হেমাঙ্গিনীর কথা শেষ না হতেই তার হাত থেকে খসে পড়ে পিস্তল খানা। একটা গুলি এসে বিদ্ধ হলো হেমাঙ্গিনীর হাতের মুঠায়। যন্ত্রণায় তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো সে।
হেমাঙ্গিনী হাত খানা চেপে ধরে ফিরে তাকিয়েই অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো–বনহুর তুমি!
হাঁ, আমি।
কে তোমাকে পথ দেখিয়ে এই স্থানে নিয়ে এলো?
অনাথ সেনের কুকুর ভোলা, যার দ্বারায় তুমি আমার কাছে চিঠি পাঠিয়ে ছিলে।
ওঃ ভোলা তাহলে বেঈমানী করেছো আমার সঙ্গে। হেমাঙ্গিনী উবু হয়ে তার হাত থেকে খসে পড়া পিস্তল খানা বাম হস্তে তুলে নেবার চেষ্টা করতেই বনহুর পা দিয়ে পিস্তল খানা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারপর বললো–পারলেনা হেমাঙ্গিনী অনাথ সেনকে পরপারে পাঠাতে পারলেনা হিন্দল রাজ বংশকে নির্মূল করতে। অনাথ সেন কোন পাপ করেনি কাজেই তার প্রতি তোমার হিংসা কার্যকরি হবেনা।
বনহুর তুমি যতই তেজদ্বীপ্ত পুরুষ হওনা কেন এখানে একবার প্রবেশ করেছে আর বেরুবার পথ পাবেনা।
বলল বনহুর–তাই নাকি।
অনাথ সেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো, সে ভাবতেও পারেনি এ ভাবে ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়ে নেবেন। এবার বললো অনাথ সেন-দস্যু সম্রাট আপনি এই মুহূর্তে না এলে আমার মৃত্যু অনিবার্য ছিলো। আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে দিবো। আমাকে এই রাক্ষসীর কবল থেকে রক্ষা করুন দস্যু সম্রাট।
কেউ পারবেনা আমার কবল থেকে তোমাকে রক্ষা করতে।
অট্টহাসি হাসলো বনহুর–তুমিই রক্ষা পাবেনা হেমাঙ্গিনী। তোমার অনুচরগণ আমার হাতে বন্দী এবং তুমিও!
না, আমি বিশ্বাস করিনা…
তোমার সহকারী এবং অনুচরগণকে বন্দী করতে আমার এতে বিলম্ব হলো, আর সেই সুযোগে তুমি অনাথ মুখ খানা বিকৃত করে ফেলছিলো।
বনহুর বললো–হেমাঙ্গিনী তুমি তোমার চিঠিতে লিখেছিলে একদিন তুমি আমাকে ভালবেসে ছিলে তাই তোমার অপরাধ এ মুহর্তে ক্ষমা করে দিলাম, নইলে তোমাকে হত্যা করতে আমার কিছু মাত্র বেগ পেতে হতোনা। হাতে গুলি বিদ্ধ না করে তোমার শরীরে বিদ্ধহত আমার এই গুলিটি। যা হোক যে ভাবেই আমি এখনে এসেছি সেই ভাবেই আমি বেরিয়ে যেতে পারবো।
পারবে না বনহুর, আমার এই দুর্গম গুহা থেকে বেরিয়ে যাবার কারো সাধ্য নাই..
বেরিয়ে যায় এই তো? এসো তোমার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেই। কারণ যে ভাবে তোমার হাত থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে তাতে তোমার জীবন হানিও ঘটতে পারে। তোমাকে এতো সহজে মরতে দিতে পারিনা কারণ তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত এতো সহজ নয়।
বনহুর হেমাঙ্গিনীর ওড়নাটা একটানে কেড়ে নিয়ে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো ভাল করে। তারপর বললো–অনাথ সেনকে মুক্ত করে দাও হেমাঙ্গিনী কারণ সে সম্পূর্ণ নির্দোষ।
না, অনাথ সেনই সব নষ্টের মূল।
মিথ্যা কথা। হেমাঙ্গিনী তুমি জানোনা বিজয় সিংহকে হত্যা করেও তুমি হিন্দল রাজ বংশ সমূলে নির্মূল করতে পারবেনা। কারণ রাজা মঙ্গল সিংহ এখনও জীবিত…….
মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে উঠলো হেমাঙ্গিনীর মুখ মন্ডল, তারপরই হাসবার চেষ্টা করে বললো—আমাকে মিথ্যা ধোকা দিওনা বনহুর।
মিথ্যা নয় সত্য এবং যাকে তুমি তোমার স্বামীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলো সে সেদিন রাজা মঙ্গল সিংহকে হত্যা না করে তাকে এক গোপন স্থানে সরিয়ে রাখে এবং সেখানেই তাকে দিনান্তে এক মুঠি খাদ্য দিয়ে আসে….এই ভাবে সুদীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে আছেন তোমার স্বামী।
আমি-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার কথা বনহুর।
না পারলেও, বুঝতে কষ্ট হচ্ছেনা তোমার, কারণ তোমার স্বামী জীবিত। কাজেই বিজয় সিংহকে হত্যা করে কোনই ফল হবেনা তোমার, এ কথা তোমার জানা না থাকলেও আমি জানি।
আমি বিশ্বাস করি না।
রথীন্দ্রকে তুমি স্বামী হত্যার দায়িত্ব দাওনি বলতে চাও?
তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলতে চাইনা। হাঁ, আমার স্বামী রাজা মঙ্গল সিংহ আমার যোগ্য স্বামী ছিলোনা তাই আমি তাকে সরিয়ে দিয়েছি।
তুমি মানবী দেবী না রাক্ষসী? স্বামীকে যে নারী হত্যা করে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়-সে নিশ্চয়ই রাক্ষসী…।
হাঁ রাণী হেমাঙ্গিনী রাক্ষসীই বটে। তোমার রক্তে আমার স্বর্ণ সিংহাসন ধৌত করবো তারপর আমি তাকে উপবেশন করবো।
চমৎকার। সেদিন ধন্য হবে আমার রক্ত কণিকা। হেমাঙ্গিনী তোমার হাতের ব্যথাটা কি ভয়ংকর কষ্ট দিচ্ছে তোমাকে?
ঠাট্টা করছে বনহুর। আমার দক্ষিণ হস্তে আঘাত করে তুমি ভাল করোনি। জানোতত আমাকে খাইয়ে দেবার কেউ নেই। সবাই আমাকে ভয় করে কিন্তু ভালবাসার আভাস কারো মধ্যে নেই। অনাথ সেন বড় নিমক হারামী, রথীন্দ্র বিশ্বাস ঘাতক, বিজয় সিংহ বিমাতা বলে ঘৃণার চোখে দেখে, জানিনা আমার অনুচরগণ আমাকে কেমন চোখে দেখে। বনহুর ভালবাসা আমি পাইনি কারো কাছে, যদি আমার জীবন কাহিনী শুনতে তাহলে তোমার লৌহ হৃদয় গলে যেতে বরফ গলা নদীর মত।
হেমাঙ্গিনী কথা বলছিলো পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে। দক্ষিণ হস্ত খানাকে ধরে রেখেছিলো বাম হস্তে শক্ত করে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে যন্ত্রণায় মুখ খানা তার করুণ হয়ে উঠছিলো, হয় তো পিস্তল খানা নাগালের মধ্যে পেলে বনহুরকে লক্ষ্য করে বাম হস্তেই গুলি ছুঁড়তো কিন্তু উপায় হীনা সে। তা ছাড়া বনহুরের কোমরের বেল্টে জমকালো রিভলভার রক্ষিত আছে, যার গুলিতে হেমাঙ্গিনীর দক্ষিণ হস্ত অকেজো হয়েছে।