০. প্রসঙ্গকথা / ভূমিকা

 

বাংলা দেশের ইতিহাস – দ্বিতীয় খণ্ড (মধ্যযুগ]
ভারততত্ত্ব-ভাস্কর শ্ৰীরমেশচন্দ্র মজুমদার এম-এ, পিএই-ডি, ডি-লিট্‌ সম্পাদিত

.

প্রসঙ্গকথা (বর্তমান সংস্করণ)

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি গৌড়রাজমালা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R. C. Majumdar) The History of Bengal Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।

এই গ্রন্থ রচনায় রমেশচন্দ্র মজুমদার একজন মেধাবি ঐতিহাসিকের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থ তিনি টিকা টিপ্পনির ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সহজবোধ্যভাবে যেন পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। অথচ তারপরেও নানা তথ্যে সমৃদ্ধ একটি অভিজাত ইতিহাস গ্রন্থই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।

আমরা দেখেছি বিশ শতক পর্যন্ত কালপরিসরের মধ্যে অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের প্রয়াস ছাড়া প্রায় সকল ইতিহাস গ্রন্থই রাজনৈতিক ইতিহাসে আটকে ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চ্চা তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। এর বড় কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার মত তথ্য সূত্রের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসূত্র অনুসন্ধানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নতুন করে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে।

অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সূত্র-সংকটের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। তাই তাঁর গ্রন্থে (বাংলাদেশের ইতিহাস) অত্যন্ত সার্থকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্পষ্টভাবেই।

ইতিহাসে একটি কথা রয়েছে যে ইতিহাস বা ইতিহাসের ঘটনা বার বার ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো বলা হয় ইতিহাসে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। শেষ সত্যে পৌঁছা যায় না, তবে নতুন নতুন তথ্যে বার বার সংস্কার করে সত্যের দিকে এগিয়ে চলা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তখন প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিজ মেধা প্রয়োগ করে তিনি অনেক বাধাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

একারণেই তাঁর গ্রন্থে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিল্পকলা সকল কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ। একজন ইতিহাস পাঠককে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানানোর জন্য যেভাবে সূচি বিন্যাস করা দরকার তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছেন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন বাংলাদেশের সাথে। নৃতাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ ধারা উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম আলোচনায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শাসকদের শাসনকালের বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার।

আমরা বলতেই পারি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশেষ করে শিল্প ইতিহাস রচনার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার তার গ্রন্থের শেষ পর্বে।

অবশ্য ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ পাঠ করা সমালোচকদের অভিযোগ রয়েছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। কারণ তিনি হিন্দুদের পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই ম্লেচ্ছ ও যবন বলে অভিহিত করেছেন তাঁর গ্রন্থে। কোনো কোনো জায়গায় ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণে কিছুটা একদেশদর্শিতার সংকট রয়েছে। অবশ্য বঙ্গভঙ্গোত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল তাতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির মুসলমান ও একই ধারার হিন্দু-অবস্থান পুরুষানুক্রমে টিকে ছিল। আর. সি. মজুমদারের ইতিহাস চর্চ্চা কখনো কখনো খুব সীমিতভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে এড়াতে পারেনি। পাঠক যদি সময়ের বাস্তবতা মেনে পাঠ করেন তবে খুব একটা অস্বস্তিতে পরতে হবে না।

এ কথাটি ঠিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যখন গবেষণা করেন তখন প্রত্নউপাদানের অনেকটাই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই কোনো কোনো ঘটনা বা সন তারিখ সচেতন মানুষের কাছে ভুল মনে হতে পারে। যেমন তিনি বখতিয়ার খলজির নদীয়া আক্রমণের তারিখ ১২০২ বলেছিলেন। এই তারিখ নিয়ে দীর্ঘকাল পর্যন্ত গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল। প্রায় আড়াই দশক আগে আমরা বখতিয়ার খলজির মুদ্রা শনাক্ত করতে পারি। আর মুদ্রা উত্তীর্ণের তারিখ যাচাই করে বলতে পারি নদীয়া আক্রমণের তারিখটি ছিল ১২০৪। ইতিহাস লিখনের এটিই রীতি। এভাবেই যুগে যুগে সংশোধিত হয় প্রাপ্ত নতুন উপাদান ব্যবহার করে। তাই ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে এজাতীয় তথ্য ভুল না ভেবে নির্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্ত বলে মানতে হবে।

পাশাপাশি বখতিয়ার খলজি (ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি) প্রসঙ্গে বর্তমান গ্রন্থটিতে আরেকটি বিশ্লেষণ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত প্রকৃত ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করছে। ইতিহাসের একটি ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন থেকে আমরা বহন করে আসছিলাম। আর তা হচ্ছে বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়। ১৯৯৬-এ এনসিটিবির পাঠ্য বই, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বই ইত্যাদিতে সংস্কার করে আমরা লিখছি বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল বঙ্গ’ নয় নদীয়া ও লখনৌতি। অর্থাৎ প্রাচীন জনপদ বঙ্গে’র সীমানায় বখতিয়ার প্রবেশ করেননি। আবার বখতিয়ারের অনেক পরে মানচিত্রে বাংলা বা বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ড চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৩৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুরো বাংলাকে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর। সুতরাং বখতিয়ার প্রকৃত অর্থে বাংলা বা বঙ্গ বিজেতা নন। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের দ্বারোঘাটন করেছিলেন মাত্র। অথচ অত আগে প্রত্নসূত্র না থাকলেও নিজ প্রজ্ঞা দিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ইতিহাসের সত্যটিই উপস্থিত করেছিলেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বর্তমান গ্রন্থের পাঠক মাত্রই ড. মজুমদারের অমন পাণ্ডিত্যের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হবেন।

মুদ্রণ না থাকায় এই অসাধারণ গ্রন্থটি দীর্ঘকাল সহজলভ্য ছিল না। দিব্যপ্রকাশ ধ্রুপদী ইতিহাস গ্রন্থ পুণঃমুদ্রণ করে, অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করায় একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলো। দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার প্রীতিভাজন সুলেখক মঈনুল আহসান সাবের যখন প্রকাশের পূর্বে এই বইখানির একটি ভূমিকা লিখে দিতে বললেন, তখন আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিকের গ্রন্থের ভূমিকা লেখা আমার মত অর্ব্বাচীনের সাজে না। কিন্তু সাবের ভাইয়ের অনুরোধ ফেলা মুশকিল। তাই ভূমিকা নয়–গ্রন্থ প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলার সুযোগটুকু নিলাম।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
অধ্যাপক
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

.

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

মালদহ-নিবাসী রজনীকান্ত চক্রবর্তী সর্বপ্রথমে বাংলা ভাষায় বাংলা দেশের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু তৎপ্রণীত ‘গৌড়ের ইতিহাস’ সেকালে খুব মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইলেও ইহা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত ইতিহাস বলিয়া গণ্য করা যায় না। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ও ১৩২৪ সনে প্রকাশিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস–দ্বিতীয় ভাগ’ এই শ্রেণীর প্রথম গ্রন্থ। ইহার ৩১ বৎসর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ইংরেজী ভাষার মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস প্রবীণ ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় (History of Bengal, Volume II, 1948)। কিন্তু এই দুইখানি গ্রন্থেই কেবল রাজনীতিক ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। রাখালদাসের গ্রন্থে “চৈতন্যদেব ও গৌড়ীয় সাহিত্য’ নামে একটি পরিচ্ছেদ আছে, কিন্তু অন্যান্য সকল পরিচ্ছেদেই কেবল রাজনীতিক ইতিহাসই আলোচিত হইয়াছে। শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায় ‘বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ)’ নামে একটি ইতিহাসগ্রস্ত লিখিয়াছেন। কিন্তু এই গ্রন্থখানিও প্রধানত রাজনীতিক ইতিহাস।

একুশ বৎসর পূর্বে মৎসম্পাদিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস প্রথম ভাগ (History of Bengal Vol. I. 1943) অবলম্বনে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিয়াছিলাম। ইংরেজী বইয়ের অনুকরণে এই বাংলা গ্রন্থেও রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়বিধ ইতিহাসের আলোচনা ছিল। এই গ্রন্থের এ যাবৎচারিটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা এই শ্রেণীর ইতিহাসের জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা সূচিত করে–এই ধারণার বশবর্তী হইয়া আমার পরম স্নেহাস্পদ ভূতপূর্ব ছাত্র এবং পূর্ব্বোক্ত বাংলা দেশের ইতিহাসের প্রকাশক শ্রীমান সুরেশচন্দ্র দাস, এম. এ. আমাকে একখানি পূর্ণাঙ্গ মধ্যযুগের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিতে অনুরোধ করে। কিন্তু এই গ্রন্থ লেখা অধিকতর দুরূহ মনে করিয়া আমি নিবৃত্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস-প্রথম ভাগে রাজনীতিক ও সামাজিক ইতিহাস উভয়ই আলোচিত হইয়াছিল –সুতরাং মোটামুটি ঐতিহাসিক উপকরণগুলি সকলই সহজলভ্য ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের রাজনীতিক ইতিহাস থাকিলেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এ যাবৎ লিখিত হয় নাই। অতএব তাহা আগাগোড়াই নূতন করিয়া অনুশীলন করিতে হইবে। আমার পক্ষে বৃদ্ধ বয়সে এইরূপ শ্রমসাধ্য কার্যে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিযুক্ত নহে বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিলাম। কিন্তু শ্রীমান সুরেশের নির্বন্ধাতিশয্যে এবং দুইজন সহযোগী সাগ্রহে আংশিক দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আমি এই কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি। একজন আমার ভূতপূর্ব ছাত্র অধ্যাপক শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায়। ইহাদের সহায়তার জন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।

বর্তমানকালে বাংলা দেশের–তথা ভারতের–মধ্যযুগের সংস্কৃতি বা সমাজের ইতিহাস লেখা খুবই কঠিন। কারণ এ বিষয়ে নানা প্রকার বদ্ধমূল ধারণা ও সংস্কারের প্রভাবে ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধি করা দুঃসাধ্য হইয়াছে। এই শতকের গোড়ার দিকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে যাহাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই যোগদান করে, সেই উদ্দেশ্যে হিন্দু রাজনীতিকেরা হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে কতকগুলি সম্পূর্ণ নূতন “তথ্য প্রচার করিয়াছেন। গত ৫০/৬০ বৎসর যাবৎ ইহাদের পুনঃপুনঃ প্রচারের ফলে এ বিষয়ে কতকগুলি বাঁধা গৎ বা বুলি অনেকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। ইহার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা গুরুতর–অথচ ঐতিহাসিক সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত-ত্রয়োদশ অধ্যায়ের-হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সম্বন্ধ অংশে আলোচনা করিয়াছি। ইহার সারমর্ম এই যে ভারতের প্রাচীন হিন্দু-সংস্কৃতি লোপ পাইয়াছে এবং মধ্যযুগে মুসলিম সংস্কৃতির সহিত সমন্বয়ের ফলে এমন এক সম্পূর্ণ নূতন সংস্কৃতির আবির্ভাব হইয়াছে, যাহা হিন্দুও নহে মুসলমানও নহে। মুসলমানেরা অবশ্য ইহা স্বীকার করেন না এবং ইসলামীয় সংস্কৃতির ভিত্তির উপরই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত, ইহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু ভারতে হিন্দু-সংস্কৃতি’ এই কথাটি এবং ইহার অন্তর্নিহিত ভাবটি উল্লেখ করিলেই তাহা সংকীর্ণ অনুদার সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচায়ক বলিয়া গণ্য করা হয়। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা এই মতের সমর্থন করে কিনা তাঁহার কোনরূপ আলোচনা না করিয়াই কেবলমাত্র বর্তমান রাজনীতিক তাগিদে এই সব বুলি বা বাঁধা গৎ ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। একজন সর্বজনমান্য রাজনৈতিক নেতা বলিয়াছেন যে অ্যাংলো-স্যাকসন, জুট, ডেন ও নর্মান প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির মিলনে যেমন ইংরেজ জাতির উদ্ভব হইয়াছে, ঠিক সেইরূপে হিন্দু-মুসলমান একেবারে মিলিয়া (coalesced) একটি ভারতীয় জাতি গঠন করিয়াছে। আদর্শ হিসাবে ইহা যে সম্পূর্ণ কাম্য, তাহাতে সন্দেহ নাই-কিন্তু ইহা কতদূর ঐতিহাসিক সত্য, তাহা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই জন্যই এই প্রসঙ্গটি এই গ্রন্থে আলোচনা করিতে বাধ্য হইয়াছি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে বিচারের ফলে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তাহা অনেকেই হয়ত গ্রহণ করিবেন না। কিন্তু “বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ” একই নীতিবাক্য স্মরণ করিয়া আমি যাহা প্রকৃত সত্য বলিয়া বুঝিয়াছি, তাহা অসঙ্কোচে ব্যক্ত করিয়াছি। এই প্রসঙ্গে ৫১ বৎসর পূর্বে আচার্য যদুনাথ সরকার বর্ধমান সাহিত্য সম্মিলনের ইতিহাস-শাখার সভাপতির ভাষণে যাহা বলিয়াছিলেন, তাঁহার কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :

“সত্য প্রিয়ই হউক, আর অপ্রিয়ই হউক, সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরোধী হউক, তাহা ভাবিব না। আমার স্বদেশগৌরবকে আঘাত করুক আর না করুক, তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য, সমাজের বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উপহাস ও গঞ্জনা সহিতে হয়, সহিব। কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, গ্রহণ করিব। ইহাই ঐতিহাসিকের প্রতিজ্ঞা।”

এই আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহা অনেকেরই মনঃপূত হইবে না ইহা জানি। তাঁহাদের মধ্যে যাহারা ইহার ঐতিহাসিক সত্য স্বীকার করেন, তাঁহারাও বলিবেন যে এরূপ সত্য প্রচারে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও জাতীয় একীকরণের (National integration) বাধা জন্মিবে। একথা আমি মানি না। মধ্যযুগের ইতিহাস বিকৃত করিয়া কল্পিত হিন্দু-মুসলমানের ভ্ৰাতৃভাব ও উভয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের কথা প্রচার করিয়া বেড়াইলেই ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। সত্যের দৃঢ় প্রস্তরময় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা না করিয়া কাল্পনিক মনোহর কাহিনীর বালুকার স্তূপের উপর এইরূপ মিলন-সৌধ প্রস্তুত করিবার প্রয়াস যে কিরূপ ব্যর্থ হয় পাকিস্তান তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আমি যাহা লিখিয়াছি-রাজনীতিক দলের বাহিরে অনেকেই তাঁহার সমর্থন করেন–কিন্তু প্রকাশ্যে বলিতে সাহস করেন না। তবে সম্প্রতি ইহার একটি ব্যতিক্রম দেখিয়া সুখী হইয়াছি। এই গ্রন্থের যে অংশে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি তাহা মুদ্রিত হইবার পরে প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধ পড়িলাম। বড়বাবু’ নামক গ্রন্থে চারি মাস পূর্বে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যে কিরূপ নিষ্ঠার সহিত পরস্পরের সংস্কৃতির সহিত কোনও রূপ পরিচয় স্থাপন করিতে বিমুখ ছিল, আলী সাহেব তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গপ্রধান সরস রচনায় তাঁহার বর্ণনা করিয়াছেন। কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছিঃ

“ষড়দর্শননির্মাতা আর্য্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর সাত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুষ্পঠীতে দর্শনচর্চ্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লতনিজম্ তথা কিন্দী, ফারাবী বুআলীসিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গাজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবুরুশ (লাতিনে আভের) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চ্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো আরিস্ত তলের দর্শনচর্চ্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি এক বারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পঠীতে কিসের চর্চ্চা হচ্ছে। …এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ট বুআলীসিনার চিকিৎসাশাস্ত্র..আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করেছেন, সেই চরক সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ান হচ্ছে তারই সন্ধান তিনি পেলেন না।…পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।… শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন…কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্ম্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্ম্মের সংগঠন ও সংস্কার, এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।* [*এই গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে-ধর্ম ও সমাজ অংশে আমিও এই মত ব্যক্তি করিয়াছি।] …মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে বিশেষ করে মোগল আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক কণামাত্র লাভবান হন নি।…হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।’

সৈয়দ মুজতবা আলীর এই উক্তি আমি আমার মতের সমর্থক প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত করি নাই। কিন্তু একদিকে যেমন রাজনীতির প্রভাবে হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতির মধ্যে একটি কাল্পনিক মিলনক্ষেত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, তেমনি একজন মুসলমান সাহিত্যিকের মানসিক অনুভূতি যে ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করে ইহা দেখানই আমার উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক আলোচনার দ্বারা আমি যে সত্যের সন্ধান পাইয়াছি, তাহা রাজনীতিক বাঁধা বুলির অপেক্ষা এই সাহিত্যিক অনুভূতিরই বেশি সমর্থন করে। আমার মত যে অভ্রান্ত এ কথা বলি না। কিন্তু প্রচলিত মতই যে সত্য তাহাও স্বীকার করি না। বিষয়টি লইয়া নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে আলোচনা করা প্রয়োজন-এবং এই গ্রন্থে আমি কেবলমাত্র তাহাই চেষ্টা করিয়াছি। আচার্য যদুনাথ ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন তাহা অনুসরণ করিয়া চলিলে হয়ত প্রকৃত সত্যের সন্ধান মিলিবে। এই গ্রন্থ যদি সেই বিষয়ে সাহায্য করে তাহা হইলেই আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।

এই গ্রন্থের ‘শিল্প’ অধ্যায় প্রণয়নে শ্রীযুক্ত শ্রীঅমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রণীত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। তিনি অনেকগুলি ফটোও দিয়াছেন। এইজন্য তাঁহার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টও বহু ফটো দিয়াছেন–ইহার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। স্থানান্তরে কোন্ ফটোগুলি কাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত, তাঁহার উল্লেখ করিয়াছি।

মধ্যযুগের বাংলায় মুসলমানদের শিল্প সম্বন্ধে ঢাকা হইতে প্রকাশিত এ এ দানীর গ্রন্থ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। এই গ্রন্থে মুসলমানগণের বহুসংখ্যক সৌধের বিস্তৃত বিবরণ ও চিত্র আছে। হিন্দুদের শিল্প সম্বন্ধে এই শ্রেণীর কোন গ্রন্থ নাই–এবং হিন্দু মন্দিরগুলি চিত্র সহজলভ্য নহে। এই কারণে শিল্পের উৎকর্ষ হিসাবে মুসলমান সৌধগুলি অধিকতর মূল্যবান হইলেও হিন্দু মন্দিরের চিত্রগুলি বেশি সংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

পূর্বেই বলিয়াছি যে মধ্যযুগের বাংলার সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস ইতিপূর্বে লিখিত হয় নাই। সুতরাং আশা করি এ বিষয়ে এই প্রথম প্রয়াস বহু দোষত্রুটি সত্ত্বেও পাঠকদের সহানুভূতি লাভ করিবে।

মধ্যযুগের ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলিতে সাধারণত হিজরী অব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। পাঠকগণের সুবিধার জন্য এই অব্দগুলির সমকালীন খ্রীষ্টীয় অব্দের তারিখসমূহ পরিশিষ্টে দেওয়া হইয়াছে।

মধ্যযুগে বাংলা দেশে মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল পর্যন্ত কয়েকটি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে ত্রিপুরা এবং কোমতা-কোচবিহার এই দুই রাজ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক কালে এ দুয়েরই আয়তন বেশ বিস্তৃত ছিল। উভয় রাজ্যেই শাসন কার্যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইত এবং বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হইয়াছিল–হিন্দু ধর্ম্মের প্রাধান্যও অব্যাহত ছিল। ত্রিপুরার রাজকীয় মুদ্রায় বাংলা অক্ষরে রাজা ও রাণী এবং তাঁহাদের ইষ্ট দেবতার নাম লিখিত হইত। মধ্যযুগে হিন্দুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতীক স্বরূপ বাংলার ইতিহাসে এই দুই রাজ্যের বিশিষ্ট স্থান আছে। এই জন্য পরিশিষ্টে এই দুই রাজ্য সম্বন্ধে পৃথকভাবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়াছি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী কোচবিহারের ও ত্রিপুরার মুদ্রার বিবরণী ও চিত্র সংযোজন করিয়াছেন, এজন্য আমি তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।

শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন পাল রোড
কলিকাতা-২৬

.

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

এই সংস্করণে নবাবিষ্কৃত ত্রিপুরার কয়েকটি মুদ্রার বিবরণ সংযোজিত হইয়াছে। ত্রিপুরা সরকার একখানি নূতন পুঁথি হইতে ‘রাজমালার নূতন সংস্করণ প্রকাশিত করিয়াছেন। এই গ্রন্থখানি কলিকাতায় না পাওয়ায় ত্রিপুরা সরকারের নিকট ভি. পি. ডাকযোগে পাঠাইতে চিঠি লিখিয়াছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রন্থখানি তো দূরের কথা চিঠির উত্তরও পাই নাই। গ্রন্থখানি যথাসময়ে পাইলে ত্রিপুরা সম্বন্ধে হয়ত নূতন সংবাদ মিলিত। নিজের দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে এরূপ ঔদাসীন্য দুঃখের বিষয়।

ত্রিপুরার কয়েকটি নূতন মুদ্রার সাহায্যে ড. অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী পরিশিষ্টে ত্রিপুরারাজ্যের মুদ্রা সম্বন্ধে যে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন তাহা পূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয় নাই।

বর্তমান রাজনীতিক পরিস্থিতিতে এই গ্রন্থের নামকরণ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ১৯৪৫ সালে এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ–উভয়েরই ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। তখন হইতেই ইহার নাম “বাংলা দেশের ইতিহাস”। কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত এই নামের অর্থ তথা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কাহারও মনে কোন সন্দেহ বা কোন প্রশ্ন জাগিবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণ করায় গোলযোগের সৃষ্টি হইয়াছে। কেহ কেহ আমাদিগকে বর্তমান গ্রন্থের নাম পরিবর্তন করিতে অনুরোধ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নাই। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা আবশ্যক যে ইতিহাসের দিক হইতে পূর্ববঙ্গের “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণের কোন সমর্থন নাই। “বাংলা”র পূর্বরূপ “বাঙ্গালা” নাম মুসলমানদের দেওয়া-নামটি বাংলার একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম “বঙ্গাল” শব্দের অপভ্রংশ, ইহা “বঙ্গ” শব্দের মুসলমান রূপ নহে। মুসলমানেরা প্রথম হইতেই সমগ্র বঙ্গদেশকে মুলুক বাঙ্গালা বলিত। চতুর্দ্দশ শতাব্দী হইতেই “বাঙ্গালা” (Bangalah) শব্দটি গৌড় রাজ্য বা লখনৌতি রাজ্যের প্রতিশব্দরূপে বিভিন্ন সমসাময়িক মুসলিম গ্রন্থে (যেমন ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’) ব্যবহৃত হইয়াছে। পরে হিন্দুরাও দেশের এই নাম ব্যবহার করেন। পর্তুগীজরা যখন এদেশে আসেন তখন সমগ্র (পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ) বঙ্গদেশের এই ‘বাঙ্গালা’ নাম গ্রহণ করিয়া ইহাকে বলেন ‘Bengala’ পরে ইংরেজেরা ইহার ঈষৎ পরিবর্তন করিয়া লেখেন ‘Banglah’। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে ইংরেজের আমলে যে দেশ Bengal বলিয়া অভিহিত হইত, মুসলমান শাসনের প্রথম হইতেই সেই সমগ্র দেশের নাম ছিল বাঙ্গালা–বাংলা। সুতরাং বাংলা দেশ ইংরেজ আমলের Bengal প্রদেশের নাম–ইহার কোন এক অংশের নাম নয়। বঙ্গদেশের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সকল অংশের লোকেরাই চিরকাল বাঙালী বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছে, আজও দেয়। ইহাও সেই প্রাচীন বঙ্গাল ও মুসলমানদের মুলুক ‘বাঙ্গালা’ নামই স্মরণ করাইয়া দেয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে না ইহাও যেমন অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর, ‘বাংলাদেশ’ বলিলে কেবল পূর্ববঙ্গ বুঝাইবে ইহাও দ্রুপ অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর।

দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙ্গালা, বাংলাদেশ, বাঙালী শব্দগুলি সমগ্র Bengal বা বাংলা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পর আজ হঠাৎ কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গকে (যাহা আদিতে মুসলমানদের “বাঙ্গালা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।–”বঙ্গ ওয়া বাঙ্গালাহ” তাঁহার প্রমাণ), “বাংলাদেশ” বলিতে হইবে এরূপ ব্যবস্থা বা ঘোষণা করার অধিকার কোন গভর্নমেন্টের নাই। উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়া আরও একটি কারণে ইহা অযৌক্তিক। অবিভক্ত বাংলা দেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির গঠনে যাহারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী অধিবাসী তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অবদানও যথেষ্ট ছিল। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়া “বাংলাদেশ” ও ইহার অধিবাসীদের বাদ দিয়া “বাঙালী জাতি” কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য লর্ড কার্জন যখন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়াছিলেন, তখন পশ্চিম অংশেরই নাম রাখিয়াছিলেন Bengal অর্থাৎ “বাংলা”। বর্তমান বাংলা দেশ তখন পূর্ববঙ্গ (East Bengal) বলিয়া অভিহিত হইত।

বর্তমান পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রনায়কগণ ইতিহস ও ভূগোলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাহাদের দেশের “বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ করিয়াছেন। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই–ইহার কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক। সাধারণ লোকে কিন্তু বাংলাদেশ” নামের অর্থ পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারে নাই। তাঁহার প্রমাণ–এখনও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় ও লেখায় পশ্চিমবঙ্গকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করে; ভারতের আন্তঃরাজ্য ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পশ্চিমবঙ্গের দলগুলি “বাংলা দল” নামে আখ্যাত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালিত হইলে তাহাকে “বাংলা বন্ধ” বলা হয়। আমরাও “বাংলাদেশ” নামের মৌলিক অর্থকে উৎখাত করার বিরোধী। সেইজন্য বর্তমান গ্রন্থের “বাংলা দেশের ইতিহাস” নাম অপরিবর্তিত রাখা হইল। শুধু পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিবঙ্গ নহে–ত্রিপুরা এবং বর্তমান বিহার ও আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বাংলা-ভাষী অঞ্চলগুলিকেও আমরা “বাংলাদেশ”-এর অন্তর্গত বলিয়া গণ্য করিয়াছি এবং এই সমস্ত অঞ্চলেরই ইতিহাস এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে।

শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৩০ শে ভাদ্র, ১৩৮০
৪ নং বিপিন পাল রোড,
কলিকাতা-২৬

০১. বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা

প্রথম পরিচ্ছেদ – বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা

ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী

১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাওরীর দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হইয়া মুহম্মদ ঘোরী সর্বপ্রথম ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার মাত্র কয়েক বৎসর পরে তুর্কির অধিবাসী অসমসাহসী ভাগ্যান্বেষী ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতভাবে পূর্ব ভারতে অভিযান চালাইয়া প্রথমে দক্ষিণ বিহার এবং পরে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের অনেকাংশ জয় করিয়া এই অঞ্চলে প্রথম মুসলিম অধিকার স্থাপন করিলেন। বখতিয়ার প্রথমে “নোদীয়হ” অর্থাৎ নদীয়া (নবদ্বীপ) এবং পরে “লখনৌতি” অর্থাৎ লক্ষ্মণাবতী বা গৌড় জয় করেন। মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয়ের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ঐ বিবরণের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহার যাথার্থ্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে।

বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় তথা বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা কোন্ বৎসরে হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। মীনহাজ-ই সিরাজ লিখিয়াছেন যে বিহার দুর্গ অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করার অব্যবহিত পরে বখতিয়ার বদায়ুনে গিয়া কুলুদ্দীন আইবকের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহাকে নানা উপঢৌকন দিয়া প্রতিদানে তাঁহার নিকট হইতে খিলাৎ লাভ করেন; কুলুদ্দীনের কাছ হইতে ফিরিয়া বখতিয়ার আবার বিহার অভিমুখে অভিযান করেন এবং ইহার পরের বৎসর তিনি “নোদীয়” আক্রমণ করিয়া জয় করেন। কুলুদ্দীনের সভাসদ হাসান নিজামীর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে কুস্তুদ্দীন কালিঞ্জর দুর্গ জয় করেন, এবং কালিঞ্জর হইতে তিনি সরাসরি বায়ুনে চলিয়া আসেন; তাঁহার বদায়ুনে আগমনের পরেই “ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার উদ-বিহার (অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার) হইতে তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে কুড়িটি হাতি, নানারকমের রত্ন ও বহু অর্থ উপঢৌকনস্বরূপ দিলেন। সুতরাং বখতিয়ার ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের পরের বৎসর অর্থাৎ ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপ জয় করিয়াছিলেন এইরূপ ধারণা করাই সংগত।

“নোদীয়হ” জয়ের পরে, মীনহাজ-ই-সিরাজের মতে, “নোদীয়হ্‌” ও “লখনৌতি” জয়ের পরে বখতিয়ার লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু বখতিয়ারের জীবদ্দশায় এবং তাঁহার মৃত্যুর প্রায় কুড়ি বৎসর পর পর্যন্ত বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত দেবকোট (আধুনিক নাম গঙ্গারামপুর) বাংলার মুসলিম শক্তির প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল।

নদীয়া ও লখনৌতি জয়ের পরে বখতিয়ার একটি রাজ্যের কার্যত স্বাধীন অধীশ্বর হইলেন। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে বখতিয়ার বাংলা দেশের অধিকাংশই জয় করিতে পারেন নাই। তাঁহার নদীয়া ও লক্ষণাবতী বিজয়ের পরেও পূর্ববঙ্গে লক্ষণসেনের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল, লক্ষণসেন যে ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দেও জীবিত ও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁহার প্রমাণ আছে। লক্ষণসেনের মৃত্যুর পরে তাঁহার বংশধররা এবং দেব বংশের রাজারা পূর্ববঙ্গ শাসন করিয়াছিলেন। ১২৬০ খ্রীষ্টাব্দে মীনহাজ-ই-সিরাজ তাঁহার ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থ সম্পূর্ণ করেন। তিনি লিখিয়াছেন যে তখনও পর্যন্ত লক্ষণসেনের বংশধররা পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। ১২৮৯ খ্রীষ্টাব্দেও মধুসেন নামে একজন রাজার রাজত্ব করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দশকের আগে মুসলমানরা পূর্ববঙ্গের কোন অঞ্চল জয় করিতে পারেন নাই। দক্ষিণবঙ্গের কোন অঞ্চলও মুসলমানদের দ্বারা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিজিত হয় নাই। সুতরাং বখতিয়ারকে বঙ্গবিজেতা’ বলা সংগত হয় না। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তরবঙ্গের কতকাংশ জয় করিয়া বাংলা দেশে মুসলিম শাসনের প্রথম সূচনা করিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার কীর্তি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহাসিকরাও বখতিয়ারকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলেন নাই; তাহারা বখতিয়ার ও তাঁহার উত্তরাধিকারীদের অধিকৃত অঞ্চলকে লখনৌতি রাজ্য বলিয়াছেন, ‘বাংলা রাজ্য’ বলেন নাই।

বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় হইতে সুরু করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলানের হাতে ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকীর পরাজয় ও পতন পর্যন্ত লখনৌতি রাজ্যের ইতিহাস একমাত্র মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ হইতে জানা যায়। নীচে এই গ্রন্থ অবলম্বনে এই সময়কার ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার লিপিবদ্ধ হইল।

নদীয়া ও লখনৌতি বিজয়ের পরে প্রায় দুই বৎসর বখতিয়ার আর কোন অভিযানে বাহির হন নাই। এই সময়ে তিনি পরিপূর্ণভাবে অধিকৃত অঞ্চলের শাসনে মনোনিবেশ করেন। সমগ্র অঞ্চলটিকে তিনি কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করিলেন এবং তাঁহার সহযোগী বিভিন্ন সেনানায়ককে তিনি বিভিন্ন বিভাগের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। ইহারা সকলেই ছিলেন হয় তুর্কী নাহয় খিলজী জাতীয়। রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে বখতিয়ার আলী মর্দান, মুহম্মদ শিরান, হসামুদ্দীন ইউয়জ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। বখতিয়ার তাঁহার রাজ্যে অনেকগুলি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করিলেন। হিন্দুদের বহু মন্দির তিনি ভাঙিয়া ফেলিলেন এবং বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন।

লখনৌতি জয়ের প্রায় দুই বৎসর পরে বখতিয়ার তিব্বত জয়ের সংকল্প করিয়া অভিযানে বাহির হইলেন। লখনৌতি ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী প্রদেশে কোচ, মেচ ও থারু নামে তিনটি জাতির লোক বাস করিত। মেচ জাতির একজন সর্দার একবার বখতিয়ারের হাতে পড়িয়াছিল, বখতিয়ার তাহাকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া আলী নাম রাখিয়াছিলেন। এই আলী বখতিয়ারের পথপ্রদর্শক হইল। বখতিয়ার দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করিলেন। আলী মেচ তাঁহাকে কামরূপ রাজ্যের অভ্যন্তরে বেগমতী নদীর তীরে বর্ধন নামে একটি নগরে আনিয়া হাজির করিল। বেগমতী ও বর্ধনের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। বখতিয়ার বেগমতীর তীরে তীরে দশ দিন গিয়া একটি পাথরের সেতু দেখিতে পাইলেন, তাহাতে বারোটি খিলান ছিল। একজন তুর্কী ও একজন খিলজী আমীরকে সেতু পাহারা দিবার জন্য রাখিয়া বখতিয়ার অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া সেতু পার হইলেন।

এদিকে কামরূপের রাজা বখতিয়ারকে দূতমুখে জানাইলেন যে ঐ সময় তিব্বত আক্রমণের উপযুক্ত নয়; পরের বৎসর যদি বখতিয়ার তিব্বত আক্রমণ করেন, তাহা হইলে তিনিও তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া এ অভিযানে যোগ দিবেন। বখতিয়ার কামরূপরাজের কথায় কর্ণপাত না করিয়া তিব্বতের দিকে অগ্রসর হইলেন। পূর্ব্বোক্ত সেতুটি পার হইবার পর বখতিয়ার পনেরো দিন পার্ব্বত্য পথে চলিয়া ষোড়শ দিবসে এক উপত্যকায় পৌঁছিলেন এবং সেখানে লুণ্ঠন সুরু করিলেন; এই স্থানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। এই দুর্গ ও তাঁহার আশপাশ হইতে অনেক সৈন্য বাহির হইয়া বখতিয়ারের সৈন্যদলকে আক্রমণ করিল। ইহাদের কয়েকজন বখতিয়ারের বাহিনীর হাতে বন্দী হইল। তাহাদের কাছে বখতিয়ার জানিতে পারিলেন যে ঐ স্থান হইতে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে করমপত্তন বা করারপত্তন নামে একটি স্থানে পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য আছে। ইহা শুনিয়া বখতিয়ার আর অগ্রসর হইতে সাহস করিলেন না।

কিন্তু প্রত্যাবর্তন করাও তাঁহার পক্ষে সহজ হইল না। তাঁহার শত্রুপক্ষ ঐ এলাকার সমস্ত লোকজন সরাইয়া যাবতীয় খাদ্যশস্য নষ্ট করিয়া দিয়াছিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা তখন নিজেদের ঘোড়াগুলির মাংস খাইতে লাগিল। এইভাবে অশেষ কষ্ট সহ্য করিয়া বখতিয়ার কোনরকমে কামরূপে পৌঁছিলেন।

কিন্তু কামরূপে পৌঁছিয়া বখতিয়ার দেখিলেন পূর্ব্বোক্ত সেতুটির দুইটি খিলান ভাঙা; যে দুইজন আমীরকে তিনি সেতু পাহারা দিতে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহারা বিবাদ করিয়া ঐ স্থান ছাড়িয়া গিয়াছিল, ইত্যবসরে কামরূপের লোকেরা আসিয়া এই দুইটি খিলান ভাঙিয়া দেয়। বখতিয়ার তখন নদীর তীরে তাঁবু ফেলিয়া নদী পার হইবার জন্য নৌকা ও ভেলা নির্মাণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু সে চেষ্টা সফল হইল না। তখন বখতিয়ার নিকটবর্তী একটি দেবমন্দিরে সসৈন্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কামরূপের রাজা এই সময় বখতিয়ারের স্বপক্ষ হইতে বিপক্ষে চলিয়া গেলেন। (বোধহয় মুসলমানরা দেবমন্দিরে প্রবেশ করায় তিনি ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন।) তাঁহার সেনারা আসিয়া ঐ দেবমন্দির ঘিরিয়া ফেলিল এবং মন্দিরটির চারিদিকে বাঁশ দিয়া প্রাচীর খাড়া করিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা চারিদিকে বন্ধ দেখিয়া মরিয়া হইয়া প্রাচীরের একদিকে ভাঙিয়া ফেলিল এবং তাহাদের মধ্যে দুই-একজন অশ্বারোহী অশ্ব লইয়া নদীর ভিতরে কিছুদূর গমন করিল। তীরের লোকেরা “রাস্তা মিলিয়াছে” বলিয়া চীৎকার করায় বখতিয়ারের সমস্ত সৈন্য জলে নামিল। কিন্তু সামনে গভীর জল ছিল, তাহাতে বখতিয়ার এবং অল্প কয়েকজন অশ্বারোহী ব্যতীত আর সকলেই ডুবিয়া মরিল। বখতিয়ার হতাবশিষ্ট অশ্বারোহীদের লইয়া কোনক্রমে নদীর ওপারে পৌঁছিয়া আলী মেচের আত্মীয়স্বজনকে প্রতীক্ষারত দেখিতে পাইলেন। তাহাদের সাহায্যে তিনি অতিকষ্টে দেবকোটে পৌঁছিলেন।

দেবকোটে পৌঁছিয়া বখতিয়ার সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। ইহার অল্পদিন পরেই তিনি পরলোকগমন করিলেন। (৬০২ হি. = ১২০৫-০৬ খ্র.)। কেহ কেহ বলেন যে বখতিয়ারের অনুচর নারান-কোই-র শাসনকর্ত্তা আলী মর্দান তাঁহাকে হত্যা করেন। তিব্বত অভিযানের মতো অসম্ভব কাজে হাত না দিলে হয়তো এত শীঘ্ন বখতিয়ারের এরূপ পরিণতি হইত না।

ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী

ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী ও তাঁহার ভ্রাতা আহমদ শিরান বখতিয়ার খিলজীর অনুচর ছিলেন। বখতিয়ার তিব্বত অভিযানে যাত্রা করিবার পূর্বে এই দুই ভ্রাতাকে লখনোর ও জাজনগর আক্রমণ করিতে পাঠাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে বখতিয়ারের প্রত্যাবর্তনের সময় মুহম্মদ শিরান জাজনগরে ছিলেন। বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতার কথা শুনিয়া তিনি দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ইতিমধ্যে বখতিয়ার পরলোকগমন করিয়াছিলেন। তখন মুহম্মদ শিরান প্রথমে নারান-কোই আক্ৰমণ করিয়া আলী মর্দানকে পরাস্ত ও বন্দী করিলেন এবং দেবকোটে ফিরিয়া আসিয়া নিজেকে বখতিয়ারের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করিলেন। এদিকে আলী মর্দান কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া দিল্লিতে সুলতান কুত্ৰুদ্দীন আইবকের শরণাপন্ন হইলেন। কায়েমাজ রুমী নামে কুত্ৰুদ্দীনের জনৈক সেনাপতি এই সময়ে অযোধ্যায় ছিলেন, তাঁহাকে কুত্ৰুদ্দীন লখনৌতি আক্রমণ করিতে বলিলেন। কায়েমাজ লখনৌতি রাজ্যে পৌঁছিয়া অনেক খিলজী আমীরকে হাত করিয়া ফেলিলেন। বখতিয়ারের বিশিষ্ট অনুচর, গাঙ্গুরীর জায়গীরদার হসামুদ্দীন ইউয়জ অগ্রসর হইয়া কায়েমাজকে স্বাগত জানাইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া দেবকোটে লইয়া গেলেন। মুহম্মদ শিরান তখন কায়েমাজের সহিত যুদ্ধ না করিয়া দেবকোট হইতে পলাইয়া গেলেন। অতঃপর কায়েমাজ হসামুদ্দীনকে দেবকোটের কর্তৃত্ব দান করিলেন। কিন্তু কায়েমাজ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করিলে মুহম্মদ শিরান এবং তাঁহার দলভুক্ত খিলজী আমীররা দেবকোট আক্রমণের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।

এই সংবাদ পাইয়া কায়েমাজ আবার ফিরিয়া আসিলেন। তখন তাঁহার সহিত মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার অনুচরদের যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার দলের লোকেরা পরাজিত হইয়া মদা এবং সন্তোষের দিকে পলায়ন করিলেন। পলায়নের সময় তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ হইল এবং এই বিবাদের ফলে মুহম্মদ শিরান নিহত হইলেন।

আলী মর্দান (আলাউদ্দীন)

আলী মর্দান কিছুকাল দিল্লিতেই রহিলেন। কুলুদ্দীন আইবক যখন গজনীতে যুদ্ধ করিতে গেলেন, তখন তিনি আলী মর্দানকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। গজনীতে আলী মর্দান তুর্কীদের হাতে বন্দী হইলেন। কিছুদিন বন্দীদশায় থাকিবার পর আলী মর্দান মুক্তিলাভ করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া আসিলেন। তখন কুস্তুদ্দীন তাঁহাকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। আলী মর্দান দেবকোটে আসিলে হসামুদ্দীন ইউয়জ তাহাকে অভ্যর্থনা জানাইলেন এবং আলী মর্দান নির্বিবাদে লখনৌতির শাসনভার গ্রহণ করিলেন। (আ ১২১০ খ্রী)।

কুলুদ্দীন যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন আলী মর্দান দিল্লির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু কুল্লুদ্দীন পরলোকগমন করিলে (নভেম্বর ১২১০ খ্রী) আলী মর্দান স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন এবং আলাউদ্দীন নাম লইয়া সুলতান হইলেন। তাঁহার পর তিনি চারিদিকে সৈন্য পাঠাইয়া বহু খিলজী আমীরকে বধ করিলেন। তাঁহার অত্যাচার ক্রমে ক্রমে চরমে উঠিল। তিনি বহু লোককে বধ করিলেন এবং নিরীহ দরিদ্র লোকদের দুর্দশার একশেষ করিলেন। অবশেষে তাঁহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া বহু খিলজী আমীর ষড়যন্ত্র করিয়া আলী মর্দানকে হত্যা করিলেন। ইহার পর তাঁহারা হসামুদ্দীন ইউয়জকে লখনৌতির সুলতান নির্বাচিত করিলেন। হসামুদ্দীন ইউয়জ গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে বসিলেন (আ ১২১৩ খ্রী)।

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি প্রিয়দর্শন, দয়ালু ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। আলিম, ফকির ও সৈয়দদের তিনি বৃত্তি দান করিতেন। দূরদেশ হইতেও বহু মুসলমান অর্থের প্রত্যাশী হইয়া তাঁহার কাছে আসিত এবং সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া যাইত। বহু মসজিদও তিনি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীনের শাসনকালে দেবকোটের প্রাধান্য হ্রাস পায় এবং লখনৌতি পুরাপুরি রাজধানী হইয়া উঠে। গিয়াসুদ্দীনের আর একটি বিশেষ কীর্তি দেবকোট হইতে লখনোর বা রাজনগর (বর্তমান বীরভূম জেলার অন্তর্গত) পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ উচ্চ রাজপথ নির্মাণ করা। এই রাজপথটির কিছু চিহ্ন পঞ্চাশ বছর আগেও বর্তমান ছিল। গিয়াসুদ্দীন বসকোট বা বসনকোট নামক স্থানে একটি দুর্গও নির্মাণ করাইয়াছিলেন। বাগদাদের খলিফা অন্নাসিরোলেদীন ইল্লাহের নিকট হইতে গিয়াসুদ্দীন তাঁহার রাজ-মর্যাদা স্বীকারসূচক পত্র আনান। গিয়াসুদ্দীনের অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের কয়েকটিতে খলিফার নাম আছে।

কিন্তু ১৫ বৎসর রাজত্ব করিবার পর গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের অদৃষ্টে দুর্দিন ঘনাইয়া আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ৬২২ হিজরায় (১২২৫-২৬ খ্র) গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহকে দমন করিয়া লখনৌতির দিকে রওনা হইলে গিয়াসুদ্দীন তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য এক নৌবাহিনী পাঠাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ইলতুৎমিসের নামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করিতে ও খুৎবা পাঠ করিতে স্বীকৃত হইয়া এবং অনেক টাকা ও হাতি উপঢৌকন দিয়া ইলতুৎমিসের সহিত সন্ধি করিলেন। ইলতুৎমিস তখন ইজুদ্দীন জানী নামে এক ব্যক্তিকে বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের প্রত্যাবর্তনের অল্পকাল পরেই গিয়াসুদ্দীন ইজুদ্দীন জানীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া বিহার অধিকার করিলেন। ইজুদ্দীন তখন ইলতুৎমিসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদের কাছে গিয়া সমস্ত কথা জানাইলেন এবং তাঁহার অনুরোধে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। এই সময়ে গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ পূর্ববঙ্গ এবং কামরূপ জয় করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, সুতরাং নাসিরুদ্দীন অনায়াসেই লখনৌতি অধিকার করিলেন। গিয়াসুদ্দীন এই সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং নাসিরুদ্দীনের সহিত যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু যুদ্ধে তাঁহার পরাজয় হইল এবং তিনি সমস্ত খিলজী আমীরের সহিত বন্দী হইলেন। অতঃপর গিয়াসুদ্দীনের প্রাণবধ করা হইল (৬২৪ হি = ১২২৬-২৭ খ্রী)।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের পরাজয় ও পতনের ফলে লখনৌতি রাজ্য সম্পূর্ণভাবে দিল্লির সুলতানের অধীনে আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস প্রথমে নাসিরুদ্দীন মাহমুদকেই লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সুলতান গারি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি লখনৌতি অধিকার করার পর দিল্লি ও অন্যান্য বিশিষ্ট নগরের আলিম, সৈয়দ এবং অন্যান্য ধার্মিক ব্যক্তিদের কাছে বহু অর্থ পাঠাইয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীন অত্যন্ত যোগ্য ও নানাগুণে ভূষিত ছিলেন। তাঁহার পিতা ইলতুৎমিসের নিকট একবার বাগদাদের খলিফার নিকট হইতে খিলাৎ আসিয়াছিল, ইলতুৎমিস তাঁহার মধ্য হইতে একটি খিলাৎ ও একটি লাল চন্দ্রাতপ লখনৌতিতে পুত্রের কাছে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র দেড় বৎসর লখনৌতি শাসন করিবার পরেই নাসিরুদ্দীন মাহমুদ রোগাক্রান্ত হইয়া পরলোকগমন করেন। তাঁহার মৃতদেহ লখনৌতি হইতে দিল্লিতে লইয়া গিয়া সমাধিস্থ করা হয়।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পিতার অধীনস্থ শাসনকর্ত্তা হিসাবে লখনৌতি শাসন করিলেও পিতার অনুমোদনক্রমে নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহার কোন কোন মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নাম দেখিতে পাওয়া যায়।

ইখতিয়ারুদ্দীন মালিক বলকা

নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনকালে হসামুদ্দীন ইউয়জের পুত্র ইখতিয়ারুদ্দীন দৌলৎ শাহ-ই-বলকা আমীরের পদ লাভ করিয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীনের মৃত্যুর পর তিনি বিদ্রোহী হইলেন এবং লখনৌতি রাজ্য অধিকার করিলেন। তখন ইলতুৎমিস তাঁহাকে দমন করিতে সসৈন্যে লখনৌতি আসিলেন এবং তাঁহাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া আলাউদ্দীন জানী নামে তুর্কীস্থানের রাজবংশসম্ভুত এক ব্যক্তিকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

আলাউদ্দীন জানী, সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ ও আওর খান

আলাউদ্দীন জানী অল্পদিন লখনৌতি শাসন করিবার পরে ইলতুৎমিস কর্ত্তৃক পদচ্যুত হন এবং সৈফুদ্দীন আইবক নামে আর এক ব্যক্তি তাঁহার স্থানে নিযুক্ত হন। সৈফুদ্দীন আইবক অনেকগুলি হাতি ধরিয়া ইলতুৎমিসকে পাঠাইয়াছিলেন, এজন্য ইলতুৎমিস তাঁহাকে ‘য়গানতৎ’ উপাধি দিয়াছিলেন। দুই-তিন বৎসর শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ পরলোকগমন করেন। প্রায় একই সময়ে দিল্লিতে ইলতুৎমিসও পরলোকগমন করিলেন (১২৩৬ খ্রী)।

ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরে তাঁহার উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তারা স্বাধীন রাজার মতো আচরণ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে আওর খান নামে একজন তুর্কী লখনৌতি ও লখনোর অধিকার করিয়া বসিলেন। বিহারের শাসনকর্ত্তা তুগরল তুগার খানের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধিল এবং তুগান খান লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। লখনৌতি নগর ও বসনকোট দুর্গের মধ্যবর্তী স্থানে তুগান খান আওর খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। ফলে লখনোর হইতে বসনকোট পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন তুগান খানের হস্তে আসিল।

তুগরল তুগান খান

তুগান খানের শাসনকালে সুলতানা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার অভিষেকের সময়ে তুগান খান দিল্লিতে কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠাইয়াছিলেন। রাজিয়া তুগান খানকে একটি ধ্বজ ও কয়েকটি চন্দ্রাতপ উপহার দিয়াছিলেন। তুগাল খান সুলতানা রাজিয়ার নামে লখনৌতির টাকশালে মুদ্রাও উত্তীর্ণ করাইয়াছিলেন। রাজিয়ার সিংহাসনচ্যুতির পরে তুগান খান অযোধ্যা, কড়া ও মানিকপুর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করিয়া বসিলেন।

এই সময়ে ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’র লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজ অযোধ্যায় ছিলেন। তুগরল তুগান খানের সহিত মীনহাজের পরিচয় হইয়াছিল। তুগান খান মীনহাজকে বাংলাদেশে লইয়া আসেন। মীনহাজ প্রায় তিন বৎসর এদেশে ছিলেন এবং এই সময়কার ঘটনাবলী তিনি স্বচক্ষে দেখিয়া তাঁহার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

তুগান খানের শাসনকালে জাজনগরের (উড়িষ্যা) রাজা লখনৌতি আক্রমণ করেন। উড়িষ্যার শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, এই জাজনগররাজ উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় রাজা প্রথম নরসিংহদেব। তুগরল তুগান খান তাঁহার আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা আক্রমণ চালান এবং জাজনগর অভিমুখে অভিযান করেন (৬৪১ হি = ১২৪৩-৪৪ খ্রী)। মীনহাজ-ই-সিরাজ এই অভিযানে তুগান খানের সহিত গিয়াছিলেন। তুগান খান জাজনগর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত কটাসিন দুর্গ অধিকার করিয়া লইলেন। কিন্তু দুর্গ জয়ের পর যখন তাঁহার সৈন্যরা বিশ্রাম ও আহারাদি করিতেছিল, তখন জাজনগররাজের সৈন্যরা অকস্মাৎ পিছন হইতে তাহাদের আক্রমণ করিল। ফলে তুগান খান পরাজিত হইয়া লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর তিনি তাঁহার দুইজন মন্ত্রী শফুলমুল আশারী ও কাজী জলালুদ্দীন কাসানীকে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহের কাছে পাঠাইয়া তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। আলাউদ্দীন তখন অযোধ্যার শানকর্ত্তা কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরানকে তুগান খানের সহায়তা করিবার আদেশ দিলেন। ইতিমধ্যে জাজনগরের রাজা আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিলেন। তিনি প্রথমে লখনোর আক্রমণ করিলেন এবং সেখানকার শাসনকর্ত্তা ফখু-উ-মুল করিমুদ্দীন লাগরিকে পরাজিত ও নিহত করিয়া স্থান দখল করিয়া লইলেন। তাঁহার পর তিনি লখনৌতি অবরোধ করিলেন। অবরোধের ফলে তুগান খানের খুবই অসুবিধা হইয়াছিল, কিন্তু অবরোধের দ্বিতীয় দিনে অযোধ্যার শাসনকর্ত্তা তমুর খান তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া উপস্থিত হইলেন। তখন জাজনগররাজ লখনৌতি পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

কিন্তু জাজনগররাজের বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুগরল তুগান খান ও তমুর খানের মধ্যে বিবাদ বাধিল এবং বিবাদ যুদ্ধে পরিণত হইল। সারাদিন যুদ্ধ চলিবার পর অবশেষে সন্ধ্যায় কয়েক ব্যক্তি মধ্যস্থ হইয়া যুদ্ধ বন্ধ করিলেন। যুদ্ধের শেষে তুগান খান নিজের আবাসে ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার আবাস ছিল নগরের প্রধান দ্বারের সামনে এবং সেখানে তিনি সেদিন একাই ছিলেন। তমুর খান এই সুযোগে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তুগান খানের আবাস আক্রমণ করিলেন। তখন তুগান খান পলাইতে বাধ্য হইলেন। অতঃপর তিনি মীনহাজ-ই-সিরাজকে তমুর খানের কাছে পাঠাইলেন এবং মীনহাজের দৌত্যের ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল। সন্ধির শর্ত অনুসারে তমুর খান লখনৌতির অধিকারপ্রাপ্ত হইলেন এবং তুগান খান তাঁহার অনুচরবর্গ, অর্থভাণ্ডার এবং হাতিগুলি লইয়া দিল্লিতে গমন করিলেন। দিল্লির দুর্বল সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহ তুগান খানের উপর তমুর খানের এই অত্যাচারের কোনই প্রতিবিধান করিতে পারিলেন না। তুগান খান অতঃপর আউধের শাসনভার প্রাপ্ত হইলেন।

কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরান ও জলালুদ্দীন মসূদ জানী

তমুর খান দিল্লির সুলতানের কর্তৃত্ব অস্বীকারপূর্বক দুই বৎসর লখনৌতি শাসন করিয়া পরলোকগমন করিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি ও তুগরল তুগান খান একই রাত্রিতে (৯ মার্চ, ১২৪৭ খ্রী) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁহার পর আলাউদ্দীন জানীর পুত্র জালালুউদ্দীন মসূদ জানী বিহার ও লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। ইনি “মালিক-উশ-শর্ক” ও “শাহ্” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রায় চারি বৎসর তিনি এ দুইটি প্রদেশ শাসন করিয়াছিলেন।

১০

ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান (মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহ)

জালালুদ্দীন মসূদ জানীর পরে যিনি লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন, তাঁহার নাম মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান। ইনি প্রথমে আউধের শাসনকর্ত্তা এবং পরে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হন। ইহার পূর্বে ইনি দুইবার দিল্লির তল্কালীন সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুইবারই উজীর উলুগ খান বলবনের হস্তক্ষেপের ফলে ইনি সুলতানের মার্জনা লাভ করেন। ইঁহার শাসনকালে জাজনগরের সহিত লখনৌতির আবার যুদ্ধ বাধিয়াছিল। তিনবার যুদ্ধ হয়, প্রথম দুইবার জাজনগরের সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়, কিন্তু তৃতীয়বার তাহারাই য়ুজবক তুগরল খানের বাহিনীকে পরাজিত করে এবং য়ুজবকের একটি বহুমূল্য শ্বেতহস্তীকে জাজনগরের সৈন্যেরা লইয়া যায়। ইহার পরের বৎসর য়ুজবক উমর্দন রাজ্য [*এই রাজ্যের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে] আক্রমণ করেন। অলক্ষিতভাবে অগ্রসর হইয়া তিনি ঐ রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন; তখন সেখানকার রাজা রাজধানী ছাড়িয়া পলায়ন করিলেন এবং তাঁহার অর্থ, হস্তী, পরিবার, অনুচরবর্গ–সমস্তই য়ুজবকের দখলে আসিল।

উমর্দন রাজ্য জয় করিবার পর য়ুজবক খুবই গর্বিত হইয়া উঠিলেন এবং আউধের রাজধানী অধিকার করিলেন। ইহার পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া সুলতান মুগীসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিলেন। কিন্তু আউধে এক পক্ষ কাল অবস্থান করিবার পর তিনি যখন শুনিলেন যে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরিত সম্রাটের সৈন্যবাহিনী অদূরে আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তিনি নৌকাযোগে লখনৌতিতে পলাইয়া আসিলেন। য়ুজবক স্বাধীনতা ঘোষণা করায় ভারতের হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহার বিরূপ সমালোচনা করিতে লাগিলেন।

লখনৌতিতে পৌঁছিবার পর য়ুজবক কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কামরূপরাজের সৈন্যবল বেশি ছিল না বলিয়া তিনি প্রথমে যুদ্ধ না করিয়া পিছু হটিয়া গেলেন। যুজবক তখন কামরূপের প্রধান নগর জয় করিয়া প্রচুর ধনরত্ন হস্ত গত করিলেন। কামরূপরাজ য়ুজবকের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করিয়া দূত পাঠাইলেন। তিনি য়ুজবকের সামন্ত হিসাবে কামরূপ শাসন করিতে এবং তাহাকে প্রতি বৎসর হস্তী ও স্বর্ণ পাঠাইতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। য়ুজবক এই প্রস্তাবে সম্মত হন নাই। কিন্তু যুবক একটা ভুল করিয়াছিলেন। কামরূপের শস্যসম্পদ খুব বেশি ছিল বলিয়া য়ুজবক নিজের বাহিনীর আহারের জন্য শস্য সঞ্চয় করিয়া রাখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কামরূপের রাজা ইহার সুযোগ লইয়া তাঁহার প্রজাদের দিয়া সমস্ত শস্য কিনিয়া লওয়াইলেন এবং তাঁহার পর তাহাদের দিয়া সমস্ত পয়ঃপ্রণালীর মুখ খুলিয়া দেওয়াইলেন। ইহার ফলে য়ুজবকের অধিকৃত সমস্ত ভূমি জলমগ্ন হইয়া পড়িল এবং তাঁহার খাদ্যভাণ্ডার শূন্য হইয়া পড়িল। তখন তিনি লখনৌতিতে ফিরিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু ফিরিবার পথও জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। সুতরাং য়ুজবকের বাহিনী অগ্রসর হইতে পারিল না। ইহা ব্যতীত অল্প সময়ের মধ্যেই তাহাদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে কামরূপরাজের বাহিনী আসিয়া ঘিরিয়া ধরিল। তখন পর্বতমালাবেষ্টিত একটি সংকীর্ণ স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে য়ুজবক পরাজিত হইয়া বন্দী হইলেন এবং বন্দীদশাতেই তিনি পরলোকগমন করিলেন।

মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহের সমস্ত মুদ্রায় লেখা আছে যে এগুলি “নদীয়া ও অর্জ বদন (?)-এর ভূমি-রাজস্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক ভ্রমবশত এগুলিকে নদীয়া ও “অৰ্জ বদন” বিজয়ের স্মারক-মুদ্রা বলিয়া মনে করিয়াছেন। কিন্তু নদীয়া বা নবদ্বীপ য়ুজবকের বহু পূর্বে বখতিয়ার খিলজী জয়–করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, যুজবকের এই মুদ্রাগুলি হইতে এ কথা বুঝায় না যে য়ুজবকের রাজত্বকালেই নদীয়া ও অর্জ বদন (?) প্রথম বিজিত হইয়াছিল। ‘অর্জ বদন’-কে কেহ ‘বর্ধনকোটে’র, কেহ ‘বর্ধমানের, কেহ ‘উমদনে’র বিকৃত রূপ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।

১১

জলালুদ্দীন মসূদ জানী, ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী ও তাজুদ্দীন অর্সলান খান

য়ুজবকের মৃত্যুর পরে লখনৌতি রাজ্য আবার দিল্লির সম্রাটের অধীনে আসে, কারণ ৬৫৫ হিজরায় (১২৫৭-৫৮ খ্রী) লখনৌতি টাকশাল হইতে দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা উৎকীর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু ঐ সময়ে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কে ছিলেন, তাহা জানা যায় না। ৬৫৬ হিজরায় জলালুদ্দীন মসূদ জানী দ্বিতীয়বার লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু ৬৫৭ হিজরার মধ্যেই তিনি পদচ্যুত বা পরলোকগত হন, কারণ ৭৫৭ হিজরায় যখন কড়ার শাসনকর্ত্তা তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি আক্রমণ করেন, তখন ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী নামে এক ব্যক্তি লখনৌতি শাসন করিতেছিলেন। ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী লখনৌতি অরক্ষিত অবস্থায় রাখিয়া পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করিতে গিয়াছিলেন। সেই সুযোগে তাজুদ্দীন অর্সলান খান মালব ও কালিঞ্জর আক্রমণ করিবার ছলে লখনৌতি আক্রমণ করেন। লখনৌতি নগরের অধিবাসীরা তিনদিন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া অবশেষে আত্মসমর্পণ করিল। অর্সলান খান নগর অধিকার করিয়া লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। তাঁহার আক্রমণের খবর পাইয়া ইজুদ্দীন বলবন ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু তিনি অর্সলান খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত হইলেন। ইজুদ্দীন বলবনের শাসনকালের আর কোনো ঘটনার কথা জানা যায় না, তবে ৬৫৭ হিজরায় লখনৌতি হইতে দিল্লিতে দুইটি হস্তী ও কিঞ্চিৎ অর্থ প্রেরিত হইয়াছিল-এইটুকু জানা গিয়াছে। ইজুদ্দীন বলবনকে নিহত করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি রাজ্যের অধিপতি হইলেন।

১২

তাতার খান ও শের খান

ইহার পরবর্তী কয় বৎসরের ইতিহাস একান্ত অস্পষ্ট। তাজুদ্দীন অর্সলান খানের পরে তাতার খান ও শের খান নামে বাংলার দুইজন শাসনকর্ত্তার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

০২. বাংলায় মুসলমান রাজ্যের বিস্তার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাংলায় মুসলমান রাজ্যের বিস্তার

আমিন খান ও তুগরল খান

১২৭১ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে দিল্লির সুলতান বলবন আমিন খান ও তুগরল খানকে যথাক্রমে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা ও সহকারী শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করেন। তুগরল বলবনের বিশেষ প্রীতিভাজন ছিলেন। লখনৌতির সহকারী শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হইয়া তুগরল জীবনের সর্বপ্রথম একটি গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার প্রাপ্ত হইলেন। আমিন খান নামেই বাংলার শাসনকর্ত্তা রহিলেন। তুগরলই সর্বেসর্বা। হইয়া উঠিলেন।

জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে তুগরল “অনেক অসমসাহসিক কঠিন কর্ম” করিয়াছিলেন। তারিখ-ই-মুরারক শাহী’তে লেখা আছে যে, তুগরল সোনারগাঁওয়ের নিকটে একটি বিরাট দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহা ‘কিলা-ই-তুগরল’ নামে পরিচিত ছিল। এই দুর্গ সম্ভবত ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিণে নরকিলা (লরিকল) নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। মোটের উপর, তুগরল যে পূর্ববঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত মুসলিম রাজত্ব বিস্তার করিয়াছিলেন, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বারনির গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, তুগরল জাজনগর (উড়িষ্যা) রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে রাঢ়ের নিম্নার্ধ অর্থাৎ বর্তমানে মেদিনীপুর জেলার সমগ্র অংশ এবং বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও হুগলি জেলার অনেকাংশ জাজনগর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তুগরল জাজনগর আক্রমণ করিয়া লুণ্ঠন চালাইলেন এবং প্রচুর ধনরত্ন ও হস্তী লাভ করিয়া ফিরিয়া আসিলেন।

জিয়াউদ্দীন বারনির গ্রন্থ হইতে ইহার পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে যাহা জানা যায়, তাঁহার সারমর্ম নীচে প্রদত্ত হইল।

জাজনগর-অভিযান হইতে প্রত্যাবর্তনের পর তুগরল নানা প্রকারে দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করিলেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এই অভিযানের লুণ্ঠনলব্ধ সামগ্রীর এক-পঞ্চমাংশ দিল্লিতে প্রেরণ করিবার কথা, কিন্তু তুগরল তাহা করিলেন না। বলবন এতদিন পাঞ্জাবে মঙ্গোলদের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন বলিয়া বাংলার ব্যাপারে মন দিতে পারেন নাই। এই সময় তিনি আবার লাহোরে সাংঘাতিক অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। সুলতান দীর্ঘকাল প্রকাশ্যে বাহির হইতে না পারায় ক্রমশ গুজব রটিল তিনি মারা গিয়াছেন। এই গুজব বাংলা দেশেও পৌঁছিল। তখন তুগরল স্বাধীন হইবার সুবর্ণসুযোগ দেখিয়া আমিন খানের সহিত শত্রুতায় লিপ্ত হইলেন; অবশেষে লখনৌতি নগরের উপকণ্ঠে উভয়ের মধ্যে এক যুদ্ধ হইল। তাহাতে আমিন খান পরাজিত হইলেন।

এদিকে বলবন সুস্থ হইয়া উঠিলেন এবং দিল্লিতে আসিয়া পৌঁছিলেন। তাঁহার অসুস্থ থাকার সময়ে তুগরল যাহা করিয়াছিলেন, সেজন্য তিনি তুগরলকে শাস্তি দিতে চাহেন নাই। তিনি তুগরলকে এক ফরমান পাঠাইয়া বলিলেন, তাঁহার রোগমুক্তি যেন তুগরল যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করেন। কিন্তু তুগরল তখন পুরোপুরিভাবে বিদ্রোহী হইয়া গিয়াছেন। তিনি সুলতানের ফরমান আসার অব্যবহিত পরেই এক বিপুল সৈন্যসমাবেশ করিয়া বিহার আক্রমণ করিলেন; বলবনের রাজত্বকালেই বিহার লখনৌতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হইয়াছিল। ইহার পর তুগরল মুগীসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হইলেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ ও খুবা পাঠ করাইলেন। তাঁহার দরবারের জাঁকজমক দিল্লির দরবারকেও হার মানাইল।

বাংলা দেশে তুগরল বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রকৃতি ছিল উদার। দানেও তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। দরবেশদের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহের জন্য তিনি একবার পাঁচ মণ স্বর্ণ দান করিয়াছিলেন, দিল্লিতেও তিনি দানস্বরূপ অনেক অর্থ ও সামগ্রী পাঠাইয়াছিলেন। বলবনের কঠোর স্বভাবের জন্য তাঁহাকে সকলেই ভয় করিত, প্রায় কেহই ভালোবাসিত না। সুতরাং বলবনের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তুগরল সমুদয় অমাত্য, সৈন্য ও প্রজার সমর্থন পাইলেন।

তুগরলের বিদ্রোহের খবর পাইয়া বলবন তাঁহাকে দমন করিবার জন্য আনুমানিক ১২৭৮ খ্রীষ্টাব্দে আউধের শাসনকর্ত্তা মালিক তুরমতীর অধীনে একদল সৈন্য পাঠাইলেন, এই সৈন্যদলের সহিত তমর খান শামলী ও মালিক তাজুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আর-একদল সৈন্য যোগ দিল। তুগরলের সৈন্যবাহিনীর লোকবল এই মিলিত বাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল, তাহাতে অনেক হাতি এবং পাইক (হিন্দু পদাতিক সৈন্য) থাকায় বলবনের বাহিনীর নায়কেরা তাহাকে সহজে আক্রমণ করিতেও পারিলেন না। দুই বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন রহিল, ইতিমধ্যে তুগরল শত্রুবাহিনীর অনেক সেনাধ্যক্ষকে অর্থ দ্বারা হস্তগত করিয়া ফেলিলেন। অবশেষে যুদ্ধ হইল এবং তাহাতে মালিক তুরমতী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইলেন। তাঁহার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলাইতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের যথাসর্বস্ব হিন্দুরা লুঠ করিয়া লইল এবং অনেক সৈন্য–ফিরিয়া গেলে বলবন পাছে শাস্তি দেন, এই ভয়ে তুগরলের দলে যোগ দিল। বলবন তুরমতাঁকে ক্ষমা করিতে পারেন নাই, গুপ্তচর দ্বারা তাঁহাকে হত্যা করাইয়াছিলেন।

ইহার পরের বৎসর বলবন তুগরলের বিরুদ্ধে আর-একজন সেনাপতির অধীনে আর-একটি বাহিনী প্রেরণ করিলেন। কিন্তু তুরগল এই বাহিনীর অনেক সৈন্যকে অর্থ দ্বারা হস্তগত করিলেন এবং তাঁহার পর তিনি যুদ্ধ করিয়া সেনাপতিকে পরাজিত করিলেন।

তখন বলবন নিজেই তুগরলের বিরুদ্ধে অভিযান করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। প্রথমে তিনি শিকারে যাওয়ার ছল করিয়া দিল্লি হইতে সমান ও সনামে গেলেন এবং সেখানে তাঁহার অনুপস্থিতিতে রাজ্যশাসন ও মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে সঙ্গে লইয়া আউধের দিকে রওনা হইলেন। পথিমধ্যে তিনি যত সৈন্য পাইলেন, সংগ্রহ করিলেন এবং আউধে পৌঁছিয়া আরো দুই লক্ষ সৈন্য সগ্রহ করিলেন। তিনি এক বিশাল নৌবহরও সংগঠন করিলেন এবং এখানকার লোকদের নিকট হইতে অনেক কর আদায় করিয়া নিজের অর্থভাণ্ডার পরিপূর্ণ করিলেন।

তুগরল তাঁহার নৌবহর লইয়া সরযূ নদীর মোহানা পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি বলবনের বাহিনীর সহিত যুদ্ধ না করিয়া পিছু হটিয়া আসিলেন। বলবনের বাহিনী নির্বিঘ্নে সরযূ নদী পার হইল, ইতিমধ্যে বর্ষা নামিয়াছিল, কিন্তু বলবনের বাহিনী বর্ষার অসুবিধা ও ক্ষতি উপেক্ষা করিয়া অগ্রসর হইল। তুগরল লখনৌতিতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, কিন্তু এখানেও তিনি সুলতানের বিরাট বাহিনীকে প্রতিরোধ করিতে পারিবেন না বুঝিয়া লখনৌতি ছড়িয়া চলিয়া গেলেন। লখনৌতির সম্ভ্রান্ত লোকেরা বলবন কর্ত্তৃক নির্যাতিত হইবার ভয়ে তাঁহার সহিত গেল।

বলবন লখনৌতিতে উপস্থিত হইয়া জিয়াউদ্দীন বারনির মাতামহ সিপাহশালার হসামুদ্দীনকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন এবং নিজে সেখানে একদিন মাত্র থাকিয়া সৈন্যবাহিনী লইয়া তুগরলের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন।

বারনি লিখিয়াছেন, তুগরল জাজনগরের (উড়িষ্যা) দিকে পলাইয়াছিলেন; কিন্তু বলবন তুগরলের জলপথে পলায়নের পথ বন্ধ করিবার জন্য সোনারগাঁওয়ে গিয়া সেখানকার হিন্দু রাজা রায় দনুজের সহিত চুক্তি করিয়াছিলেন। লখনৌতি বা গৌড় হইতে উড়িষ্যা যাইবার পথে সোনারগাঁও পড়ে না। এইজন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক বারনির উক্তি ভুল বলিয়া মনে করিয়াছেন, কেহ কেহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে দ্বিতীয় জাজনগর রাজ্যের অস্তিত্ব কল্পনা করিয়াছেন, আবার কেহ কেহ বারনির গ্রন্থে ‘হাজীনগর’-এর স্থানে ‘জাজনগর’ লিখিত হইয়াছে বলিয়া মনে করিয়াছেন। কিন্তু সম্ভবত বারনির উক্তিতে কোনোই গোলযোগ নাই। তখন ‘জাজনগর’ বলিতে উড়িষ্যার রাজার অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল বুঝাইত, সে সময় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা এবং হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার অনেকাংশ উড়িষ্যার রাজার অধিকারে ছিল। সেইরূপ ‘সোনারগাঁও’ বলিতেও সোনারগাঁওয়ের রাজার অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল বুঝাইত; তখনকার দিনে শুধু পূর্ববঙ্গ নহে, মধ্যবঙ্গেরও অনেকখানি অঞ্চল এই রাজার অধীনে ছিল। বলবন খবর পাইয়াছিলেন যে তুগরল জাজনগর রাজ্যের দিকে গিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরার্ধ পার হইলেই তিনি ঐ রাজ্যে পৌঁছিবেন, কিন্তু বলবনের বাহিনী তাঁহার নাগাল ধরিয়া ফেলিলে তিনি পূর্বদিকে সরিয়া গিয়া সোনারগাঁওয়ের রাজার অধিকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া জলপথে পলাইতে পারেন, তখন আর তাঁহাকে ধরিবার কোনো উপায় থাকিবে না। এইজন্য বলবনকে সোনারগাঁওয়ের রাজা রায় দনুজের সহিত চুক্তি করিতে হইয়াছিল।

এখন প্রশ্ন এই যে, এই রায় দনুজ কে? ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গে দশরথদেব নামে একজন রাজা ছিলেন, ইহার পিতার নাম ছিল দামোদরদেব। দশরথদেব ও দামোদরদেবের কয়েকটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়াছে। দামোদরদেব ১২৩০-৩১ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অন্তত ১২৪৩-৪৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার পরে রাজা হন দশরথদেব, দশরথদেবের তাম্রশাসন হইতে জানা যায় তাঁহার ‘অরিরাজ–দনুজমাধব’ বিরুদ ছিল। বাংলার কুলজীগ্রন্থগুলিতে লেখা আছে যে লক্ষ্মণসেনের সামান্য পরে দনুজমাধব নামে একজন রাজার আবির্ভাব হইয়াছিল। বলবন ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে রায় দনুজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। সুতরাং ‘অরিরাজ-দনুজমাধব’ দশরথদেব কুলজীগ্রন্থের দনুজমাধব এবং বারনির গ্রন্থে উল্লিখিত রায় দনুজকে অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া গ্রহণ করা যায়।

রায় দনুজ অত্যন্ত পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। তিনি বলবনের শিবিরে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন এই শর্তে যে তিনি বলবনের সভায় প্রবেশ করিলে বলবন উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাকে সম্মান দেখাইবেন। বলবন এই শর্ত পালন করিয়াছিলেন।

যাহা হউক, বলবনের সহিত আলোচনার পর রায় দনুজ কথা দিলেন যে তুগরল যদি তাঁহার অধিকারের মধ্যে জলে বা স্থলে অবস্থান করেন অথবা জলপথে পলাইতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহাকে আটকাইবেন। ইহার পর বলবন ৭০ ক্রোশ চলিয়া জাজনগর রাজ্যের সীমান্তের খানিকটা দূরে পৌঁছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বারনির এই উক্তিকেও ভুল মনে করিয়াছেন, কিন্তু তখনকার ‘সোনারগাঁও রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত হইতে ‘জাজনগর’ রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের দূরত্ব কোনো কোনো জায়গায় কিঞ্চিদূর্ধ্ব ৭০ ক্রোশ (১৪০ মাইল) হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।

জাজনগরের সীমার কাছাকাছি উপস্থিত হইয়া বলবন তুগরলের কোনো সংবাদ পাইলেন না, তিনি অন্য পথে গিয়াছিলেন। বলবন মালিক বেক্তকে সাত-আট হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্য দিয়া আগে পাঠাইয়া দিলেন। বেতর চারিদিকে গুপ্তচর পাঠাইয়া তুগরলের খোঁজ লইতে লাগিলেন। অবশেষে একদিন তাঁহার দলের মুহম্মদ শের-আন্দাজ এবং মালিক মুকদ্দর একদল বণিকের কাছে সংবাদ পাইলেন যে তুগরল দেড় ক্রোশ দূরেই শিবির স্থাপন করিয়া আছেন, পরদিন তিনি জাজনগর রাজ্যে প্রবেশ করিবেন। শের-আন্দাজ মালিক বেক্তরূসের কাছে এই খবর পাঠাইয়া নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন অনুচর লইয়াই তুগরলের শিবির আক্রমণ করিলেন। তুগরল বলবনের সমগ্র বাহিনী আক্রমণ করিয়াছে ভাবিয়া শিবিরের সামনের নদী সাঁতরাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু একজন সৈন্য তাঁহাকে শরাহত করিয়া তাঁহার মাথা কাটিয়া ফেলিল। তখন তুগরলের সৈন্যেরা শের-আন্দাজ ও তাঁহার অনুচরদের আক্রমণ করিল। ইঁহারা হয়তো নিহত হইতেন, কিন্তু মালিক বেতস্ তাঁহার বাহিনী লইয়া সময়মত উপস্থিত হওয়াতে ইঁহারা রক্ষা পাইলেন।

