একজন প্রসিদ্ধ শিল্পসমালোচক বাংলার এই যুগের শিল্প-বিবর্ত্তন সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দের শিল্পের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করিয়াছেন। তাঁহার মতে নবম শতাব্দে দেহের কমনীয়তা, সুডৌল গঠন ও শান্ত সমাহিত মুখশ্রী; দশমে শক্তিব্যঞ্জক দৃঢ় বলিষ্ঠ দেহ; একাদশে ক্ষীণ তনু, সুকোমল ভাবপ্রবণতা, মুখমণ্ডলের অপার্থিব দিব্যভাব ও দেহের ঊৰ্দ্ধভাগের লাবণ্য ও সুষমা; এবং দ্বাদশে ভাবব্যঞ্জনাহীন মুখশ্রী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কৃত্রিম আড়ষ্টতা ও বসন ভূষণের প্রাচুর্য্য;-ইহাই এই চারি যুগের বাংলার শিল্পের প্রধান লক্ষণ। নিছক শিল্পের হিসাবে বাংলার মূর্ত্তিগুলিকে মোটামুটি এইরূপভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা সম্ভবপর, কিন্তু এই চারিটি শ্রেণী যে পর পর চারিটি শব্দের প্রতীক, এই মত গ্রহণ করা কঠিন। পূর্ব্বোক্ত গোবিন্দচন্দ্র ও তৃতীয় গোপালের সময়কার মূর্ত্তির তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে। প্রথম মহীপাল ও গোবিন্দচন্দ্র সমসাময়িক। কিন্তু এই দুই রাজার নামাঙ্কিত লিপিযুক্ত দুইটি বিষ্ণুমূর্ত্তি উপরি-উক্ত শ্রেণীবিভাগে এক পর্যায়ে পড়ে না।
কালানুযায়ী বিশ্লেষণ সম্ভবপর না হইলেও, পালযুগের শিল্প সম্বন্ধে সাধারণভাবে কয়েকটি সিদ্ধান্ত করা যায়। শিল্পীগণ পাথরের বা ধাতুর উপর খোদাই করিতে যে অসাধারণ দক্ষতা লাভ করিয়াছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। লতা, পাতা, জীব, জন্তু ও নানারূপ নকশার কাজ অনেক মূর্ত্তিতে এমন নিপুণ ও সূক্ষ্মভাবে সম্পাদিত হইয়াছে যে, বহুবর্ষব্যাপী শিক্ষা ও সাধনা এবং পুরুষানুক্রমিক অভ্যাস ব্যতীত ইহা কদাচ সম্ভবপর হইত না। এই যুগের মূৰ্ত্তিগুলি যত্নপূৰ্ব্বক পরীক্ষা করিলে বাংলার লুপ্ত চারুশিল্প সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায় এবং বাংলা দেশে যে অন্তত পাঁচ-ছয়শত বৎসর একটি জীবন্ত ও উচ্চাঙ্গের শিল্পধারা অব্যাহতভাবে প্রবাহিত ছিল, ইহাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।
মনুষ্যমূর্ত্তিগঠনই ভাস্কৰ্য্যশিল্পের উৎকর্ষের সর্বশ্রেষ্ট পরিচয় ও প্রমাণ। বাংলার শিল্পী এ বিষয়ে কতটা সফলতা লাভ করিয়াছিল, তাঁহার বিচার করিতে হইলে বাংলার দেব-দেবীমূৰ্ত্তিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। ধর্ম্মপ্রাণ ব্যক্তির নিকট দেব-দেবীর মূৰ্ত্তি মাত্রেই সুন্দর। রাধাকৃষ্ণের নামসম্বলিত কবিতা ও সংগীত মাত্রেই যেমন একশ্রেণীর লোককে মুগ্ধ করে, দেব-দেবীর যেকোনো চিত্র বা মূৰ্ত্তিই তেমনি অনেকের নিকট অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যের আকর বলিয়া প্রতীয়মান হয়; এমনকি কালীঘাটের পটের ছবিও কেহ কেহ উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু ইহা ভক্তের দৃষ্টি, শিল্পের অনুভূতি নহে। শিল্পের প্রকৃত বিচার করিতে হইলে, তাহা কেবল ভাব ও সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তির দিক দিয়াই করিতে হইবে। দেব-দেবীর মূর্ত্তিই যে আমাদের অতীত ভাস্কৰ্য্যশিল্পের একমাত্র নিদর্শন, ইহা এই শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস জানিবার একটি অন্তরায়। কিন্তু এই অন্তরায় অগ্রাহ্য বা অস্বীকার না করিয়া ইহার সাহায্যেই যত দূর সম্ভব শিল্পের পরিচয় দিতে হইবে। