বনহুর গুহার মেঝেতে একটি বড় পাথরে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গিনীর কথা শুনছিলো।
অনাথ সেন ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত তার চোখ দুটো ঘোলাটে দেখা যাচ্ছে, যতদূর সম্ভব নিজকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে সজাগভাবে শুনছে হেমাঙ্গিনী আর বনহুরের কথাগুলো।
বললো বনহুর–অনাথ সেন যখন এ যাত্রা বেঁচেই গেলো তাকে জীবিত রাখার চেষ্টা করতে হবে। পাশের গুহায় পাথরের টেবিলে প্রচুর খাদ্য পানিয় দেখলাম থরে থরে সাজানো, নিশ্চয়ই তোমার জন্য ওগুলো প্রহর গুণছে। আমি ওখান থেকে কিছু খাবার অনাথ সেনকে এনে দিতে পারি যদিও সে আমার আপনজন বা বন্ধু নয়। তবে যদি তুমি অনুমতি করো? আমি জানি তুমি অমত করবেনা হেমাঙ্গিনী।
কথা গুলো বলে বনহুর হেমাঙ্গিনীর হাত থেকে খসে পড়া পিস্তল খানা তুলে নিয়ে পাশের গুহায় চলে গেলো এবং একটু পরেই ফিরে এলো থালায় কিছু খাবার আর এক গেলাস পানি নিয়ে।
এবার বনহুর নিজের হাতে অনাথ সেনকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। খাওয়ানো শেষ হলে পানি পান করালো বনহুর স্বহস্তে তারপর বললো–হেমাঙ্গিনী চাবির গোছা দাও। আমি জানি চাবির গোছা তোমার কাছে আছে। দাও……হাত পাতলো বনহুর হেমাঙ্গিনীর দিকে।
হেমাঙ্গিনী নির্বাক দৃষ্টি মেলে বনহুরকে লক্ষ্য করছিলো, দস্যু হলেও তার মধ্যে আছে একটি মহৎ হৃদয় কিন্তু ওকে নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। বনহুর তার শত্রু…বললো হেমাঙ্গিনী চাবি আমার কাছে আছে, কিন্তু আমি দেবোনা। কারণ অনাথ সেন তোমাকে এখানে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। নইলে কোনদিন তুমি এখানে আসতে পারতে না।
অনাথ সেন যদি ভুল করে থাকে তবে আমি তার হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি কারণ…..
কারণ শুনতে চাইনা বনহুর! এই নাও চাবী খুলে দাও ওর হাত পা এর বাধন। কিন্তু মনে রেখো এর পর যদি সে আমার পিছনে কোন মতলব আটে তা হলে রক্ষা পাবেনা।
হাসলো বনহুর, তারপর বললো–তুমি আর সে সুযোগ পাবেনা হেমাঙ্গিনী। আমি তোমাকে বন্দী করেছি, তোমার সাহায্য কারীরা কেউ জীবিত নেই।
না, তারা দুঃসাহসী…….
