হেমাঙ্গিনী বললো–আমি তোমার কোন অনুগ্রহ চাইনা বনহুর।
যে অপরাধ তুমি করেছে তার সমুচিত শাস্তি ছিলো মৃত্যুদন্ড। পুরুষ হলে সে শাস্তি থেকে রেহাই পেতেনা, নারী বলেই ক্ষমা পেয়েছে হেমাঙ্গিনী নইলে।
নইলে কি করতে তুমি?
আমার রিভলভার তোমার কৃতকার্যের জবাব দিতো। এসো হেমাঙ্গিনী-তোমাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু মনে রেখো হেমাঙ্গিনী এর পর যদি তুমি কোন রকম কুকর্ম করো তবে রেহাই পাবেনা।
বনহুর শেষ কথাগুলো এমন ভাবে বললো হেমাঙ্গিনীর কোন জবাব দেওয়ার মত সাহস হলো না। শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো।
বজরা থেকে নামতেই সম্মুখে দেখতে পেলো একটি পাকি।
পালকী বাহকগণ রাজ কর্মচারীর পোশাকে সজ্জিত। ওরা ছাড়াও কয়েকজন অশ্বারোহী তারাও রাজকীয় পোশাকে সজ্জিত।
বনহুর নেমে এলো বজরা থেকে, হেমাঙ্গিনী এতোক্ষণ বনহুরের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। তাকে নতুন পোশাকে সজ্জিত দেখলো। পা-জামা পাঞ্জাবী, পায়ে জরির কাজ করা নাগড়া জুতো, মাথায় মনি মুক্তা খচিত টুপি।
অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে এ পোশাকে।
একটি অশ্বপৃষ্ঠে উঠে বসলো বনহুর।
হেমাঙ্গিনী পাল্কীতে আরোহণ করলো।
বেশ কিছু সময়ের মধ্যে অদূরে পরিলক্ষিত রাজা মঙ্গল সিংহের, রাজপ্রাসাদ। সুউচ্চ রাজপ্রাসাদের কিছু অংশ নজরে পড়তে বোঝা গেলো রাজ প্রাসাদটিকে সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে।
রাজপ্রাসাদ নজরে পড়লেও প্রাসাদে পৌঁছতেই সময় লাগলো অনেক। সমুদ্রতীর ছেড়ে বালুচর তারপর ছোট খাটো পাহাড় ও টিলা। তারপর গ্রামাঞ্চল শস্যক্ষেত। এ সব পেরিয়ে রাজ প্রাসাদের সম্মুখে এসে পৌঁছলো রানী হেমাঙ্গিনীর পালকী এবং তার রক্ষী বাহিনী।
বনহুর অশ্ব থেকে নামলো।
রাজা মঙ্গল সিংহ তাকে অভিনন্দন জানালেন। অন্যান্য রাজ পরিষদ রাজা মঙ্গল সিংহের চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাজকুমার বিজয় সিংহও ছিলো সেখানে। অনাথ সেন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো মহারাজের পিছনে, তার মুখমন্ডল দেখে মনে হচ্ছিলো সে মোটেই খুশি নয়। তার ললাট ভ্রুকুঞ্চিত, চোখ দুটিতে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। এক পাশে রথীন্দ্রনাথ, তার মুখে অপরাধীর ছাপ ফুটে উঠেছে। মহারাজকে হত্যা না করে মহারাণীর বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য সে রাণীর কাছে অপরাধী।
অনাথ সেন বনহুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে রাজা মঙ্গল সিংহকে যেখানে রাখা হয়েছিলো সেখানে। সেখানেই অনাথ সেন এবং রথীন্দ্র সব কথা বলেছিলো রাজা মঙ্গল সিংহকে এবং মঙ্গল সিংহকে বলেছিলো বনহুর আপনি দেবতা সমতুল্য মানুষ, যদিও আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আপনার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো তবু সে নারী তাই ক্ষমার যোগ্য। আপনি তাকে ক্ষমা করলে এ যাত্রা তাকে আমি জীবনে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। বলুন রাজা মঙ্গল সিংহ- আপনি তাকে ক্ষমা করে আবার আপনার রাজ্যে রাণী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি আছেন?