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও দেব-দেবীর মূর্ত্তির মধ্য দিয়েই শিল্পের বিকাশ হইয়াছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপীয় শিল্পীগণও দেব-দেবীর মূৰ্ত্তির মধ্য দিয়াই অনবদ্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করিয়া জগতে অমরত্ব লাভ করিয়াছেন। প্রাচীনযুগের ‘ভেনাস ডি মিলো এবং মধ্যযুগের র্যাফেল ও টিসিয়ান অঙ্কিত ম্যাডোনা ও ভেনাসের মূর্ত্তি দেবীরূপে কল্পিত হইলেও, ভাব ও সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তির জন্যই ইহা শিল্পজগতে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে।
সারনাথে গুপ্তযুগের যে সমুদয় মূর্ত্তি আছে, পালযুগের শিল্পে তাঁহার প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে অনেক গুরুতর প্রভেদ আছে। প্রথমত, গুপ্তযুগের সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গীর পরিবর্তে বাংলার মূর্ত্তিগুলির কতকটা আড়ষ্টভাব ও জড়তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। দ্বিতীয়ত, গুপ্তযুগের মূর্ত্তিতে একটি আত্মনিহিত অতীন্দ্রিয় ভাবের অভিব্যক্তিই শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য, দেহের সুষমা ও লাবণ্য অপ্রধান ও এই ভাবেরই দ্যোতক মাত্র। বাংলার মূর্ত্তিগুলিতে এই আধ্যাত্মিক ভাব অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দ ও ভোগের ছবিই যেন বেশী করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। একের আদর্শ শান্ত-সমাহিত অন্তদৃষ্টি, অন্যের আদর্শ কান্ত ও কমনীয় বাহ্য রূপ। বাংলার মূর্ত্তিতে যে আধ্যাত্মিক ভাবের বিকাশ নাই তাহা নহে, কিন্তু তাঁহার প্রকাশভঙ্গীতে সাধারণত অন্তরের সংযম অপেক্ষা ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাসই বেশী বলিয়া মনে হয়। তবে পালযুগের শ্রেষ্ঠ মূর্ত্তিগুলিতে এই দুই আদর্শের সমন্বয় দেখিতে পাওয়া যায়। এই মূর্ত্তিগুলি “কোমল অথচ সংযত, ভাবপ্রবণ অথচ ধ্যানস্থ, লীলায়িত অথচ দৃঢ়প্রতিষ্ঠ।” বাংলার শিল্প গুপ্তযুগের শিল্পের অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইলেও, সমসাময়িক পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের শিল্প অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কারণ এই সমুদয় শিল্পে সাধারণত গুপ্তযুগের আধ্যাত্মিক ভাব এবং পালযুগের সৌন্দর্য্য ও লাবণ্য উভয়েরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে মধ্যযুগের এই মূর্ত্তিগুলি প্রাণহীন ও অসুন্দর, এবং ধর্ম্মমত ও ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের পাষাণময় রূপ ব্যতীত শিল্প হিসাবে ইহার বিশেষ কোনো সার্থকতা নাই। অবশ্য কদাচিৎ এই সমুদয় অঞ্চলেও সুন্দর মূর্ত্তি দেখা যায়,-দৃষ্টান্ত স্বরূপ এলিফান্টা দ্বীপের মূর্ত্তিগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণত এই সমুদয় দেশে মধ্যযুগের মূর্ত্তিগুলি শ্রীহীন। কেবল বিহারে ও উড়িষ্যায় বাংলার ন্যায় সৌন্দর্য্যের আদর্শ শিল্পে বর্ত্তমান দেখা যায়। বাংলার পালযুগের শিল্পের প্রভাব এই দুই প্রদেশে এমনকি যবদ্বীপ ও পূৰ্ব্ব ও ভারতীয় অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে বিস্তৃত হইয়াছিল।