হাঁ, কারণ বিজয় সিংহ একদিন আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই তাকে আমি…….
হেমাঙ্গিনী এসব করে কি তুমি তৃপ্ত হবে মনে করেছে?
হবো, কারণ আমি যা পাইনি তা হয়তো আর পাবোনা। পাবো রাজসিংহাসনের একচ্ছত্রি সম্রাজ্ঞী হবার সৌভাগ্য। পাবো অগণিত প্রজাদের শ্রদ্ধা……
হাসলো বনহুর–মিথ্যা দুরাশা হেমাঙ্গিনী! প্রজাদের শ্রদ্ধা তুমি কোন দিন পাবেনা কারণ তোমার কার্যকলাপ জঘন্য তা কারো জানার বাকি নেই। যারা হয়তো জানেনা তারাও জানবে একদিন।
তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি যাতে তৃপ্তি হবো সেটাই আমি চাই। বনহুর ধন রত্ন লুটে নেওয়া যায়, কিন্তু প্রেম ভালবাসা লুটে নেওয়া যায় না। তাই আমি বড় অসহায়, মা জীবিত থাকলে হয়তো আমাকে কোন ভিখারী যুবকের সংগে বিয়ে দিতে। সেখানে থাকতোনা মনি মানিক, থাকতোনা রাজ প্রাসাদ। পেতাম স্বামীর ভালবাসা, প্রেম পূর্ণ প্রীতির সোহাগ। হেমাঙ্গিনীর গন্ড বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে।
বনহুর নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে। হেমাঙ্গিনীর ব্যথা উপলব্ধি করে অন্তর দিয়ে। সে বুঝতে পারে কেন হেমাঙ্গিনীর মধ্যে একটা ক্ষুদ্ধ মানসী অমানুষীর রূপ নিয়েছে।
বলে হেমাঙ্গিনী-আজ আমার বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, সেই অগ্নিশিখার বিস্ফোরণ ঘটেছে বনহুর, তাই আমি হয়ে উঠেছি উন্মাদিনী, রাক্ষসী, যা খুশি বলো তাই। একটু থেমে হেমাঙ্গিনী বললো–বনহুর আমার সাধনা সার্থক হয়নি বলেই আমি নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই একচ্ছত্রী সম্রাজ্ঞী হিসাবে। আমার থাকবে রাজ্য, অগণিত প্রজা, আমার থাকবে স্বর্ণ সিংহাসন, এ আমার স্বপ্ন।
হেমাঙ্গিনীর চোখে মুখে ফুটে উঠে একটি আত্নহারার ভাব। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য, পরমুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে হেমাঙ্গিনী বলে উঠলো–সে রাজা মঙ্গল সিংহ জীবিত আছে, রথীন্দ্র তাকে হত্যা না করে আমাকে মিথ্যা প্রতারণা করেছে। রথীন্দ্রকে আমি দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিয়েছিলাম। ভাবিনি সে আমার সঙ্গে বেঈমানী করবে। ওকে আমি হত্যা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাবো না।
বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো–না, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না কারণ তারই জন্য রাজা মঙ্গলসিংহ জীবনে বেঁচে আছে। বিজয় সিংহ জানেনা তুমি তাকে বা তার পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলে। আমি রথীন্দ্রর ব্যাপারে জানি সে মহারাজকে তোমার সম্বন্ধে কোন কথাই বলে নাই। কাজেই তুমি যেমন পূর্বে রাণী ছিলে তেমনি থাকবে।
না না আমি চাই না আর রাজরাণী হতে আমি আমার স্বর্ণ সিংহাসন নিয়ে সুখী হতে চাই। কিন্তু মনে রেখো বনহুর তোমাকে আমি হত্যা করবোই এবং আমার স্বর্ণসিংহাসন তোমার রক্তে রঞ্জীত করবোই।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বনহুর, বলে- তুমি এখন বন্দী আমার কাছে। বরং এসো দু’জন মিলে রাজা মঙ্গল সিংহকে বন্দীখানা থেকে উদ্ধার করে আনি। রথীন্দ্রকেও মুক্তি দাও, তোমার ক্ষমার গুণে সে কোন দিনই তোমার ক্ষতি সাধন করবেনা।
বনহুর তুমি ওদের হয়ে খুব কথা বলছে-আমি তোমাকেও ক্ষমা করবোনা।
আমাকে ক্ষমা নাইবা করলে। তুমি নিজের কথা ভাবো হেমাঙ্গিনী। তোমার একটি অনুচরকে আমি জীবিত রাখিনি। কারণ, তারা রাজা মঙ্গল সিংহকে হত্যার চেষ্টায় সহায়তা করায় সবাইকে আমি হত্যা করেছি। কেউ তোমাকে সহায়তা করতে আর এগিয়ে আসবেনা। চলো আমার সঙ্গে….
তুমি আমাকেও হত্যা করতে চাও বনহুর?
নারী হত্যা আমি করিনি কারণ তারা…যাক শেষ কথা নাইবা শুনলে। হাঁ, তোমাকে হত্যা করা আমার কাছে অতি নগণ্য কাজ বরং তোমাকে যদি মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পারি সেটাই হবে আমার সার্থকতা।
একটু থেমে বললো বনহুর। এসো আমার সংগে।
কোথায় যাবো? বললো হেমাঙ্গিনী।
বলেছি তো তোমাকে হত্যা করবো না। তুমি এ মুহূর্তে অসহায়। এসো-বনহুর হেমাঙ্গিনী পথ থেকে সরে দাঁড়ালো।
বনহুর আর হেমাঙ্গিনী যখন গুহা গহ্বর থেকে বেরিয়ে এলো তখন বাইরে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেলো।
বনহুর বললো–উঠে পড়ো। ও তুমি একা উঠতে পারবে না, আমি তোমাকে সাহায্য করছি।
হেমাঙ্গিনীর হাত ধরে ঘোড়ার গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বনহুর নিজেও চেপে বসলো। কোচওয়ান গাড়ি ছাড়লো।
এবড়ো থেবড়ো পথ, ঘোড়ার গাড়িটা চলছে।
বনহুর বললো–তোমার কষ্ট হচ্ছে হেমাঙ্গিনী?
না।
রাগ করোনা আমি নিরুপায় হয়ে তোমার হাতে গুলি ছুঁড়েছি।
তাতে আমার তেমন কিছু যায় আসেনা। বললো হেমাঙ্গিনী।
তোমার হাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এটা অস্বীকার করতে পারোনা। তবে গুলিবিদ্ধ হয়নি, হাতের কিছু অংশ মাংস কেটে গেছে। তোমার হাতের কোন ক্ষতি হবে না হেমাঙ্গিনী। আমি এখন তোমাকে আমার একটি বজরায় নিয়ে যাচ্ছি।
বজরা…
হাঁ, তোমার ভয়ের কোন কারণ নাই। আমি কোন অসহায় নারীর প্রতি কোন জুলুম করিনা। সেটা আমার নেশা নয়।
জানি।
ঐ তো সমুদ্রতীর এসে গেছে।
হাঁ দেখতে পাচ্ছি। তবে তোমার উদ্দেশ্য এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না হেমাঙ্গিনী।
ঘোড়া গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে, পথ ততটা এবড়ো থেবড়ো নয়। তাই ঝাঁকুনিও কম। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটলো তাদের।
সমুদ্রতীরে এসে ঘোড়াগাড়িটা থেমে পড়লো।
অদূরে সমুদ্রতীরে একটি বজরা অপেক্ষা করছে।
বনহুর বললো–এসো হেমাঙ্গিনী। বাম হস্তে আমার হাত ধরে নেমে পরো।