- বইয়ের নামঃ দস্যু বনহুর সমগ্র
- লেখকের নামঃ রোমেনা আফাজ
- প্রকাশনাঃ সালমা বুক ডিপো
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.০১ দস্যু বনহুর
০১.
দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান। পথে-ঘাটে-মাঠে শুধু ঐ এক কথা-দস্যু বনহুর–দস্যু বনহুর! কখন যে কোথায় কার ওপর হানা দিয়ে বসবে কে জানে!
ধনীরা তো সব সময় আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ভয়ই বেশি। দস্যু বনহুরের জন্য কারও মনে শান্তি নেই। দস্যু বনহুর যে কে, কেমন তার আসল রূপ, তা কেউ জানে না। কোথা থেকে আসে সে, কোথায় চলে যায়, তাও কেউ বুঝতে পারে না। গভীর রাতে জমকালো একটা অশ্বপৃষ্ঠে দেখা যায় তাকে। গোটা শরীরে তার কালো পোশাক। মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি। মুখে একটা কালো রুমাল জড়ানো। কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভালবার। বিশেষতঃ অন্ধকার রাতেই বনহুর হানা দেয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পথে-ঘাটে-মাঠে সব জায়গায় হয় তার আবির্ভাব।
বনহুরের নামে মানুষ যতই আতঙ্কিত হউক না কেন, আদতে বনহুর ছিল অত্যন্ত সুন্দর সুপুরুষ। মনও ছিল তার উদার—মহৎ। দস্যুবৃত্তি বনহুরের পেশা নয়—নেশা। খেয়ালের বশে সে দস্যুতা করত। দস্যুতায় বনহুর আনন্দ পেত।
হয়তো এক ধনীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে বিলিয়ে দিত,সে দীন-হীন গরীবদের মধ্যে। নয় ফেলে দিত সাগরের জলে। অদ্ভুত ছিল বনহুরের চালচলন। বনহুরের প্রাণ ছিল যেমন কোমল, তেমনি কঠিন।
বনহুরের সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার অশ্ব তাজ। যেখানে যেত বনহুর, তাজ হত তার সঙ্গী। নিজ হাতে সে তাজকে ছো্লা খাওয়াতো, গা ঘষে দিত, এমন কি তাজ যখন ঘাস খেত, বনহুর পাশে বশে খেত রুটি আর মাংস। মাঠে যখন চরতো, বনহুর বসে থাকতো তার পাশে। হয়ত শিস দিয়ে খাস খাওয়াতো।
তাজও তেমনি ভালবাসতো বনহুরকে। বনহুরের ইঙ্গিত তাজ বুঝতো। তাজ ছিল অত্যন্ত চালাক ও বুদ্ধিমান অশ্ব। তার গতিও ছিল উল্কার মত দ্রুত। অন্ধকারেও তাজ কোনদিন পথ হারাতো না।
দস্যুতা করতে গিয়ে অনেক সময় বনহুর তাজকে বাইরে রেখে প্রবেশ করতো অন্দরবাড়িতে। হয়ত ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বনহুকে অন্য পথে প্রাচীর টপকে পালাতে হত। বনহুর শুধু একটি শিস দিত, সঙ্গে সঙ্গে তাজ গিয়ে হাজির হত তার পাশে। বনহুর প্রাচীরের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে তাজের পিঠে। তারপর আর কে পায় তাকে!
তাজের লাগাম ছিল না! বনহুর তাজের কাঁধের কেশ ধরে উবু হয়ে থাকে, তাজ ছুটতো হাওয়ার বেগে।
০২.
তাজের পিঠে ছুটে চলেছে বনহুর।
প্রান্তরের বুক চিরে গহন বনে প্রবেশ করলো বনহুরের অশ্ব। এবার তার গতি কিছুটা মন্থর হয়ে এলো। গহন বনের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ ধরে ছুটতে লাগলো তাজ। ভোরের আলো তখন গহন বনকে অনেকটা হাল্কা করে এনেছে।
বনের মধ্যে বহুকালের পুরানো এক রাজপ্রাসাদ। কালের কঠোর নিষ্পেষণে আজ সে প্রাসাদ শুধু ইটের স্তুপে পরিণত হয়েছে। এককালে সেখানে যে বিরাট এক রাজবাড়ি ছিল অনুমানে তা বুঝা যায়। আজ সে প্রাসাদের গায়ে বিরাট বিরাট অশ্বথ বৃক্ষ জন্মেছে। আগাছায় ভরে উঠেছে প্রাসাদের অন্তপুর। সেটা যেন ঐ ভগ্নপ্রাসাদের নিকটে এসে আরও ঘন হয়েছে।
বনটা ছিল শহর ছেড়ে অনেক দূরে। তাই কোন লোকজন এ বনে কোনদিন প্রবেশ করত না। শিকারীরা মাঝে মাঝে শিকারে আসত বটে, কিন্তু তারা বনের খুব ভিতরে প্রবেশ করার সাহস পেত না। কাজেই ভগ্নপ্রাসাদটি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সেই ভগ্নপ্রাসাদের সম্মুখে এসে বনহুরের অশ্ব থেমে ছিল। লাফিয়ে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন লোক এসে তাজকে ধরল। বনহুর ভগ্নপ্রাসাদের একটা দরজা লক্ষ্য করে এগুতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করল বনহুর, অমনি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে তখন দেখলে মনে হবে, যেন একটা পাথরখণ্ড বা একটা মরচে ধরা লৌহপাত।
বনহুর দরজার ওপাশে পৌঁছতেই দু’জন সশস্ত্র দস্যু সসম্মানে সরে দাঁড়ালো।
বাইরে থেকে রাজপ্রাসাদটাকে ভগ্নস্তুপ বলে মনে হলেও আদতে ভিতরটা তার ভগ্নস্তুপ ছিল না। সুন্দর ঝকঝকে একটা রাজবাড়ি বলেই মনে হত। বাড়ির ভিতরের পথগুলো সাদা মার্বেল পাথরে গাঁথা। উঠানে সুন্দর সুন্দর ফোয়ারা, তার চারপাশে ফুলের বাগান।
বনহুর সে পথ ধরে সোজা এগিয়ে চলল। কিছুদূর এগুতেই সম্মুখে বিরাট বাঘের মুখের আকারে পাথরের মুখ হা করে রয়েছে। বনহুর বাঘের একটা দাঁতে পা দিয়ে চাপ দিতেই বাঘের জিভটা ভিতরে ঢুকে গেল, সেখানে দেখা গেল একটা সুড়ঙ্গ পথ, সে সুড়ঙ্গপথে দ্রুত এগিয়ে চলল সে।
মাটির নিচে রাজপ্রাসাদের মত আর একটা বাড়ি। পাশাপাশি কয়েকটা কক্ষ। প্রত্যেক কক্ষে বেলওয়ারী ঝাড় ঝুলছে। ঝাড়ের মধ্যে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে।
মাঝখানের বড় একটা কক্ষে এক বৃদ্ধ শায়িত। শয্যাশায়িত ব্যক্তি যদিও বৃদ্ধ, তবু তার চেহারা বলিষ্ঠ। মস্তবড় গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মানে বালা। হাতে বালা। লোকটা অসুস্থ, মাঝে মাঝে সে কোকিয়ে ছিল। চোখের রঙ ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মাংসপেশীগুলো যদিও শিথিল হয়ে এসেছে, তবু দেখলে বুঝা যায়, এককালে তার শরীরে ছিল অসীম শক্তি। শয্যাশায়িত বৃদ্ধ দস্যু কালু খাঁ।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করলো।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো কালুখা–কে, বনহুর?