হয়তো আমার বলেও কোন ফল হবে না, আর তোমার শুনেও কোন লাভ হবেনা, তবু আমার স্বস্তি আসবে বা শান্তি পাবো। বুকটা আমার হাল্কা হবে অনেক খানি। কোনদিন কাউকে যা বলতে পারিনি তোমাকে বলবো বনহুর।
বেশ বলো? বনহুর পাশে পড়ে থাকা পাথরটার উপরে বসে পড়লো।
হেমাঙ্গিনী দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তবুও বলছে সে–আমি রাজ কন্যা নই আমার বাবা একজন জ্যোতিষি ছিলেন। তিনি শিশুকালে আমার হস্তরেখা দেখে বলেছিলেন আমি নাকি রাজরাণী হবো। বাবা মরে গেলেন একদিন সর্পদংশনে, তিনি পূর্ব থেকেই জানতেন তার মৃত্যু সর্পদংশনে হবে, তাই তিনি সর্বক্ষণ সাবধানে চলাফেরা করতেন। তবুও তাকে সর্পদংশনে প্রাণ দিতে হলো।
. কি ভাবে তাকে সর্পদংশন করলো? বললো বনহুর।
সে এক অদ্ভুত ঘটনা। বাবা ঘুমিয়ে ছিলেন আমি মাঝখানে মাও পাশে। হঠাৎ বাবার খুব গরম বোধ হওয়ায় তিনি বিছানা থেকে নেমে উঠানে এসে বসলেন। এমন সময় তার পায়ে কি যেন কামড়ে দিলো, বাবা আর্তনাদ করে উঠলেন। মা ও আমার ঘুম ভেঙে গেলো, মা লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে এলেন, দেখলেন একটি সর্পরাজ ধীরে ধীরে উঠানের পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। বাবা পা ধরে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। ওঝা এল অনেক ঝাড় ফুক দিলো কিন্তু কোন লাভ হলোনা। বাবা মৃত্যুবরণ করলেন। তারপর জীবন দুর্বিসহ এক মুঠি অন্নের জন্য মা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেড়াতে লাগলেন-একটু থেমে আবার বলতে লাগলো হেমাঙ্গিনী বনহুর তুমি আমার পরম শত্রু জেনেও তোমার কাছে আমার জীবন কাহিনী বিনা দিধায় ব্যক্ত করছি কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি বনহুর।
বনহুর নত মুখে শুনছিলো হেমাঙ্গিনীর কথা গুলো এবার সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো হেমাঙ্গিনীকে।
হেমাঙ্গিনী বলে চললো-দিন দিন আমি বড় হতে লাগলাম। মাঝে মাঝে মা বলতেন, হায় হতভাগিনী,তোর বাবা বলেছিলেন তুই নাকি রাজরাণী হবি। সব মিথ্যা সব মিথ্যা যার কপালে এক মুঠি অন্ন জোটেনা সে হবে রাজরাণী। দু’দিন পর আমি মরলে তোকে যে ভিক্ষে করতে হবে হেমা। মা বাবা আমাকে হেমা বলে ডাকতেন। সত্যি একদিন মাও চির বিদায় নিলেন, মন আমার বিদ্রোহ হয়ে উঠলো, আমি ভিক্ষে করবোনা। বাবা বলেছিলেন, রাজরাণী হবে। তাই একদিন কিছু ফুল নিয়ে রাজবাড়ীতে গেলাম। রাজা মঙ্গল সিংহের সবে পত্নী বিয়োগ হয়েছে ছোট্ট শিশু বিজয় তখন হামাগুড়ি দেয়। আমি ফুল নিয়ে যেতেই প্রহরী আমাকে বাধা দিলো। মহারাজ সিংহাসনে বসেই আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি প্রহরীকে বললেন, আসতে দাও। দারোয়ান আমাকে ছেড়ে দিল। আমি মহারাজের কাছে গেলাম। রাজা মঙ্গল সিংহ আমার নিকট হতে একটি পুষ্প মাল্য কিনে নিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কি দিতে হবে। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললাম, আপনার মাথার ঐ রাজ মুকুট। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো আমার মুখের দিকে কারণ তারা কোন দিন এমন দাবি শোনেনি কারো মুখে। বিস্ময় নিয়ে সবাই যখন তাকিয়ে আছে। রাজাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন রাজা নিজের মাথা থেকে রাজ মুকুট খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দিলেন।
সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ী করলো।
একজন বললো–মহারাজ আপনি একি করলেন।
রাজা মঙ্গল সিংহ বললেন-পুষ্প মাল্যের কোন মূল্য হয়না, তাই ও যা চেয়েছে তাই দিলাম। যাও সারথীকে বলো ওকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিতে। হাঁ, আমাকে সেদিন মহারাজ মঙ্গল সিংহ তার মূল্যবান ঘোড়ার গাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
বনহুরও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো হেমাঙ্গিনীর দিকে।
হেমাঙ্গিনী বলছে-বাড়ি এসে ঘুমাতে পারলাম না। রাজ মুকুট দেখার জন্য শত শত লোক নারী পুরুষ ভীড় জমাতে লাগলো আমাদের বাড়িতে। সেদিন ভাবিনী এ রাজ মুকুট আমাকে রাজরাণীর আসনে বসাবে। রাজা মঙ্গল সিংহ একদিন আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলো রাজবাড়ীতে রানীর আসনে স্থান দিলেন
একটু থামলো হমাঙ্গিনী তারপর আবার বলতে শুরু করলো কিন্তু আমি সুখী হতে পারলাম না। বাসর ঘরে রাজা মঙ্গল সিংহ তার ঘুমন্ত শিশু বিজয়কে বুকে জড়িয়ে খুব কাদলেন। আমার ভাল লাগলো না, বুঝতে পারলাম মহারাজ তার প্রথম স্ত্রীকে স্মরণ করে কাঁদছে। মন আমার বিষিয়ে উঠলো, মহারাজের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা আসলো। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলাম, দেখলাম মহারাজ তার ঘুমন্ত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন।
ক্রমান্বয়ে দিন কাটতে লাগলো, স্বামীর সান্নিধ্য পেলাম কিন্তু তার প্রেম ভালবাসা পেলাম না কোনদিন। নীরস জীবন কাটতে লাগলো আমার। অর্থ ধন রত্ন মনি মানিক্যর অভাব ছিলো না। মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতো, তখন পূর্বের অবস্থা স্মরণ করতাম। ভিখারীর মেয়ে হয়ে রাজরাণী হয়েছি এই তো অনেক বেশি, নাইবা পেলাম স্বামীর প্রেম প্রীতি ভালবাসা। কিন্তু নিজের মনকে বেশীদিন ধরে রাখতে পারলামনা। নারীর কাম্য স্বামীর ভালবাসা, যার তুলনা হয়না ধন রত্ন মনি মানিক্যের সঙ্গে…দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো, সব সময় মন চাইতো রাজাকে সরিয়ে কি তবে নিজে রাজসিংহাসনের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হবো।
তারপর যা তুমি শুনেছো বনহুর তা সত্য।
রাজাকে হত্যা করেও তুমি তৃপ্ত হওনি, তুমি বিজয় সিংহকে হত্যা করার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।