজ পরিবারের আনন্দ তাদেরকেও সর্বকাজে উৎসাহী করে তুলেছে।
. রাণী হেমাঙ্গিনীর মনে মাঝে মাঝে হরমোহনের কথা স্মরণ হয়, লোকটা তাকে কুমন্ত্র দিয়ে অসৎ পথে চলার উৎসাহী করে সে সরে পড়েছিলো, বলেছিলো সময় হলেই সে ফিরে আসবে কিন্তু আজও সে ফিরে এলোনা কেন ভেবে পায়না।
হরমোহনকে নিয়ে রাণীর বেশীক্ষণ ভাববার সময় নেই এখন। হরমোহন ফিরে এসেছে হিন্দ্ৰলে। এসে সে যখন সব জানতে পেরেছে তখন আর তার রাণী হেমাঙ্গিনীর সংগে দেখা করার কোন ইচ্ছাই জাগেনি মনে। বরং একটা হিংসাতুক ইচ্ছাই তাকে উম্মাদ করে তুলেছে, যেমন করে হোক উচিৎ শিক্ষা সে হেমাঙ্গিনীকে দেবে।
কয়েক মাস কেটে গেলো হেমাঙ্গিনীর যখন স্বামী সংসার নিয়ে পরমানন্দে দিন কাটাচ্ছে তখন সে হেমাঙ্গিনীর সহচরী কিংকরীকে কৌশলে নিয়ে আসে তার অতিথি ভবনে।
হরমোহন হিন্দ্রলে একজন প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বসবাস করছিলো। কিংকরীকে সুকৌশলে হিল বাস ভবনে নিয়ে আসে। তারপর তাকে মহামূল্যবান একটি হীরক আংটি উপহার দিয়ে হরমোহন কিংকরীর মন জয় করে নেয়। এরপর চলে গোপন আলোচনা হরমোহন আর কিংকরীর মধ্যে।
তারপর ফিরে আসে কিংকরী রাজপ্রাসাদে।
হেমাঙ্গিনীর প্রধান সহচরী বলে তার কোন বাধা ছিলোনা রাজ প্রাসাদে। যখন যেখানে যেমন খুশি প্রবেশের অধিকার ছিলো কিংকরীর।
কিংকরী ছিলো এক ফুলওয়ালীর মেয়ে।
মা ও মেয়ে প্রতিদিন সকাল বিকাল ফুল ও ফুলের মালা নিয়ে আসতো রাজ প্রাসাদে। হেমাঙ্গিনীর খুব ভাল লাগে কিংকরীকে। নিজের মনোবাসনা মহারাজ মঙ্গল সিংহের নিকট ব্যক্ত করে। মঙ্গল সিংহ হেসে বলেছিলেন-বেশ তো, তোমার যদি কিংকরীকে ভাল লাগে তবে সহচরী করে নাও।
হেমাঙ্গিনী মহারাজের মত পেয়ে কিংকরীকে সহচরী করে নিয়েছিলো।
সে আজ থেকে কমপক্ষে দশ বছর আগের কথা। হেমাঙ্গিনী সবে রাণী হয়ে রাজ প্রাসাদে এসেছিলো।
সহচরী হিসাবে সর্বক্ষণ পাশে পাশে থাকতো কিংকরী। মা ফুলওয়ালী গরিব বিধবা মহিলা। যুবতী কন্যাকে রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে আনন্দের সীমা ছিলো না তার। অভাব, রাক্ষসী অভাবের করাল গ্রাস থেকে মা ও মেয়ে মুক্তি পায়। হেমাঙ্গিনী প্রায়ই নানাভাবে কিংকরী মায়ের অভাব দূর করতো, এ কারণে ফুলওয়ালীর দুঃখ তেমন আর ছিলোনা।
কিংকরী রাজপ্রাসাদে যখন আসে তখন বয়স তার মোল বা সতের ছিলো, এখন ছাব্বিশ কিংবা সাতাইশ হবে। সুন্দরী, ছিমছাম চেহারা রূপে ঢল ঢলে তার গোটা অঙ্গ।
হরমোহন সহজেই কিংকরীকে হাত করে নেয়।
একদিন কিংকরী বলে-রানী মা চলুন না বজরায় চেপে নদী পথে কোন নতুন স্থানে যাওয়া যাক। সর্বক্ষণ এই রাজপ্রাসাদ আর ভাল লাগেনা। মনে হয় যেন আমরা বন্দিনী।
হাঁ, ঠিকই বলেছো কিংকরী, মুক্ত বিহঙ্গের মত ছিলাম। আমিই ছিলাম আমার জগতে একচ্ছত্রী সম্রাজ্ঞী। যখন যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করে ফিরেছি আর এখন শুধু পাষাণ প্রাচীরে ঘোড়া রাজ প্রাসাদ, সত্যিই কোথাও ঘুরে এলে মন ভাল লাগবে।
তা হলে মহারাজকে বলুন রাণী মা! বললো কিংকরী।
রাণীর সাধ অপূর্ণ রাখেন না রাজা মঙ্গল সিংহ।
রাণী বলতেই রাজা রাজি হয়ে গেলেন এবং পুত্র বিজয় সিংহকে ডেকে বললেন-বিজয় সিংহ প্রসাদকে বলে দাও আমার বড় বজরাটিকে সুসজ্জিত করতে। তোমার মা ও কিংকরী নৌবিহারে যাবে। তুমিও যাবে তাদের সঙ্গে বুঝলে।
বিজয় সিংহ বললো–বেশ তত আনি জি, তোমার নির্দেশ পালন করবো। অনেক দিন নৌবিহারে যাওয়া হয়নি।
কিংকরী রাণীকে নির্জনে ডেকে বললো–রাণী মা রাজকুমার বিজয় সিংহ যদি আপনার সঙ্গে নৌবিহারে যায় তবে আমি যাবো না।
হেমাঙ্গিনী বললো–কেনো? রাজকুমার সঙ্গে থাকলে বরং ভাল হবে। সাহসী একজন লোক থাকা ভাল।
হেসে বললো কিংকরী, রাণী মা আমরা জানি যে কোন পুরুষের চেয়ে আপনি শক্তিশালী এবং সাহসী।
হাঁ, তা বটে। কিন্তু কেনো জানিনা আজকাল মনটা আমার বড় কোমল হয়ে গেছে। মাতৃত্বের স্বাদ আমাকে আচ্ছাদিত করেছে। বনহুর কি যাদু জানে যার দরুন আমার মধ্যে এ পরিবর্তন।
কিংকরী যেন চমকে উঠলো।
হেমাঙ্গিনী বললো–কিরে কিংকরী, অমন করে চমকে উঠলি কেনো?
আপনি যে কি করে ঐ নাম মুখে আনলেন…
কোন নাম?
বনহুর।
ও, হাসলো হেমাঙ্গিনী, বললো–বনহুর নামটা তোকে ভীত করে তুলেছে, তাই না?