হেমাঙ্গিনীর মনে নানা প্রশ্ন জাগছিলো, বনহুরকে সে এতো কাছাকাছি দেখেনাই, আজ হেমাঙ্গিনীর স্বপ্ন যেন স্বার্থক। বনহুরের প্রতি তার চরম রাগ থাকলেও সে রাগ ও ক্রুদ্ধ ভাব সব যেন উবে গেছে। যে বনহুরকে মনে প্রাণে কামনা করতো, যার সান্নিধ্য পাবার জন্য উনাখ ছিলো একদিন হেমাঙ্গিনী, সেই বনহুর আজ তার কত কাছে। মুহূর্তের জন্য হেমাঙ্গিনী তার গুলিবিদ্ধ হাতের যন্ত্রণার কথা ভুলে যায়।
বনহুর বললো–কি ভাবছো?
না কিছু না।
চলো।
অদূরে সমুদ্রে বজরা।
বনহুর আর হেমাঙ্গিনী বজরায় উঠে পড়লো।
সুন্দর সুসজ্জিত বজরার কক্ষগুলি।
বনহুরকে দেখবা মাত্র বজরার মাঝি বেশী বনহুরের অনুচরগণ কুর্ণিশ জানালো।
বনহুর বললো–রনজিৎ তুমি সব প্রস্তুত করেছো?
করেছি সর্দার। বললো রনজিৎ।
বলিষ্ঠ জোয়ান রনজিতের মাথায় ঝাকড়া চুল। দু’কানে দুটি বালা। গোফগুলো মোচড়ানো এবং মোটা। তাকে দেখলে মনে হয় রাজ বংশীয়। অবশ্য এ কথা সত্য, রনজিতের জীবন কাহিনী বড় করুণ। শিশু বেলায় ওর মা বাবাকে হত্যা করে রনজিতকে ধরে নিয়ে আসে কোন এক ডাকাত দল। সেখানে সে মানুষ হতে থাকে। প্রতিদিন তাকে শুধু মাংস আর রুটি খেতে দেওয়া হতো। কোন কোন দিন শুধু মাংস দেওয়া হতো এবং তাকে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়া, সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটা ঘোড়ায় চড়া এসব শিক্ষা দেওয়া হতো। কিছুটা বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডাকাত দল সঙ্গে নিয়ে যেতো এবং কি ভাবে লুটতরাজ রাহাজানি করে এসব শিক্ষা দেওয়া হতো। তারপর শুরু হলো একা একা ডাকাতি রাহাজানি করা। দলবল সকলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে যেদিকে পারে চলে যেতো। ডাকাতি করে যে বেশি মালামাল আনতে তাকে পেট পুরে খেতে দেওয়া হতো। রনজিত ছিলো সৎ ব্যক্তি, সে অসহায়দের মালামাল লুণ্ঠণ করতো না, তাই তার মালামাল কম থাকতো। ডাকাতের সর্দার এ কারণে তাকে খাবার যৎ সামান্য দিতে এবং মাঝে মধ্যে প্রহার করতো।
একদিন রনজিত ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। সর্দারের আচরণ সে মোটেই সহ্য করতে পারলো না, সে সর্দারকে কিছু না বলেই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। তরুণ রনজিত আর ফিরে এলো না।
এক মাস দু’মাস কেটে গেলো।
রনজিত এক হোটেনে নিয়ে সেখানে থেকে গেলো। কান্দাই শহরের বড় হোটেল। সেখানে একদিন রহমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। রনজিতের স্বাস্থ্য এবং আচরণ ভাল লাগলো। রহমান কথায় কথায় জানতে পারলো তার জীবন কাহিনী। রহমানও তার সর্দার বনহুরের সম্বন্ধে বলেছিলো সেদিন।
কেন যেন খুব ভাল লেগেছিলো রনজিতের কাছে তার সর্দারের কথাগুলো। এর পর প্রায়ই, রহমান ঐ হোটেলে যেতো এবং রনজিতের সংগে আলাপ আলোচনা করতো।
রহমানেরও ভাল লেগেছিলো রনজিতকে তাই একদিন রহমান সর্দার বনহুরের অনুমতি নিয়ে রনজিতকে, হাজির করেছিলো বনহুরের সম্মুখে।