কিন্তু আমি তাদের সবাইকে পৃথিবী থেকে বিদায় করেছি। হাঁ, দুঃখ যে আমার হয়নি তা নয়। তোমার নির্মম কাজে তোমাকে সাহায্য করার জন্যই তাদের এই পরিণতি। আমি সুস্থ শান্ত মস্তিষ্কে এদের হত্যা করেছি। এদের লাশ তোমার তৃতীয় গুহায় স্তূপ করে রেখে তোমার সন্ধানে এসেছি। আমার আগ্নেয় অস্ত্রের শ শুনতে পাওনি কারণ আমার অস্ত্রটি ছিলো শব্দ বিহীন।
বনহুর এ কাজটা তুমি ভাল করেনি। তোমার আচরণে খুশি হবো ভেবেছিলাম কিন্তু সব তুমি বিনষ্ট করে দিলে। হৃদয়হীন তুমি এই মুহূর্তে আমি তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিতাম, হারাকে হত্যা করে তুমি আমার শত্রু হয়েছো না না তোমাকে আমি জীবিত রাখতে পারিনা। অধর দংশন করে হেমাঙ্গিনী।
ততক্ষণে বনহুর অনাথ সেনকে মুক্ত করে দিয়েছে।
বলে বনহুর–অনাথ সেন আপনি এবার যেতে পারেন। আপনার পথ মুক্ত, রাণী হেমাঙ্গিনী বা তার কোন অনুচর আপনার পথ রোধ করতে পারবে না।
অনাথ সেন হাত তুলে বললো–দস্যু সম্রাট আপনার চির মঙ্গল হোক।
হেমাঙ্গিনী বললো–বনহুর সবাইকে হত্যা করলেও আমাকে তুমি বন্দী করতে পারোনি-বা পারবে না।
বনহুর দৃঢ় গলায় বললো–কোন নারীর প্রতি আমার কোন নির্মম আচরণ করার ইচ্ছা নেই, সে কারণেই আমি তোমার উপর কঠিন আচরণ করিনি। তবে তুমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তা হলে আমি বাধ্য হবো……
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো হেমাঙ্গিনী। বনহুর আমি তোমার আচরণে মুগ্ধ বটে, তবে তোমার করুণার পাত্রী আমি নই। হামরাকে হত্যা করেছে, হত্যা করেছে আমার সঙ্গী সাথীদেরকে। আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি না। আমি যা বলি বা মনে করি তা আমি করবোই। আমার স্বর্ণ সিংহাসন আমি তোমার রক্তে রঞ্জিত করবোই এটা কেউ রোধ করতে পারবেনা।
আমার রক্তে তোমার স্বর্ণ সিংহাসন রঞ্জিত করবে সে তত বড় সুন্দর কথা। কিন্তু এক শর্তে আমি তোমাকে রক্ত দেবো সেটা হলো রাজা মঙ্গল সিংহকে তুমি আর হত্যার চেষ্টা করবেনা এবং রাজ কুমার বিজয় সিংহকে তুমি মুক্তি দেবে। এবার বলল হেমাঙ্গিনী আমার কথায় তুমি রাজি।
আনমনা হয়ে গেলো হেমাঙ্গিনী, মুখ মন্ডল ক্রমান্বয়ে ক্রোধান্ত হয়ে উঠলো। এবার বললো সে হিন্দলের একমাত্র সম্রাজ্ঞী আমি সবাই জানে মহারাজের মৃত্যু হয়েছে, এখন তাকে জীবিত বলে আমি স্বীকার করতে পারিনা বনহুর। রথীন্দ্রকে আমি হত্যা করবোই কারণ সে আমাকে ধোকা দিয়েছে। না, তাকে আমি ক্ষমা করবোনা……
বললো বনহুর–আমি বুঝতে পারছি রথীন্দ্ৰ তোমার আদেশ পালন করেনি।
হাঁ, সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড….
কিন্তু যে আদেশ তুমি তাকে দিয়েছিলে, তার জন্য তুমিও অপরাধী এবং তোমার দন্ড মৃত্যু।
বনহুর রাজা মঙ্গল সিংহ আমার যোগ্য স্বামী ছিলো না। তার মধ্যে ছিলোনা কোন প্রেম ভালবাসা একটা নারী কি চায় সে তা বুঝতোনা। পূর্বস্ত্রীর স্মৃতি মন্থন করে সে বেঁচেছিলো বা আছে। তাই তাকে আমি সহ্য করতে পারিনি কোন দিন। বনহুর আমার জীবন কাহিনী শুনলে তুমি বুঝবে, কেন আমি এত নির্মম হয়েছি।
বললো বনহুর–অনাথ সেনকে মুক্ত করে বিদায় দিয়েছি এখন বলতে পারো তোমার জীবন কাহিনী, তবে শুনে বা বলে কোন ফল হবে কি?