রাজা মঙ্গল সিংহ মহৎ ব্যক্তি, তিনি তার মহত্বের গুণে ক্ষমা করে দিলেন এবং রাণী হিসাবে তাকে গ্রহণ করবেন বলে স্বীকার করেছিলেন।
রাণী হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে বনহুর যখন রাজ প্রাসাদে ফিরে এলো তখন সকলে উপস্থিত ছিলো।
অনেকে ঘৃণায় মুখ বিকৃত করলো, অনেকে কটুক্তি করতেও ছাড়লোনা। খুশি। হলোনা তেমন করে কেউ।
রাজা মঙ্গল সিংহ যখন রাণীর দিকে হাত দু’খানা প্রসারিত করে বললো–হেমা এসো। তোমার স্বর্ণসিংহাসন তোমার উপবেশনের প্রতিক্ষায় আছে। কেউ তোমার স্বর্ণসিংহাসন স্পর্শ করবে না।
হেমাঙ্গিনী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–মহারাজ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। জানি আমি তোমার রাণী হবার যোগ্যতা হারিয়েছি তবু তুমি আমাকে ঘৃণা না করে আনন্দে অভিনন্দন জানালে। ঐ স্বর্ণ সিংহাসন আমার জন্য নয় আমি ঐ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করবো আমার সন্তান বিজয় সিংহকে। এসো বিজয় একবার পূর্বের মত মা বলে ডাকো ……
হাত বাড়ালো হেমাঙ্গিনী বিজয় সিংহর দিকে।
বিজয় সিংহ এখন ছোট্টটি নাই সে এখন যুবক। সে এখন সব বোঝে জানে। নীরবে পিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার বিজয় সিংহ চোখ তুলে তাকালো বিমাতার মুখের দিকে। আজ আর সে মুখে নাই তিক্ততার আভাষ। মাতৃস্নেহের মাধুর্য পরিলক্ষিত হচ্ছে সে মুখে। মুহূর্তে বিজয় সিংহের মুখভাব প্রসন্ন হলো, সে ঝাঁপিয়ে পড়লো হেমাঙ্গিনীর বুকে, অস্ফুট কণ্ঠে ডাকলোমা…মাগো…
উপস্থিত সবার চোখে অশ্রু ঝরলো।
অনাথ সেন বললো–আজ আমি তৃপ্ত।
বনহুরের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
*
হেমাঙ্গিনীর প্রধান অনচর হরমোহন যখন জানতে পারলো রাণী হেমাঙ্গিনীকে বনহুর জোর পূর্বক ধরে নিয়ে গেছে এবং রাজা মঙ্গল সিংহের সঙ্গে সুকৌশলে মিলন করিয়ে দিয়েছে। আরও একটি অপরাধ বনহুর করেছে সেটা হলো স্বর্ণসিংহাসন রাজা মঙ্গল সিংহের সন্তান বিজয় সিংহকে উপহার দিয়েছে।
হরমোহন ছিলো রাজসৈনিক এবং মঙ্গল সিংহের দেহরক্ষী। হেমাঙ্গিনীকে সেই গোপনে কুবুদ্ধি দিয়ে রাজা মঙ্গল সিংহের বিরুদ্ধাচরণে উদ্ভদ্ধ করে। অবশ্য হরমোহন যখন বুঝতে পেরেছিলো, রাণী হেমাঙ্গিনীর রাজা মঙ্গল সিংহকে সুনজরে দেখেনা, তখনই সে কুবুদ্ধি আঁটে এবং প্রয়োগ করে সুদর্শণা রাণী হেমাঙ্গিনীর উপর।
ফল ভালই হলো। হরমোহন জয়ী হয়েছিলো রাণী হেমাঙ্গিনী যখন তার প্রিয়তম স্বামী মঙ্গল সিংহকে হত্যার জন্য উন্মাদিনী হয়ে উঠেছিলো। রানীকে তার কাজে সলা পরামর্শ দিয়ে সে কিছু দিনের জন্য সরে পড়েছিলো, যেন কোন দোষ তার কাছে না চাপে।