তুগরল নিহত হইলে বলবন বিজয়গৌরবে লুণ্ঠনলব্ধ প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং বহু বন্দী লইয়া লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন। লখনৌতির বাজারে এক ক্রোশেরও অধিক দৈর্ঘ্য পরিমিত স্থান জুড়িয়া সারি সারি বধ্যমঞ্চ নির্মাণ করা হইল এবং সেই-সব বধ্যমঞ্চে তুগরলের পুত্র, জামাতা, মন্ত্রী, কর্মচারী, ক্রীতদাস, সৈন্যাধ্যক্ষ, দেহরক্ষী, তরবারি-বাহক এবং পাইকদের ফাঁসি দেওয়া হইল। তুগরলের অনুচরদের মধ্যে যাহারা দিল্লির লোক, তাহাদের দিল্লিতে লইয়া গিয়া তাহাদের আত্মীয় ও বন্ধুদের সামনে বধ করা হইবে বলিয়া বলবন স্থির করিলেন। অবশ্য দিল্লিতে লইয়া যাওয়ার পর বলবন দিল্লির কাজীর অনুরোধে তাহাদের অধিকাংশকেই মুক্তি দিয়াছিলেন। লখনৌতিতে এত লোকের প্রাণ বধ করিয়া বলবন যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার সমর্থকদেরও মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়াছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের পরে বলবন আরো কিছুদিন লখনৌতিতে রহিলেন এবং এখানকার বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করিলেন। তাঁহার পর তিনি তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। বুগরা খানকে অনেক সদুপদেশ দিয়া এবং পূর্ববঙ্গ বিজয়ের চেষ্টা করিতে বলিয়া বলবন আনুমানিক ১২৮২ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (বুগরা খান)

বলবনের কনিষ্ঠ পুত্রের প্রকৃত নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ, কিন্তু ইনি বুগরা খান নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তুগরলের বিরুদ্ধে বলবনের অভিযানের সময় ইনি বলবনের বাহিনীর পিছনে যে বাহিনী ছিল, তাহা পরিচালনা করিয়াছিলেন। বলবন তুগরলের স্বর্ণ ও হস্তীগুলি দিল্লিতে লইয়া গিয়াছিলেন, অন্যান্য সম্পত্তি বুগরা খানকে দিয়াছিলেন। বুগরা খানকে তিনি ছত্র প্রভৃতি রাজচিহ্ন ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়াছিলেন।

বুগরা খান অত্যন্ত অলস এবং বিলাসী ছিলেন। লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত হইয়া তিনি ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিলেন। পিতা দূর বিদেশে, সুতরাং বুগরা খানকে নিবৃত্ত করিবার কেহ ছিল না।

এইভাবে বৎসর চারেক কাটিয়া গেল। তাঁহার পর বলবনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মঙ্গোলদিগের সহিত যুদ্ধে নিহত হইলেন (১০ ফেব্রুয়ারি, ১২৮৫ খ্রী)। উপযুক্ত পুত্রের মৃত্যুতে বলবন শোকে ভাঙিয়া পড়িলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পীড়িত হইয়া শয্যা গ্রহণ করিলেন। বলবন তখন নিজের অন্তিম সময় আসন্ন। বুঝিয়া বুগরা খানকে বাংলা হইতে আনাইয়া তাঁহাকে দিল্লিতে থাকিতে ও তাঁহার মৃত্যুর পরে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিলেন। অতঃপর বুগরা খান তিন মাস দিল্লিতেই রহিলেন। কিন্তু কঠোর সংযমী বলবনের কাছে থাকিয়া ভোগবিলাসের তৃষ্ণা মিটানোর কোনো সুযোগই মিলিতেছিল না বলিয়া বুগরা খান অধৈর্য হইয়া উঠিলেন। এদিকে বলবনেরও দিন দিন অবস্থার উন্নতি হইতেছিল। তাঁহার ফলে একদিন বুগরা খান সমস্ত ধৈর্য হারাইয়া বসিলেন এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া আবার লখনৌতিতে ফিরিয়া গেলেন। পথে তিনি পিতার অবস্থার পুনরায় অবনতি হওয়ার সংবাদ পাইয়াছিলেন, কিন্তু আবার দিল্লিতে ফিরিতে তাঁহার সাহস হয় নাই। লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিয়া বুগরা খান পূর্ববৎ এদেশ শাসন করিতে লাগিলেন।

ইহার অল্প পরেই বলবন পরলোকগমন করিলেন (১২৮৭ খ্রী)। মৃত্যুকালে তিনি তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্রের পুত্র কাইখসরুকে আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার উজীর ও কোতোয়ালের সহিত কাইখসরুর পিতার বিরোধ ছিল, এইজন্য তাঁহারা কাইখসরুকে দিল্লির সিংহাসনে না বসাইয়া বুগরা খানের পুত্র কাইকোবাদকে বসাইলেন। এদিকে লখনৌতিতে বুগরা খান স্বাধীন হইলেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ ও খুত্বা পাঠ করাইতে সুরু করিলেন।

কাইকোবাদ তাঁহার পিতার চেয়েও বিলাসী ও উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি সুলতান হইবার পরে দিল্লির সন্নিকটে কীলোখারী নামক স্থানে একটি নূতন প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া চরম উজ্জ্বলতায় মগ্ন হইয়া গেলেন। মালিক নিজামুদ্দীন এবং মালিক কিওয়ামুদ্দীন নামে দুই ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ছিল, ইহাদের প্রথমজন প্রধান বিচারপতি ও রাজপ্রতিনিধি এবং দ্বিতীয়জন সহকারী রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হইল এবং ইহারাই রাজ্যের সর্বময় কর্ত্তা হইয়া দাঁড়াইল। ইহাদের কুমন্ত্রণায় কাইকোবাদ কাইখসরুকে নিহত করাইলেন, পুরাতন উজীরকে অপমান করিলেন এবং বলবনের আমলের কর্মচারীদের সকলকেই একে একে নিহত বা পদচ্যুত করিলেন।

কাইকোবাদ যে এইরূপে সর্বনাশের পথে অগ্রসর হইয়া চলিতেছেন, এই সংবাদ লখনৌতিতে বুগরা খানের কাছে পৌঁছিল। তিনি তখন পুত্রকে অনেক সদুপদেশ দিয়া পত্র লিখিলেন। কিন্তু কাইকোবাদ ( বোধ হয় পিতার “উপযুক্ত পুত্র” বলিয়াই) পিতার উপদেশ কর্ণপাত করিলেন না। বুগরা খান যখন দেখিলেন যে পত্র লিখিয়া কোনো লাভ নাই, তখন তিনি স্থির করিলেন দিল্লির সিংহাসন অধিকার করার চেষ্টা করিবেন এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি এক সৈন্যবাহিনী লইয়া অগ্রসর হইলেন।

পিতা সসৈন্যে দিল্লিতে আসিতেছেন শুনিয়া কাইকোবাদ তাঁহার প্রিয়পাত্র নিজামুদ্দীনের সহিত পরামর্শ করিলেন এবং তাঁহার পরামর্শ অনুযায়ী এক সৈন্যবাহিনী লইয়া বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। সরযূ নদীর তীরে যখন তিনি পৌঁছিলেন তখন বুগরা খান সরযূর অপর পারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

ইহার পর দুই-তিন দিন উভয় বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া রহিল। কিন্তু যুদ্ধ হইল না। তাঁহার বদলে সন্ধির কথাবার্তা চলিতে লাগিল। সন্ধির শর্ত স্থির হইলে বুগরা খান তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র কাইকাউসকে উপঢৌকন সমেত কাইকোবাদের দরবারে পাঠাইলেন। কাইকোবাদও পিতার কাছে নিজের শিশুপুত্র কাইমুরকে একজন উজীরের সঙ্গে উপহারসমেত পাঠাইলেন। পৌত্রকে দেখিয়া বুগরা খান সমস্ত কিছু ভুলিয়া গেলেন এবং দিল্লির উজীরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া তাহাকে আদর করিতে লাগিলেন।

দুষ্ট নিজামুদ্দীনের পরামর্শে কাইকোবাদ এই শর্তে বুগরা খানের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন যে বুগরা খান কাইকোবাদের সভায় সাধারণ প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তার মতোই তাঁহাকে অভিবাদন করিবেন ও সম্মান দেখাইবেন। অনেক আলাপ আলোচনা ও ভীতিপ্রদর্শনের পরে বুগরা খান এই শর্তে রাজী হইয়াছিলেন। এই শর্ত পালনের জন্য বুগরা খান একদিন বৈকালে সরযূ নদী পার হইয়া কাইকোবাদের শিবিরে গেলেন। কাইকোবাদ তখন সম্রাটের উচ্চ মসনদে বসিয়াছিলেন। কিন্তু পিতাকে দেখিয়া তিনি আর থাকিতে পারিলেন না। তিনি খালি পায়েই তাঁহার পিতার কাছে দৌড়াইয়া গেলেন এবং তাঁহার পায়ে পড়িবার উপক্রম করিলেন। বুগরা খান তখন কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। কাইকোবাদ পিতাকে মসনদে বসিতে বলিলেন, কিন্তু বুগরা খান তাহাতে রাজী না হইয়া পুত্রকে লইয়া গিয়া মসনদে বসাইয়া দিলেন এবং নিজে মসনদের সামনে করজোড়ে দাঁড়াইয়া রহিলেন। এইভাবে বুগরা খান “ম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর কাইকোবাদ মসনদ হইতে নামিয়া আসিলেন। তখন সভায় উপস্থিত আমীরেরা দুই বাদশাহের শির স্বর্ণ ও রত্নে ভূষিত করিয়া দিলেন। শিবিরের বাহিরে উপস্থিত লোকেরা শিবিরের মধ্যে আসিয়া দুইজনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে লাগিল, কবিরা বাদশাহদ্বয়ের প্রশস্তি করিতে লাগিলেন, এক কথায় পিতাপুত্রের মিলনে কাইকোবাদের শিবিরে মহোৎসব উপস্থিত হইল। তাঁহার পর বুগরা খান নিজের শিবিরে ফিরিয়া আসিলেন।

ইহার পরেও কয়েকদিন বুগরা খান ও কাইকোবাদ সরযূ নদীর তীরেই রহিয়া গেলেন। এই কয়দিনও পিতাপুত্রে সাক্ষাৎকার ও উপহারবিনিময় চলিয়াছিল। বিদায়গ্রহণের পূর্বাহে বুগরা খান কাইকোবাদকে প্রকাশ্যে অনেক সদুপদেশ দিলেন, সংযমী হইতে বলিলেন এবং মালিক নিজামুদ্দীন ও কিওয়ামুদ্দীনকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ করিতে পরামর্শ দিলেন, কিন্তু বিদায় লইবার সময় কাইকোবাদের কানে কানে বলিলেন যে, তিনি যেন এই দুইজন আমীরকে প্রথম সুযোগ পাইবামাত্র বধ করেন। ইহার পর দুই সুলতান নিজের নিজের রাজধানীতে ফিরিয়া গেলেন।

বিখ্যাত কবি আমীর খসরু কাইকোবাদের সভাকবি ছিলেন এবং এই অভিযানে তিনি কাইকোবাদের সঙ্গে গিয়াছিলেন। কাইকোবাদের নির্দেশে তিনি বুগরা খান ও কাইকোবাদের এই মধুর মিলন অবিকলভাবে বর্ণনা করিয়া ‘কিরান-ই-সদাইন’ নামে একটি কাব্য লিখেন। সেই কাব্য হইতেই উপরের বিবরণ সংকলিত হইয়াছে।

কাইকোবাদের সঙ্গে সন্ধি হইবার পরে বুগরা খান-আউধের যে অংশ তিনি অধিকার করিয়াছিলেন, তাহা কাইকোবাদকে ফিরাইয়া দেন। কিন্তু বিহার তিনি নিজের দখলেই রাখিলেন।

দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিবার পথে কাইকোবাদ মাত্র কয়েকদিন ভালোভাবে চলিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার পর আবার তিনি উচ্ছঙ্খল হইয়া উঠেন। তাঁহার প্রধান সেনাপতি জলালুদ্দীন খিলজী তাঁহাকে হত্যা করান (১২৯০ খ্রী)। ইহার তিনমাস পরে জলালুদ্দীন কাইকোবাদের শিশুপুত্র কাইমুকে অপসারিত করিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইহার পর বৎসর হইতে বাংলার সিংহাসনে বুগরা খানের দ্বিতীয় পুত্র রুকনুদ্দীন কাইকাউসকে অধিষ্ঠিত দেখিতে পাই। কাইকোবাদের মৃত্যুজনিত শোকই বুগরা খানের সিংহাসন ত্যাগের কারণ বলিয়া মনে হয়।

রুকনুদ্দীন কাইকাউস

মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, রুকনুদ্দীন কাইকাউস ৬৯০ হইতে ৬৯৮ হি বা ১২৯১ হইতে ১২৯৮-৯৯ খ্রী পর্যন্ত লখনৌতির সুলতান ছিলেন। তাঁহার রাজত্বকালে বিশেষ কোনো ঘটনার কথা জানা যায় নাই।

কাইকাউসের প্রথম বৎসরের একটি মুদ্রায় লেখা আছে যে ইহা ‘বঙ্গ’-এর ভূমি-রাজস্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছে। সুতরাং পূর্ববঙ্গের কিছু অংশ যে কাইকাউসের রাজ্যভুক্ত ছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই অংশ ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই মুসলমানগণ কর্ত্তৃক বিজিত হইয়াছিল। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী অঞ্চলও কাইকাউসের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্ভবত এই অঞ্চল কাইকাউসের রাজত্বকালেই প্রথম বিজিত হয়, কারণ প্রাচীন প্রবাদ অনুসারে জাফর খান নামে একজন বীর মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ত্রিবেণী জয় করিয়াছিলেন। কাইকাউসের অধীনস্থ রাজপুরুষ এক জাফর খানের নামাঙ্কিত দুইটি শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তন্মধ্যে একটি শিলালিপি ত্রিবেণীতেই মিলিয়াছে। ইহা হইতে মনে হয়, এই জাফর খানই কাইকাউসের রাজত্বকালে ত্রিবেণী জয় করেন। বিহারেও কাইকাউসের অধিকার ছিল, এই প্রদেশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন খান ইখতিয়ারুদ্দীন ফিরোজ আতিগীন নামে একজন প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি।

কাইকাউসের সহিত প্রতিবেশী রাজ্যগুলির কী রকম সম্পর্ক ছিল, সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে দিল্লির খিলজী সুলতানদের বাংলার উপর একটা আক্রোশ ছিল। জলালুদ্দীন খিলজী মুসলিম ঠগীদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত না করিয়া নৌকায় বোঝাই করিয়া বাংলা দেশে পাঠাইয়া দিতেন, যাহাতে উহারা বাংলা দেশে লুঠতরাজ চালাইয়া এদেশের শাসক ও জনসাধারণকে অস্থির করিয়া তুলে।

শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ

রুকনুদ্দীন কাইকাউসের পর শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ লখনৌতির সুলতান হন। ৭০১ হইতে ৭২২ হি বা ১৩০১ হইতে ১৩২২ খ্রী–এই সুদীর্ঘ একুশ বৎসর কাল তিনি রাজত্ব করেন। তাঁহার রাজ্যের আয়তন ছিল বিরাট। তাঁহার পূর্ববর্তী লখনৌতির সুলতানরা যে রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন, তাঁহার অতিরিক্ত বহু অঞ্চল –সাতগাঁও, ময়মনসিংহ ও সোনারগাঁও, এমন-কি সুদূর সিলেট পর্যন্ত তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। ইনি অত্যন্ত পরাক্রান্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন নরপতি ছিলেন, কিন্তু ইহার সম্বন্ধে খুব কম তথ্যই জানা যায়। ইহার বংশপরিচয়ও আমাদের অজ্ঞাত। ইন্বতার মতে ইনি বুগরা খানের পুত্র। কিন্তু মুদ্রার সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা ইবুবক্তৃতার মত ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। যতদূর মনে হয় রুকনুদ্দীন কাইকাউসের আমলে যিনি বিহারের শাসনকর্ত্তা ছিলেন, সেই ইখতিয়ারুদ্দীন ফিরোজ আতিগীনই কাইকাউসের মৃত্যুর পরে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ নাম লইয়া সুলতান হন। ইতিপূর্বে বলবন বুগরা খানকে সাহায্য করিবার জন্য “ফিরোজ” নামক দুইজন যোগ্য ব্যক্তিকে বাংলা দেশে রাখিয়া গিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একজন ফিরোজকে বুগরা খান কাইকোবাদের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন; অপরজন বাংলাতেই ছিলেন, ইনিও আমাদের আলোচ্য শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের সহিত অভিন্ন হইতে পারেন।

শিলালিপির সাক্ষ্যের সহিত প্রাচীন কিংবদন্তীর সাক্ষ্য মিলাইয়া লইলে দেখা যায়, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলেই সর্বপ্রথম সাতগাঁও মুসলিম শক্তি কর্ত্তৃক বিজিত হয়; এই বিজয়ে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব করেন ত্রিবেণী-বিজেতা জাফর খান; এই জাফর খান অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন, শিলালিপিতে ইনি “রাজা ও সম্রাটদের সাহায্যকারী” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন; ত্রিবেণী ও সাতগাঁও বিজয়ের পরে জাফর খান এই অঞ্চলেই পরলোকগমন করেন; ত্রিবেণীতে তাঁহার সমাধি আছে।

শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায়, শ্রীহট্ট বা সিলেটও শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজত্বকালেই প্রথম বিজিত হইয়াছিল এবং সিলেট-বিজয়ের ব্যাপারে শেষ জলাল মুজাররদ কুন্যায়ী (কুন্যার অধিবাসী) নামে একজন দরবেশ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। শাহ জলাল নামে একজন দরবেশ মুসলমানদের সিলেট অভিযানে নেতৃত্ব করিয়াছিলেন বলিযা প্রাচীন প্রবাদও আছে। এই শেখ জলাল বা শাহ জলাল বিখ্যাত দরবেশ শেখ জালালুদ্দিন তব্রিজী (১২৯৭-১৩৪৭ খ্রী) হইতে ভিন্ন ব্যক্তি।

কিংবদন্তী অনুসারে সাতগাঁও ও সিলেটের শেষ হিন্দু রাজাদের নাম যথাক্রমে ভূদেব নৃপতি ও গৌড়গোবিন্দ; উভয়েই নাকি গোবধ করার জন্য মুসলিম প্রজাদের পীড়ন করিয়াছিলেন এবং সেই কারণে মুসলমানরা তাহাদের রাজ্য আক্রমণ ও অধিকার করিয়াছিল। এই-সব কিংবদন্তীর বিশেষ কোনো ভিত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না।

শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের অন্তত ছয়টি বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্র ছিলেন বলিয়া জানা যায়। ইঁহাদের নাম-শিহাবুদ্দীন বুগড়া শাহ, জলালুদ্দীন মাহমুদ শাহ, গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ, নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ, হাতেম খান ও কলু খান। ইঁহাদের মধ্যে হাতেম খান পিতার রাজত্বকালে বিহার অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন বলিয়া শিলালিপি হইতে জানা যায়। শিহাবুদ্দীন, জলালুদ্দীন, গিয়াসুদ্দীন ও নাসিরুদ্দীন পিতার জীবদ্দশাতেই বিভিন্ন টাকশাল হইতে নিজেদের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহা হইতে কেহ কেহ মনে করিয়াছেন যে ইঁহারা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন। কিন্তু এই মত যে ভ্রান্ত, তাহা মুদ্রার সাক্ষ্য এবং বিহারের সমসাময়িক দরবেশ হাজী আহমদ য়াহয়া মনেরির মলফুজৎ’ (আলাপ-আলোচনার সগ্রহ)-এর সাক্ষ্য হইতে প্রতিপন্ন হয়। প্রকৃত সত্য এই যে, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ তাঁহার ঐ চারিজন পুত্রকেও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের নিজ গ্রামে মুদ্রা প্রকাশের অধিকার দিয়াছিলেন।

আহমদ য়াহয়া মনেরির ‘মলফুজৎ’-এর মতে ‘কামরু’ (কামরূপ)-ও শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল এবং তাঁহার শাসনকর্ত্তা ছিলেন গিয়াসুদ্দীন। এই মলফুজৎ হইতে জানা যায় যে গিয়াসুদ্দীন অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত প্রকৃতির এবং হাতেম খান একান্ত মৃদু ও উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন। ‘মলফুজৎ’-এর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজধানী ছিল সোনারগাঁওয়ে।

চর্তুদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হইতেই বাংলার সুলতানের মুদ্রায় পাণ্ডুয়া (মালদহ জেলা) নগরের নামান্তর ‘ফিরোজাবাদ’-এর উল্লেখ দেখা যায়। সম্ভবত শামসুদ্দীন ফিরোজশাহের নাম অনুসারেই নগরীটির এই নাম রাখা হইয়াছিল।

বাহাদুর শাহ ও নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ

শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তিনজন সমসাময়িক লেখকের বিবরণ পাওয়া যায়। ইঁহারা হইলেন জিয়াউদ্দীন বারনি, ইসমি এবং ইবনবতা। এই তিনজন লেখকের উক্তি এবং মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে যাহা জানা যায়, তাঁহার সংক্ষিপ্তসার নীচে প্রদত্ত হইল।

শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র শিহাবুদ্দীন বুগড়া শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। কিন্তু তাঁহার ভ্রাতা গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ শিহাবুদ্দীনকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া লখনৌতি অধিকার করিলেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরের হাতে শিহাবুদ্দীন বুগড়া ও নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম ব্যতীত তাঁহার আর সমস্ত ভ্রাতাই নিহত হইলেন। শিহাবুদ্দীন ও নাসিরুদ্দীন দিল্লির তৎকালীন সুলতান গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। শিহাবুদ্দীন বুগড়া সম্ভবত সাহায্য প্রার্থনা করার অব্যবহিত পরেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন, কারণ ইহার পরে তাঁহার আর কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। বারনি লিখিয়াছেন যে লখনৌতির কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক এই সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিলেন এবং তাঁহার পুত্র জুনা খানের উপর দিল্লির শাসনভার অর্পণ করিয়া পূর্ব ভারত অভিমুখে সসৈন্যে যাত্রা করিলেন (জানুয়ারি, ১৩২৪ খ্রী)। প্রথমে তিনি ত্রিহুত আক্রমণ করিলেন এবং সেখানকার কর্ণাট-বংশীয় রাজা হরিসিংহদেবকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া ঐ রাজ্যে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা করিলেন। ত্রিহুতে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিত তাঁহার সহিত যোগদান করিলেন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক তাঁহার পালিত পুত্র তাতার খানের অধীনে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নাসিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলেন। এই বাহিনী লখনৌতি অধিকার করিয়া লইল।

গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ ইতিমধ্যে লখনৌতি হইতে পূর্ববঙ্গে পলাইয়া গিয়াছিলেন এবং গিয়াসপুর (বর্তমান ময়মনসিংহ শহরের ২৫ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে) অবস্থান করিতেছিলেন। শত্রুবাহিনীর অগ্রগতির খবর পাইয়া তিনি ঐ ঘাঁটি হইতে বাহির হইয়া লখনৌতির দিকে অগ্রসর হইলেন।

অতঃপর দুই পক্ষে যুদ্ধ হইল। ইসমি এই যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়াছেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর প্রচণ্ড আক্রোশে তাঁহার ভ্রাতা নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম-পরিচালিত শত্রুবাহিনীর বাম অংশে আক্রমণ চালাইতে লাগিলেন। তাঁহার আক্রমণের মুখে দিল্লির সৈন্যেরা প্রথম প্রথম ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু সংখ্যাধিক্যের বলে তাহারা শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর তখন পূর্ববঙ্গের দিকে পলায়ন করিলেন। হয়বউল্লার নেতৃত্বে দিল্লির একদল সৈন্য তাঁহার অনুসরণ করিল। অবশেষে গিয়াসুদ্দীনের ঘোড়া একটি নদী পার হইতে গিয়া কাদায় পড়িয়া গেলে দিল্লির সৈন্যেরা তাহাকে বন্দী করিল। . গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরকে তখন লখনৌতিতে লইয়া যাওয়া হইল এবং সেখানে দড়ি বাঁধিয়া তাঁহাকে গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সভায় উপস্থিত করা হইল।

গিয়াসুদ্দীন তুগলক বাংলাকে তাঁহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিমকে লখনৌতি অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করিলেন; তাতার খান সোনারগাঁও ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন। নাসিরুদ্দীনের নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে সার্বভৌম সম্রাট হিসাবে প্রথমে গিয়াসুদ্দীন তুগলকের এবং পরে মুহম্মদ তুগলকের নাম থাকিত।

গিয়াসুদ্দীন তুগলক বাংলা দেশ হইতে লুণ্ঠিত বহু ধনরত্ন এবং বন্দী গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরকে লইয়া দিল্লির দিকে রওনা হইলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি দিল্লিতে পৌঁছিতে পারেন নাই। তাঁহার পুত্র জুনা খান দিল্লির উপকণ্ঠে তাঁহার অভ্যর্থনার জন্য যে মণ্ডপ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রবেশ করিবামাত্র তাহা ভাঙিয়া পড়িল এবং ইহাতেই তাঁহার প্রাণান্ত হইল (১৩২৫ খ্রী)।

ইহার পর জুনা খান মুহম্মদ শাহ নাম লইয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ তুগলক নামে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করিলেন। লখনৌতি অঞ্চলের শাসনভার কেবলমাত্র নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহের অধীনে না রাখিয়া তিনি পিণ্ডার খিলজী নামে এক ব্যক্তিকে নাসিরুদ্দীনের সহযোগী শাসনকর্ত্তা রূপে নিয়োগ করিয়া দিল্লি হইতে পাঠাইয়া দিলেন এবং পিণ্ডারকে ‘কদর খান’ উপাধি দিলেন; মালিক আবু রেজাকে তিনি লখনৌতির উজীরের পদে নিয়োগ করিলেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহকেও তিনি মুক্তি দিলেন এবং তাঁহাকে সোনারগাঁওয়ে তাতার খানের সহযোগী শাসকর্ত্তারূপে নিয়োগ করিয়া পাঠাইলেন; ইতিপূর্বে তিনি তাঁহার অভিষেকের সময়ে তাতার খানকে ‘বহরাম খান’ উপাধি দিয়াছিলেন। মালিক ইজুদ্দীন য়াহিয়াকে তিনি সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিলেন।

ইহার দুই বৎসর পর যখন মুহম্মদ তুগলক কিসলু খানের বিদ্রোহ দমন করিতে মুলতানে গেলেন (৭২৮ হি = ১৩২৭-২৮ খ্রী), তখন লখনৌতি হইতে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম গিয়া তাঁহার সহিত যোগদান করিলেন এবং কিসলু খানের সহিত যুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দিলেন। ইহার পর নাসিরুদ্দীনের কী হইল, সে সম্বন্ধ কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না।

গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ ১৩২৫ খ্রী হইতে ১৩২৮ খ্রী পর্যন্ত বহরম খানের সঙ্গে যুক্তভাবে সোনারগাঁও অঞ্চল শাসন করেন। এই কয় বৎসর তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করেন; সেই-সব মুদ্রায় যথারীতি সম্রাট হিসাবে মুহম্মদ তুগলকের নামও উল্লিখিত থাকিত। অতঃপর মুহম্মদ তুগলক যখন মুলতানে কিসলু খানের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর সুযোগ বুঝিয়া বিদ্রোহ করিলেন। কিন্তু বহরাম খানের তৎপরতার দরুন তিনি বিশেষ কিছু করিবার সুযোগ পাইলেন না। বহরাম খান গিয়াসুদ্দীনের বিদ্রোহের সংবাদ পাইবামাত্র সমস্ত সেনানায়ককে একত্র করিলেন এবং এই সম্মিলিত বাহিনী লইয়া গিয়াসুদ্দীনকে আক্রমণ করিলেন। তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া গিয়াসুদ্দীন পরাজিত হইলেন এই যমুনা নদীর দিকে পলাইতে লাগিলেন। কিন্তু বহরাম খান তাঁহার সৈন্যবাহিনীকে পিছন হইতে আক্রমণ করিলেন। গিয়াসুদ্দীনের বহু সৈন্য নদী পার হইতে গিয়া জলে ডুবিয়া গেল। গিয়াসুদ্দীন স্বয়ং বহরাম খানের হাতে বন্দী হইলেন। বহরাম খান তাঁহাকে বধ করিয়া তাঁহার গাত্রচর্ম ছাড়াইয়া লইয়া মুহম্মদ তুগলকের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। মুহম্মদ তুগলক সমস্ত সংবাদ শুনিয়া সকলকে চল্লিশ দিন উৎসব করিতে আদেশ দিলেন এবং গিয়াসুদ্দীন ও মুলতানের বিদ্রোহীর গাত্রচর্ম বিজয়-গম্বুজে টাঙাইয়া রাখিতে আদেশ দিলেন।

ইহার পর দশ বৎসর কদর খান, বহরাম খান ও মালিক ইজুদ্দীন য়াহিয়া মুহম্মদ তুগলকের অধীনস্থ শাসনকর্ত্তা হিসাবে যথাক্রমে লখনৌতি, সোনারগাঁও ও সাতগাঁও অঞ্চল শাসন করেন। এই দশ বৎসরের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে নাই। ১৩৩৮ খ্রীষ্টাব্দে বহরম খান পরলোক গমন করিবার পর তাঁহার বৰ্মরক্ষক ফখরুদ্দীন সোনারগাঁওয়ে বিদ্রোহ করিলেন। এই ঘটনা হইতেই বাংলার ইতিহাসের একটি নূতন অধ্যায় সুরু হইল।

০৩. বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ

জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থে ফখরুদ্দীনের বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় কিঞ্চিৎ পরবর্তীকালে রচিত ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’ হইতে।

এই বিবরণ নির্ভরযোগ্য। এই গ্রন্থের মতে বহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁহার বর্ম্মরক্ষক ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও অধিকার করিয়া নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কদর খান, সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তা ইজুদ্দীন য়াহিয়া এবং সম্রাটের অধীনস্থ অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তাঁহাকে দমন করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন। তাঁহাদের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ফখরুদ্দীন পলায়ন করেন। তাঁহার হাতি ও ঘোড়াগুলি কদর খানের অধীনে আসে। কদর খান লুঠ করিয়া অনেক রৌপ্যমুদ্রাও হস্তগত করেন। মালিক হিসামুদ্দীন নামে জনৈক পদস্থ অমাত্য কদর খানকে এই অর্থ রাজকোষে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন। কিন্তু কদর খান তাহা করিলেন না। তিনি সৈন্যদের এই লুঠের কোনো ভাগও দিলেন না। ইহাতে সৈন্যেরা তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইল এবং তাহারা ফখরুদ্দীনের সঙ্গে যোগ দিয়া কদর খানকে হত্যা করিল। ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও পুনরধিকার করিলেন। লখনৌতিও তিনি সাময়িকভাবে অধিকার করিলেন এবং মুখলিশ নামে এক ব্যক্তিকে ঐ অঞ্চলে শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু কদর খানের অধীনস্থ আরিজ-ই-লস্কর (সৈন্যবাহিনীর বেতন-দাতা) আলী মুবারক মুখলিশকে বধ করিয়া লখনৌতি অধিকার করিলেন। তিনি মুহম্মদ তুগলককে লখনৌতিতে একজন শাসনকর্ত্তা পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন। মুহম্মদ তুগলক দিল্লির শাসনকর্ত্তা য়ুসুফকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু লখনৌতিতে পৌঁছিবার পূর্বেই য়ুসুফ পরলোকগমন করিলেন। মুহম্মদ তুগলক আর কাহাকেও তাঁহার জায়গায় নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন না। এদিকে লখনৌতিতে কোনো শাসনকর্ত্তা না থাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল। ইহার জন্য ফখরুদ্দীনের আক্রমণ রোধ করাও কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। তাই আলী মুবারক বাধ্য হইয়া আলাউদ্দীন (আলাউদ্দীন আলী শাহ) নাম গ্রহণ করিয়া নিজেকে লখনৌতির নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলেন।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ লখনৌতি বেশিদিন নিজের অধিকারে রাখিতে পারেন। নাই বটে, কিন্তু সোনারগাঁও সমেত পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ বরাবরই তাঁহার অধীনে ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ঔরঙ্গজেবের অধীনস্থ কর্মচারী শিহাবুদ্দীন তালিশ লিখিয়াছিলেন যে ফখরুদ্দীন চট্টগ্রামও জয় করিয়াছিলেন এবং চাঁদপুর হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তিনি একটি বাঁধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; চট্টগ্রামের বহু মসজিদ ও সমাধিও তাঁহারই আমলে নির্মিত হয়।

ইবন বতুতা ফখরুদ্দীনের রাজত্বকালে বাংলা দেশে আসিয়াছিলেন। তিনি গোলযোগের ভয়ে ফখরুদ্দীনের সহিত দেখা করেন নাই। ইবন্ বক্তৃতার ভ্রমণ বিবরণী হইতে ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে অনেক সংবাদ পাওয়া যায়। ইবন বতুতা লিখিয়াছেন যে, ফখরুদ্দীনের সহিত (আলাউদ্দীন) আলী শাহের প্রায়ই যুদ্ধ হইত। ফখরুদ্দীনের নৌবল বেশি শক্তিশালী ছিল, তাই তিনি বর্ষাকাল ও শীতকালে লখনৌতি আক্রমণ করিতেন, কিন্তু গ্রীষ্মকালে আলী শাহ ফখরুদ্দীনর রাজ্য আক্রমণ করিতেন, কারণ স্থলে তাঁহারই শক্তি বেশি ছিল। ফকীরদের প্রতি ফখরুদ্দীনের অপরিসীম দুর্বলতা ছিল। তিনি একবার শায়দা নামে একজন ফকীরকে তাঁহার অন্যতম রাজধানী সোদকাওয়াঙ’ অর্থাৎ চাটগাঁও শহরে তাঁহার প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়া জনৈক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়াছিলেন। বিশ্বাসঘাতক শায়দা সেই সুযোগে বিদ্রোহ করে এবং ফখরুদ্দীনের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে। ফখরুদ্দীন তখন ‘চাটগাঁওয়ে’ ফিরিয়া আসেন। শায়দা তখন সোনারগাঁও-এ পলাইয়া যায় এবং ঐ স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া থাকে, কিন্তু সোনারগাঁওয়ের অধিবাসীরা তাহাকে বন্দী করিয়া সুলতানের বাহিনীর কাছে পাঠাইয়া দেয়। তখন শায়দা ও অন্য অনেক ফকীরের প্রাণদণ্ড হইল। ইহার পরেও কিন্তু ফখরুদ্দীনের ফকীরদের প্রতি দুর্বলতা কমে নাই। তাঁহার আদেশের বলে ফকীররা মেঘনা নদী দিয়া বিনা ভাড়ায় নৌকায় যাতায়াত করিতে পারিত; নিঃসম্বল ফকীরদের খাদ্যও দেওয়া হইত। সোনারগাঁও শহরে কোনো ফকীর আসিলে সে আধ দীনার (আট আনার মতো) পাইত।

ইবন বতুতার বিবরণ হইতে জানা যায় যে ফখরুদ্দীনের আমলে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব সুলভ ছিল। ফখরুদ্দীন কিন্তু হিন্দুদের প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করেন নাই। ইবন বতুতা হব’ শহরে (আধুনিক শ্রীহট্ট জেলার অন্ত ভুক্ত) গিয়া দেখিয়াছিলেন যে সেখানকার হিন্দুরা তাহাদের উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক সরকারকে দিতে বাধ্য হইত এবং ইহা ব্যতীত তাহাদের আরো নানারকম কর দিতে হইত।

কয়েকখানি ইতিহাসগ্রন্থের মতে ফখরুদ্দীন শক্রর হাতে নিহত হইয়া পরলোকগমন করিয়াছিলেন। কিন্তু কাহার হাতে তিনি নিহত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে বিভিন্ন বিবরণের উক্তির মধ্যে ঐক্য নাই এবং এই-সব বিবরণের মধ্যে যথেষ্ট ভুলও ধরা পড়িয়াছে। ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে যে-সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার ভিত্তিতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ হইতে ১৩৫০ খ্রী পর্যন্ত রাজত্ব করিয়া স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন।

ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে আর-একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে তাঁহার মুদ্রাগুলি অত্যন্ত সুন্দর, বাংলাদেশে প্রাপ্ত সমস্ত মুদ্রার মধ্যে এইগুলিই শ্রেষ্ঠ।

ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ঠিক পরেই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ নামে এক ব্যক্তি পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন (১৩৪৯-১৩৫২ খ্রী)। ইখতিয়ারুদ্দীনের সোনারগাঁও এর টাকশালে উৎকীর্ণ অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। এই মুদ্রাগুলি হুবহু ফখরুদ্দীনের মুদ্রার অনুরূপ। এইসব মুদ্রায় ইখতিয়ারুদ্দীনকে “সুলতানের পুত্র সুলতান” বলা হইয়াছে। সুতরাং ইখতিয়ারুদ্দীন যে ফখরুদ্দীনেরই পুত্র, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইতিহাসগ্রন্থগুলিতে এই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নাম পাওয়া যায় না, তবে ‘মলফুজুস-সফর’ নামে একটি সমসাময়িক সূফীগ্রন্থে ইহার নাম উল্লিখিত হইয়াছে।

৭৫৩ হিজরায় (১৩৫২-৫৩ খ্রী) শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও অধিকার করেন। কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থের মতে তিনি ফখরুদ্দীনকে এই সময়ে বধ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইতে পারে না, কারণ ফখরুদ্দীন ইহার তিন বৎসর পূর্বেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন। সম্ভবত ইখতিয়ারুদ্দীনই ইলিয়াস শাহের হাতে নিহত হন।

আলাউদ্দীন আলী শাহ

আলাউদ্দীন আলী শাহ কীভাবে লখনৌতির রাজা হইয়াছিলেন, তাহা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের সহিত আলী শাহের প্রায়ই সংঘর্ষ হইত। এ সম্বন্ধেও পূর্বে আলোচনা করা হইয়াছে।

আলী শাহ সম্ভবত লখনৌতি অঞ্চল ভিন্ন আর-কোনো অঞ্চল অধিকার করিতে পারেন নাই। তাঁহার সমস্ত মুদ্রাই পাণ্ডুয়া বা ফিরোজাবাদের টাকশালে নির্মিত হইয়াছিল। যতদূর মনে হয় তিনি গৌড় বা লখনৌতি হইতে পাণ্ডুয়ায় তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। ইহার পর প্রায় একশত বৎসর পাণ্ডুয়াই বাংলার রাজধানী ছিল। আলাউদ্দীন আলী শাহ ৭৪২ হিজরায় (১৩৪১ ৪২ খ্রী) সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং মাত্র এক বৎসর কয়েক মাস রাজত্ব করিয়া পরলোক গমন করেন। মালিক ইলিয়াস হাজী নামে তাঁহার অধীনস্থ এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করিয়া তাহাকে বধ করেন এবং শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নাম গ্রহণ করিয়া নিজে সুলতান হন।

পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত শাহ জলালের দরগা’ আলাউদ্দীন আলী শাহই প্রথম নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পূর্ব-ইতিহাস বিশেষ কিছু জানা যায় না। চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শতাব্দীর আরবী ঐতিহাসিক ই-ই হজর ও আল-সখাওয়ীর মতে ইলিয়াস শাহের আদি নিবাস ছিল পূর্ব ইরানের সিজিস্তানে। পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাসগ্রন্থগুলির কোনোটিতে তাঁহাকে আলী শাহের ধাত্রীমাতার পুত্র, কোনোটিতে তাঁহার ভৃত্য বলা হইয়াছে।

লখনৌতি রাজ্যের অধীশ্বর হইবার পর ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার ও অর্থসংগ্রহে মন দেন। প্রথমে সম্ভবত তিনি সাতগাঁও অঞ্চল অধিকার করেন। নেপালের সমসাময়িক শিলালিপি ও গ্রন্থাদি হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস নেপাল আক্রমণ করিয়া সেখানকার বহু নগর জ্বালাইয়া দেন এবং বহু মন্দির ধ্বংস করেন; বিখ্যাত পশুপতিনাথের মূর্ত্তিটি তিনি তিন খণ্ড করেন (১৩৫০ খ্রী)। ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার করিবার জন্য নেপালে অভিযান করেন নাই, সেখানে ব্যাপকভাবে লুঠপাট করিয়া ধন সংগ্রহ করাই ছিল তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য। ‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ও ‘তারিখ-ই ফিরিশতা’য় লেখা আছে, ইলিয়াস উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া চিল্কা হ্রদের সীমা পর্যন্ত অভিযান চালান এবং সেখানে ৪৪টি হাতি সমেত অনেক সম্পত্তি লুঠ করেন। বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে জানা যায় যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়াছিলেন; ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মুল্লা তকিয়ার মতে ইলিয়াস হাজীপুর অবধি জয় করেন। সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ নামে একটি সমসাময়িক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী প্রভৃতি অঞ্চলও জয় করেন। পূর্বদিকেও ইলিয়াস রাজ্যবস্তিার করিয়াছিলেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় যে ইলিয়াস ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নিকট হইতে সোনারগাঁও অঞ্চল অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন (১৩৫২ খ্রী)। কামরূপেরও অন্তত কতকাংশ ইলিয়াসের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল, কারণ তাঁহার পুত্র সিকন্দর শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসরের একটি মুদ্রা কামরূপের টাকশালে উত্তীর্ণ হইয়াছিল।

এইভাবে ইলিয়াস শাহ নানা রাজ্য জয় করায় এবং পূর্বতন তুগলক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক অঞ্চল অধিকার করায় দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুগলক ক্রুদ্ধ হন এবং ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। এই অভিযানের সময় ফিরোজ শাহ কর হ্রাস প্রভৃতির প্রলোভন দেখাইয়া ইলিয়াস শাহের প্রজাদের দলে টানিবার চেষ্টা করেন এবং তাহাতে আংশিক সাফল্য লাভ করেন। এই অভিযানের ফলে শেষপর্যন্ত ত্রিহুত প্রভৃতি নববিজিত অঞ্চলগুলি ইলিয়াসের হস্তচ্যুত হয়, কিন্তু বাংলায় তাঁহার সার্বভৌম অধিকার অক্ষুণ্ণই রহিয়া যায়।

জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’, শামস্-ই সিরাজ আফিফ-এর ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং অজ্ঞাতনামা সমসাময়িক ব্যক্তির লেখা ‘সিরাৎ-ই ফিরোজ শাহী’ হইতে ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের সংঘর্ষের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। এই তিনটি গ্রন্থই ফিরোজ শাহের পক্ষভুক্ত লোকের লেখা বলিয়া ইহাদের মধ্যে একদেশদর্শিতা উৎকটরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। ইহাদের বিবরণের সারমর্ম এই।

ফিরোজ শাহ তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের পরেই (১৩৫১ খ্রী) সংবাদ পান যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়া সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের উপর অত্যাচার ও লুঠতরাজ চালাইতেছে। ১৩৫৩ খ্রষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ ইলিয়াসকে দমন করিবার জন্য এক বিশাল বাহিনী লইয়া বাংলার দিকে যাত্রা করেন। অযোধ্যা প্রদেশ হইয়া তিনি ত্রিহুতে পৌঁছান এবং ত্রিহুত পুনরধিকার করেন। অতঃপর ফিরোজ শাহ বাংলাদেশে উপনীত হইয়া ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়া জয় করিয়া লন। ইলিয়াস তাঁহার পূর্বেই পাণ্ডুয়া হইতে তাঁহার লোকজন সরাইয়া লইয়া একডালা নামক একটি অনতিদূরবর্তী দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই একডালা যেমনই বিরাট, তেমনি দুর্ভেদ্য দুর্গ, ইহার চারিদিক নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ফিরোজ শাহ কিছুকাল একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়া রহিলেন, কিন্তু ইলিয়াস আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণই দেখাইলেন না। অবশেষে একদিন ফিরোজ শাহের সৈন্যেরা এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাওয়ায় ইলিয়াস মনে করিলেন ফিরোজ শাহ পশ্চাদপসরণ করিতেছেন (ইহা বারনির বিবরণে লিখিত হইয়াছে, আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর বিবরণ এক্ষেত্রে ভিন্নরূপ), তখন তিনি একডালা দুর্গ হইতে সসৈন্যে বাহির হইয়া ফিরোজ শাহের বাহিনীকে আক্রমণ করিলেন। দুই পক্ষে যে যুদ্ধ হইল তাহাতে ইলিয়াস পরাজিত হইলেন, এবং ইহার পর তিনি আবার একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

এতদূর পর্যন্ত এই তিনটি গ্রন্থের বিবরণের মধ্যে মোটামুটিভাবে ঐক্য আছে, কেবলমাত্র দুই একটি খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়; ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে বিদ্বেষমূলক উক্তিগুলি বাদ দিলে এই বিবরণ মোটের উপর নির্ভরযোগ্য। কিন্তু যুদ্ধের ধরন এবং পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তিনটি গ্রন্থের উক্তিতে মিল নাই এবং তাহা বিশ্বাসযোগ্যও নহে। বারনির মতে এই যুদ্ধে ফিরোজ শাহের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়। নাই, ইলিয়াসের অসংখ্য সৈন্য মারা পড়িয়াছিল এবং ফিরোজ শাহ ৪৪টি হাতি সমেত ইলিয়াসের বহু সম্পত্তি হস্তগত করিয়াছিলেন; ইলিয়াসের পরাজয়ের পরে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই, তিনি মনে করিয়াছিলেন যে ৪৪টি হাতি হারানোর ফলে ইলিয়াসের দম্ভ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আফিফের মতে ইলিয়াস শাহের অন্তঃপুরের মহিলারা একডালা দুর্গের ছাদে দাঁড়াইয়া মাথার কাপড় খুলিয়া শোক প্রকাশ করায় ফিরোজ শাহ বিচলিত হইয়াছিলেন এবং মুসলমানদের নিধন ও মহিলাদের অমর্যাদা করিতে অনিচ্ছুক হইয়া একডালা দুর্গ অধিকারের পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়াছিলেন; তিনি বাংলাদেশের বিজিত অঞ্চলগুলি স্থায়িভাবে নিজের অধিকারে রাখার ব্যবস্থাও করেন নাই, কারণ এ দেশ জলাভূমিতে পূর্ণ! ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গের অধিবাসীদের, বিশেষত মহিলাদের করুণ আবেদনের ফলে একডালা দুর্গ অধিকারে ক্ষান্ত হইয়াছিলেন।

এই সমস্ত কথা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। ফিরোজ শাহ যে এই সমস্ত কারণের জন্য একডালা দুর্গ অধিকারে বিরত হন নাই, তাঁহার প্রমাণ–ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পরে তিনি আর একবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন ও একডালা দুর্গ জয়ের চেষ্টা করিয়াছিলেন। মোটের উপর ইহাই সত্য বলিয়া মনে হয় যে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই বলিয়াই করেন নাই। যুদ্ধের ফিরোজ শাহের কোন ক্ষতি হয় নাই-বারনির এই কথাও সত্য বলিয়া মনে হয় না। আফিফ লিখিয়াছেন যে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইয়াছিল এবং পরবর্তী গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’তে তাঁহার উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়।

আসল কথা, ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের যুদ্ধে কোন পক্ষই চূড়ান্তভাবে জয়ী হইতে পারে নাই। ফিরোজ শাহ যুদ্ধের ফলে শেষপর্যন্ত কয়েকজন বন্দী, কিছু লুঠের মাল এবং কয়েকটি হাতি ভিন্ন আর কিছুই লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার পক্ষেও নিশ্চয়ই কিছু ক্ষতি হইয়াছিল, যাহা তাঁহার অনুগত ঐতিহাসিকরা গোপন করিয়া গিয়াছেন। ইলিয়াস যুদ্ধের আগেও একডালা দুর্গে ছিলেন, এখনও সেখানেই রহিয়া গেলেন। সুতরাং কার্যত তাঁহার কোন ক্ষতিই হয় নাই। ফিরোজ শাহ যে কেন পশ্চাদপসরণ করিলেন, তাহাও স্পষ্টই বোঝা যায়। বারনি ও আফিফ লিখিয়াছেন যে, যে সময় ফিরোজ শাহ একডালা অবরোধ করিয়াছিলেন, তখন বর্ষাকাল আসিতে বেশি দেরি ছিল না। বর্ষাকাল আসিলে চারিদিক জলে প্লাবিত হইবে, ফলে ফিরোজ শাহের বাহিনী বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে, মশার কামড়ে ঘোড়াগুলি অস্থির হইবে এবং তখন ইলিয়াস অনায়াসেই জয়লাভ করিবেন, এই সব ভাবিয়া ফিরোজ শাহ অত্যন্ত বিচলিত বোধ করিতেছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, ফিরোজ শাহের আক্রমণের সময় ইলিয়াস প্রথমেই সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া কৌশলপূর্ণ পশ্চাদপসরণ করিয়াছিলেন, ফিরোজ শাহকে দেশের মধ্যে অনেক দূর আসিতে দিয়াছিলেন এবং নিজে একডালার দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় লইয়া বর্ষার প্রতীক্ষায় কালহরণ করিতেছিলেন। ফিরোজ শাহ ইলিয়াসের সঙ্গে একদিনের যুদ্ধে কোনরকমে নিজের মান বাঁচাইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এই যুদ্ধে ইলিয়াসের শক্তিরও পরিচয় পাইয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন যে ইলিয়াসকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। উপরন্তু বর্ষাকাল আসিয়া গেলে তিনি ইলিয়াস শাহের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইবেন। সেইজন্য, ইলিয়াসের হাতি জয় করিয়া তাঁহার দর্প চূর্ণ করিয়াছি, এই জাতীয় কথা বলিয়া ফিরোজ শাহ আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলেন এবং মানে মানে বাংলা দেশ হইতে প্রস্থান করিয়াছিলেন।

ফিরোজ শাহ একডালার নাম বদলাইয়া ‘আজাদপুর’ রাখিয়াছিলেন। দিল্লিতে পৌঁছিয়া ফিরোজ শাহ ধুমধাম করিয়া ‘বিজয়-উৎসব’ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা দেশ হইতে তাঁহার বিদায়গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইলিয়াস তাঁহার অধিকৃত বাংলার অঞ্চলগুলি পুনরধিকার করিয়া লইয়াছিলেন। শেষপর্যন্ত এই দুই সুলতানের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ ইলিয়াস শাহের স্বাধীনতা কার্যত স্বীকার করিয়া লন। ইহার পরে দুই রাজা নিয়মিতভাবে পরস্পরের কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করিতেন।

একডালার যুদ্ধে ইলিয়াস শাহের সৈন্যদের মধ্যে সর্বপেক্ষা বেশি বীরত্ব প্রদর্শন করে তাঁহার বাঙালী পাইক অর্থাৎ পদাতিক সৈন্যেরা। পাইকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু। পাইকদের দলপতি সহদেব এই যুদ্ধে প্রাণ দেন।

এই একডালা কোন্ স্থানে বর্তমান ছিল, সে সম্বন্ধে এতদিন কিছু মতভেদ ছিল। তবে বর্তমানে এ সম্বন্ধে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে গৌড় নগরের পাশে গঙ্গাতীরে একডালা অবস্থিত ছিল। [*এ সম্বন্ধে লেখকের বিস্তৃত আলোচনা—’বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর’ গ্রন্থের (২য় সং)। অষ্টম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]

ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে প্রামাণিকভাবে আর বিশেষ কোন তথ্যই জানা যায় না। তিনি যে দৃঢ়চেতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তাহা ফিরোজ শাহের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং পরিণামে সাফল্য অর্জন হইতেই বুঝা যায়। মুসলিম সাধুসন্তদের প্রতি তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল। তাঁহার সময়ে বাংলা দেশে তিনজন। বিশিষ্ট মুসলিম সন্ত বর্তমানে ছিলেন–অখী সিরাজুদ্দীন, তাঁহার শিষ্য আলা অল হক এবং রাজা বিয়াবানি। কথিত আছে, ফিরোজ শাহের একডালা দুর্গ অবরোধের সময় রাজা বিয়াবানির মৃত্যু হয় এবং ইলিয়াস শাহ অসীম বিপদের ঝুঁকি লইয়া ফকীরের ছদ্মবেশে দুর্গ হইতে বাহির হইয়া তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন, দুর্গে ফিরিবার আগে ইলিয়াস ফিরোজ শাহের সহিত দেখা করিয়া কথাবার্তা বলিয়াছিলেন, কিন্তু ফিরোজ শাহ তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই এবং পরে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়া তাঁহাকে বন্দী করার এত বড় সুযোগ হারানোর জন্য অনুতাপ করিয়াছিলেন।

অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থের মতে ইলিয়াস শাহ ভা বা সিদ্ধির নেশা করিতেন। ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ইলিয়াস কুষ্ঠরোগী ছিলেন। কিন্তু ইহা ইলিয়াসের শত্রুপক্ষের লোকের বিদ্বেষপ্রণোদিত মিথ্যা উক্তি বলিয়া মনে হয়।

ইলিয়াস শাহ ৭৫৯ হিজরায় (১৩৫৮-৫৯ খ্রী) পরলোকগমন করেন।

সিকন্দর শাহ

ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র সিকন্দর শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি সুদীর্ঘ তেত্রিশ বৎসর (আনুমানিক ১৩৫৮ হইতে ১৩৯১ খ্রী পর্যন্ত) রাজত্ব করেন। বাংলার আর কোন সুলতান এত বেশি দিন রাজত্ব করেন নাই।

সিকন্দর শাহের রাজত্বকালে ফিরোজ শাহ তুগলক আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করেন। পূর্ব্বোল্লিখিত ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং শামস্-ই-সিরাজ আফিফের ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে এই আক্রমণ ও তাঁহার পরিণামের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। আফিফ লিখিয়াছেন যে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের জামাতা জাফর খান দিল্লিতে গিয়া ফিরোজ শাহের কাছে অভিযোগ করেন যে ইলিয়াস শাহ তাঁহার শ্বশুরের রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছেন; ফিরোজ শাহ তখন ইলিয়াসকে শাস্তি দিবার জন্য এবং জাফর খানকে শ্বশুরের রাজ্যের সিংহাসনে বসাইবার জন্য বাংলা দেশে অভিযান করেন। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশে পৌঁছান, তখন ইলিয়াস শাহ পরলোকগমন করিয়াছিলেন এবং সিকন্দর শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সিকন্দর শাহের সহিতই ফিরোজ শাহের সংঘর্ষ হইল।

আফিফ এবং ‘সিরাৎ’ হইতে জানা যায় যে, সিকন্দর ফিরোজ শাহের সহিত সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া একডালা দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। ফিরোজ শাহ অনেক দিন একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। অবশেষে উভয় পক্ষই ক্লান্ত হইয়া পড়িলে সন্ধি স্থাপিত হয়।

আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর মতে সিকন্দর শাহের পক্ষ হইতেই প্রথমে সন্ধি প্রার্থনা করা হইয়াছিল। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় না। কারণ সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ কোন সুবিধাই লাভ করিতে পারেন নাই। পরবর্তী ঘটনা হইতে দেখা যায়, তিনি বাংলা দেশের উপর সিকন্দর সাহের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন এবং সমকক্ষ রাজার মতই তাঁহার সঙ্গে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় করিয়াছিলেন। আফিফের মতে সিকন্দর শাহ জাফর খানকে সোনারগাঁও অঞ্চল ছাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু জাফর খান বলেন যে, তাঁহার বন্ধুবান্ধবের সকলেই নিহত হইয়াছে, সেইজন্য তিনি সোনারগাঁওয়ে নিরাপদে থাকিতে পারিবেন না; এই কারণে তিনি ঐ রাজ্য গ্রহণে স্বীকৃত হইলেন না। ফিরোজ শাহের এই দ্বিতীয় বঙ্গাভিযান শেষ হইতে দুই বৎসর সাত মাস লাগিয়াছিল।

সিকন্দর শাহের একটি বিশিষ্ট কীর্তি পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ (১৩৬৯ খ্রী)। স্থাপত্য-কৌশলের দিক দিয়া এই মসজিদটি অতুলনীয়। ভারতবর্ষে নির্মিত সমস্ত মসজিদের মধ্যে আদিনা মসজিদ আয়তনের দিক হইতে দ্বিতীয়।

পিতার মত সিকন্দর শাহও মুসলিম সাধুসন্তদের ভক্ত ছিলেন। দেবীকোটের বিখ্যাত সন্ত মুল্লা আতার সমাধিতে তিনি একটি মসজিদ তৈরি করাইয়াছিলেন। তাঁহার সমসাময়িক পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত দরবেশ আলা অল-হকের সহিতও তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল।

সিকন্দরের শেষ জীবন সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি করুণ কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কাহিনীটির সারমর্ম এই। সিকন্দর শাহের প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে সতেরটি পুত্র ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একটিমাত্র পুত্র জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র গিয়াসুদ্দীন সব দিক দিয়াই যোগ্য ছিলেন। ইহাতে সিকন্দরের প্রথমা স্ত্রীর মনে প্রচণ্ড ঈর্ষা হয় এবং তিনি গিয়াসুদ্দীনের বিরুদ্ধে সিকন্দর শাহের মন বিষাইয়া দিবার চেষ্টা করেন। তাহাতে সিকন্দর শাহের মন একটু টলিলেও তিনি গিয়াসুদ্দীনকেই রাজ্য শাসনের ভার দেন। গিয়াসুদ্দীন কিন্তু বিমাতার মতিগতি সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া সোনারগাঁওয়ে চলিয়া যান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করিলেন এবং পিতার নিকট সিংহাসন দাবি করিয়া। লখনৌতির দিকে রওনা হইলেন। গোয়ালপাড়ার প্রান্তরে পিতাপুত্রে যুদ্ধ হইল। গিয়াসুদ্দীন তাঁহার পিতাকে বধ করিতে সৈন্যদের নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু একজন সৈন্য না চিনিয়া সিকন্দরকে বধ করিয়া বসে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলিবার আগে সিকন্দর বিদ্রোহী পুত্রকে আশীর্বাদ জানাইয়া যান।

এই কাহিনীটি সম্পূর্ণভাবে সত্য কিনা তাহা বলা যায় না, তবে পিতার বিরুদ্ধে গিয়াসুদ্দীনের বিদ্রোহ এবং পুত্রের সহিত যুদ্ধে সিকন্দরের নিহত হওয়ার কথা যে সত্য, তাঁহার অনেক প্রমাণ আছে।

ত্রিপুরার রাজাদের ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’য় লেখা আছে যে, ত্রিপুরার বর্তমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রত্ন-ফা (ইঁহার ১৩৬৪ হইতে ১৩৬৭ খ্রীষ্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে) যখন তাঁহার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা রাজা-ফাঁকে উচ্ছেদ করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করিতে চাহেন, তখন তাঁহার অনুরোধে গৌড়ের “তুরুষ্ক নৃপতি” ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজা-ফাঁকে বিতাড়িত করিয়া রত্ন-ফাকে সিংহাসনে বসান। রত্ন-ফা “তুরুস্ক নৃপতি”র নিকট “মাণিক্য” উপাধি এবং একটি বহু মূল্য রত্ন পান। সম্ভবতঃ সিকন্দর শাহই এই “তুরুষ্ক নৃপতি”।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ

ইলিয়াস শাহী বংশের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই বংশের প্রথম তিনজন রাজাই অত্যন্ত যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তন্মধ্যে ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দর শাহ যুদ্ধ ও স্বাধীনতা রক্ষার দ্বারা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু সিকন্দর শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দীর আজম শাহ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন তাঁহার লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্বের জন্য। তাঁহার মত বিদ্বান, রুচিমান, রসিক ও ন্যায়পরায়ণ নৃপতি এ পর্যন্ত খুব কমই আবির্ভূত হইয়াছেন।

স্নেহপরায়ণ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রণক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া সিংহাসন অধিকার গিয়াসুদ্দীনের চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে সন্দেহ নাই। তবে বিমাতার চক্রান্ত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য অনেকাংশে বাধ্য হইয়াই গিয়াসুদ্দীন এইরূপ আচরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই দিক দিয়া বিচার করিলে তাহাকে সম্পূর্ণভাবে না হইলেও আংশিকভাবে ক্ষমা করা যায়।

গিয়াসুদ্দীন যে কতখানি রসিক ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা তাঁহার একটি কাজ হইতে বুঝিতে পারা যায়। এ সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ যাহা লেখা আছে, তাঁহার সারমর্ম এই। একবার গিয়াসুদ্দীন সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িয়া বাঁচিবার আশা ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং সর্ব, গুল ও লালা নামে তাঁহার হারেমের তিনটি নারীকে তাঁহার মৃত্যুর পর শবদেহ ধৌত করার ভার দিয়াছিলেন। কিন্তু সেবারে তিনি সুস্থ হইয়া উঠেন এবং তাঁহার পর ঐ তিনটি নারীকে হারেমের অন্যান্য নারীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিতে থাকে। ঐ তিনটি নারী সুলতানকে এই কথা জানাইলে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের নামে একটি ফার্সী গজল লিখিতে সুরু করেন। কিন্তু এক ছত্রের বেশি তিনি আর লিখিতে পারেন নাই, তাঁহার রাজ্যের কোন কবিও ঐ গজলটি পূরণ করিতে পারেন নাই। তখন গিয়াসুদ্দীন ইরানের শিরাজ শহরবাসী অমর কবি হাফিজের নিকট ঐ ছত্রটি পাঠাইয়া দেন। হাফিজ উহা পূরণ করিয়া ফেরৎ পাঠান।

এই কাহিনীর প্রথমাংশের খুঁটিনাটি বিবরণগুলি সব সত্য কিনা তাহা বলা যায়, তবে দ্বিতীয়াংশ অর্থাৎ হাফিজের কাছে গিয়াসুদ্দীন কর্ত্তৃক গজলের এক ছত্র পাঠানো এবং হাফিজের তাহা সম্পূর্ণ করিয়া পাঠানো সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’তেও এই ঘটনাটি সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রিয়াজ’ ও ‘আইন’-এ এই গজলটির কয়েক ছত্র উদ্ধৃত হইয়াছে, সেইগুলি সমেত সম্পূর্ণ গজলটি (হাফিজের মৃত্যুর অল্প পরে তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুহম্মদ গুল অাম কর্ত্তৃক সংকলিত) দিওয়ান-ই-হাফিজে পাওয়া যায়, তাহাতে সুলতান গিয়াসুদ্দীন ও বাংলাদেশের নাম আছে।

গিয়াসুদ্দীনের ন্যায়নিষ্ঠা সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সেটি এই। একবার গিয়াসুদ্দীন তীর ছুঁড়িতে গিয়া আকস্মিকভাবে এক বিধবার পুত্রকে আহত করিয়া বসেন। ঐ বিধবা কাজী সিরাজুদ্দীনের কাছে এ সম্বন্ধে নালিশ করে। কর্তব্যনিষ্ঠ কাজী তখন পেয়াদার হাত দিয়া সুলতানের কাছে সমন পাঠান। পেয়াদা সহজ পথে সুলতানের কাছে সমন লইয়া যাওয়ার উপায় নাই দেখিয়া অসময়ে আজান দিয়া সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন সুলতানের কাছে পেয়াদাকে লইয়া যাওয়া হইলে সে তাহাকে সমন দিল। সুলতান তৎক্ষণাৎ কাজীর আদালতে উপস্থিত হইলেন। কাজী তাঁহাকে কোন খাতির না দেখাইয়া বিধবার ক্ষতিপূরণ করিতে নির্দেশ দিলেন। সুলতান সেই নির্দেশ পালন করিলেন। তখন কাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া সুলতানকে যথোচিত সম্মান দেখাইয়া মসনদে বসাইলেন। সুলতানের বগলের নীচে একটি ছোট তলোয়ার লুকানো ছিল, সেটি বাহির করিয়া তিনি কাজীকে বলিলেন যে তিনি সুলতান বলিয়া কাজী যদি বিচারের সময় তাঁহার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাইতেন, তাহা হইলে তিনি তলোয়ার দিয়া কাজীর মাথা কাটিয়া ফেলিতেন। কাজীও তাঁহার মসনদের তলা হইতে একটি বেত বাহির করিয়া বলিলেন, সুলতান যদি আইনের নির্দেশ লঙ্ঘন করিতেন, তাহা হইলে আদালতের বিধান অনুসারে তিনি এ বেত দিয়া তাঁহার পিঠ ক্ষতবিক্ষত করিতেন –ইহার জন্য তাঁহাকে বিপদে পড়িতে হইবে জানিয়াও। তখন সুলতান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কাজীকে অনেক উপহার ও পারিতোষিক দিয়া ফিরিয়া আসিলেন।

এই কাহিনীটি সত্য কিনা তাহা বলা যায় না। তবে সত্য হওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব। কারণ গিয়াসুদ্দীনকে লেখা বিহারের দরবেশ মুজাফফর শামস বলখির চিঠি হইতে জানা যায় যে গিয়াসুদ্দীন সত্যই ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বল্‌খির চিঠি হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন প্রথম দিকে সুখ এবং আমোদ-প্রমোদে নিমগ্ন ছিলেন, কিন্তু বলখির সহিত পত্রালাপের সময় তিনি পবিত্র ও ধর্মনিষ্ঠ জীবন যাপন করিতেছিলেন। গিয়াসুদ্দীন বিদ্যা, মহত্ত্ব, উদারতা, নির্ভীকতা প্রভৃতি গুণে ভূষিত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি রাজা হিসাবে জনপ্রিয় হইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীন কবিও ছিলেন এবং সুন্দর গজল লিখিয়া মুজাফফর শামস্ বলখিকে পাঠাইতেন।

বখি ভিন্ন আর একজন দরবেশের সহিত গিয়াসুদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আলা অল-হকের পুত্র নূর কুত্ত্ব আলম। ‘রিয়াজ’-এর মতে ইনি গিয়াসুদ্দীনের সহপাঠী ছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ও নূর কুত্‌ আলম উভয়ে পরস্পকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। কথিত আছে, নূর কুত্ত্ব আলমের ভ্রাতা আজম খান সুলতানের উজীর ছিলেন; তিনি নূর কুত্ত্বকে একটি উচ্চ রাজপদ দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু নূর কুত্ত্ব তাহাতে রাজী হন নাই।

মুজাফফর শামস্ বখি ও নূর কুত্ত্ব আলমের সহিত গিয়াসুদ্দীনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হইতে বুঝিতে পারা যায়, গিয়াসুদ্দীনও পিতা ও পিতামহের মত সাধুসন্ত দের ভক্ত ছিলেন। তাঁহার ধর্মনিষ্ঠার অন্য নিদর্শনও আমরা পাই। অলসখাওয়ী এবং গোলাম আলী আজাদ বিলগ্রামী নামে দুইজন প্রামাণিক গ্রন্থকারের লেখা হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন অনেক টাকা খরচ করিয়া মক্কা ও মদিনায় দুইটি মাদ্রাসা নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন। মক্কার মাদ্রাসাটি নির্মাণ করিতে বার হাজার মিশরী স্বর্ণ-মিথকল লাগিয়াছিল। গিয়াসুদ্দীন নিজে হানাফী ছিলেন কিন্তু মক্কার মাদ্রাসায় তিনি হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হানবালী মুসলিম সম্প্রদায়ের এই চারিটি মজুহবের জন্যই বক্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহা ভিন্ন গিয়াসুদ্দীন মক্কাতে একটি সরাইও নির্মাণ করান এবং মাদ্রাসা ও সরাইয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বহুমূল্যের সম্পত্তি দান করেন। তিনি মক্কার আরাফাহ্ নামক স্থানে একটি খাল খনন করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দিন মক্কায় য়াকুৎ অনানী নামক এক ব্যক্তিকে পাঠাইয়াছিলেন, ইনিই এই সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। গিয়াসুদ্দীন মক্কা ও মদিনার লোকদের দান করিবার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠাইয়াছিলেন, তাঁহার এক অংশ মক্কা শরীফ গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্টাংশ হইতে মক্কা ও মদিনার প্রতিটি লোককেই কিছু কিছু দেওয়া হয়।

বিদেশে দূত প্রেরণ গিয়াসুদ্দীনের একটি অভিনব ও প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। জৌনপুরের সুলতান মালিক সাওয়ারের কাছে তিনি দূত পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে হাতি উপহার দিয়াছিলেন। চীনদেশের ইতিহাস হইতে জানা যায়, চীন সম্রাট য়ুং-লোর কাছে গিয়াসুদ্দীন ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ খ্রীষ্টাব্দে উপহার সমেত দূত পাঠাইয়াছিলেন। য়ুং-লো ইহার প্রত্যুত্তরস্বরূপ কয়েকবার গিয়াসুদ্দীনের কাছে উপহার সমেত দূত পাঠান।

কিন্তু গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত ব্যাপারেই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা নহে। কোন কোন ব্যাপারে তিনি শোচনীয় ব্যর্থতারও পরিচয় দিয়াছেন। যেমন, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তিনি মোটেই সুবিধা করিতে পারেন নাই। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁহার পিতার সহিত তাঁহার যে বিরোধ ও যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে রাজ্যের সামরিক শক্তি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। সিংহাসনে আরোহণের পর গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন, তাহাতেও সামরিক শক্তির অপচয় ভিন্ন আর কোন ফল হয় নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজয় বরণ করিতে হয়। কথিত আছে, শাহেব খান (?) নামে এক ব্যক্তির সহিত গিয়াসুদ্দীন দীর্ঘকাল নিষ্ফল যুদ্ধ চালাইয়া প্রচুর শক্তি ক্ষয় করিয়াছিলেন, অবশেষে নূর কুত্ত্ব আলম উভয় পক্ষে সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু সন্ধির কথাবার্তা চলিবার সময় গিয়াসুদ্দীন শাহেব খানকে আক্রমণ করিয়া বন্দী করেন এবং এই বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা কোনক্রমে নিজের মান বাঁচান। গিয়াসুদ্দীন কামরূপ-কামতা রাজ্যের কিছু অংশ সাময়িকভাবে অধিকার করিয়াছিলেন। কথিত আছে, গিয়াসুদ্দীন কামতা-রাজ ও অহোম-রাজের মধ্যে বিরোধের সুযোগ লইয়া কামতা রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার আক্রমণের ফলে কামতা-রাজ অহোম-রাজের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিয়া সন্ধি করেন এবং তাঁহার পর উভয় রাজা মিলিতভাবে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তাঁহার ফলে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনী কামতা রাজ্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়। মিথিলার অমর কবি বিদ্যাপতি তাঁহার একাধিক গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক শিবসিংহ একজন গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন; যতদূর মনে হয়, এই গৌড়েশ্বর গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ।

গিয়াসুদ্দীন যে তাঁহার শেষ জীবনে হিন্দুদের সম্বন্ধে ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন ও তাঁহার জন্যই শেষ পর্যন্ত তিনি শোচনীয় পরিণাম বরণ করিয়াছিলেন, তাহা মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে। মুজাফফর শামস্ বলখির ৮০০ হিজরায় (১৩৯৭ খ্রী) লেখা চিঠিতে পাই তিনি গিয়াসুদ্দীনকে বলিতেছেন যে মুসলিম রাজ্যে বিধর্মীদের উচ্চ পদে নিয়োগ করা একেবারেই উচিত নহে। গিয়াসুদ্দীন বলখিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন ও তাঁহার উপদেশ অনুসারে চলিতেন। সুতরাং তিনি যে এই ব্যাপারে বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী চলিয়াছিলেন অর্থাৎ রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদ হইতে বিধর্মী হিন্দুদের অপসারিত করিয়াছিলেন, ইহাই সম্ভব। ইহার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণও আছে। গিয়াসুদ্দীন ও তাঁহার পুত্র সৈফুদ্দীন হজা শাহের রাজত্বকালে কয়েকবার চীন-সম্রাটের দূতেরা বাংলার রাজদরবারে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন যে বাংলার সুলতানের অমাত্য ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সকলেই মুসলমান, একজনও অমুসলমান নাই। এই কথা জনৈক চীনা রাজপ্রতিনিধিই লিখিয়া গিয়াছেন।

ফিরিশতার মতে হিন্দু রাজা গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের একজন আমীর ছিলেন। আবার ‘রিয়াজ’-এর মতে এই রাজা গণেশের চক্রান্তেই গিয়াসুদ্দীন নিহত হইয়াছিলেন। মনে হয়, বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করিয়া গিয়াসুদ্দীন রাজা গণেশ প্রমুখ সমস্ত হিন্দু আমীরকেই পদচ্যুত করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে রাজা গণেশ গিয়াসুদ্দীনের শত্রু হইয়া দাঁড়ান এবং শেষপর্যন্ত তিনি চক্রান্ত করিয়া গিয়াসুদ্দীনকে হত্যা করান। গিয়াসুদ্দীন যে শেষজীবনে সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হইয়াছিলেন, তাঁহার আর একটি প্রমাণ–তাঁহার রাজত্বকালে আগত চীনা রাজদূতদের কেবলমাত্র বাংলার মুসলমানদের জীবনযাত্রাই দেখানো হইয়াছিল, বাংলার হিন্দুদের সম্বন্ধে তাঁহারা কোন বিবরণই লেখেন নাই।

গিয়াসুদ্দীন যে কবি ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইরানের কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ ছিল, কিন্তু কোন ভারতীয় কবির সহিত তাঁহার কোন সম্পর্ক ছিল কিনা, সে সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। “বিদ্যাপতি কবি”-র ভণিতাযুক্ত একটি পদে জনৈক “গ্যাসদীন সুরতান”-এর প্রশস্তি আছে। অনেকের মতে এই বিদ্যাপতি কবি” মিথিলার বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি (জীবঙ্কাল আ. ১৩৭০-১৪৬০ খ্রী) এবং “গ্যাসদীন সুরতান (সুলতান)” গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ। কিন্তু এই মত সমর্থন করা যায় না। বাংলা ‘ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের রচয়িতা শাহ মোহাম্মদ সগীরের আত্মবিবরণীর একটি ছত্রের উপর ভিত্তি করিয়া অনেকে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ সগীরের সমসাময়িক ও পৃষ্ঠপোষক নৃপতি ছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ পিতার মৃত্যুর পর কুড়ি বৎসর রাজত্ব করিয়া ১৪১০ ১১ খ্রীষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন।

সৈফুদ্দীন হজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সৈফুদ্দীন হজা শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি “সুলতান-উস্-সলাতীন” (রাজাধিরাজ) উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন। সৈফুদ্দীন চীন-সম্রাট য়ুং-লোর কাছে দূত পাঠাইয়া গিয়াসুদ্দীনের মৃত্যুর ও নিজের সিংহাসনে আরোহণের সংবাদ জানাইয়াছিলেন। চীন-সম্রাটও বাংলার মৃত রাজার শোকানুষ্ঠানে যোগ দিবার জন্য এবং নূতন রাজাকে স্বাগত জানাইবার জন্য তাঁহার প্রতিনিধিদের পাঠাইয়াছিলেন।

সৈফুদ্দীনের রাজত্বকালের আর কোন ঘটনার কথা জানা যায় না। দুই বৎসর রাজত্ব করিবার পর সৈফুদ্দীন পরলোকগমন করেন। সৈফুদ্দীনের পরে শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ সুলতান হন। ইব-ই-হজর নামে একজন সমসাময়িক আরব দেশীয় গ্রন্থকার লিখিয়াছেন যে হজা শাহ তাঁহার ক্রীতদাস শিহাব (শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ) কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছিলেন।

শিহাবুদ্দীন রাজার পুত্র না হইয়াও রাজসিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, কারণ অমিত শক্তিধর রাজা গণেশ তাঁহার পিছনে ছিলেন। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে মনে হয় যে, রাজা গণেশই শিহাবুদ্দীনের রাজত্বকালে শাসনক্ষমতা করায়ত্ত করিয়াছিলেন এবং রাজকোষও তাঁহারই হাতে আসিয়াছিল, শিহাবুদ্দীন নামে মাত্র সুলতান ছিলেন।

শিহাবুদ্দীন একবার চীনম্রাটের কাছে দূত মারফৎ একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক পত্র পাঠান এবং সেই সঙ্গে জিরাফ, বাংলার বিখ্যাত ঘোড়া এবং এদেশে উৎপন্ন আরও অনেক দ্রব্য উপহারস্বরূপ পাঠান। তাঁহার পাঠানো জিরাফ চীনদেশে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

দুই বৎসর (১৪১২-১৪ খ্রী) রাজত্ব করিবার পরে শিহাবুদ্দীন পরলোকগমন করেন। কাহারও কাহারও মতে রাজা গণেশ তাঁহাকে হত্যা করাইয়াছিলেন। সমসাময়িক আরবদেশীয় গ্রন্থকার ই-ইর-হজরও লিখিয়াছেন যে গণেশ কর্ত্তৃক শিহাবুদ্দীন (শিহাব) নিহত হইয়াছিলেন। সম্ভবত শিহাবুদ্দীন গণেশের বিরুদ্ধে কোন সময়ে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন এবং তাঁহারই জন্য গণেশ তাঁহাকে পৃথিবী হইতে সরাইয়া দিয়াছিলেন।

মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁহার পুত্র আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক বিবরণীতে এই আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের নাম পাওয়া যায় না। যতদূর মনে হয়, রাজা গণেশ শিহাবুদ্দীনের মৃত্যুর পরে তাঁহার শিশুপুত্র আলাউদ্দীনকে সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নামমাত্র রাজা করিয়া রাখিয়া নিজেই রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন।

আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের কেবলমাত্র ৮১৭ হিজরায় (১৪১৪-১৫ খ্রী) মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। ৮১৮ হিজরা হইতে জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের মুদ্রা সুরু হইয়াছে। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, কয়েকমাস রাজত্ব করার পরেই আলাউদ্দীন সিংহাসনচ্যুত হইয়াছিলেন। সম্ভবত রাজা গণেশই স্বয়ং রাজা হইবার অভিপ্রায় করিয়া আলাউদ্দীনকে সিংহাসনচ্যুত করিয়াছিলেন।

 ০৪. রাজা গণেশ ও তাঁহার বংশ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – রাজা গণেশ ও তাঁহার বংশ

রাজা গণেশ

রাজা গণেশ বাংলার ইতিহাসের একজন অবিস্মরণীয় পুরুষ। তিনিই একমাত্র হিন্দু, যিনি বাংলার পাঁচ শতাধিক বর্ষব্যাপী মুসলিম শাসনের মধ্যে কয়েক বৎসরের জন্য ব্যতিক্রম করিয়া হিন্দুশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। অবশ্য গণেশের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই এই হিন্দু অভ্যুদয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও গণেশের কৃতিত্ব সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ নাই। রাজা গণেশ খাঁটি বাঙালী ছিলেন, ইহাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

‘তবকাৎ-ই-আকবরী’, ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’, ‘মাসির-ই-রহিমী’ প্রভৃতি গ্রন্থে গণেশ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। ‘রিয়াজ-উস-সলাতীন’-এর বিবরণ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ; বুকাননের বিবরণী, মুল্লা তকিয়ার বয়াজ, দরবেশদের জীবনীগ্রন্থ ‘মিরাৎ-উল আসরার’ প্রভৃতি সূত্রেও গণেশ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এই সূত্রগুলি পরবর্তীকালের রচনা। সম্প্রতি গণেশ সম্বন্ধীয় কিছু কিছু সমসাময়িক সূত্রও আবিষ্কৃত হইয়াছে; যেমন,–দরবেশ নূর কুত্ত্ব আলম ও আশরফ সিনানীর পত্রাবলী, ইব্রাহিম শকীর জনৈক সামন্তের আজ্ঞায় রচিত এবং গণেশ ও ইব্রাহিমের সংঘর্ষের উল্লেখসংবলিত ‘সঙ্গীতশিরোমণি’ গ্রন্থ, চীনসম্রাট কর্ত্তৃক বাংলার রাজসভায় প্রেরিত প্রতিনিধিদলের জনৈক সদস্যের লেখা শিং-ছা শ্যং-লান’ গ্রন্থ, আরবী ঐতিহাসিক ইব্‌ নৃ-ই-হজর ও অল-সখাওয়ীর লেখা গ্রন্থদ্বয়, দনুজমর্দনদেব ও মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা প্রভৃতি।

উপরে উল্লিখিত সূত্রগুলি বিশ্লেষণ করিয়া রাজা গণেশের ইতিহাসটি মোটামুটিভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হইয়াছে। এই পুনর্গঠিত ইতিহাসের সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।

রাজা গণেশ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী একজন জমিদার। উত্তরবঙ্গের ভাতুড়িয়া অঞ্চলে তাঁহার জমিদারী ছিল। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের অন্যতম আমীরও ছিলেন।

গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ, সৈফুদ্দীন হজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে বাংলার রাজনীতিতে গণেশ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং শেষ দুইজন সুলতানের আমলে তিনিই যে বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক ছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ৮১৭ হিজরার (১৪১৪-১৫ খ্রী) শেষদিকে গণেশ আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহকে সিংহাসনচ্যুত (ও সম্ভবত নিহত) করেন এবং নিজের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে মুসলমান-রাজত্বের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করিয়া স্বয়ং বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কিন্তু বেশিদিন রাজত্ব করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইল না। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ বিধর্মীর সিংহাসন অধিকারে অসন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার প্রচণ্ড বিরোধিতা করিতে লাগিলেন। ইহাদের নেতা ছিলেন বাংলার দরবেশরা। রাজা গণেশ এই বিরোধিতা কঠোরভাবে দমন করিলেন এবং দরবেশদের মধ্যে কয়েকজনকে বধ করিলেন। ইহাতে দরবেশরা তাঁহার উপর আরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। দরবেশদের নেতা নূর কুত্ত্ব আলম উত্তর ও পূর্ব ভারতে সর্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত নৃপতি জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শকীর নিকট উত্তেজনাপূর্ণ ভাষায় এক পত্র লিখিয়া জানাইলেন যে গণেশ ঘোরতর অত্যাচারী এবং মুসলমানদের পরম শত্রু; তিনি ইব্রাহিমকে সসৈন্যে বাংলায় আসিয়া গণেশের উচ্ছেদসাধন করিতে অনুরোধ জানাইলেন। ইব্রাহিম শর্কী এই পত্র পাইয়া এ বিষয়ে জৌনপুরের দরবেশ আশরফ দিমনানীর উপদেশ প্রার্থনা করিলেন এবং তাঁহার সম্মতিক্রমে সৈন্যবাহিনী লইয়া বাংলার দিকে রওনা হইলেন।

যে সমস্ত দেশের উপর দিয়া ইব্রাহিম গেলেন, তাহাদের মধ্যে মিথিলা বা ত্রিহুত অন্যতম। বিহুত জৌনপুরের সুলতানের অধীন সামন্ত রাজ্য। কিন্তু এই সময়ে ত্রিহুতের রাজা দেবসিংহকে উচ্ছেদ করিয়া তাঁহার স্বাধীনচেতা পুত্র শিবসিংহ (কবি বিদ্যাপতির পৃষ্ঠপোষক) রাজা হইয়াছিলেন। তিনি জৌনপুররাজের অধীনতা অস্বীকার করিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং রাজা গণেশের সহিত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। গণেশের সহিত যেমন বাংলার দরবেশদের সংঘর্ষ বাধিয়াছিল, শিবসিংহের সহিতও তেমনি ত্রিহুতের দরবেশদের সংঘর্ষ বাধিয়াছিল। ইব্রাহিম শর্কী যখন ত্রিহুতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন শিবসিংহ তাঁহার সহিত সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন এবং পরাজিত হইয়া পলায়ন করিলেন। ইব্রাহিম তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এবং তাঁহার সুদৃঢ় দুর্গ লেহরা জয় করিয়া তাঁহাকে বন্দী করিলেন। অতঃপর ইব্রাহিম শিবসিংহের পিতা দেবসিংহকে আনুগত্যের সর্তে ত্রিহুতের রাজপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিলেন।

ইহার পর ইব্রাহিম আবার তাঁহার অভিযান শুরু করিলেন এবং বাংলায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজা গণেশ তাঁহার বিপুল সামরিক শক্তির নিকট দাঁড়াইতে পারিলেন না। তাঁহার উপরে তাঁহার পুত্র রাজনীতিচতুর যদু (নামান্তর জিক্সল) পিতার পক্ষ ত্যাগ করিয়া ইব্রাহিমের পক্ষে যোগ দিলেন। তখন গণেশ সরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হইলেন। যদু রাজ্যের লোভে নিজের ধর্ম পর্যন্ত বিসর্জন দিলেন। ইব্রাহিম যদুকে মুসলমান করিয়া বাংলার সিংহাসনে বসাইলেন। যদু সুলতান হইয়া জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ নাম গ্রহণ করিলেন। ৮১৮ হিজরার (১৪১৫-১৬ খ্রী) মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।

অতঃপর ইব্রাহিম দেশে ফিরিয়া গেলেন। জলালুদ্দীনের সিংহাসনে আরোহণের ফলে বাংলার আবার হিন্দু-প্রাধান্যের অবসান ঘটিয়া মুসলিম-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইল। কিন্তু এই পরিবর্তন বেশিদিন স্থায়ী হইল না। রাজা গণেশ কিছুদিন পরে সুযোগ বুঝিয়া প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং অল্পায়াসে নিজের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করিলেন। পুত্র জলালুদ্দীন নামে সুলতান রহিলেন, কিন্তু তিনি পিতার ক্রীড়নকে পরিণত হইলেন। বাংলা দেশে আবার হিন্দুধর্ম্মের জয়পতাকা উড়িতে লাগিল। গণেশ আবার তাঁহার প্রতিপক্ষ দরবেশদিগকে ও অন্যান্য মুসলমানদিগকে দমন করিতে লাগিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া নূর কুত্ত্ব আলম অত্যন্ত মর্মাহত হইলেন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করিলেন।

এদিকে রাজা গণেশ যখন নানা দিক দিয়া নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিলেন, তখন তিনি পুত্র জলালুদ্দীনকে অপসারিত করিয়া স্বয়ং ‘দনুজমর্দনদেব’ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ‘দনুজমর্দনদেব’-এর বঙ্গাক্ষরে ক্ষোদিত মুদ্রাও প্রকাশিত হইল, এই মুদ্রাগুলির এক পৃষ্ঠায় রাজার নাম এবং অপর পৃষ্ঠায় টাকশালের নাম, উৎকীর্ণ হওয়ার সাল এবং “চণ্ডীচরণপরায়ণস্য” লেখা থাকিত। ‘দনুজমর্দনদেব’-রূপে সমগ্র ১৩৩৯ শকাব্দ (১৪১৭-১৮ খ্রী) এবং ১৩৪০ শকাব্দের (১৭১৮-১৯ খ্রী) কিয়দংশ রাজত্ব করিবার পর রাজা গণেশ পরলোকগমন করিলেন। সম্ভবত তিনি জলালুদ্দীন (যদু)-কে তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হিন্দুধর্ম্মে পুনর্দীক্ষিত করাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন। সম্ভবত জলালুদ্দীনের ষড়যন্ত্রেই গণেশের মৃত্যু হয়।

স্বল্প সময়ের জন্য রাজত্ব করিলেও রাজা গণেশ বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলের উপরই তাঁহার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন। উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের প্রায় সমস্তটা এবং মধ্যবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের কতকাংশ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রাজা গণেশ যে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং কুশাগ্রবুদ্ধি কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন, তাহা তাঁহার পূর্ববর্ণিত ইতিহাস হইতেই বুঝা যায়। তিনি নিষ্ঠাবান হিন্দুও ছিলেন। চণ্ডীদেবীর প্রতি তাঁহার আনুগত্যের কথা তিনি মুদ্রায় ঘোষণা করিয়াছিলেন; বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ পদ্মলাভের তিনি চরণপূজা করিতেন, এ কথা পদ্মনাভের বংশধর জীব গোস্বামীর সাক্ষ্য হইতে জানা যায়। পরমধর্মদ্বেষ হইতে রাজা গণেশ একেবারে মুক্ত হইতে পারেন নাই। কয়েকটি মসজিদ ও ঐস্লামিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি ধ্বংস করিয়াছিলেন। তিনি বহু মুসলমানের প্রতি দমননীতি প্রয়োগও করিয়াছিলেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে উহা করিয়াছিলেন। মুসলমানদের প্রতি গণেশের অত্যাচার সম্বন্ধে কোন কোন সূত্রে অনেক অতিরঞ্জিত বিবরণ স্থান পাইয়াছে। ফিরিশতার কথা বিশ্বাস করিলে বলিতে হয় গণেশ অনেক মুসলমানের আন্তরিক ভালবাসাও লাভ করিয়াছিলেন। ফিরিশতার মতে গণেশ দক্ষ সুশাসকও ছিলেন।

গৌড় ও পাণ্ডুয়ার কয়েকটি বিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তি গণেশেরই নির্মিত বলিয়া বিশেষজ্ঞরা মনে কনের। ইহাদের মধ্যে গৌড়ের ‘ফতে খানের সমাধি-ভবন’ নামে পরিচিত একটি সৌধ এবং পাণ্ডুয়ার একলাখী প্রাসাদের নাম উল্লেখযোগ্য। গণেশ বিখ্যাত আদিনা মসজিদের সংস্কার সাধন করিয়া উহাকে তাঁহার কাছারীবাড়ীতে পরিণত করিয়াছিলেন বলিয়া প্রবাদ আছে।

গণেশের নাম প্রায় সমস্ত ফার্সী পুথিতেই ‘কান্‌স্’ লেখা হইয়াছে, এই কারণে কেহ কেহ মনে করেন তাঁহার প্রকৃত নাম ছিল ‘কংস’। কিন্তু প্রাচীন ফার্সী পুঁথিতে প্রায় সর্বত্রই ‘গ’ (গাফ্‌)-এর জায়গায় ‘ক’ (কাফ্‌) লিখিতে হইত বলিয়া ইহার উপর গুরুত্ব আরোপ করিতে পারা যায় না। বুকাননের বিবরণী এবং কয়েকটি বৈষ্ণব গ্রন্থের সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, ‘গণেশ’ই তাঁহার প্রকৃত নাম। কোন কোন সূত্রের মতে তাঁহার নাম ছিল ‘কাশী’।

মহেন্দ্রদেব

গণেশ বা দনুজমর্দনদেবের সমস্ত মুদ্রাই ১৩৩৯ ও ১৩৪০ শকাব্দের। ১৩৪০ শকাব্দেই আবার মহেন্দ্রদেব নামে আর একজন হিন্দু রাজার মুদ্রা পাওয়া যাইতেছে। ইঁহার মুদ্রাগুলি দনুজমর্দনদেবের মুদ্রারই অনুরূপ।

ইহা হইতে বুঝা যায় যে, মহেন্দ্রদেব দনুজমর্দনদেবের উত্তরাধিকারী এবং সম্ভবত পুত্র। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন মহেন্দ্রদেব জলালুদ্দীনেরই হিন্দু নাম, পিতার মৃত্যুর পরে জলালুদ্দীন কিছু সময়ের জন্য এই নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নহে। মহেন্দ্রদেব তাঁহার মুদ্রায় নিজেকে ‘চণ্ডীচরণপরায়ণ’ বলিয়াছেন, যাহা নিষ্ঠাবান মুসলমান জলালুদ্দীনের পক্ষে সম্ভব নহে।

‘তারিখ-ই ফিরিশতা’র মতে গণেশের আর একজন পুত্র ছিলেন, ইনি জলালুদ্দীনের কনিষ্ঠ। দনুজমর্দনদেবের ও জলালুদ্দীনের মুদ্রার মাঝখানে মহেন্দ্রদেবের মুদ্রার আবির্ভাব হইতে এইরূপ অনুমান খুব অসঙ্গত হইবে না যে, মহেন্দ্রদেব জলালুদ্দীনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, গণেশের মৃত্যুর পরে তিনি সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন; কিন্তু জলালুদ্দীন অল্প সময়ের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করিয়া সিংহাসন পুনরাধিকার করেন। অবশ্য ইহা নিছক অনুমান মাত্রা। কিন্তু ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ গ্রন্থে এই অনুমানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়।

মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল হইতে ১৪১৯ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী–এই নয় মাসের মধ্যে দনুজমর্দনদেব, মহেন্দ্রদেব ও জলালুদ্দীন–তিনজন রাজাই রাজত্ব করিয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, মহেন্দ্রদেব খুবই অল্প সময় রাজত্ব করিতে পারিয়াছিলেন।

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ দুই দফায় রাজত্ব করিয়াছিলেন–প্রথমবার ৮১৮-১৯ হিজরায় (১৪১৫-১৬ খ্রী) এবং দ্বিতীয়বার ৮২১-৩৬ হিজরায় (১৪১৮-৩৩ খ্রী)।

প্রথমবারের রাজত্বে জলালুদ্দীনের রাজসভায় চীন-সম্রাটের দূতেরা আসিয়াছিলেন। চীনা বিবরণী ‘শিংছা-শ্যং-লান’ হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন প্রধান দরবার ঘরে বসিয়া চীনা রাজদূতদের দর্শন দিয়াছিলেন ও চীন-সম্রাট কর্ত্তৃক প্রেরিত পত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার পর তিনি চীনা দূতদের এক ভোজ দিয়া আপ্যায়িত করিয়াছিলেন, এই ভোজে মুসলমানী রীতি অনুযায়ী গোমাংস পরিবেশন করা হইয়াছিল এবং সুরা দেওয়া হয় নাই। অতঃপর জলালুদ্দীন দূতদের প্রত্যেককে পদমর্যাদা অনুযায়ী উপহার প্রদান করেন এবং স্বর্ণময় আধারে রক্ষিত একটি পত্র চীন-সম্রাটকে দিবার জন্য তাঁহাদের হাতে দেন।

জলালুদ্দীনের দ্বিতীয়বার রাজত্বেরও কয়েকটি ঘটনার কথা জানিতে পারা যায়। আবদুর রজ্জাক রচিত ‘মতলা-ই-সদাইন’ ও চীনা গ্রন্থ ‘মিং-শ-বৃ’-এর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করিলে জানা যায়, ১৪২০ খ্রীষ্টাব্দে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী জলালুদ্দীনের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। তৈমুরলঙ্গের পুত্র শাহরুখ তখন পারস্যের হিরাটে ছিলেন; তাঁহার নিকটে এবং চীন-সম্রাট য়ুং-লোর নিকটে দূত পাঠাইয়া জলালুদ্দীন ইব্রাহিমের আক্রমণের কথা জানান। তখন শাহরুখ ও য়ুং লো উভয়েই ইব্রাহিমকে ভর্ৎসনা করিয়া অবিলম্বে আক্রমণ বন্ধ করিতে বলেন, ইব্রাহিমও আক্রমণ বন্ধ করেন।

আরাকান দেশের ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, আরাকানরাজ মেং সোয়উন (নামান্তর নরমেইখলা) ব্রহ্মের রাজার সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া রাজ্য হারান এবং বাংলার সুলতানের অর্থাৎ জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জলালুদ্দীনকে আরাকানরাজ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করায় জলালুদ্দীন প্রীত হইয়া তাঁহার রাজ্য উদ্ধারের জন্য এক সৈন্যবাহিনী দেন। ঐ সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া ব্রহ্মের রাজার সহিত যোগ দেয় এবং আরাকানরাজকে বন্দী করে। আরাকানরাজ কোনক্রমে পলাইয়া আসিয়া জলালুদ্দীনকে সব কথা জানান। তখন জলালুদ্দীন আর একজন সেনানায়ককে প্রেরণ করেন এবং ইহার প্রচেষ্টায় ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানরাজের হৃত রাজ্য উদ্ধার হয়। কিন্তু জলালুদ্দীনের উপকারের বিনিময়ে আরাকানরাজ তাঁহার সামন্ত হইতে বাধ্য হইলেন।

ইব্‌ন্‌-ই-হজর ও অল-সখাওয়ীর লেখা গ্রন্থদ্বয় হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন ইসলামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং তাঁহার পিতা কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত মসজিদগুলির সংস্কার সাধন করেন; তিনি আবু হানিফার সম্প্রদায়ের মতবাদ গ্রহণ করেন; মক্কায় তিনি অনেকগুলি ভবন ও একটি সুন্দর মাদ্রাসা নির্মাণ করাইয়া ছিলেন; খলিফার নিকট এবং মিশরের রাজা অল-আশরফ বাসবায়ের নিকট তিনি অনেক উপহার পাঠাইয়াছিলেন; খলিফা জলালুদ্দীনের প্রার্থনা অনুযায়ী জলালুদ্দীনকে সম্মান-পরিচ্ছদ পাঠাইয়া তাঁহার “অনুমোদন” জানান।

উপরে প্রদত্ত বিবরণ হইতে জানা যায় যে, জলালুদ্দীন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ইহার প্রমাণ অন্যান্য বিষয় হইতে পাওয়া যায়। প্রায় দুই শত বৎসর ধরিয়া বাংলার সুলতানদের মুদ্রায় ‘কলমা’ উৎকীর্ণ হইত না, জলালুদ্দীন কিন্তু তাঁহার মুদ্রায় ‘কলমা খোদাই করান। রাজত্বের শেষদিকে জলালুদ্দীন খলীফ আল্লাহ (ঈশ্বরের উত্তরাধিকারী) উপাধি গ্রহণ করেন। জলালুদ্দীন তাঁহার পূর্বতন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম্মের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। বুকাননের বিবরণী অনুসারে তিনি অনেক হিন্দুকে জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছিলেন, যাহার ফলে বহু হিন্দু কামরূপে পলাইয়া গিয়াছিল। ‘রিয়াজ’-এর মতে ইতিপূর্বে জলালুদ্দীনকে হিন্দুধর্ম্মে পুনর্দীক্ষিত করার ব্যাপারে যে সমস্ত ব্রাহ্মণ অংশগ্রহণ করিয়াছিল, জলালুদ্দীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়া তাহাদের যন্ত্রণা দিয়া গোমাংস খাওয়াইয়াছিলেন।

কিন্তু ‘স্মৃতিরত্নহার’ নামক সামসাময়িক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, এই জলালুদ্দীনই রায় রাজ্যধর নামক একজন নিষ্ঠাবান হিন্দুকে তাঁহার সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ‘স্মৃতিরত্নহার’-এর লেখক বৃহস্পতি মিশ্রও জলালুদ্দীনের নিকটে কিছু সমাদর পাইয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, জলালুদ্দীন হিন্দুধর্ম্মের অনুরাগী না হইলেও যোগ্য হিন্দুদের মর্যাদা দান করিতেন। সংস্কৃত পণ্ডিত বৃহস্পতি মিশ্রের সমাদর করার কারণ হয়ত জলালুদ্দীনের প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সংস্কৃত শিক্ষা।

মুসলমান ঐতিহাসিকদের মতে জলালুদ্দীন সুশাসক ও ন্যায়বিচারক ছিলেন। ‘রিয়াজ’-এর মতে তিনি জনাকীর্ণ পাণ্ডুয়া নগরী পরিত্যাগ করিয়া গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।

জলালুদ্দীনের রাজ্যের আয়তন খুব বিশাল ছিল। প্রায় সমগ্র বাংলা দেশ ও আরাকান ব্যতীত–ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁহার রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল বলিয়া মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে মনে হয়।

জলালুদ্দীন ১৪৩৩ খ্রীষ্টাব্দের গোড়ার দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভবত তাঁহার অল্প কিছুকাল পরেই তিনি পরলোকগমন করেন। পাণ্ডুয়ার একলাখী প্রাসাদে তাঁহার সমাধি অছে।

শামসুদ্দীন আহ্মদ শাহ

জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র শামসুদ্দীন আহমদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। আইন-ই-আকবরী’, ‘তবকাত-ই-আকবরী’, ‘তারিখ-ই ফিরিশতা’, ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ প্রভৃতি গ্রন্থের মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহ ১৬ বা ১৮ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইতে পারে না। কারণ শামসুদ্দীন আহ্মদ শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসর অর্থাৎ ৮৩৬ হিজরা (১৪৩২-৩৩ খ্রী) ভিন্ন আর কোন বৎসরের মুদ্রা পাওয়া যায় নাই। এদিকে ৮১৪ হিজরা (১৪৩৭-৩৮ খ্রী) হইতে তাঁহার পরবর্তী সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের মুদ্রা পাওয়া যাইতেছে। বুকাননের বিবরণী অনুসারে শামসুদ্দীন তিন বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই কথাই সত্য বলিয়া মনে হয়।

ফিরিশতার মতে শামসুদ্দীন মহান, উদার, ন্যায়পরায়ণ এবং দানশীল নৃপতি ছিলেন। কিন্তু ‘রিয়াজ’-এর মতে শামসুদ্দীন ছিলেন বদমেজাজী, অত্যাচারী এবং রক্তপিপাসু; বিনা কারণে তিনি মানুষের রক্তপাত করিতেন এবং গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের উদর বিদীর্ণ করিতেন। সমসাময়িক আরব-দেশীয় গ্রন্থকার ইব-ই হজরের মতে শামসুদ্দীন মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে রাজা হইয়াছিলেন। এ কথা সত্য হইলে বলিতে হইবে, তাঁহার সম্বন্ধে ফিরিশতার প্রশংসা এবং ‘রিয়াজ’-এর নিন্দা–দুইই অতিরঞ্জিত।

‘রিয়াজ’ ও বুকাননের বিবরণীর মতে শামসুদ্দীনের দুই ক্রীতদাস সাদী খান ও নাসির খান ষড়যন্ত্র করিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন। এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ একলাখী প্রাসাদের মধ্যস্থিত শামসুদ্দীনের সমাধির গঠন শহীদের সমাধির অনুরূপ।

শামসুদ্দীন সম্বন্ধে আর কোন সংবাদ জানা যায় না। তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে গণেশের বংশের রাজত্ব শেষ হইল।

 ০৫. মাহমুদ শাহী বংশ ও হাবশী রাজত্ব

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মাহমুদ শাহী বংশ ও হাবশী রাজত্ব

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ

শামসুদ্দীন আহমদ শাহের পরবর্তী সুলতানের নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। ইনি ১৪৩৭ খ্রীষ্টাব্দ বা তাঁহার দুই এক বৎসর পূর্বে সিংহাসনে আরোহণ করেন, ‘রিয়াজ’-এর মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহের দুই হত্যাকারীর অন্যতম সাদী খান অপর হত্যাকারী নাসির খানকে বধ করিয়া নিজে রাজ্যের সর্বময় কর্ত্তা হইতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু নাসির খান তাঁহার অভিসন্ধি বুঝিয়া তাহাকে হত্যা করেন এবং নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেন। আহমদ শাহের অমাত্যেরা তাঁহার কর্তৃত্ব মানিতে রাজী না হইয়া তাঁহাকে বধ করেন এবং শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের জনৈক পৌত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। অন্য বিবরণগুলি হইতে ‘রিয়াজ’-এর বিবরণের অধিকাংশ কথারই সমর্থন পাওয়া যায় এবং তাহাদের অধিকাংশেরই মতে নাসিরুদ্দীন ইলিয়াস শাহের বংশধর। বুকাননের বিবরণীর হইতেও ‘রিয়াজ’-এর বিবরণের সমর্থন মিলে, তবে বুকাননের বিবরণীতে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে ইলিয়াস শাহের বংশধর বলা হয় নাই। বুকাননের বিবরণীর মতে শামসুদ্দীন আহমদ শাহের ক্রীতদাস ও হত্যাকারী নাসির খান এবং নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ অভিন্ন লোক।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই ধরিয়া লইয়াছেন যে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ ইলিয়াস শাহী বংশের সন্তান, এই কারণে তাঁহারা নাসিরুদ্দীনের বংশকে “পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ” নামে অভিহিত করিয়াছেন। ইহার পরিবর্তে এই বংশের “মাহমুদ শাহী বংশ” নামই (নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের নাম অনুসারে) অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। ‘রিয়াজ’-এর মতে নাসিরুদ্দীন সমস্ত কাজ ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার সহিত করিতেন; দেশের আবালবৃদ্ধনির্বিশেষে সমস্ত প্রজা তাঁহার শাসনে সন্তুষ্ট ছিল; গৌড় নগরীর অনেক দুর্গ ও প্রাসাদ তিনি নির্মাণ করান। গৌড় নগরীই ছিল নাসিরুদ্দীনের রাজধানী। নাসিরুদ্দীন যে সুযোগ্য নৃপতি ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, কারণ তাহা না হইলে তাঁহার পক্ষে সুদীর্ঘ ২৪/২৫ বৎসর রাজত্ব করা সম্ভব হইত না।

নাসিরুদ্দীনের রাজত্বকাল মোটামুটিভাবে শান্তিতেই কাটিয়াছিল। তবে উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্রদেবের (১৪৩৫-৬৭ খ্রী) এক তাম্রশাসনের সাক্ষ্য হইতে অনুমিত হয় যে, কপিলেন্দ্রদেবের সহিত নাসিরুদ্দীনের সংঘর্ষ হইয়াছিল। খুলনা যশোহর অঞ্চলে প্রচলিত ব্যাপক প্রবাদ এবং বাগেরহাট অঞ্চলে প্রাপ্ত এক শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে মনে হয় যে, খান জহান নামে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের জনৈক সেনাপতি ঐ অঞ্চলে প্রথম মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার পর বিদ্যাপতি তাঁহার দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’তে বলিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক ভৈরবসিংহ গৌড়েশ্বরকে “শ্রীকৃত করিয়াছিলেন; দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে লেখা হয়, সুতরাং ইহাতে উল্লিখিত গৌড়েশ্বর নিশ্চয়ই বাংলার তৎকালীন সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। সম্ভবত মিথিলার রাজা ভৈরবসিংহের সহিত নাসিরুদ্দীনের সংঘর্ষ হইয়াছিল। মিথিলার সন্নিহিত অঞ্চল নাসিরুদ্দীনের অধীন ছিল–ভাগলপুর ও মুঙ্গেরে তাঁহার শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং মিথিলার রাজাদের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে চীনের সহিত বাংলার রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ৩৪ বৎসর ধরিয়া এই সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। নাসিরুদ্দীন দুইবার-১৪৩৮ ও ১৪৩৯ খ্রীষ্টাব্দে চীনা-ম্রাটের কাছে উপহারসমেত রাজদূত পাঠাইয়াছিলেন। প্রথমবার তিনি চীন-সম্রাটকে একটি জিরাফও পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার পর চীনের সঙ্গে বাংলার যোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। এ জন্য নাসিরুদ্দীন দায়ী নহেন, চীন-সম্রাটই দায়ী। য়ুং-লো (১৪০২-২৫ খ্রী) যখন চীনের সম্রাট ছিলেন তখন যেমন বাংলা হইতে চীনে দূত ও উপহার যাইত, তেমনি চীন হইতে বাংলায়ও দূত ও উপহার আসিত। কিন্তু য়ুং-লোর উত্তরাধিকারীরা শুধু বাংলার রাজার পাঠানো উপহার গ্রহণ করিতেন, নিজেরা বাংলার রাজার কাছে দূত ও উপহার পাঠাইতেন না। তাহারা বোধ হয় ভাবিতেন যে সামন্ত রাজা ভেট পাঠাইয়াছে, তাঁহার আবার প্রতিদান দিব কি*! [* চীন-সম্রাটরা পৃথিবীর অন্যান্য রাজাদের নিজেদের সামন্ত বলিয়াই মনে করিতেন।] বলা বাহুল্য এই একতরফা উপহার প্রেরণ বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। তাঁহার ফলে উভয় দেশের সংযোগ অচিরেই ছিন্ন হইয়া যায়।

রুকনুদ্দীন বারবক শাহ

রুকনুদ্দীন বারবক শাহ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র ও উত্তরাধিকারী। ইনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান।

বারবক শাহ অন্তত একুশ বৎসর-১৪৫৫ হইতে ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন; ইহার মধ্যে ১৪৫৫ হইতে ১৪৫৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিজের পিতা নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন, ১৪৭৪ হইতে ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তাঁহার পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেন, অবশিষ্ট সময়ে তিনি এককভাবে রাজত্ব করেন। বাংলার সুলতানদের মধ্যে অনেকেই নিজের রাজত্বের শেষদিকে পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করিয়াছেন। সুলতানের মৃত্যুর পর যাহাতে তাঁহার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন লইয়া সংঘর্ষ না বাধে, সেইজন্যই সম্ভবত বাংলাদেশে এই অভিনব প্রথা প্রবর্তিত হইয়াছিল।

বারবক শাহ অনেক নূতন রাজ্য জয় করিয়া নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। ইসমাইল গাজী নামে একজন ধার্মিক ব্যক্তি তাঁহার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। ইনি ছিলেন কোরেশ জাতীয় আরব। “রিসালৎ-ই-শুহাদা’ নামক একখানি ফার্সী গ্রন্থে ইসমাইলের জীবনকাহিনী বর্ণিত হইয়াছে; এই কাহিনীর মধ্যে কিছু কিছু অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য উপাদান থাকিলেও মোটের উপর ইহা বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। “রিসালৎ-ই-শুহাদা’র মতে ইসমাইল ছুটিয়া-পটিয়া নামক একটি নদীতে সেতু নির্মাণ করিয়া তাঁহার বন্যা নিবারণ করিয়াছিলেন এবং “মান্দারণের বিদ্রোহী রাজা গজপতিকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া তিনি মান্দারণ দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন একথাও এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হইয়াছে; ইহার অন্তর্নিহিত প্রকৃত ঘটনা সম্ভবত এই যে, ইসমাইল গজপতি-বংশীয় উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্রদেবের কোন সৈন্যাধ্যক্ষকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া মান্দারণ দুর্গ জয় করিয়াছিলেন। এই মান্দারণ দুর্গ বাংলার অন্তর্গত ছিল। কপিলেন্দ্রদেব তাহা জয় করেন। রিসালৎ’ এর মতে ইসমাইল কামরূপের রাজা “কামেশ্বরের” (কামতেশ্বর?) সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছিলেন, কিন্তু রাজা তাঁহার অলৌকিক মহিমা দেখিয়া তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ঘোড়াঘাটের দুর্গাধ্যক্ষ ভাসী রায় ইসমাইলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনায় বারবক শাহ ইসমাইলকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

মুন্না তকিয়ার বয়াজে লেখা আছে যে, বারবক শাহ ১৪৭০ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিহুত রাজ্যে অভিযান করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে হাজীপুর ও তৎসন্নিহিত স্থানগুলি পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল তাঁহার রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল এবং উত্তরে বুড়ি গণ্ডক নদী পর্যন্ত তাঁহার অধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল; বারবক শাহ ত্রিহুতের হিন্দু রাজাকে তাঁহার সামন্ত হিসাবে ত্রিহুতের উত্তর অংশ শাসনের ভার দিয়াছিলেন এবং কেদার রায় নামে একজন উচ্চপদস্থ হিন্দুকে তিনি ত্রিহুতে রাজস্ব আদায় ও সীমান্ত রক্ষার জন্য তাঁহার প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়াছিলেন; কিন্তু পূর্ব্বোক্ত হিন্দু রাজার পুত্র ভরত সিংহ। (ভৈরব সিংহ?) বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া কেদার রায়কে বলপূর্বক অপসারিত করেন; ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া বারবক শাহ তাঁহাকে শাস্তি দিবার উদ্যোগ করেন, কিন্তু ত্রিহুতের রাজা তাঁহার নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তাহাকে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে আর কোন গোলযোগ ঘটে নাই।

মুল্লা তকিয়ার বয়াজের এই বিবরণ মূলত সত্য, কেন না সমসাময়িক মৈথিল পণ্ডিত বর্ধমান উপাধ্যায়ের লেখা দণ্ডবিবেক’ হইতে সমর্থন পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে ত্রিহুত জৌনপুরের শর্কী সুলতানদের অধীন সামন্ত রাজ্য ছিল। কিন্তু শর্কী বংশের শেষ সুলতান হোসেন শাহের অক্ষমতার জন্য তাঁহার রাজত্বকালে জৌনপুর সাম্রাজ্য ভাঙিয়া যায়। এই সুযোগেই বারবক শাহ ত্রিহুত অধিকার করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

বারবক শাহের শিলালিপিগুলিতে তাঁহার পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক ‘অল-ফাজিল ও ‘অল-কামিল’ এই দুইটি উপাধির উল্লেখ দেখা যায়। বারবক শাহ শুধু পণ্ডিত ছিলেন না, তিনি বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্ম্মেরই অনেক কবি ও পণ্ডিত তাঁহার কাছে পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে একজন ছিলেন বৃহস্পতি মিশ্র। ইনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং গীতগোবিন্দটীকা, কুমারসম্ভবটীকা, রঘুবংশটীকা, শিশুপালবধটীকা, অমরকোষটীকা, স্মৃতিরত্নহার প্রভৃতি গ্রন্থের লেখ। ইহার সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ অমরকোষটীকা ‘পদচন্দ্রি। বৃহস্পতির প্রথম দিককার বইগুলি জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়; জলালুদ্দীনের সেনাপতি রায় রাজ্যধর তাঁহার শিষ্য ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জলালুদ্দীনের কাছেও তিনি খানিকটা সমাদর লাভ করিয়াছিলেন, ‘স্মৃতিরত্নহার’-এ তিনি জলালুদ্দীনের নাম উল্লেখ করিয়াছেন; ‘পদচন্দ্রিকা’র প্রথমাংশও জলালুদ্দীনেরই রাজত্বকালে–১৪১৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়। কিন্তু ‘পদচন্দ্রিকা’র শেষাংশ অনেক পরে-১৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়; তখন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ বাংলার সুলতান। পদচন্দ্রিকায় বৃহস্পতি লিখিয়াছেন যে তিনি গৌড়েশ্বরের কাছে ‘পণ্ডিতসার্বভৌম’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন এবং রাজা তাঁহাকে উজ্জ্বল মণিময় হার, দ্যুতিমান দুইটি কুণ্ডল রত্নখচিত দশ আঙ্গুলের অঙ্গুরীয় দিয়া হাতির পিঠে চড়াইয়া স্বর্ণকলসের জলে অভিষেক করাইয়া ছত্র ও অশ্বের সহিত রায়মুকুট’ উপাধি দান করিয়াছিলেন। বিশারদ (সম্ভবত ইনি বাসুদেব সার্বভৌমের পিতা) নামে একজন পণ্ডিতের লেখা একটি জ্যোতির্বিষয়ক বচন হইতে বুঝা যায় তিনিও বারবক শাহের সমসাময়িক ছিলেন ও সম্ভবত তাঁহার পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন।

‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামক বিখ্যাত বাংলা কাব্যের রচয়িতা মালাধর বসু বলিয়াছেন যে গৌড়েশ্বর তাঁহাকে “গুণরাজ খান” উপাধি দিয়াছিলেন। এই গৌড়েশ্বরই বারবক শাহ। বাংলা রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাসও তাঁহার আত্মকাহিনীতে লিখিয়াছেন যে তিনি একদিন গৌড়েশ্বরের সভায় গিয়াছিলেন এবং তাঁহার কাছে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করিয়াছিলেন। এই গৌড়েশ্বর যে কে, সে সম্বন্ধে গবেষকরা এতদিন অনেক জল্পনা কল্পনা করিয়াছেন। সম্প্রতি এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, যাহা হইতে বলা যায়, এই গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দীন বারবক শাহ। বর্তমান গ্রন্থের বাংলা সাহিত্য সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে।