কেন যেন রনজিতকে বনহুরেরও খুব পছন্দ হয়।
বনহুরকেও রনজিতের ভাল লাগলো সেদিন! তখন সে হোটেলের কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে এলো এবং বনহুরের অনুচর হিসেবে শপথ গ্রহণ করলো।
সেই থেকে রনজিত বনহুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে কাজ করে আসছে। শুধু রনজিত নয় রাজা সিংহও বনহুরের একজন প্রিয় অনুচর। দুঃসাহসী এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান রাজা সিংহ। এরা হিন্দুধর্মী হলেও বনহুরকে তারা অতিব শ্রদ্ধা করে।
হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে বনহুর যখন বজরায় এসে পৌঁছলো তখন রনজিত এবং রাজাসিংহ ছিলো সেই বজরায়। তাদের পূর্ব হতেই সব কিছু নির্দেশ দেওয়া ছিলো।
বনহুর আদেশ করলো, নিয়ে যাও রনজিত রানীমাতাকে তার কামরায় পৌঁছে দাও।
রনজিত মাথা কাৎ করে বললো–আচ্ছা সর্দার।
বনহুর এবার হেমাঙ্গিনীকে বললো–যাও রানীজী তুমি ওর সঙ্গে যাও।
হেমাঙ্গিনী বললো–বনহুর তোমার উদ্দেশ্য কি? আমাকে এদের হাতে তুলে দিয়ে কোথায় পালাবে? মনে রেখো আমার প্রতি তুমি কোন অসৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে চাইলেও পরিত্রাণ পাবে না।
হাসলো বনহুর, হেসে বললো–নারীজাতির প্রতি আমার কোন প্রতিহিংসা নাই। বরং আমি তোমার মঙ্গল কামনা করছি। তুমি তোমার বিশ্রাম কামরায় বিশ্রাম করো। আমি পালাবো না।
হেমাঙ্গিনীকে পাশের কামরায় পৌঁছে দিলো রনজিত।
একটু পরেই জল খাবার এলো, হেমাঙ্গিনী হাতের ব্যথায় যদিও কাতর ছিলো তবুও ক্ষুধার জ্বালা কম ছিলোনা। তাই হেমাঙ্গিনী জল খাবার কিছুটা খেলো।
খাবার পর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো হেমাঙ্গিনী।
বনহুর বজরার বাইরে জায়নামাজ বিছিয়ে এশার নামাজ শেষ করে নিলো। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বনহুর নামাজ কাজা করতোনা। আল্লাহই ছিলো তার সহায়।
ঘুম যখন ভাঙলো দেখলো তীরে ভীড়েছে তাদের বজরা।
হেমাঙ্গিনী চোখ মেলে বুজরার জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দিকে। এমন সময় বনহুরের কণ্ঠস্বর-তোমার গন্তব্যস্থানে এসে গেছে হেমাঙ্গিনী এবার তোমাকে নামতে হবে।
কোন স্থান আমার গন্তব্যস্থান?
হিন্দল রাজ্যের রাজপ্রাসাদ তোমার গন্তব্যস্থান। যেখানে তোমার অপেক্ষায় রাজা মঙ্গল সিংহ, পুত্র বিজয় সিংহ এবং আরও অনেকে প্রতিক্ষা করছে। হেমাঙ্গিনী তোমার স্বর্ণ সিংহাসনও রয়েছে সেখানে।
বনহুর এ সব তুমি কি বলছো?
হাঁ, সব সত্য। যে রাজাকে তুমি হত্যা করেছিলে সেই রাজা তোমাকে বরণ করে নেবে। যে অনাথ সেনকে তুমি হত্যা করতে চেয়েছিলে সেও খুশি মনে তোমাকে অভিনন্দন জানাবে। রথীন্দ্র নিজেও অপরাধী তাকে তুমি ক্ষমা করো কারণ তার সতোর জন্যই আজ তুমি দেবসমতুল্য স্বামীকে ফিরে পেলে, ফিরে পেলে রাজ্য, রাজ সিংহাসন। বিজয় সিংহের মত সন্তান…….আর কোন কথা নয় হেমাঙ্গিনী নেমে পড়ে।