‘ফরঙ্গ-ই-ইব্রাহিমী’ নামক ফার্সী ভাষার একটি শব্দকোষ গ্রন্থের (শরনামা নামেই বিশেষভাবে পরিচিত) রচয়িতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকীও বারবক শাহের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। ইহার আদি নিবাস ছিল জৌনপুরে। বারবক শাহের উচ্ছ্বসিত স্তুতি করিয়া ফারুকী লিখিয়াছেন “যিনি প্রার্থীকে বহু ঘোড়া দিয়াছেন। যাহারা পায়ে হাঁটে তাহারাও (ইঁহার কাছে) বহু ঘোড়া দান স্বরূপ পাইয়াছে। এই মহান আবুল মুজাফফর, যাহার সর্বাপেক্ষা সামান্য ও সাধারণ উপহার একটি ঘোড়া।” ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকীর গ্রন্থে আমীর জৈনুদ্দীন হারাওয়ী নামে একজন সমসাময়িক কবির নাম উল্লিখিত হইয়াছে। ফারুকী ইহাকে “মালেকুশ শোয়ারা” বা রাজকবি বলিয়াছেন। ইহা হইতে মনে হয়, ইনি বারবক শাহ ও তাঁহার পরবর্তী সুলতানদের সভাকবি ছিলেন।

বারবক শাহ যে উদার ও অসাম্প্রদিয়ক মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন, তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায় হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা হইতে। ইহা ভিন্ন বারবক শাহ হিন্দুদের উচ্চ রাজপদেও নিয়োগ করিতেন। দ্রব্যগুণের বিখ্যাত টীকাকার শিবদাস সেন লিখিয়াছেন যে তাঁহার পিতা অনন্ত সেন গৌড়েশ্বর বারবক শাহের “অন্তরঙ্গ” অর্থাৎ চিকিৎসক ছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্রের ‘পদচন্দ্রিকা হইতে জানা যায় যে, তাঁহার বিশ্বাস রায় প্রভৃতি পুত্রেরা বারবক শাহের প্রধান মন্ত্রীদের অন্যতম ছিলেন। পুরাণসর্বস্ব’ নামক একটি গ্রন্থের (সঙ্কলনকাল ১৪৭৪ খ্রী) হইতে জানা যায় যে ঐ গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা গোবর্ধনের পৃষ্ঠপোষক কুলধর বারবক শাহের কাছে প্রথমে “সত্য খান” এবং পরে “শুভরাজ খান” উপাধি লাভ করেন, ইহা হইতে মনে হয়, কুলধর বারবক শাহের অধীনে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। আমরা পূর্বেই দেখিয়া আসিয়াছি যে কেদার রায় ছিলেন ত্রিহুতে বারবক শাহের প্রতিনিধি, নারায়ণদাস ছিলেন তাঁহার চিকিৎসক এবং ভান্দসী রায় ছিলেন তাঁহার রাজ্যের সীমান্তে ঘোড়াঘাট অঞ্চলে একটি দুর্গের অধ্যক্ষ। কৃত্তিবাস তাঁহার আত্মকাহিনীতে গৌড়েশ্বরের অর্থাৎ বারবক শাহের যে কয়জন সভাসদের উল্লেখ করিয়াছেন, তাঁহার মধ্যে কেদার রায় এবং নারায়ণ ছাড়াও জগদানন্দ রায়, “ব্রাহ্মণ” সুনন্দ, কেদার খাঁ, গন্ধর্ব রায়, তরণী, সুন্দর, শ্রীবৎস্য, মুকুন্দ প্রভৃতি নাম পাওয়া যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে মুকুন্দ ছিলেন “রাজার পণ্ডিত”; কেদার খা বিশেষ প্রতিপত্তিশালী সভাসদ ছিলেন এবং কৃত্তিবাসের সংবর্ধনার সময়ে তিনি কৃত্তিবাসের মাথায় “চন্দনের ছড়া” ঢালিয়াছিলেন; সুন্দর ও শ্রীবৎস্য ছিলেন “ধর্ম্মাধিকারিণী” অর্থাৎ বিচারবিভাগীয় কর্মচারী। গন্ধর্ব রায়কে কৃত্তিবাস “গন্ধর্ব অবতার” বলিয়াছেন, ইহা হইতে মনে হয়, গন্ধর্ব রায় সুপুরুষ ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন; কৃত্তিবাস কর্ত্তৃক উল্লিখিত অন্যান্য সভাসদের পরিচয় সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।

বারবক শাহের বিভিন্ন শিলালিপি হইতে ইকরার খান, আজমল খান, নসরৎ খান, মরাবৎ খান জহান, অলকা খান, আশরফ খান, খুর্শীদ খান, উজৈর খান, রাস্তি খান প্রভৃতি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নাম পাওয়া যায়। ইঁহাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তা; ইহাদের অন্যতম রাস্তি খান চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন; ইহার পরে ইঁহার বংশধররা বহুদিন পর্যন্ত ঐ অঞ্চল শাসন করিয়াছিলেন।

বারবক শাহ শুধু যে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরই রাজপদে নিয়োগ করিতেন তাহা নয়। প্রয়োজন হইলে ভিন্ন দেশের লোককে নিয়োগ করিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করিতেন না। মুল্লা তকিয়ার বয়াজ হইতে জানা যায় যে, তিনি ত্রিহুতে অভিযানের সময় বহু আফগান সৈন্য সগ্রহ করিয়াছিলেন। তারিখ-ই-ফিরিশতা’য় লেখা আছে যে বারবক শাহ বাংলায় ৮০,০০০ হাবশী আমদানী করিয়াছিলেন এবং তাহাদের প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা, মন্ত্রী, অমাত্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। এই কথা সম্ভবত সত্য, কারণ বারবক শাহের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরে হাবশীরা বাংলার সর্বময় কর্ত্তা হইয়া ওঠে, এমনকি তাহারা বাংলার সিংহাসনও অধিকার করে। হাবশীদের এদেশে আমদানী করা ও শাসনক্ষমতা দেওয়ার জন্য কোন কোন গবেষক বারবক শাহের উপর দোষারোপ করিয়াছেন কিন্তু বারবক শাহ হাবশীদের শারীরিক পটুতার জন্য তাহাদিগকে উপযুক্ত পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন; তাহারা যে ভবিষ্যতে এতখানি শক্তিশালী হইবে, ইহা বুঝা তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে হাবশীদের ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য বারবক শাহ দায়ী নহেন, দায়ী তাঁহার উত্তরাধিকারীরা।

আরাকানদেশের ইতিহাসের মতে আরাকানরাজ মেং-খরি (১৪৩৪-৫৯ খ্রী) রামু (বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত) ও তাঁহার দক্ষিণস্থ বাংলার সমস্ত অঞ্চল জয় করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুত্র ও উত্তরাধিকারী বসোআহপু (১৪৫৯-৮২ খ্রী) চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন। ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে ১৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বারবক শাহ চট্টগ্রাম পুনরধিকার করিয়াছিলেন, কারণ ঐ সালে উত্তীর্ণ চট্টগ্রামের একটি শিলালিপিতে রাজা হিসাবে তাঁহার নাম আছে।

বারবক শাহের বিভিন্ন প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। তিনি একজন সত্যকার সৌন্দর্যরসিকও ছিলেন। তাঁহার মুদ্রা এবং শিলালিপিগুলির মধ্যে অনেকগুলি অত্যন্ত সুন্দর। তাঁহার প্রাসাদের একটি সমসাময়িক বর্ণনা পাওয়া গিয়াছে; তাহা হইতে দেখা যায় যে, এই প্রাসাদটির মধ্যে উদ্যানের মত একটি শান্ত ও আনন্দদায়ক পরিবেশ বিরাজ করিত, ইহার নীচ দিয়া একটি পরম রমণীয় জলধারা প্রবাহিত হইত এবং প্রাসাদটিতে “মধ্য তোরণ” নামে একটি অপূর্ব সুন্দর “বিশেষ প্রবেশপথ হিসাবে নির্মিত” তোরণ ছিল। গৌড়ের “দাখিল দরওয়াজা” নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তোরণটি বারবক শাহই নির্মাণ করাইয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে।

বাংলার সুলতানদের মধ্যে রুকনুদ্দীন বারবক শাহ যে নানা দিক দিয়াই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহ

রুকনুদ্দীন বারবক শাহের পুত্র শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহ কিছুদিন পিতার সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করিয়াছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তিনি এককভাবে ১৪৭৬-৮১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সর্বসমেত তাঁহার রাজত্ব ছয় বৎসরের মত স্থায়ী হইয়াছিল।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহকে উচ্চশিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ ও শাসনদক্ষ নরপতি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে য়ুসুফ শাহ আইনের শৃঙ্খলা কঠোরভাবে রক্ষা করিতেন; কেহ তাঁহার আদেশ অমান্য করিতে সাহস পাইত না; তিনি তাঁহার রাজ্যে প্রকাশ্যে মদ্যপান একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন; আলিমদের তিনি সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন, যেন তাহারা ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি করিতে গিয়া কাহারও পক্ষ অবলম্বন না করেন; তিনি বহু শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, ন্যায়বিচারের দিকেও তাঁহার আগ্রহ ছিল। তাই যে মামলার বিচার করিতে গিয়া কাজীরা ব্যর্থ হইত, সেগুলির অধিকাংশ তিনি স্বয়ং বিচার করিয়া নিস্পত্তি করিতেন।

য়ুসুফ শাহ যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তাঁহার রাজত্বকালে গৌড় ও তাঁহার আশেপাশে অনেকগুলি মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল। তাহাদের কয়েকটির নির্মাতা ছিলেন স্বয়ং য়ুসুফ শাহ। কেহ কেহ মনে করেন, গৌড়ের বিখ্যাত লোটন মসজিদ ও চামকাটি মসজিদ য়ুসুফ শাহই নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

য়ুসুফ শাহের যেমন স্বধর্ম্মের প্রতি নিষ্ঠা ছিল, তেমনি পরধর্ম্মের প্রতি বিদ্বেষও ছিল। তাঁহার প্রমাণ, তাঁহারই রাজত্বকালে পাণ্ডুয়ায় (হুগলি জেলা) হিন্দুদের সূর্য ও নারায়ণের মন্দিরকে মসজিদ ও মিনারে পরিণত করা হইয়াছিল এবং ব্রহ্মশিলা নির্মিত বিরাট সূর্যমূর্ত্তির বিকৃতিসাধন করিয়া তাঁহার পৃষ্ঠে শিলালিপি খোদাই করা হইয়াছিল। পাণ্ডুয়ার (হুগলি) পূর্ব্বোক্ত মসজিদটি এখন বাইশ দরওয়াজা’ নামে পরিচিত। ইহার মধ্যে হিন্দু মন্দিরের বহু শিলাস্তম্ভ ও ধ্বংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। পাণ্ডুয়া (হুগলি) সম্ভবত য়ুসুফ শাহের রাজত্বকালেই বিজিত হইয়াছিল, কারণ এখানে সর্বপ্রথম তাঁহারই শিলালিপি পাওয়া যায়।

জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের মৃত্যুর পরে সিকন্দর শাহ নামে একজন রাজবংশীয় যুবক সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অযোগ্য ছিলেন বলিয়া অমাত্যেরা তাঁহাকে অল্প সময়ের মধ্যেই অপসারিত করেন। ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীনে’র মতে এই সিকন্দর শাহ ছিলেন য়ুসুফ শাহের পুত্র; তিনি উন্মাদরোগগ্রস্ত ছিলেন; এই কারণে তিনি যেদিন সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, সেই দিনই অমাত্যগণ কর্ত্তৃক অপসারিত হন। কিন্তু মতান্তরে সিকন্দর শাহ দুই মাস রাজত্ব করিয়াছিলেন। শেষোক্ত মতই সত্য বলিয়া মনে হয়; কারণ যে যুবককে সুস্থ ও যোগ্য জানিয়া অমাত্যেরা সিংহাসনে বসাইয়া ছিলেন, তাঁহার অযোগ্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইতে যে কিছু সময় লাগিয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাসগ্রস্থগুলির উক্তি ব্যতীত এই সিকন্দর শাহের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

পরবর্তী সুলতানের নাম জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। ইনি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র এবং শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের খুল্লতাত। ইনি ৮৮৬ হইতে ৮৯২ হিজরা (১৪৮১-৮২ খ্রী হইতে ১৪৮৭-৮৮ খ্রী) পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইঁহার মুদ্রাগুলি হইতে জানা যায় যে ইহার দ্বিতীয় নাম ছিল হোসেন শাহ।

‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে ফতেহ্ শাহ বিজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও উদার নৃপতি ছিলেন এবং তাঁহার রাজত্বকালে প্রজারা খুব সুখে ছিল। সমসাময়িক কবি বিজয়গুপ্তের লেখা ‘মনসামঙ্গলে লেখা আছে যে এই নৃপতি বাহুবলে বলী ছিলেন এবং তাঁহার প্রজাপালনের গুণে প্রজারা পরম সুখে ছিল। ফার্সী শব্দকোষ শরনামা’র রচয়িতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকী জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের প্রশস্তি করিয়া একটি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন।

কিন্তু বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের হাসন-হোসেন পালায় যাহা লেখা আছে, তাহা হইতে মনে হয়, ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে হিন্দু প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষের যথেষ্ট কারণ বর্তমান ছিল। পালাটিতে হোসেনহাটী গ্রামের কাজী হাসন-হোসেন ভ্রাতৃ-যুগলের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। এই দুই ভাই এবং হোসেনের শালা দুলা হিন্দুদের উপর অপরিসীম অত্যাচার করিত, ব্রাহ্মণদের নাগালে পাইলে তাহারা তাহাদের পৈতা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া মুখে থুতু দিত। একদিন এক বনে একটি কুটিরে রাখাল বালকেরা মনসার ঘট পূজা করিতেছিল, এমন সময়ে তকাই নামে একজন মোল্লা ঝড়বৃষ্টির জন্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হয়; সে মনসার ঘট ভাঙিতে গেল, কিন্তু রাখাল বালকেরা তাহাকে বাধা দিয়া প্রহার করিল এবং নাকে খৎ দিয়া ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করিল। তকাই ফিরিয়া আসিয়া হাসন-হোসেনের কাছে রাখাল বালকদের নামে নালিশ করিল। নালিশ শুনিয়া হাসন-হোসেন বহু সশস্ত্র মুসলমানকে একত্র সংগ্রহ করিয়া রাখালদের কুটির আক্রমণ করিল, তাহাদের আদেশে সৈয়দেরা রাখালদের কুটির এবং মনসার ঘট ভাঙিয়া ফেলিল। রাখালরা ভয় পাইয়া বনের মধ্যে লুকাইয়াছিল। কাজীর লোকেরা বন তোলপাড় করিয়া তাহাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করিল। হাসন-হোসেন বন্দী রাখালদের “ভূতের” পূজা করার জন্য ধিক্কার দিতে লাগিল।

এই কাহিনী কাল্পনিক বটে, কিন্তু কবির লেখনীতে ইহার বর্ণনা যেরূপ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা হইতে মনে হয় যে, সে যুগের মুসলমান কাজী ও ক্ষমতাশালী রাজকর্মচারীরা সময় সময় হিন্দুদের উপর এইরূপ অত্যাচার করিত এবং কবি স্বচক্ষে তাহা দেখিয়া এই বর্ণনার মধ্যে তাহা প্রতিফলিত করিয়াছেন।

জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালেই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন–১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে।

চৈতন্যদেবের বিশিষ্ট ভক্ত যবন হরিদাস তাঁহার অনেক আগেই জন্মগ্রহণ করেন। ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায় যে, হরিদাস মুসলমান হইয়াও কৃষ্ণ নাম করিতেন; এই কারণে কাজী তাঁহার বিরুদ্ধে “মুলুক-পতি” অর্থাৎ আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তার কাছে নালিশ করেন। মুলুক-পতি তখন হরিদাসকে বলেন, যে হিন্দুদের তাঁহারা এত ঘৃণা করেন, তাহাদের আচার ব্যবহার হরিদাস কেন অনুসরণ করিতেছেন? হরিদাস ইহার উত্তরে বলেন যে, সব জাতির ঈশ্বর একই। মুলুক-পতি বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও হরিদাস কৃষ্ণনাম ত্যাগ করিয়া “কলিমা উচ্চারণ” করিতে রাজী হইলেন না। তখন কাজীর আজ্ঞায় হরিদাসকে বাজারে লইয়া গিয়া বাইশটি বেত্রাঘাত করা হইল। শেষ পর্যন্ত হরিদাসের অলৌকিক মহিমা দর্শন করিয়া মুলুক-পতি তাঁহার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিলেন যে আর কেহ তাঁহার কৃষ্ণনামে বিঘ্ন সৃষ্টি করিবে না। চৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল; সুতরাং ইহা যে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালেরই ঘটনা তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ হইতে জানা যায় যে, চৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে নবদ্বীপের নিকটবর্তী পিরল্যা গ্রামের মুসলমানরা গৌড়েশ্বরের কাছে গিয়া মিথ্যা নালিশ করে যে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা তাঁহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছে, গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে বলিয়া প্রবাদ আছে, সুতরাং গৌড়েশ্বর যেন নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে নিশ্চিত না থাকেন। এই কথা শুনিয়া গৌড়েশ্বর “নবদ্বীপ উচ্ছন্ন” করিতে আজ্ঞা দিলেন। তাঁহার লোকেরা তখন নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের প্রাণবধ ও সম্পত্তি লুঠ করিতে লাগিল এবং নবদ্বীপের মন্দিরগুলি ধ্বংস করিয়া তুলসীগাছগুলি উপড়াইয়া ফেলিতে লাগিল। বিখ্যাত পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম এই অত্যাচারে সন্ত্রস্ত হইয়া সপরিবারে নবদ্বীপ ত্যাগ করিয়া উড়িষ্যায় চলিয়া গেলেন। কিছুদিন এইরূপ অত্যাচার চলিবার পর কালী দেবী স্বপ্নে গৌড়েশ্বরকে দেখা দিয়া ভীতিপ্রদর্শন করিলেন। তখন গৌড়েশ্বর নবদ্বীপে অত্যাচার বন্ধ করিলেন এবং তাঁহার আজ্ঞায় বিধ্বস্ত নবদ্বীপের আমূল সংস্কার সাধন করা হইল। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জয়ানন্দের এই বিবরণের আংশিক সমর্থন পাওয়া যায়। বৃন্দাবনদাস লিখিয়াছেন যে, চৈতন্যদেবের জন্মের সামান্য পূর্বে নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত গঙ্গাদাস রাজভয়ে সন্ত্রস্ত হইয়া সপরিবারে গঙ্গা পার হইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন। বৃন্দাবনদাস আরও লিখিয়াছেন যে চৈতন্যদেবের জন্মের ঠিক আগে শ্রীবাস ও তাঁহার তিন ভাইয়ের হরিনাম-সঙ্কীর্তন দেখিয়া নবদ্বীপের লোকে বলিত “মহাতীব্র নরপতি” নিশ্চয়ই ইহাদিগকে শাস্তি দিবেন। এই নরপতি” জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। সুতরাং নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপর গৌড়েশ্বরের অত্যাচার সম্বন্ধে জয়ানন্দের বিবরণকে মোটামুটিভাবে সত্য বলিয়াই গ্রহণ করা যায়। বলা বাহুল্য এই গৌড়েশ্বরও জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ। অবশ্য জয়ানন্দের বিবরণের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় সত্য না-ও হইতে পারে। গৌড়েশ্বরকে কালী দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন এবং গৌড়েশ্বর ভীত হইয়া অত্যাচার বন্ধ করিয়াছিলেন–এই কথা কবিকল্পনা ভিন্ন আর কিছুই নয়। কিন্তু জয়ানন্দের বিবরণ মূলত সত্য, কারণ বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবতে ইহার সমর্থন মিলে এবং জয়ানন্দ নবদ্বীপে মুসলিম রাজশক্তির যে ধরনের অত্যাচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে রচিত বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের হাসন-হোসেন পালাতেও সেই ধরনের অত্যাচারের বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং ফতেহ্ শাহ যে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করিয়াছিলেন, এবং পরে নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া অত্যাচার বন্ধ করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ নাই। এই অত্যাচারের কারণ বুঝিতেও কষ্ট হয় না। চৈতন্যচরিত-গ্রন্থগুলি পড়িলে জানা যায় যে, গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে বলিয়া পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে বাংলায় ব্যাপক আকারে প্রবাদ রটিয়াছিল। চৈতন্যদেবের জন্মের কিছু পূর্বেই নবদ্বীপ বাংলা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসাবে গড়িয়া উঠে এবং এখানকার ব্রাহ্মণেরা সব দিক দিয়াই সমৃদ্ধি অর্জন করেন; এই সময়ে বাহির হইতেও অনেক ব্রাহ্মণ নবদ্বীপে আসিতে থাকেন। এইসব ব্যাপার দেখিয়া গৌড়েশ্বরের বিচলিত হওয়া এবং এতগুলি ঐশ্বর্যবান ব্রাহ্মণ একত্র সমবেত হইয়া গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হওয়ার প্রবাদ সার্থক করার ষড়যন্ত্র করিতেছে ভাবা খুবই স্বাভাবিক। ইহার কয়েক দশক পূর্বে বাংলা দেশে রাজা গণেশের অভ্যুত্থান হইয়াছিল। দ্বিতীয় কোন হিন্দু অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় পরবর্তী গৌড়েশ্বররা নিশ্চয় সন্ত্রস্ত হইয়া থাকিতেন। সুতরাং এক শ্রেণীর মুসলমানদের উস্কানিতে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সন্দেহের চোখে দেখিয়া তাহাদের উপর অত্যাচার করিয়াছিলেন, ইহাতে অস্বাভাবিক কিছুই নাই।

বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত’ হইতে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালের কোন কোন ঘটনা সম্বন্ধে সংবাদ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে চৈতন্যদেবের জন্মের আগের বৎসর দেশে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; চৈতন্যদেবের জন্মের পরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং দুর্ভিক্ষেরও অবসান হয়; এইজন্যই তাঁহার ‘বিশ্বম্ভর নাম রাখা হইয়াছিল। চৈতন্যভাগবত’ হইতে আরও জানা যায় যে যবন হরিদাসকে যে সময়ে বন্দিশালায় প্রেরণ করা হইয়াছিল, সেই সময়ে বহু ধনী হিন্দু জমিদার কারারুদ্ধ ছিলেন; মুসলিম রাজশক্তির হিন্দু-বিদ্বেষের জন্য ইঁহারা কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন, না খাজনা বাকী পড়া বা অন্য কোন কারণে ইহাদের কয়েদ করা হইয়াছিল, তাহা বুঝিতে পারা যায় না।

বৃন্দাবনদাস জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহকে “মহাতীব্র নরপতি” বলিয়াছেন। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে কেহ অন্যায় করিলে ফতেহ্ শাহ তাহাকে কঠোর শাস্তি দিতেন।

কিন্তু এই কঠোরতাই পরিণামে তাঁহার কাল হইল। ফিরিশতা লিখিয়াছেন যে এই সময়ে হাবশীদের প্রতিপত্তি এতদূর বৃদ্ধি পাইয়াছিল যে তাহারা সব সময়ে সুলতানের আদেশও মানিত না। ফতেহ্ শাহ কঠোর নীতি অনুসরণ করিয়া তাহাদের কতকটা দমন করেন এবং আদেশ-অমান্যকারীদের শাস্তিবিধান করেন। কিন্তু তিনি যাহাদের শাস্তি দিতেন, তাহারা প্রাসাদের প্রধান খোঁজা বারবকের সহিত দল পাকাইত। এই ব্যক্তির হাতে রাজপ্রাসাদের সমস্ত চাবি ছিল।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, প্রতি রাত্রে যে পাঁচ হাজার পাইক সুলতানকে পাহারা দিত, তাহাদের অর্থ দ্বারা হাত করিয়া খোঁজা বারবক এক রাত্রে তাহাদের দ্বারা ফতেহ্ শাহকে হত্যা করাইল। ফতেহ্ শাহর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় মাহমুদ শাহী বংশের রাজত্ব শেষ হইল।

সুলতান শাহজাদা

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে ফতেহ্ শাহকে হত্যা করিবার পরে খোঁজা বারবক “সুলতান শাহজাদা” নাম লইয়া সিংহাসনে আরোহণ করে। ইহা সত্য হওয়াই সম্ভব, কিন্তু এই ঘটনা সম্বন্ধে তথা বারবক বা সুলতান শাহজাদার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচ্য সময়ে অনেক পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থগুলির উক্তি ভিন্ন আর কোন প্রমাণ মিলে নাই।

আধুনিক গবেষকরা মনে করেন বারবক জাতিতে হাবশী ছিল এবং তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা দেশে হাবশী রাজত্ব সুরু হইল। কিন্তু এই ধারণার কোন ভিত্তি নাই, কারণ কোন ইতিহাসগ্রন্থেই বারবককে হাবশী বলা হয় নাই। যে ইতিহাসগ্রন্থটিতে বারবক সম্বন্ধে সর্বপ্রথম বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাইতেছে, সেই তারিখ-ই-ফিরিশতা’র মতে বারবক বাঙালী ছিল।

‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ অনুসারে ফতেহ্ শাহের প্রধান অমাত্য মালিক আন্দিল সুলতান শাহজাদাকে হত্যা করেন।

সুলতান শাহজাদার রাজত্বকাল কোনও মতে আট মাস, কোনও মতে ছয় মাস, কোনও মতে আড়াই মাস।

৮৯২ হিজরার (১৪৮৭-৮৮ খ্র) গোড়ার দিকে জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ ও শেষ দিকে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ্ রাজত্ব করিয়াছিল। ঐ বৎসরেরই মাঝের দিকে কয়েক মাস সুলতান শাহজাদা রাজত্ব করিয়াছিল।

সুলতান শাহজাদা তাঁহার প্রভুকে হত্যা করিয়া সিংহাসন অধিকার করিয়াছিল। আবার তাহাকে বধ করিয়া একজন অমাত্য সিংহাসন অধিকার করিলেন। এই ধারা কয়েক বৎসর ধরিয়া চলিয়াছিল; এই কয়েক বৎসরে বাংলা দেশে অনেকেই প্রভুকে হত্যা করিয়া রাজা হইয়াছিলেন। বাবর তাঁহার আত্মকাহিনীতে বাংলা দেশের এই বিচিত্র ব্যাপারের উল্লেখ করিয়াছেন এবং যেভাবে এদেশে রাজার হত্যাকারী সকলের কাছে রাজা বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিত, তাহাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন।

সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ

পরবর্তী রাজার নাম সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ। ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে মালিক আন্দিলই এই নাম লইয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহই বাংলার প্রথম হাবশী সুলতান। অনেকের ধারণা হাবশী সুলতানরা অত্যন্ত অযোগ্য ও অত্যাচারী ছিলেন এবং তাঁহাদের রাজত্বকালে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাস ও অরাজকতা বিরাজমান ছিল। কিন্তু এই ধারণা সত্য নহে। বাংলার প্রথম হাবশী সুলতান সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ মহৎ, দানশীল এবং নানাগুণে ভূষিত ছিলেন। তিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম। অন্যান্য হাবশী সুলতানদের মধ্যে এক মুজাফফর শাহ ভিন্ন আর কোন হাবশী সুলতানকে কোন ইতিহাসগ্রন্থে অত্যাচারী বলা হয় নাই।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ তাঁহার বীরত্ব, ব্যক্তিত্ব, মহত্ত্ব ও দয়ালুতার জন্য প্রশংসিত হইয়াছেন। ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এর মতে তিনি বহু প্রজাহিতকর কাজ করিয়াছিলেন; তিনি এত বেশি দান করিতেন যে পূর্ববর্তী রাজাদের সঞ্চিত সমস্ত ধনদৌলত তিনি নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়াছিলেন; কথিত আছে একবার তিনি এক দিনেই এক লাখ টাকা দান করিয়াছিলেন; তাঁহার অমাত্যেরা এই মুক্তহস্ত দান পছন্দ করেন নাই; তাঁহারা একদিন ফিরোজ শাহের সামনে একলক্ষ টাকা মাটিতে স্থূপীকৃত করিয়া তাহাকে ঐ অর্থের পরিমাণ বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ফিরোজ শাহের নিকট এক লক্ষ টাকার পরিমাণ খুবই কম বলিয়া মনে হয় এবং তিনি এক লক্ষের পরিবর্তে দুই লক্ষ টাকা দরিদ্রদের দান করিতে বলেন।

‘রিয়াজ-উস্-সলাতীনে লেখা আছে যে, ফিরোজ শাহ গৌড় নগরে একটি মিনার, একটি মসজিদ এবং একটি জলাধার নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে মিনারটি এখনও বর্তমান আছে। ইহা ফিরোজ মিনার’ নামে পরিচিত।

ফিরোজ শাহের মৃত্যু কীভাবে হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। কোন কোন মত অনুসারে তাঁহার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়; কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থের মতে তিনি পাইকদের হাতে নিহত হইয়াছিলেন। ফিরোজ শাহ ১৪৮৭ খ্রী হইতে ১৪৯০ খ্রী–কিঞ্চিদধিক তিন বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ “ফতে শাহের ক্রীতদাস” ও “নপুংসক” ছিলেন। কিন্তু এই মতের সপক্ষে কোন প্রমাণ নাই।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (দ্বিতীয়)

পরবর্তী সুলতানের নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। ইহার পূর্বে এই নামের আর একজন সুলতান ছিলেন, সুতরাং ইহাকে দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ বলা উচিত।

ইহার পিতৃপরিচয় রহস্যাবৃত। ‘ফিরিশ্‌তা’ ও ‘রিয়াজ’-এর মতে ইনি সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহের পুত্র, কিন্তু হাজী মুহম্মদ কন্দাহারী নামে ষোড়শ শতাব্দীর একজন ঐতিহাসিকের মতে ইনি জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের পুত্র। এই সুলতানের শিলালিপিতে ইঁহাকে শুধুমাত্র সুলতানের পুত্র সুলতান বলা হইয়াছে-পিতার নাম করা হয় নাই। ফিরোজ শাহ ও ফতেহ্ শাহ-উভয়েই সুলতান ছিলেন, সুতরাং দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কাহার পুত্র ছিলেন, তাহা সঠিকভাবে বলা অত্যন্ত কঠিন। তবে ইহাকে সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহের পুত্র বলিয়া মনে করার পক্ষেই যুক্তি প্রবলতর।

‘ফিরিশতা’, ‘রিয়াজ’ ও মুহম্মদ কাহারীর মতে দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে হাবৃশ খান নামে একজন হাবশী (কন্দাহারীর মতে ইনি সুলতানের শিক্ষক, ফিরোজ শাহের জীবদ্দশায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন) সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করেন, সুলতান তাঁহার ক্রীড়নকে পরিণত হন। কিছুদিন এইভাবেই চলিবার পরে (কন্দাহারীর মতে হাবৃশ খান তখন নিজে সুলতান হইবার মতলব আঁটিতেছিলেন) সিদি বদ্ নামে আর একজন হাবশী বেপরোয়া হইয়া উঠিয়া হাশ খানকে হত্যা করে এবং নিজেই শাসনব্যবস্থার কর্ত্তা হইয়া বসে। কিছুদিন পরে এক রাত্রে সিদি বদ পাইকদের সর্দারের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে হত্যা করে এবং পরের দিন প্রভাতে সে অমাত্যদের সম্মতিক্রমে (শামসুদ্দীন) মুজাফফর শাহ নাম লইয়া সিংহাসনে বসে।

মুজাফফর শাহ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের হত্যা এবং তাঁহার সিংহাসন অধিকারের কথা সম্পূর্ণ সত্য, কারণ বাবর তাঁহার আত্মকাহিনীতে ইহার উল্লেখ করিয়াছেন।

শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ

শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ সম্বন্ধে কোন প্রামাণিক বিবরণ পাওয়া যায় না। পরবর্তী কালে রচিত কয়েকটি ইতিহাসগ্রন্থের মতে মুজাফফর শাহ অত্যাচারী ও নিষ্ঠুরপ্রকৃতির লোক ছিলেন; রাজা হইয়া তিনি বহু দরবেশ, আলিম ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করেন। অবশেষে তাঁহার অত্যাচার যখন চরমে পৌঁছিল, তখন সকলে তাঁহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইল; তাঁহার মন্ত্রী সৈয়দ হোসেন বিরুদ্ধবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন এবং মুজাফফর শাহকে বধ করিয়া নিজে রাজা হইলেন।

মুজাফফর শাহের নৃশংসতা, অত্যাচার ও কুশাসন সম্বন্ধে পূর্ব্বোল্লিখিত গ্রন্থগুলিতে যাহা লেখা আছে, তাহা কতদূর সত্য বলা যায় না; সম্ভবত খানিকটা অতিরঞ্জন আছে।

কীভাবে মুজাফফর শাহ নিহত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুইটি মত প্রচলিত আছে। একটি মত এই যে, মুজাফফর শাহের সহিত তাঁহার বিরোধীদের মধ্যে কয়েক মাস ধরিয়া যুদ্ধ চলিবার পর এবং লক্ষাধিক লোক এই যুদ্ধে নিহত হইবার পর মুজাফফর শাহ পরাজিত ও নিহত হন। দ্বিতীয় মত এই যে, সৈয়দ হোসেন পাইকদের সর্দারকে ঘুষ দিয়া হাত করেন এবং কয়েকজন লোক সঙ্গে লইয়া মুজাফফর শাহের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন। সম্ভবত শেষোক্ত মতই সত্য, কারণ বাবরের আত্মকাহিনীতে ইহার প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়।

মুজাফফর শাহের রাজত্বকালে পাণ্ডুয়ায় নূর কুত্ত্ব আলমের সমাধি-ভবনটি পুনর্নির্মিত হয়। এই সমাধি-ভবনের শিলালিপিতে মুজাফফর শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আছে। মুজাফফর শাহ গঙ্গারামপুরে মৌলনা আতার দরগায়ও একটি মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। সুতরাং মুজাফফর শাহ যে দরবেশ ও ধার্মিক লোকদের হত্যা করিতেন–পূর্ব্বোল্লিখিত ইতিহাসগ্রন্থগুলির এই উক্তিতে আস্থা স্থাপন করা যায় না।

মুজাফফর শাহ ৮৯৬ হইতে ৮৯৮ হিজরা পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা দেশে হাবশী রাজত্বের অবসান হইল। পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া হাবশীদের বাংলা হইতে বিতাড়িত করেন। রুকনুদ্দীন বারবক শাহের রাজত্বকালে যাহারা এদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রথম অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ পায়, কয়েক বৎসরের মধ্যেই তাহাদের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ ও তাঁহার ঠিক পরেই সদলবলে বিদায় গ্রহণ–দুইই নাটকীয় ব্যাপার। এই হাবশীদের মধ্যে সকলেই যে খারাপ লোক ছিল না, সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহই তাঁহার প্রমাণ। হাবশীদের চেয়েও অনেক বেশি দুবৃত্ত ছিল পাইকেরা। ইহারা এদেশেরই লোক। ১৪৮৭ হইতে ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন সুলতানের আততায়ীরা এই পাইকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়াই রাজাদের বধ করিয়াছিল। জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের হত্যাকারী বারবক স্বয়ং পাইকদের সর্দার ও বাঙালী ছিল বলিয়া তারিখ-ই-ফিরিশতায় লিখিত হইয়াছে।

বাংলায় হাবশীদের মধ্যে যাঁহারা প্রাধান্যলাভ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে মালিক আন্দিল (ফিরোজ শাহ), সিদি ব (মুজাফফর শাহ), হাবশ খান, কাফুর প্রভৃতির নাম বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ ও শিলালিপি হইতে জানা যায়। রজনীকান্ত চক্রবর্তী তাঁহার ‘গৌড়ের ইতিহাসে’ আরও কয়েকজন “প্রধান হাবশী”র নাম করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাদের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

০৬. হোসেন শাহী বংশ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – হোসেন শাহী বংশ

আলাউদ্দীন হোসেন শাহ

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দীন হোসেন শাহের নামই সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত। ইহার অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমত, আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজ্যের আয়তন অন্যান্য সুলতানদের রাজ্যের তুলনায় বৃহত্তর ছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলার অন্যান্য সুলতানদের তুলনায় হোসেন শাহের অনেক বেশি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন (অর্থাৎ গ্রন্থাদিতে উল্লেখ, শিলালিপি প্রভৃতি) মিলিয়াছে। তৃতীয়ত, হোসেন শাহ ছিলেন চৈতন্যদেবের সমসাময়িক এবং এইজন্য চৈতন্যদেবের নানা প্রসঙ্গের সহিত হোসেন শাহের নাম যুক্ত হইয়া বাঙালীর স্মৃতিতে স্থান লাভ করিয়াছে।

কিন্তু এই বিখ্যাত নরপতি সম্বন্ধে প্রামাণিক তথ্য এ পর্যন্ত খুব বেশি জানতে পারা যায় নাই। তাঁহার ফলে অধিকাংশ লোকের মনেই হোসেন শাহ সম্বন্ধে যে ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে সত্য অপেক্ষা কল্পনার পরিমাণই অধিক। সুতরাং হোসেন শাহর ইতিহাস যথাসম্ভব সঠিকভাবে উদ্ধারের জন্য একটু বিস্তৃত আলোচনা আবশ্যক।

মুদ্রা, শিলালিপি এবং অন্যান্য প্রামাণিক সূত্র হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পিতার নাম সৈয়দ আশরফ অল-হোসেনী। ‘রিয়াজ’-এর মতে হোসেন শাহের পিতা তাঁহাকে ও তাঁহার ছোট ভাই য়ুসুফকে সঙ্গে লইয়া তুর্কিস্থানের তারমুজ শহর হইতে বাংলায় আসিয়াছিলেন এবং রাঢ়ের চাঁদপুর (বা চাঁদপাড়া) মৌজায় বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন; সেখানকার কাজী তাঁহাদের দুই ভাইকে শিক্ষা দেন এবং তাঁহাদের উচ্চ বংশমর্যাদার কথা জানিয়া হোসেনের সহিত নিজের কন্যার বিবাহ দেন। স্টুয়ার্টের মতে হোসেন আরবের মরুভূমি হইতে বাংলায় আসিয়াছিলেন। একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে হোসেন বাল্যকালে চাঁদপাড়ায় এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতে রাখালের কাজ করিতেন; বাংলার সুলতান হইয়া তিনি ঐ ব্রাহ্মণকে মাত্র এক আনা খাজনায় চাঁদপাড়া গ্রামখানি জায়গীর দেন; তাঁহার ফলে গ্রামটি আজও পর্যন্ত একানী চাঁদপাড়া নামে পরিচিত; হোসেন কিন্তু কিছুদিন পর তাঁহার বেগমের নিবন্ধে ঐ ব্রাহ্মণকে গোমাংস খাওয়াইয়া তাঁহার জাতি নষ্ট করিয়াছিলেন। এই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে কতখানি সত্য আছে, তাহা বলা যায় না। তবে চাঁদপুর বা চাঁদপাড়া গ্রামের সহিত হোসেন শাহের সম্পর্কের কথা সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ এই অঞ্চলে তাঁহার বহু শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁহার ‘‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ (মধ্যলীলা, ২৫শ পরিচ্ছেদ) লিখিয়াছেন যে, রাজা হইবার পূর্বে সৈয়দ হোসেন “গৌড়-অধিকারী” (বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে চাকুরী করিতেন; সুবুদ্ধি রায় তাঁহাকে এক দীঘি কাটানোর কাজে নিয়োগ করেন এবং তাঁহার কার্যে ত্রুটি হওয়ায় তাঁহাকে চাবুক মারেন; পরে সৈয়দ হোসেন সুলতান হইয়া সুবুদ্ধি রায়ের পদমর্যাদা অনেক বাড়াইয়া দেন; কিন্তু তাঁহার বেগম একদিন তাঁহার দেহে চাবুকের দাগ আবিষ্কার করিয়া সুবুদ্ধি রায়ের চাবুক মারার কথা জানিতে পারেন এবং সুবুদ্ধি রায়ের প্রাণবধ করিতে সুলতানকে অনুরোধ জানান। সুলতান তাহাতে সম্মত না হওয়ায় বেগম সুবুদ্ধি রায়ের জাতি নষ্ট করিতে বলেন। হোসেন শাহ তাহাতেও প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু স্ত্রীর নির্বন্ধাতিশয্যে অবশেষে সুবুদ্ধি রায়ের মুখে করোয়ার (বদনার) জল দেওয়ান এবং তাঁহার ফলে সুবুদ্ধি রায়ের জাতি যায়।

এই বিবরণ সত্য বলিয়াই মনে হয়, কারণ কৃষ্ণদাস কবিরাজ দীর্ঘকাল বৃন্দাবনে হোসেন শাহের অমাত্য এবং সুবুদ্ধি রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপ-সনাতনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করিয়াছিলেন। সুবুদ্ধি রায়ও স্বয়ং শেষজীবনে বহুদিন বৃন্দাবনে বাস করিয়াছিলেন, সুতরাং কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁহারও সহিত পরিচিত ছিলেন বলিয়া মনে হয়। অতএব কৃষ্ণদাস যে পূর্ব্বোক্ত কাহিনী কোন প্রামাণিক সূত্র হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।

পর্তুগীজ ঐতিহাসিক জোআঁ-দে-বায়োস তাঁহার ‘দা এসিয়া’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে আগমনের একশত বৎসর পূর্বে একজন আরব বণিক দুইশত জন অনুচর লইয়া বাংলায় আসিয়াছিলেন; নানা রকম কৌশল করিয়া তিনি ক্রমশ বাঙলার সুলতানের বিশ্বাসভাজন হন ও শেষপর্যন্ত তাঁহাকে বধ করিয়া গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। কেহ কেহ মনে করেন যে, এই কাহিনী হোসেন শাহ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। কিন্তু জোআঁ-দে-বারোস ঐ আরব বণিকের যে সময় নির্দেশ করিয়াছেন, তাহা হোসেন শাহের সময়ের একশত বৎসর পূর্ববর্তী।

যাহা হউক, হোসেন শাহের পূর্ব-ইতিহাস অনেকখানি রহস্যাবৃত। কয়েকটি বিবরণে খুব জোর দিয়া বলা হইয়াছে যে তিনি বিদেশ (আরব বা তুর্কিস্তান) হইতে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। কোন কোন মতে হোসেন শাহ বিদেশাগত নহেন, তিনি বাংলা দেশেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ফ্রান্সিস বুকাননের মতে হোসেন রংপুরের বোদা বিভাগের দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। হোসেন শাহের মাতা যে হিন্দু ছিলেন, এইরূপ কিংবদন্তীও প্রচলিত আছে। বাবর তাঁহার আত্মজীবনীতে হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহকে “নরসৎ শাহ বঙ্গালী’ বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত এবং কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতে ইঙ্গিত করা হইয়াছে যে, হোসেন শাহের দেহ কৃষ্ণবর্ণ ছিল। এই সমস্ত বিষয় হইতে মনে হয়, হোসেন শাহ বিদেশী ছিলেন না, তিনি বাঙালীই ছিলেন; যে সমস্ত সৈয়দ-বংশ বাংলা দেশে বহু পুরুষ ধরিয়া বাস করিয়া আসিতেছিল, সেইরূপ একটি বংশেই তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।

সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পূর্বে হোসেন শাহ হাবশী সুলতান মুজাফফর শাহের উজীর ছিলেন বিভিন্ন ইতিহাসপ্রন্থে ও বাবরের আত্মজীবনীতে এ কথা উল্লিখিত হইয়াছে, ইহার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। ইতিহাসগ্রন্থগুলির মতে মুজাফফর শাহের উজীর থাকিবার সময় হোসেন একদিকে তাঁহাকে বৈধ অবৈধ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিতেন ও অপর দিকে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রচার করিতেন; ইহা খুবই নিন্দনীয়। যে ভাবে হোসেন প্রভুকে বধ করিয়া রাজা হইয়াছিলেন, তাঁহারও প্রশংসা করা যায় না। তবে মুজাফফর শাহও তাঁহার প্রভুকে হত্যা করিয়া রাজা হইয়াছিলেন। সেই জন্য তাঁহার প্রতি হোসেনের এই আচরণকে “শঠে শাঠ্যং সমাচরয়েৎ” নীতির অনুসরণ বলিয়া ক্ষমা করা যায়।

মুদ্রা ও শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর হইতে ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যে কোন এক সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় যে তাঁহার যথেষ্ট বয়স হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ আছে।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে মুজাফফর শাহের মৃত্যুর পরে প্রধান অমাত্যেরা একত্র সমবেত হইয়া হোসেনকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করেন। তবে, ‘ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ’-এর মতে হোসেন শাহ অমাত্যদিগকে লোভ দেখাইয়া রাজপদ লাভ করিয়াছিলেন। হোসেন অমাত্যদিগকে বলিয়াছিলেন যে তাঁহারা যদি তাহাকে রাজপদে নির্বাচন করেন, তবে তিনি গৌড় নগরের মাটির উপরের সমস্ত ধন সম্পত্তি তাহাদিগকে দিবেন এবং মাটির নীচে লুকানো সব সম্পদ তিনি নিজে লইবেন। অমাত্যেরা এই সর্তে সম্মত হইয়া তাহাকে রাজা করেন এবং গৌড়ের মাটির উপরের সম্পত্তি লুঠ করিয়া লইতে থাকেন; কয়েক দিন পরে হোসেন শাহ তাঁহাদিগকে লুঠ বন্ধ করিতে বলেন; তাঁহারা তাহাতে রাজী না হওয়ায় হোসেন বারো হাজার লুণ্ঠনকারীকে বধ করেন; তখন অন্যেরা লুঠ বন্ধ করে; হোসেন নিজে কিন্তু গৌড়ের মাটির নীচের সম্পত্তি লুঠ করিয়া হস্তগত করেন; তখন ধনী ব্যক্তিরা সোনার থালাতে খাইতেন; হোসেন এইরূপ তেরশত সোনার থালা সমেত বহু গুপ্তধন লাভ করিলেন।

এই বিবরণ সত্য হইলে বলিতে হইবে হোসেন শাহ সিংসাহনে আরোহণের সময় নানা ধরনের ক্রুর কুটনীতি ও হীন চাতুরীর আশ্রয় লইয়াছিলেন।

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে হোসেন রাজা হইয়া অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যে পরিপূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা সত্য, কারণ সমসাময়িক সাহিত্য হইতে ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। ইতিহাসগ্রন্থগুলির মতে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সুলতানের হত্যাকাণ্ডে যাহারা প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিল, সেই পাইকদের দলকে হোসেন শাহ ভাঙিয়া দেন এবং প্রাসাদ রক্ষার জন্য অন্য রক্ষিদল নিযুক্ত করেন; হাবশীদের তিনি তাঁহার রাজ্য হইতে একেবারে বিতাড়িত করেন; তাহারা গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতে চলিয়া গেল; হোসেন সৈয়দ, মোগল ও আফগানদের উচ্চপদে নিয়োগ করিলেন।

হোসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের প্রায় দুই বৎসর পরে (১৪৯৫ খ্রী) জৌনপুরের রাজ্যচ্যুত সুলতান হোসেন শাহ শর্কী দিল্লির সুলতান সিকন্দর শাহ লোদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং পরাজিত হইয়া বাংলায় পলাইয়া আসেন। বাংলার সুলতান হোসেন শাহ তাঁহাকে আশ্রয় দেন। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া সিকন্দর লোদী বাংলার সুলতানের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। হোসেন শাহও তাঁহার পুত্র দানিয়েলের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। উভয় বাহিনী বিহারের বাঢ় নামক স্থানে পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন রহিল, কিন্তু যুদ্ধ হইল না। অবশেষে দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল। এই সন্ধি অনুসারে দুই পক্ষের অধিকার পূর্ববৎ রহিল এবং হোসেন শাহ সিকন্দর লোদীকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে সিকন্দরের শত্রুদের তিনি ভবিষ্যতে নিজ রাজ্যে আশ্রয় দিবেন না। সিকন্দরও হোসেনকে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইহার পর সিকন্দর লোদী দিল্লিতে ফিরিয়া গেলেন। দিল্লির পরাক্রান্ত সুলতানের সহিত সংঘর্ষের এই সম্মানজনক পরিণাম হোসেন শাহের পক্ষে বিশেষ গৌরবের বিষয়, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

হোসেন শাহ তাঁহার রাজত্বের প্রথম বৎসর হইতেই মুদ্রায় নিজেকে “কামরূপ-কামতা-জাজনগর-উড়িষ্যা-বিজয়ী” বলিয়া অভিহিত করিতে এবং এই রাজ্যগুলি বিজয়ের সক্রিয় চেষ্টা করিতে থাকেন। কয়েক বৎসরের চেষ্টায় তিনি কামতাপুর ও কামরূপ রাজ্য সম্পূর্ণভাবে জয় করিলেন। ঐ অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে হোসেন শাহ বিশ্বাসঘাতকতার সাহায্যে কামতাপুর (কোচবিহার) ও কামরূপ (আসামের পশ্চিম অংশ) জয় করিয়াছিলেন; কামতাপুর ও কামরূপের রাজা খেন-বংশীয় নীলাম্বর তাঁহার মন্ত্রীর পুত্রকে বধ করিয়াছিলেন সে তাঁহার রাণীর প্রতি অবৈধ আসক্তি প্রকাশ করিয়াছিল বলিয়া, তাহাকে বধ করিয়া তিনি তাঁহার পিতাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার মাংস খাওয়াইয়াছিলেন; তখন তাঁহার পিতা প্রতিশোধ লইবার জন্য গঙ্গাস্নান করিবার অছিলা করিয়া গৌড়ে চলিয়া আসেন এবং হোসেন শাহকে কামতাপুর আক্রমণের জন্য উত্তেজিত করেন। হোসেন শাহ তখন কামতাপুর আক্রমণ করেন, কিন্তু নীলাম্বর তাঁহার আক্রমণ প্রতিহত করেন। অবশেষে হোসেন শাহ মিথ্যা করিয়া নীলাম্বরকে বলিয়া পাঠান যে তিনি চলিয়া যাইতে চাহেন, কিন্তু তাঁহার পূর্বে তাঁহার বেগম একবার নীলাম্বরের রাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন; নীলাম্বর তাহাতে সম্মত হইলে হোসেন শাহের শিবির হইতে তাঁহার রাজধানীর ভিতরে পালকী যায়, তাহাতে নারীর ছদ্মবেশে সৈন্য ছিল; তাহারা কামতাপুর নগর অধিকার করে; ১৪৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।

এই প্রবাদের খুঁটিনাটি বিবরণগুলি এবং ইহাতে উল্লিখিত তারিখ সত্য বলিয়া মনে হয় না। তবে হোসেন শাহের কামতাপুর-কামরূপ বিজয় যে ঐতিহাসিক ঘটনা, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, কারণ ‘রিয়াজ, বুকাননের বিবরণী এবং কামতাপুর অঞ্চলের কিংবদন্তী-সমস্ত সূত্রই এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে একমত। ‘আসাম বুরঞ্জী’র মতে কোচ রাজা বিশ্বসিংহ হোসেন শাহের অধীনস্থ আটগাঁওয়ের মুসলমান শাসনকর্ত্তা “তুরকা কোতয়াল”কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া কামতাপুর-কামরূপ রাজ্য পুনরধিকার করেন। কথিত আছে যে ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের পরে কামতাপুর রাজ্য হইতে মুসলমানরা বিতাড়িত হইয়াছিল। এই সব কথা কতদূর সত্য, তাহা বলা যায় না।

ঐ সময়ে কামরূপের পূর্ব ও দক্ষিণে আসাম ও অহোম রাজ্য অবস্থিত ছিল। রাজ্যটি দুর্গম পার্ব্বত্য অঞ্চলে পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য এবং এখানে বর্ষার প্রকোপ খুব বেশি হওয়ার জন্য বাহিরের কোন শক্তির পক্ষে এই রাজ্য জয় করা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শিহাবুদ্দীন তালিশ নামে মোগল সরকারের জনৈক কর্মচারী তিহার তারিখ-ফতে-ই-আশাম’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, হোসেন শাহ ২৪,০০০ পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া আসাম আক্রমণ করেন, তখন আসামের রাজা পার্ব্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হোসেন শাহ আসামের সমতল অঞ্চল অধিকার করিয়া সেখানে তাঁহার জনৈক পুত্রকে (কিংবদন্তী অনুসারে ইহার নাম “দুলাল গাজী”) এক বিশাল সৈন্যাবহিনী সহ রাখিয়া নিজে গৌড়ে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু যখন বর্ষা নামিল, তখন চারিদিক জলে ভরিয়া গেল। সেই সময়ে আসামের রাজা পার্ব্বত্য অঞ্চল হইতে নামিয়া হোসেনের পুত্রকে বধ করিলেন ও তাঁহার সৈন্য ধ্বংস করিলেন। মীর্জা মুহম্মদ কাজিমের ‘আলমগীরনামা’ এবং গোলাম হোসেনের ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এ শিহাবুদ্দীন তালিশের এই বিবরণের পরিপূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু অসমীয়া বুরঞ্জীগুলির মতে বাংলার রাজা “খুনফৎ” বা “খুফৎ” (হুসন) “বড় উজীর” ও “বিৎ মালিক” (বা “মি মানিক”) নামে দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে আসাম জয়ের জন্য ২০,০০০ পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য এবং অসংখ্য রণতরী প্রেরণ করিয়াছিলেন; এই বাহিনী প্রায় বিনা বাধায় অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়; তাঁহার পর আসামরাজ সুহুঙ্গ মুঙ্গ তাহাদের প্রচণ্ড বাধা দেন; দুই পক্ষের মধ্যে নৌযুদ্ধ হয় এবং তাহাতে মুসলমানরা প্রথম দিকে জয়লাভ করিলেও শেষ পর্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়; “বড় উজীর” পলাইয়া প্রাণ বাঁচান; কিছুদিন পরে তিনি আবার “বিৎ মালিক” সমভিব্যাহারে আসাম আক্রমণ করেন; ইতিমধ্যে আসামরাজ কয়েকটি নদীর মোহনায় ঘাঁটি বসাইয়া তাঁহার প্রধান সেনাপতিদের মোতায়েন করিয়া রাখিয়াছিলেন; বাংলার সৈন্যবাহিনী জলপথ ও স্থলপথে সিংরী পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া সেখানকার ঘাঁটি আক্রমণ করে ও এখানে বহুক্ষণব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে অসমীয়া সেনাপতি বরপুত্র গোহাইন বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করেন। “বিৎ মালিক এবং বাংলার বহু সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হইয়াছিল, অনেকে বন্দী হইয়াছিল; “বড় উজীর” এবারও স্বল্পসংখ্যক অনুচর লইয়া পলাইয়া গিয়া প্রাণ বাঁচাইলেন; তাঁহাদিগকে অসমীয়া বাহিনী অনেক দূর পর্যন্ত তাড়া করিয়া লইয়া গেল।

মুসলমান লেখকদের লেখা বিবরণে এবং অসমীয়া বুরঞ্জীর বিবরণে কিছু পার্থক্য থাকিলেও এবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে হোসেন শাহের আসামজয়ের প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছিল।

আসামের “হোসেন শাহী পরগণা” নামে পরিচিত একটি অঞ্চল এখনও হোসেন শাহের স্মৃতি বহন করিতেছে।

উড়িষ্যার সহিতও হোসেন শাহের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হইয়াছিল। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, হোসেন শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসরেই উড়িষ্যার সহিত তাঁহার সংঘর্ষ বাধে। ঐ সময়ে পুরুষোত্তমদেব উড়িষ্যার রাজা ছিলেন। ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয় এবং তাঁহার পুত্র প্রতাপরুদ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রতাপরুদ্রের দীক্ষাগুরু জীবদেবাচার্যের লেখা ‘ভক্তিভাগবত’ মহাকাব্য হইতে জানা যায় যে, সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতাপরুদ্রকে বাংলার সুলতানের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইতে হইয়াছিল।

হোসেন শাহের মুদ্রা ও শিলালিপি, ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীন’ এবং ত্রিপুরার ‘রাজমালা’র সাক্ষ্য অনুসারে হোসেন শাহ উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন।

পক্ষান্তরে, উড়িষ্যার বিভিন্ন সূত্রের মতে উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রই হোসেন শাহকে পরাজিত করিয়াছিলেন। জীবদেবাচার্য ‘ভক্তিভাগবত’-এ লিখিয়াছেন যে পিতার মৃত্যুর ছয় সপ্তাহের মধ্যেই প্রতাপরুদ্র বাংলার সুলতানকে পরাজিত করিয়া গঙ্গা (ভাগীরথী) নদীর তীর পর্যন্ত অঞ্চল অধিকার করিয়াছিলেন। প্রতাপরুদ্রের তাম্রশাসন ও শিলালিপিতে বলা হইয়াছে যে প্রতাপরুদ্রের নিকট পরাজিত হইয়া গৌড়েশ্বর কাঁদিয়াছিলেন এবং ভয়াকুল চিত্তে স্বস্থানে প্রস্থান করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। প্রতাপরুদ্রের রচনা বলিয়া ঘোষিত সরস্বতীবিলাস’ গ্রন্থে (১৫১৫ খ্রষ্টাব্দ বা তাঁহার পূর্বে রচিত) প্রতাপরুদ্রকে “শরণাগত জবুনা-পুরাধীনশ্বর হুশনশাহ-সুরত্রাণ-শরণরক্ষণ” বলা হইয়াছে, অর্থাৎ প্রতাপরুদ্র শুধু হোসেন শাহের বিজেতা নহেন, তাঁহার রক্ষাকর্ত্তাও! উড়িয়া ভাষার লেখা জগন্নাথ মন্দিরের মাদলা পাঞ্জী’ ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা কটকরাজবংশাবলী’ গ্রন্থের মতে বাংলার সুলতান উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া উড়িষ্যার রাজধানী কটক এবং পুরী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল জয় করিয়া লন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রায় সমস্ত দেবমূর্ত্তি তিনি নষ্ট করেন, জগন্নাথের মূর্ত্তিকে দোলায় চড়াইয়া চিল্কা হ্রদের মধ্যস্থিত চড়াইগুহা পর্বতে লইয়া গিয়া রাখা হইয়াছিল বলিয়া উহা ধ্বংস হইতে রক্ষা পায়। এই সময়ে প্রতাপরুদ্র। দক্ষিণদিকে অভিযানে গিয়াছিলেন, এবং সংবাদ পাইয়া তিনি দ্রুতগতিতে চলিয়া আসেন এবং বাংলার সুলতানকে তাড়া করিয়া গঙ্গার তীর পর্যন্ত লইয়া যান। মাদলা পাঞ্জী’র মতে ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল। এই সূত্রের মতে চউমূৰ্হিতে প্রতাপরুদ্র ও হোসেন শাহের মধ্যে বিরাট যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে পরাজিত হইয়া হোসেন শাহ মান্দারণ দুর্গে আশ্রয় লন। প্রতাপরুদ্র তখন মান্দারণ দুর্গ অবরোধ করেন। প্রতাপরুদ্রের অন্যতম সেনাপতি গোবিন্দ ভোই বিদ্যাধর ইতিপূর্বে হোসেন শাহের কটক আক্রমণের সময়ে কটক রক্ষা করিতে ব্যর্থ। হইয়াছিল, সে এখন হোসেন শাহের সহিত যোগ দিল; হোসেন শাহ ও গোবিন্দ বিদ্যাধর প্রতাপরুদ্রের সহিত প্রচণ্ড যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে মান্দারণ হইতে বিতাড়িত করিলেন। মান্দারণ হইতে অনেকখানি পশ্চাদপসরণ করিয়া প্রতাপরুদ্র গোবিন্দ বিদ্যাধরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং তাহাকে অনেক বুঝাইয়া সুজাইয়া আবার স্বদেশে আনয়ন করিলেন; ইহার পর তিনি গোবিন্দকে পাত্রের পদে অধিষ্ঠিত করিয়া তাহাকেই রাজ্য শাসনের ভার দিলেন; হোসেন শাহ আর উড়িষ্যা জয় করিতে পারিলেন না। এই বিবরণের সমস্ত কথা সত্য না হইলেও অনেকখানিই যে সত্য, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

যাহা হউক, দেখা যাইতেছে যে হোসেন শাহ ও উড়িষ্যারাজের সংঘর্ষে উভয়পক্ষই জয়ের দাবি করিয়াছেন।

বাংলার চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলি–বিশেষভাবে ‘চৈতন্যভাগবত’, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ ও ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক’ হইতে এ সম্বন্ধে অনেকটা নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়। এগুলি হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া সেখানকার বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ভাঙিয়াছিলেন ও দীর্ঘকাল ধরিয়া তাঁহার সহিত উড়িষ্যার রাজার যুদ্ধ চলিয়াছিল। চৈতন্যদেব যখন দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের শেষে নীলাচলে প্রত্যাবর্তন করেন (১৫১২ খ্রীষ্টাব্দ), তখন বাংলা ও উড়িষ্যার যুদ্ধ বন্ধ ছিল। বাংলা হইতে চৈতন্যদেবের নীলাচলে প্রত্যাবর্তনের (জুন ১৫১৫ খ্রী) অব্যবহিত পরে হোসেন শাহ আবার উড়িষ্যা অভিযান করেন।

জয়ানন্দ তাঁহার ‘চৈতন্যমঙ্গলে লিখিয়াছেন যে উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্র একবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিবার সঙ্কল্প করিয়া সে সম্বন্ধে চৈতন্যদেবের আজ্ঞা প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু চৈতন্যদেব তাঁহাকে এই প্রচেষ্টা হইতে বিরত হইতে বলেন; তিনি প্রতাপরুদ্রকে বলেন যে, “কালবন রাজা পঞ্চগৌড়েশ্বর” মহাশক্তিমান; তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিলে সে উড়িষ্যা উৎসন্ন করিবে এবং জগন্নাথকে নীলাচল ত্যাগ করিতে বাধ্য করিবে। চৈতন্যদেবের কথা শুনিয়া প্রতাপরুদ্র বাংলা আক্রমণ হইতে নিরস্ত হন। এই উক্তি কতদূর সত্য বলা যায় না।

এতক্ষণ যে আলোচনা করা হইল, তাহা হইতে পরিষ্কার বুঝিতে পারা যায় যে, ১৪৯৩-৯৪ খ্রীষ্টাব্দে হোসেন শাহের সহিত উড়িষ্যার রাজার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধ বন্ধ ছিল। কিন্তু ১৫১৫ খ্রষ্টাব্দে হোসেন শাহ আবার উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং স্বয়ং এই অভিযানে নেতৃত্ব করেন। কিন্তু এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কোন পক্ষই বিশেষ কোন স্থায়ী ফল লাভ করিতে পারেন নাই।

হোসেন শাহ এবং ত্রিপুরার রাজার মধ্যেও অনেক দিন ধরিয়া যুদ্ধবিগ্রহ চলিয়াছিল। ইহা ‘রাজমালা’ (ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস) নামক বাংলা গ্রন্থে কবিতার আকারে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রাজমালা’র দ্বিতীয় খণ্ডে (রচনাকাল ১৫৭৭ ৮৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) হোসেন শাহ ও ত্রিপুরারাজের সংঘর্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ বিবরণের সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।

হোসেন শাহের সহিত ত্রিপুরারাজের বহু সংঘর্ষ হয়। ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য বাংলার সুলতানের অধীন অনেক অঞ্চল জয় করেন। ১৪৩৫ শতকে ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন ও এতদুপলক্ষে স্বর্ণমুদ্রা প্রকাশ করেন। হোসেন শাহ তাঁহার বিরুদ্ধে গৌরাই মল্লিক নামক একজন সেনাপতির অধীনে এক বিপুল বাহিনী পাঠান। গৌরাই মল্লিক ত্রিপুরার অনেক অঞ্চল জয় করেন, কিন্তু চণ্ডীগড় দুর্গ জয় করিতে অসমর্থ হন। ইহার পর তিনি চণ্ডীগড়ের পাশ কাটাইয়া গিয়া গোমতী নদীর উপরদিক দখল করেন, বাঁধ দিয়া গোমতীর জল অবরুদ্ধ করেন এবং তিন দিন পরে বাঁধ খুলিয়া জল ছাড়িয়া দেন; ঐ জল দেশ ভাসাইয়া দিয়া ত্রিপুরার বিপর্যয় সাধন করিল। তখন ত্রিপুরারাজ অভিচার অনুষ্ঠান করিলেন; এই অনুষ্ঠানে বলিপ্রদত্ত চণ্ডালের মাথা বাংলার সৈন্যবাহিনীর ঘাঁটিতে অলক্ষিতে পুঁতিয়া রাখিয়া আসা হইল। তাঁহার ফলে সেই রাত্রেই বাংলার সৈন্যরা ভয়ে পলাইয়া গেল।

১৪৩৬ শকে ধন্যমাণিক্যের রাইকছাগ ও রাইকছম নামে দুইজন সেনাপতি আবার চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তখন হোসেন শাহ হৈতন খাঁ নামে একজন সেনাপতির অধীনে আর একটি বাহিনী পাঠান। হৈতন খাঁ সাফল্যের সহিত অগ্রসর হইয়া ত্রিপুরারাজ্যের দুর্গের পর দুর্গ জয় করিতে থাকেন এবং গোমতী নদীর তীরে গিয়া উপস্থিত হন। ইহাতে বিচলিত হইয়া ধন্যমাণিক্য ডাকিনীদের সাহায্য চান। তখন ডাকিনীরা গোমতী নদীর জল শোষণ করিয়া সাত দিন নদীর খাত শুষ্ক রাখিয়া অতঃপর জল ছাড়িয়া দিল। সেই জলে ত্রিপুরার লোকেরা বহু ভেলা ভাসাইল, প্রতি ভেলায় তিনটি করিয়া পুতুল ও প্রতি পুতুলের হাতে দুইটি করিয়া মশাল ছিল। অর্গলমুক্ত জলধারায় বাংলার সৈন্যদের হাতি ঘোড়া উট ভাসিয়া গেল, ইহা ভিন্ন তাহারা দূর হইতে জ্বলন্ত মশাল দেখিয়া ভয়ে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল; তারপর ত্রিপুরার লোকেরা তাঁহার নিকটবর্তী একটি বনে আগুন লাগাইয়া দিল। বাংলার সৈন্যেরা তখন পলাইয়া গেল, তাহাদের অনেকে ত্রিপুরার সৈন্যদের হাতে মারা পড়িল। ত্রিপুরার সৈন্যরা বাংলার বাহিনীর অধিকৃত চারিটি ঘাঁটি পুনরধিকার করিল। বাংলার বাহিনী ছয়কড়িয়া ঘাঁটিতে অবস্থান করিতে লাগিল।

এখন প্রশ্ন এই, ‘রাজমালা’র এই বিবরণ কতদূর বিশ্বাসযোগ্য। ধন্যমাণিক্য অভিচারের দ্বারা গৌরাই মল্লিককে এবং ডাকিনীদের সাহায্যে হৈতন খাকে বিতাড়িত করিয়াছিলেন বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। এইসব অলৌকিক কাণ্ড বাদ দিলে ‘রাজামালা’র বিবরণের অবশিষ্টাংশ সত্য বলিয়াই মনে হয়। সুতরাং এই বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া আমরা এই সিদ্ধান্ত করিতে পারি যে হোসেন শাহ ধন্যমাণিক্যের সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে ধন্যমাণিক্যই জয়যুক্ত হন এবং তিনি খণ্ডল পর্যন্ত হোসেন শাহের রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করিয়া লন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত জয় করেন, কিন্তু প্রতিপক্ষের আক্রমণে তাঁহাকে পূর্বাধিকৃত সমস্ত অঞ্চল হারাইতে হয় এবং গৌড়েশ্বরের সেনাপতি গৌরাই মল্লিক গোমতী নদীর তীরবর্তী চণ্ডীগড় দুর্গ পর্যন্ত অধিকার করেন; গৌরাই মল্লিক গোমতী নদীর জল প্রথমে রুদ্ধ ও পরে মুক্ত করিয়া ত্রিপুরারাজের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটাইয়াছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে ধন্যমাণিক্য আবার পূর্বাধিকৃত অঞ্চলগুলি অধিকার করেন, কিন্তু হোসেন শাহের সেনাপতি হৈতন খাঁ প্রতি-আক্রমণ করিয়া তাহাকে বিতাড়িত করেন এবং তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া গোমতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত অধিকার করেন। এইবার ত্রিপুরা-রাজ গোমতী নদীর জল প্রথমে রুদ্ধ ও পরে মুক্ত করিয়া তাহাকে বিপদে ফেলেন। তাঁহার ফলে হৈতন খাঁ পিছু হটিয়া ছয়কড়িয়ায় চলিয়া আসেন। ত্রিপুরারাজ ছয়কড়িয়ার পূর্ব পর্যন্ত হৃত অঞ্চলগুলি পুনরধিকার করেন, ত্রিপুরারাজ্যের অন্যান্য অধিকৃত অঞ্চল হোসেন শাহের দখলেই থাকিয়া যায়।

মধ্যযুগে কাম রাজ্য

মধ্যযুগে কাম রাজ্য

‘রাজমালা’র বিবরণ পড়িলে মনে হয়, ধন্যমাণিক্য বাংলার খণ্ডল পর্যন্ত যে অভিযান চালাইয়াছিলেন, তাহা হইতেই হোসেন শাহের সহিত তাঁহার সংঘর্ষের আরম্ভ হয় এবং ১৪৩৫ শক বা ১৫১৩-১৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে হোসেন শাহ ত্রিপুরারাজকে প্রতি-আক্রমণ করেন নাই। কিন্তু সোনারগাঁও অঞ্চলে ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দে উত্তীর্ণ হোসেন শাহের এক শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে থওয়াস খান নামে হোসেন শাহের একজন কর্মচারীকে ত্রিপুরার “সর-এ-লস্কর” বলা হইয়াছে। ইহা হইতে মনে হয় যে, ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই হোসেন শাহ ত্রিপুরার সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া ত্রিপুরার অঞ্চলবিশেষ অধিকার করিয়াছিলেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁহার মহাভারতে লিখিয়াছেন যে হোসেন শাহ ত্রিপুরা জয় করিয়াছিলেন। শ্রীকর নন্দী তাঁহার মহাভারতে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক, হোসেন শাহের অন্যতম সেনাপতি ছুটি খান ত্রিপুরার দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে ত্রিপুরারাজ দেশত্যাগ করিয়া “পর্বতগহ্বরে” “মহাবনমধ্যে” গিয়া বাস করিতে থাকেন; ছুটি খানকে তিনি হাতি ও ঘোড়া দিয়া সম্মানিত করেন; ছুটি খান তাঁহাকে অভয় দান করা সত্ত্বেও তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া থাকেন। এইসব কথা কতদূর যথার্থ তাহা বলা যায় না। তবে হোসেন শাহের রাজত্বকালে কোন সময়ে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে বাংলা বাহিনীর সাফল্যে ছুটি খান উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন–এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয়।

হোসেন শাহের সহিত আরাকানরাজেরও সম্ভবত সংঘর্ষ হইয়াছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই মর্মে প্রবাদ প্রচলিত আছে যে হোসেন শাহের রাজত্বকালে আরাকানীরা চট্টগ্রাম অধিকার করিয়াছিল; হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের নেতৃত্বে এক বাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে প্রেরিত হয়, তাহারা আরাকানীদের বিতাড়িত করিয়া চট্টগ্রাম পুনরধিকার করে। জোআঁ-দে-বারোসের ‘দা এশিয়া’ এবং অন্যান্য সমসাময়িক পর্তুগীজ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, ১৫১৮ খ্রীস্টাব্দে আরাকানরাজ বাংলার রাজার অর্থাৎ হোসেন শাহের সামন্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অধিকারের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার ফলেই সম্ভবত আরাকানরাজ হোসেন শাহের সামন্তে পরিণত হইয়াছিলেন।

হোসেন শাহ ত্রিহুতের কতকাংশ সমেত বর্তমান বিহার রাজ্যের অনেকাংশ জয় করিয়াছিলেন। বিহারের পাটনা ও মুঙ্গের জেলায়, এমন কি ঐ রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত সারণ জেলায়ও হোসেন শাহের শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে। বিহারের একাংশ সিকন্দর শাহ লোদীর রাজ্যভুক্ত ছিল। সিকন্দর শাহ লোদীর সহিত সন্ধি করিবার সময় হোসেন শাহ তাঁহাকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে ভবিষ্যতে তিনি সিকন্দরের শত্রুতা করিবেন না এবং সিকন্দরের শত্রুদের আশ্রয় দিবেন না। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত পালিত হয় নাই। সারণ অঞ্চলের একাংশ হোসেন শাহের এবং অপরাংশ সিকন্দর শাহের অধিকারভুক্ত ছিল। লোদী রাজবংশ সম্বন্ধীয় ইতিহাসগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, সারণে সিকন্দরের প্রতিনিধি হোসেন খান ফর্মূলির সহিত হোসেন শাহ খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা করিতে থাকায় এবং হোসেন খান ফমূলির প্রাধান্য দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে থাকায় সিকন্দর শাহ ক্রুদ্ধ হইয়া ফর্মূলির বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন (১৫০৯ খ্রী); তখন হোসেন শাহ ফলিকে আশ্রয় দেন। সিকন্দর শাহ লোদীর মৃত্যুর (১৫১৭ খ্রী) পর তাঁহার বিহারস্থ প্রতিনিধিদের সহিত হোসেন শাহ প্রকাশ্যভাবেই শত্রুতা করিতে আরম্ভ করেন।

হোসেন শাহের রাজত্বকালেই বাংলাদেশের মাটিতে পর্তুগীজরা প্রথম পদার্পণ করে। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে গোয়র পর্তুগীজ কর্তৃপক্ষ বাংলা দেশে বাণিজ্য সুরু করার অভিপ্রায়ে চারিটি জাহাজ পাঠান, কিন্তু মধ্যপথে প্রধান জাহাজটি অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হওয়ায় পর্তুগীজ প্রতিনিধিদল বাংলায় পৌঁছিতে পারেন নাই। ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে জোআঁ-দে-সিলভেরার নেতৃত্বে একদল পর্তুগীজ প্রতিনিধি চট্টগ্রামে আসিয়া পৌঁছান। সিলভেরা বাংলার সুলতানের নিকট এদেশে বাণিজ্য করার ও চট্টগ্রামে একটি কুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু সিলভেরা চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তার একজন আত্মীয়ের দুইটি জাহাজ ইতিপূর্বে দখল করিয়াছিলেন এবং চট্টগ্রামের খাদ্যভাবে পড়িয়া একটি চাল-বোঝাই নৌকা লুণ্ঠন করিয়াছিলেন বলিয়া চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা তাঁহার প্রতি বিরূপ হন ও তাঁহার জাহাজ লক্ষ্য করিয়া কামান দাগেন। পর্তুগীজরা ইহার উত্তরে চট্টগ্রাম অবরোধ করিয়া বাংলার সামুদ্রিক-বাণিজ্য বিপর্যস্ত করিল। চট্টগ্রামে শাসনকর্ত্তা এই সময়ে কয়েকটি জাহাজের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, তাই তিনি সাময়িকভাবে পর্তুগীজদের সহিত সন্ধি করিলেন। কিন্তু জাহাজগুলি বন্দরে পৌঁছিবামাত্র তিনি পর্তুগীজদের প্রতি আক্রমণ পুনরারম্ভ করিলেন। তখন সিলভেরা আরাকানে অবতরণের এবং সেখানে বাণিজ্য সুরু করার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সিলভেরা জানিতে পারিলেন যে আরাকানে অবতরণ করিলেই তিনি বন্দী হইবেন। এই কারণে তিনি নিরাশ হইয়া সিংহলে চলিয়া গেলেন।

হোসেন শাহ গৌড় হইতে নিকটবর্তী একডালায় তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। এই একডালার অবস্থান সম্বন্ধে ইলিয়াস শাহের প্রসঙ্গে পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। সম্ভবত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এবং ক্রমাগত লুণ্ঠনের ফলে গৌড় নগরী শ্রীহীন হইয়া পড়ায় হোসেন শাহ একডালায় রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন।

অনেকে মনে করিয়া থাকেন হোসেন শাহ সর্বপ্রথম সত্যপীরের উপাসনা প্রবর্তন করেন। এই ধারণার কোন ভিত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, সত্যপীরের উপাসনা যে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পূর্বে প্রবর্তিত হয় নাই, তাহা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে।

হোসেন শাহের বহু মন্ত্রী অমাত্য ও কর্মচারীর নাম এপর্যন্ত জানিতে পারা গিয়াছে। ইহাদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন। নিম্নে কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।

১। পরাগল খান : ইনি হোসেন শাহের সেনাপতি ছিলেন এবং হোসেন শাহ কর্ত্তৃক চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ইঁহারই আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করেন।

২। ছুটি খান : ইনি পরাগল খানের পুত্র। ইহার প্রকৃত নাম নসরৎ খান। ইহার আদেশে শ্রীকর নন্দী বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন। শ্রীকর নন্দীর বিবরণ অনুসারে ছুটি খান লস্করের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং ত্রিপুরার রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন।

৩। সনাতন : সনাতন হোসেন শাহের মন্ত্রী ও সভাসদ ছিলেন এবং তাঁহার বিশিষ্ট উপাধি ছিল “সাকর মল্লিক” (‘সগীর মালিক’, অর্থ ছোট রাজা)। সনাতন হোসেন শাহের অন্যতম ‘দবীর খাস’ বা প্রধান সেক্রেটারীও ছিলেন। হোসেন শাহ তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন ও তাঁহার উপর বিশেষভাবে নির্ভর করিতেন। চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা হইবার পর সনাতন রাজকার্যে অবহেলা করেন এবং উড়িষ্যা-অভিযানে সুলতানের সহিত যাইতে অস্বীকার করেন। তাঁহার এই “অপরাধের” জন্য হোসেন শাহ তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়া উড়িষ্যায় চলিয়া যান। কারারক্ষককে উৎকোচদানে বশীভূত করিয়া সনাতন মুক্তিলাভ করেন ও বৃন্দাবন যাত্রা করেন। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর একজন প্রিয় ভক্ত ছিলেন।

৪। রূপ : ইনি সনাতনের অনুজ। ইনিও হোসেন শাহের মন্ত্রী এবং দবীর খাস’ ছিলেন। দীর্ঘকাল চাকুরী করিবার পরে রূপ-সনাতনের সংসারে বিরাগ জন্মে এবং চৈতন্যের উপদেশে সংসার ত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে চলিয়া যান। অতঃপর রূপ সনাতন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের ভাষ্য রচনায় অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন।

বল্লভ (সনাতন-রূপের ভ্রাতা), শ্রীকান্ত (ইহাদের ভগ্নীপতি), চিরঞ্জীব সেন (গোবিন্দদাস কবিরাজের পিতা), কবিশেখর, দামোদর, যশোরাজ খান (সকলেই পদকর্ত্তা), মুকুন্দ (বৈদ্য), কেশব খান (ছত্রী) প্রভৃতি বিশিষ্ট হিন্দুগণ হোসেন শাহের অমাত্য, কর্মচারী চিকিৎসক প্রভৃতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনেকের ধারণা, ‘পুরন্দর খান’ নামে হোসেন শাহের একজন হিন্দু উজীর ছিলেন। এই ধারণা সত্য নহে।

হোসেন শাহের রাজ্যের আয়তন অত্যন্ত বিশাল ছিল। বাংলা দেশের প্রায় সমস্তটা এবং বিহারের এক বৃহদংশ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইহা ভিন্ন কামরূপ ও কামতা রাজ্য এবং উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিয়দংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল।

এখন আমরা হোসেন শাহের চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিব। এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে হোসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার অভ্যুদয়ের পূর্বে পরপর কয়েকজন সুলতান অল্পদিন মাত্র রাজত্ব করিয়া আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। এই অবস্থার মধ্যে রাজা হইয়া হোসেন শাহ দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করিয়াছিলেন, বিভিন্ন রাজ্য জয় করিয়া নিজের রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন এবং সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বৎসর এই বিরাট ভূখণ্ডে নিরুদ্বেগে অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করিয়াছিলেন, ইহা অল্প কৃতিত্বের কথা নহে।

‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীনে’র মতে হোসেন শাহ সুশাসক এবং জ্ঞানী ও গুণীবর্গের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; ইহার ফলে দেশে পরিপূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়; তিনি গণ্ডক নদীর কূলে একটি বাঁধ নির্মাণ করিয়া রাজ্যের সীমানা সুঝক্ষিত করেন; রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, সরাইখানা ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং আলিম ও দরবেশদের বহু অর্থ দান করেন।

হোসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁহার বা তাঁহার অধীনস্থ কর্মচারীদের দ্বারা বহু সুন্দর সুন্দর মসজিদ, ফটক প্রভৃতি নির্মিত হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে গৌড়ের “ছোট সোনা মসজিদ” এবং “গুমতি ফটক” এখনও বর্তমান আছে। ইহাদের শিল্পসৌন্দর্য অসাধারণ।

হোসেন শাহের রাজত্বকালে দেশে অশুভ ঘটনাও কিছু কিছু ঘটিয়াছিল। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায় যে, ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার রাজ্যে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল। এই জাতীয় দুর্ভিক্ষের জন্য হোসেন শাহকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা না গেলেও পরোক্ষ দায়িত্ব তিনি এড়াইতে পারেন না। … …

কয়েকজন মুসলমান পণ্ডিতের সঙ্গে হোসেন শাহের গোলযোগ সম্বন্ধে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। ইহাদের মধ্যে একজন ফার্সী ভাষায় একটি ধনুর্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন এবং তৎকালীন গৌড়েশ্বর হোসেন শাহকে এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন। দ্বিতীয় মুসলমান পণ্ডিত হোসেন শাহের কোষাগারের জন্য একখানি ঐশ্লামিক গ্রন্থের তিনটি খণ্ড নকল করেন; তৃতীয় খণ্ডের পুস্পিকায় তিনি হোসেন শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। এই বই হোসেন শাহই উৎসাহী হইয়া নকল করাইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এই নকল করানোর মধ্যে তাঁহার বিদ্যোৎসাহিতার বদলে ধর্মপরায়ণতার নিদর্শনই বেশি মিলে।

ভুলবশত হোসেন শাহকে মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক মনে করায়ও এইরূপ ধারণা প্রচলিত হইয়াছে যে হোসেন শাহ পণ্ডিত ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন।

আমাদের ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, হোসেন শাহ কোন কবি বা পণ্ডিতকে কোন উপাধি দেন নাই (যেমন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ্ দিয়াছিলেন), এবং বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবতে একজন লোককে দিয়া বলাইয়াছেন, “না করে পাণ্ডিত্যচর্চ্চা রাজা সে যবন।” সুতরাং হোসেন শাহ বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলিয়া সিদ্ধান্ত করা সমীচীন নহে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একটি পর্বকে অনেকে ‘হোসেন শাহী আমল’ নামে চিহ্নিত করিয়া থাকেন। কিন্তু এরূপ করার কোন সার্থকতা নাই। কারণ হোসেন শাহের রাজত্বকালে মাত্র কয়েকখানি বাংলা গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থগুলির রচনার মূলে যেমন হোসেন শাহের প্রত্যক্ষ প্রভাব কিছু ছিল না, তেমনি এই সমস্ত গ্রন্থ রচিত হওয়ার ফলে যে বাংলা সাহিত্যের বিরাট সমৃদ্ধি সাধিত হইয়াছিল, তাহাও নহে। কেহ কেহ ভুল করিয়া বলিয়াছেন যে হোসেন শাহের আমলে বাংলার পদাবলী-সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পদাবলী সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটে হোসেন শাহের রাজত্ব অবসানের কয়েক দশক বাদে,–জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রভৃতি কবিদের আবির্ভাবের পর। অতএব বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায়ের সঙ্গে বিশেষভাবে হোসেন শাহের নাম যুক্ত করার কোন সার্থকতা নাই।

হোসেন শাহ সম্বন্ধে আর প্রচলিত মত এই যে, তিনি ধর্ম্মের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার ছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শী ছিলেন। কিন্তু এই ধারণাও কোন বিশিষ্ট তথ্য দ্বারা সমর্থিত নহে। হোসেন শাহের শিলালিপিগুলির সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, তিনি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং ইসলামধর্ম্মের মাহাত্ম প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের মঙ্গল সাধনের জন্যই বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। হোসেন শাহ গোঁড়া মুসলমান ও পরধর্মদ্বেষী দরবেশ নূর কুত্ত্ব আলমকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন এবং প্রতি বৎসর নূর কুল্ আলমের সমাধি প্রদক্ষিণ করিবার জন্য তিনি পদব্রজে একডালা হইতে পাণ্ডুয়ায় যাইতেন।

হোসেন শাহ হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ করিতেন, ইহা দ্বারা তাঁহার হিন্দু মুসলমানে সমদর্শিতা প্রমাণিত হয় না। হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের প্রথা ইলিয়াস শাহী আমল হইতেই চলিয়া আসিতেছিল। সব সময়ে সমস্ত পদের জন্য যোগ্য মুসলমান কর্মচারী পাওয়া যাইত না, অযোগ্যদের নিয়োগ করিলে শাসনকার্যের ক্ষতি হইবে, এই কারণে সুলতানরা ঐসব পদে হিন্দুদের নিয়োগ করিতেন। হোসেন শাহও তাহাই করিয়াছিলেন। সুতরাং এ ব্যাপারে তিনি পূর্ববতী সুলতানদের তুলনায় কোনরূপ স্বাতন্ত্রের পরিচয় দেন নাই।

হোসেন শাহের রাজত্বকালে চৈতন্যদেবের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল। চৈতন্যচরিত গ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, চৈতন্যদেব যখন গৌড়ের নিকটে রামকেলি গ্রামে আসেন, তখন কোটালের মুখে চৈতন্যদেবের কথা শুনিয়া হোসেন শাহ চৈতন্যদেবের অসাধারণত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা হইতেও তাঁহার ধর্মবিষয়ে উদারতা প্রমাণিত হয় না। কারণ চৈতন্যদেব হোসেন শাহের কাজীর কাছে দুর্ব্যবহার পাইয়াছিলেন। হোসেন শাহের সরকার তাঁহার অভ্যুদয়ে কোনরূপ সাহায্য করে নাই, বরং নানাভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিল। এ ব্যাপারও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে সন্ন্যাসগ্রহণের পরে চৈতন্যদেব আর বাংলায় থাকেন নাই, হিন্দু রাজার দেশ উড়িষ্যা চলিয়া গিয়াছিলেন; বাংলায় থাকিলে বিধর্মী রাজশক্তি তাঁহার ধর্মচর্চ্চার বিঘ্ন ঘটাইতে পারে ভাবিয়াই তিনি হয়তো উড়িষ্যায় গিয়াছিলেন। হোসেন শাহ কর্ত্তৃক চৈতন্যদেবের মাহাত্ম স্বীকার যে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সে কথা চৈতন্যচরিতকারেরাই বলিয়াছেন। ইহাও লক্ষণীয় যে হোসেন শাহ চৈতন্যদেবের ক্ষতি না করিবার আশ্বাস দিলেও তাঁহার হিন্দু কর্মচারীরা তাঁহার উপর আস্থা স্থাপন করিতে পারেন নাই।

চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলির রচয়িতারা কোন সময়েই বলেন নাই যে হোসেন শাহ ধর্মবিষয়ে উদার ছিলেন। বরং তাঁহারা ইহার বিপরীত কথা লিখিয়াছেন। বৃন্দাবনদাস চৈতন্যভাগবতে’ হোসেন শাহকে “পরম দুর্বার” “যবন রাজা” বলিয়াছেন এবং চৈতন্যদেব ও তাঁহার সম্প্রদায় যে হোসেন শাহের নিকটে রামকেলি গ্রামে থাকিয়া হরিধ্বনি করিতেছিলেন, এজন্য তাঁহাদের সাহসের প্রশংসা করিয়াছেন। চৈতন্যচরিতগুলি পড়িলে বুঝা যায় যে, হোসেন শাহকে তাঁহার সমসাময়িক হিন্দুরা মোটেই ধর্মবিষয়ে উদার মনে করিত না, বরং তাঁহাকে অত্যন্ত ভয় করিত। অবৈষ্ণবরা প্রায়ই বৈষ্ণবদের এই বলিয়া ভয় দেখাইত যে, “যবন রাজা” অর্থাৎ হোসেন শাহ তাঁহাদের ধরিয়া লইয়া যাইবার জন্য তোক পাঠাইতেছেন।

সমসাময়িক পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা হোসেন শাহ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার ও তাঁহার অধীনস্থ শাসনকর্ত্তাদের আনুকূল্য অর্জনের জন্য প্রতিদিন বাংলায় অনেক হিন্দু ইসলামধর্ম গ্রহণ করিত। সুতরাং হোসেন শাহ যে হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শী ছিলেন, সে কথা বলিবার কোন উপায় নাই।

উড়িষ্যার ‘মাদলা পাঞ্জী’ ও বাংলার চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ উড়িষ্যা-অভিযানে গিয়া বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করিয়াছিলেন। শেষবারের উড়িষ্যা-অভিযানে হোসেন শাহ সনাতনকে তাঁহার সহিত যাইতে বলিলে সনাতন বলেন যে, সুলতান উড়িষ্যায় গিয়া দেবতাকে দুঃখ দিবেন, এই কারণে তাঁহার সহিত তিনি যাইতে পারিবেন না।

যুদ্ধের সময়ে হোসেন শাহ হিন্দুধর্ম্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাইয়াছেন দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করিয়া। শান্তির সময়েও তাঁহার হিন্দুর প্রতি অনুদার ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। তাঁহার মনিব সুবুদ্ধি রায় তাঁহাকে একদা বেত্রাঘাত করিয়াছিলেন, এইজন্য, তিনি সুবুদ্ধি রায়ের জাতি নষ্ট করেন। হোসেন শাহ যখন কেশব ছত্রীকে চৈতন্যদেবের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তখন কেশব ছত্রী তাঁহার, কাছে চৈতন্যদেবের মহিমা লাঘব করিয়া বলিয়াছিলেন। ইহা হইতে মনে হয়, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি হোসেন শাহের পূর্ব-ব্যবহার খুব সন্তোষজনক ছিল না।

হোসেন শাহের অধীনস্থ আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তা ও রাজকর্মচারীদের আচরণ সম্বন্ধে যে সব তথ্য পাই, সেগুলি হইতেও হোসেন শাহের হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শিতা সম্বন্ধীয় ধারণা সমর্থিত হয় না। চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায়, যখন চৈতন্যদেব নবদ্বীপে হরি-সঙ্কীর্তন করিতেছিলেন এবং তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণে অন্যেরাও কীর্তন করিতেছিল, তখন নবদ্বীপের কাজী কীর্তনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র মতে কাজী একজন কীর্তনীয়ার খোল ভাঙিয়া দিয়াছিলেন এবং কেহ কীর্তন করিলেই তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া জাতি নষ্ট করিবেন বলিয়া শাসাইয়াছিলেন।

‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহের অথবা তাঁহার পুত্র নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বেনাপোলের জমিদার রামচন্দ্র খানের রাজকর বাকী পড়ায় বাংলার সুলতানের উজীর তাঁহার বাড়ীতে আসিয়া তাহাকে স্ত্রী-পুত্র সমেত বন্দী করেন এবং তাঁহার দুর্গামণ্ডপে গরু বধ করিয়া তিন দিন ধরিয়া তাঁহার মাংস রন্ধন করান; এই তিন দিন তিনি রামচন্দ্র খানের গৃহ ও গ্রাম নিঃশেষে লুণ্ঠন করিয়া তাঁহার জাতি নষ্ট করিয়া অবশেষে তাঁহাকে লইয়া চলিয়া যান। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ হইতে আরও জানা যায় যে, সপ্তগ্রামের মুসলমান শাসকর্ত্তা নিছক গায়ের জোরে ঐ অঞ্চলের ইজারাদার হিরণ্য মজুমদার ও গোবর্ধন মজুমদারের নিকট সুলতানের কাছে তাঁহাদের প্রাপ্য আট লক্ষ টাকার ভাগ চাহিয়াছিলেন, তাঁহার মিথ্যা নালিশ শুনিয়া হোসেন শাহের উজীর হিরণ্য ও গোবর্ধনকে বন্দী করিতে আসিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের না পাইয়া গোবর্ধনের পুত্র নিরীহ রঘুনাথকে বন্দী করিয়াছিলেন; সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয়, সুলতানের কারাগারে বন্দী হইবার পরেও সপ্তগ্রামের শাসনকর্ত্তা রঘুনাথকে তর্জনগর্জন ও ভীতি-প্রদর্শন করিতে থাকেন।

বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ হোসেন শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়। এই গ্রন্থের “হাসন-হুসেন” পালায় লেখা আছে যে মুসলমানরা “জুলুম” করিত এবং “ছৈয়দ মোল্লা”রা হিন্দুদের কলমা পড়াইয়া মুসলমান করিত।

হোসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁহার মুসলমান কর্মচারীরা হিন্দুদের ধর্মকর্ম লইয়া উপহাস করিত। বৈষ্ণবদের কীর্তনকে তাহারা বলিত “ভূতের সংকীর্তন”।

কেহ কেহ বলিতে পারেন যে হোসেন শাহের মুসলমান কর্মচারীদের বা প্রজাদের হিন্দু-বিদ্বেষ হইতে সুলতানের হিন্দু-বিদ্বেষ প্রমাণিত হয় না। কিন্তু হোসেন শাহ যদি হিন্দুদের উপর সহানুভূতি-সম্পন্ন হইতেন, তাহা হইলে তাঁহার কর্মচারীরা বা অন্য মুসলমানরা হিন্দু-বিদ্বেষের পরিচয় দিতে ও হিন্দুদের উপর নির্যাতন করিতে সাহস পাইত বলিয়া মনে হয় না। তাহা ছাড়া, হোসেন শাহও যে খুব বেশি হিন্দুদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না, সে কথাও চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলিতে লেখা আছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃতের এক জায়গায় দেখা যায়, নবদ্বীপের মুসলমানরা স্থানীয় কাজীকে বলিতেছে যে নবদ্বীপে হিন্দুরা “হরি হরি” বলিয়া কোলাহল করিতেছে একথা শুনিলে বাদশাহ (অর্থাৎ হোসেন শাহ) কাজীকে শাস্তি দিবেন। চৈতন্যভাগবতে দেখা যায়, হোসেন শাহের হিন্দু কর্মচারীরা বলিতেছে যে হোসেন শাহ “মহাকালযবন” এবং তাঁহার ঘন ঘন “মহাতমোগুণবুদ্ধি জন্মে”। নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবরা হোসেন শাহকে কোনদিনই উদার মনে করেন নাই। তাহাদের মতে হোসেন শাহ দ্বাপর যুগের কৃষ্ণলীলার সময়ে জরাসন্ধ ছিলেন।

সুতরাং হোসেন শাহ যে অসাম্প্রদায়িক-মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন এবং হিন্দুদের প্রতি অপক্ষপাত আচরণ করিতেন, এই ধারণা একেবারেই ভুল।

অবশ্য হোসেন শাহ যে উকট রকমের হিন্দু-বিদ্বেষী বা ধর্মোন্মাদ ছিলেন না, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি যদি ধর্মোন্মাদ হইতেন, তাহা হইলে নবদ্বীপের কীর্তন বন্ধ করায় সেখানকার কাজী ব্যর্থতা বরণ করার পর স্বয়য়ং অকুস্থলে উপস্থিত হইতেন এবং বলপূর্বক কীর্তন বন্ধ করিয়া দিতেন। তাঁহার রাজত্বকালে কয়েকজন মুসলমান হিন্দু-ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। চৈতন্যচরিতগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে শ্রীবাসের মুসলমান দর্জি চৈতন্যদেবের রূপ দেখিয়া প্রেমোন্মাদ হইয়া মুসলমানদের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করিয়া হরিনাম কীর্তন করিয়াছিল; উৎকল সীমান্তের মুসলমান সীমাধিকারী ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে চৈতন্যদেবের ভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল; ইতিপূর্বে-নির্যাতিত যবন হরিদাস হোসেন শাহের রাজত্বকালে স্বাধীনভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেন এবং নবদ্বীপে নগর-সংকীর্তনের সময়ে সম্মুখের সারিতে থাকিতেন। তাঁহার পর, হোসেন শাহেরই রাজত্বকালে চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা পরাগল খান ও তাঁহার পুত্র ছুটি খান হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ মহাভারত শুনিতেন। হোসেন শাহের রাজধানীর খুব কাছেই রামকেলি, কানাই-নাটশালা প্রভৃতি গ্রামে বহু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব বাস করিতেন। ত্রিপুরা-অভিযানে গিয়া হোসেন শাহের হিন্দু সৈন্যেরা গোমতী নদীর তীরে পাথরের প্রতিমা পূজা করিয়াছিল। হোসেন শাহ ধর্মোন্মাদ হইলে এ সব ব্যাপার সম্ভব হইত না।

আসল কথা, হোসেন শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও রাজনীতিচতুর নরপতি। হিন্দুধর্ম্মের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষের পরিচয় দিলে অথবা হিন্দুদের মনে বেশি আঘাত দিলে তাঁহার ফল যে বিষময় হইবে, তাহা তিনি বুঝিতেন। তাই তাঁহার হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপ সংখ্যায় অল্প না হইলেও তাহা কোনদিনই একেবারে মাত্রা ছাড়াইয়া যায় নাই।

. অনেকের ধারণা, হোসেন শাহই বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান এবং তাঁহার রাজত্বকালে বাংলা দেশ ও বাঙালী জাতি চরম সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছিল। এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। তবে বাংলার অন্যান্য শ্রেষ্ঠ সুলতানদের সম্বন্ধে হোসেন শাহের মত এত বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, সে কথাও মনে রাখিতে হইবে। হোসেন শাহের রাজত্বকালেই চৈতন্যদেবের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল বলিয়া চৈতন্যচরিতগ্রন্থগুলিতে প্রসঙ্গক্রমে হোসেন শাহ ও তাঁহার আমল সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ হইয়াছে। অন্য সুলতানদের রাজত্বকালে অনুরূপ কোন ঘটনা ঘটে নাই বলিয়া তাঁহাদের সম্বন্ধে এত বেশি তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ হয় নাই। সুতরাং হোসেন শাহই যে বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম তিনজন সুলতান এবং রুকনুদ্দীন বারবক শাহ কোন কোন দিক দিয়া তাঁহার তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারেন।

হোসেন শাহের শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, তিনি ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সম্ভবত তাঁহার কিছু পরে তিনি পরলোকগমন করিয়াছিলেন। বাবরের আত্মকাহিনী হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, হোসেন শাহের স্বাভাবিক মৃত্যু হইয়াছিল।

নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহ

আলাউদ্দীন হোসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় যে পিতার মৃত্যুর অন্ত ত তিন বৎসর পূর্বে নসরৎ শাহ যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত হন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রকাশ করিবার অধিকার লাভ করেন। কোন কোন ইতিহাসগ্রন্থের মতে নসরৎ শাহ হোসেন শাহের ১৮ জন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পরে তিনি তাঁহার ভ্রাতাদের কোন অনিষ্ট করিয়া তাহাদের পিতৃদত্ত বৃত্তি দ্বিগুণ করিয়া দেন।

‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ এবং অন্য কয়েকটি সূত্র হইতে জানা যায় যে, নসরৎ শাহ ত্রিহুতের রাজা কংসনারায়ণকে বন্দী করিয়া বধ করেন এবং ত্রিহুত সম্পূর্ণভাবে অধিকার করার জন্য তাঁহার ভগ্নীপতি মখদুম আলমকে নিযুক্ত করেন। ত্রিহুতে প্রচলিত একটি শ্লোকের মতে ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।

হোসেন শাহের রাজ্য বাংলার সীমা অতিক্রম করিয়া বিহারের তিতরেও অনেকখানি পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল বটে, কিন্তু পাশেই পরাক্রান্ত লোদী সুলতানদের রাজ্য থাকায় বাংলার সুলতানকে কতকটা সশঙ্কভাবে থাকিতে হইত। নসরৎ শাহের সিংহাসনে আরোহণের দুই বৎসর পরে লোদী সুলতানদের রাজ্যে ভাঙন ধরিল; পাটনা হইতে জৌনপুর পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল প্রায় স্বাধীন হইল এবং এই অঞ্চলে লোহানী ও ফর্মুলি বংশীয় আফগান নায়করা প্রাধান্য লাভ করিলেন। নসরৎ শাহ ইঁহাদের সহিত মৈত্রী স্থাপন করিলেন।

এদিকে ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে বাবর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া দিল্লি অধিকার করিলেন এবং দ্রুত রাজ্যবিস্তার করিতে লাগিলেন। আফগান নায়কেরা তাঁহার হাতে পরাজিত হইয়া পূর্ব ভারতে পলাইয়া গেলেন। ক্রমশ ঘর্ঘরা নদীর তীর পর্যন্ত অঞ্চল বাবরের রাজ্যভুক্ত হইল। ঘর্ঘরা নদীর এপার হইতে নসরৎ শাহের রাজ্য আরম্ভ। বাবর কর্ত্তৃক পরাস্ত ও বিতাড়িত আফগানদের অনেকে নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় লাভ করিল। কিন্তু নসরৎ প্রকাশ্যে বাবরের বিরুদ্ধাচরণ করিলেন না। বাবর নসরতের কাছে দূত পাঠাইয়া তাঁহার মনোভাব জানিতে চাহিলেন, কিন্তু ঐ দূত নসরৎ শাহের সভায় বৎসরাধিককাল থাকা সত্ত্বেও নসরৎ শাহ খোলাখুলিভাবে কিছুই বলিলেন না। অবশেষে যখন বাবরের সন্দেহ জাগ্রত হইল, তখন নসরৎ বাবরের দূতকে ফেরৎ পাঠাইয়া নিজের দূতকে তাঁহার সঙ্গে দিয়া বাবরের কাছে অনেক উপহার পাঠাইয়া বন্ধুত্ব ঘোষণা করিলেন। ফলে বাবর বাংলা আক্রমণের সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন।

ইহার পর বিহারের লোহানী-প্রধান বহার খানের আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় তাঁহার বালক পুত্র জলাল খান তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন। শের খান সূর দক্ষিণ বিহারের জায়গীর গ্রহণ করিলেন। ইতিমধ্যে ইব্রহিম লোদীর ভ্রাতা মাহমুদ নিজেকে ইব্রাহিমের উত্তরাধিকারী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। তিনি জৌনপুর অধিকার করিলেন এবং বালক জলাল খান লোহানীর রাজ্য কাড়িয়া লইলেন। জলাল খান হাজীপুরে পলাইয়া গিয়া তাঁহার পিতৃবন্ধু নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় চাহিলেন, কিন্তু নসরৎ শাহ তাঁহাকে হাজীপুরে আটক করিয়া রাখিলেন। শের খান প্রমুখ বিহারের আফগান নায়কেরা মাহমুদের সহিত যোগ দিলেন। অতঃপর তাহারা বাবরের রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কিন্তু শের খান শীঘ্রই বশ্যতা স্বীকার করিলেন। অন্যদের দমন করিবার জন্য বাবর সৈন্যবাহিনীসমেত বক্সারে আসিলেন। জলাল লোহানী অনুচরবর্গ সমেত কৌশলে নসরতের কবল হইলে মুক্তিলাভ করিয়া বক্সারে বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করিবার জন্য রওনা হইলেন।

‘রিয়াজের মতে নসরৎ শাহও বাবরের বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাবরের আত্মকাহিনীতে এরূপ কোন কথা পাওয়া যায় না। বাবর নসরতের নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কোন প্রকাশ্য প্রমাণ পান নাই। তিনি তিনটি সর্তে নসরৎ শাহের সহিত সিন্ধ করিতে চাহিলেন। এই সর্তগুলির মধ্যে একটি হইল, ঘর্ঘরা নদী দিয়া বাবরের সৈন্যবাহিনীর অবাধ চলাচলের অধিকার দিতে হইবে। কিন্তু বাবর বারবার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও নসরৎ শাহ সন্ধির প্রস্ত বি অনুমোদন করিলেন না অথবা অবিলম্বে এই প্রস্তাবের উত্তর দিলেন না। এদিকে বাবর চরের মারফৎ সংবাদ পাইলেন যে বাংলার সৈনাবাহিনী গণ্ডক নদীর তীরে মখদূম-ই-আলমের নেতৃত্বে ২৪টি স্থানে সমবেত হইয়া আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সুদৃঢ় করিতেছে এবং তাহারা বাবরের নিকট আত্মসমর্পণেচ্ছু আফগানদের আটকাইয়া রাখিয়া নিজেদের দলে টানিতেছে। বাবর নসরৎ শাহকে ঘর্ঘরা নদীর এপার হইতে সৈন্য সরাইয়া লইয়া তাঁহার পথ খুলিয়া দিতে বলিয়া পাঠাইলেন এবং নসরৎ তাহা না করিলে তিনি যুদ্ধ করিবেন, ইহাও জানাইয়া দিলেন। কয়েকদিন অপেক্ষা করিয়াও যখন বাবর নসরতের কাছে কোন উত্তর পাইলেন না, তখন তিনি বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত করিলেন।

বাবর বাংলার সৈন্যদের শক্তি এবং কামান চালনায় দক্ষতার কথা জানিতেন, সেইজন্য বক্সারে খুব শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী লইয়া আসিয়াছিলেন। এই সৈন্যবাহিনী লইয়া বাবর জোর করিয়া ঘর্ঘরা নদী পার হইলেন। তাঁহার ফলে ১৫২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২রা মে হইতে ৬ই মে পর্যন্ত বাংলার সৈন্যবাহিনীর সহিত বাবরের বাহিনীর যুদ্ধ হইল। বাংলার সৈন্যেরা প্রশংসনীয়ভাবে যুদ্ধ করিল; তাহাদের কামান-চালনার দক্ষতা দেখিয়া বাবর মুগ্ধ হইলেন; তিনি দেখিলেন বাঙালীদের কামান-চালনার হাত এত পাকা যে লক্ষ্য স্থির না করিয়া যথেচ্ছভাবে কামান-চালাইয়া তাহারা শত্রুদের পর্যুদস্ত করিতে পারে। দুইবার বাঙালীরা বাবরের বাহিনীকে পরাস্ত করিল। কিন্তু তাহারা শেষ রক্ষা করিতে পারিল না, বাবরের বাহিনীর শক্তি অধিক হওয়ায় তাহারাই শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। যুদ্ধের শেষদিকে বসন্ত রাও নামে বাংলার একজন বিখ্যাত হিন্দু বীর অনুচরবর্গ সমেত বাবরের সৈন্যদের হাতে নিহত হইলেন। ৬ই মে দ্বিপ্রহরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হইয়া গেল। বাবর তাঁহার সৈনাবাহিনী সমেত ঘর্ঘরা নদী পার হইয়া সারণে পৌঁছিলেন। এখানে জলাল খান লোহানী তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন বাবর জলালকে বিহারে তাঁহার সামন্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিলেন।

কিন্তু নসরৎ শাহ এই সময়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। ঘর্ঘরার যুদ্ধের কয়েকদিন পরে মুঙ্গেরের শাহজাদা ও লস্কর-উজীর হোসেন খান মারফৎ তিনি বাবরের কাছে দূত পাঠাইয়া জানাইলেন যে বাবরের তিনটি সর্ত মানিয়া সন্ধি করিতে তিনি সম্মত। এই সময়ে বাবরের শত্রু আফগান নায়কদের কতকাংশ পর্যদস্ত, কতক নিহত হইয়াছিল, কয়েকজন বাবরের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল এবং কয়েকজন বাংলায় আশ্রয় লইয়াছিল; তাঁহার উপর বর্ষাও আসন্ন হইয়া উঠিতেছিল। তাই বাবরও সন্ধি করিতে রাজী হইয়া অপর পক্ষকে পত্র দিলেন। এইভাবে বাবর ও নসরৎ শাহের সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটিল। বাবরের সহিত সংঘর্ষের ফলে নসরৎ শাহকে কিছু কিছু অঞ্চল হারাইতে হইল এবং এই অঞ্চলগুলি বাবরের রাজ্যভুক্ত হইল।

‘রিয়াজ’-এর মতে বাবরের মৃত্যুর পর যখন হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তাঁহার কিছুদিন পরে নসরৎ শাহের কাছে সংবাদ আসে যে হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন; তখন নসরৎ হুমায়ুনের শত্রু গুজরাটের সুলতান বাহাদূর শাহের কাছে অনেক উপহার সমেত দূত পাঠান-উদ্দেশ্য তাঁহার সহিত জোট বাঁধা। এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয় এবং সত্য হইলে ইহা হইতে নসরৎ শাহের কূটনীতিজ্ঞানের একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়।

বাবর ভিন্ন আর যেসব শক্তির সহিত নসরৎ শাহের সংঘর্ষ হইয়াছিল, তন্মধ্যে ত্রিপুরা অন্যতম। ‘রাজমালা’র মতে নসরৎ শাহের সমসাময়িক ত্রিপুরারাজ দেবমাণিক্য চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন। পক্ষান্তরে মুহম্মদ খান মঞ্জুল হোসেন কাব্যে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পূর্বপুরুষ হামজা খান ত্রিপুরার সহিত যুদ্ধে বিজয়ী হইয়াছিলেন। হামজা খান সম্ভবত চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং সময়ের দিক্‌ দিয়া তিনি নসরৎ শাহের সমসাময়িক। সুতরাং নসরৎ শাহের সহিত ত্রিপুরারাজের যুদ্ধ হইয়াছিল বলিয়া বুঝা যাইতেছে, তবে এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই জয়ের দাবি করায় আসলে ইহার ফল কী হইয়াছিল তাহা বলা কঠিন।

‘অহোম বুরঞ্জী’তে লেখা আছে যে, নসরৎ শাহের রাজত্বকালে–১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা কর্ত্তৃক আসাম আক্রান্ত হইয়াছিল; ঐ বৎসরে “তুরবক” নামে বাংলার সুলতানের একজন মুসলমান সেনাপতি ৩০টি হাতি, ১০০০টি ঘোড়া এবং বহু কামান লইয়া অহোম রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তেমনি দুর্গ জয় করিয়া সিঙ্গরি নামক দুর্ভেদ্য ঘাঁটির সম্মুখে তাঁবু ফেলিয়া অপেক্ষা করিতে থাকেন। বরপাত্র গোহাইন এবং রাজপুত্র সুক্লেনের নেতৃত্বে অহোমরাজের সৈন্যেরা সিঙ্গরি রক্ষা করিতে থাকে। অল্পকালের মধ্যেই দুই পক্ষে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হইয়া গেল। কিছুদিন খণ্ডযুদ্ধ চলিবার পর সুক্রেন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হইয়া মুসলমানদিগকে আক্রমণ করিলেন। মুসলমানরা প্রথমে তুমুল যুদ্ধের ফলে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেও শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। এই যুদ্ধে আটজন অহোম সেনাপতি নিহত হইলেন, রাজপুত্র সুক্রেন কোনক্রমে প্রাণে বাঁচিয়াও মারাত্মকভাবে আহত হইলেন, বহু অহোম সৈন্য জলে ডুবিয়া মরিল, অন্যেরা সালা নামক স্থানে পলাইয়া গেল। অহোমরাজ সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করিয়া বরপাত্র গোহাইনের অধীনে রাখিলেন।

নসরৎ শাহের রাজত্বকালে পর্তুগীজরা আর একবার বাংলা দেশে ঘাঁটি স্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করে। সিলভেরার আগমনের পর হইতে পর্তুগীজরা প্রতি বৎসরেই বাংলাদেশে একটি করিয়া জাহাজ পাঠাইত। ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে রুই-ভাজ পেরেরার অধিনায়কত্বে এইরূপ একটি পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামে আসে। পেরেরা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছিয়া সেখানে অবস্থিত খাজা শিহাবুদ্দীন নামে একজন ইরানী বণিকের পর্তুগীজ রীতিতে নির্মিত একটি জাহাজ কাড়িয়া লইয়া চলিয়া যান।

১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দে মাতিম-আফলো-দে-মেলোর পরিচালনাধীন একটি পর্তুগীজ জাহাজ ঝড়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া বাংলার উপকূলের কাছে আসিয়া পড়ে। এখানকার কয়েক জন ধীবর ঐ জাহাজে পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে পৌঁছাইয়া দিবার নাম করিয়া চকরিয়ায় লইয়া যায়। চকরিয়ার শাসনকর্ত্তা খোদা বশ খান জনৈক প্রতিবেশী ভূস্বামীর সহিত যুদ্ধে এই পর্তুগীজদের নিয়োজিত করেন, কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি তাহাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুক্তি না দিয়া সোরে শহরে বন্দী করিয়া রাখেন। ইহার পর আর একদল পর্তুগীজ অন্য এক জাহাজে করিয়া চকরিয়ায় আসিলেন এবং তাঁহাদের সব জিনিস খোদা বখশ খানকে দিয়া আফলো-দে-মেলোকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু খোদা বখশ খান আরও অর্থ চাহিলেন। পর্তুগীজদের কাছে আর কিছু ছিল না। দে-মেলো সদলবলে পলাইয়া ইহাদের সহিত যোগ দিতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলেন; তাঁহার রূপবান তরুণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে ব্রাহ্মণেরা ধরিয়া দেবতার নিকট বলি দিল; অবশেষে পূর্ব্বোক্ত খাজা শিহাবুদ্দীনের মধ্যস্থতায় আফসো-দে-মেলো প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হন এবং পর্তুগীজরা শিহাবুদ্দীনকে তাঁহার লুণ্ঠিত জাহাজ জিনিসপত্র সমেত ফিরাইয়া দেয়। শিহাবুদ্দীন বাংলার সুলতানের সহিত একটা বিষয়ের নিষ্পত্তি করিবার জন্য ও ওরমুজ যাইবার জন্য পর্তুগীজ জাহাজের সাহায্য চাহেন এবং তাঁহার বিনিময়ে পর্তুগীজদের বাংলায় বাণিজ্য করিবার ও চট্টগ্রামে দুর্গ নির্মাণ করিবার অনুমতি দিতে নসরৎ শাহকে সম্মত করাইবার চেষ্টা করিতে প্রতিশ্রুত হন। গোয়র পর্তুগীজ গভর্নর এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেও এ সম্বন্ধে কিছু ঘটিবার পূর্বেই নসরৎ শাহের মৃত্যু হইল।

নসরৎ শাহ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। গৌড়ে তিনি অনেকগুলি মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। আহার মধ্যে বিখ্যাত বারদুয়ারী বা সোনা মসজিদ অন্যতম। অনেকের ধারণা গৌড়ের বিখ্যাত ‘কম্ রসুল’ ভবনও নসরৎ শাহ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; কিন্তু আসলে এটি শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের আমলে নির্মিত হইয়াছিল। নসরৎ শাহ কেবলমাত্র এই ভবনের প্রকোষ্ঠে একটি মঞ্চ নির্মাণ করান এবং তাঁহার উপরে হজরৎমুহম্মদের পদচিহ্ন-সংবলিত একটি কালো কারুকার্যখচিত মর্মর-বেদী বসান। নসরৎ শাহ অনেক প্রাসাদও নির্মাণ করাইয়াছিলেন।

নসরৎ শাহের নাম সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি রচনায়–যেমন শ্রীকর নন্দীর মহাভারতে এবং কবিশেখরের পদে–উল্লিখিত দেখিতে পাওয়া যায়। কবিশেখর নসরৎ শাহের কর্মচারী ছিলেন।

নসরৎ শাহের রাজ্যের আয়তন খুব বেশি ছিল। প্রায় সমগ্র বাংলা দেশ বিহুত ও বিহারের অধিকাংশ এবং উত্তর প্রদেশের কিয়দংশ নসরৎ শাহের অধিকারভুক্ত ছিল।

‘রিয়াজ’এর মতে নসরৎ শাহ শেষজীবনে জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করিয়া তাঁহার রাজত্বকে কলঙ্কিত করেন; এই কথার সত্যতা সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। বিভিন্ন বিবরণের মতে নসরৎ শাহ আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন; রিয়াজে’র মতে তিনি পিতার সমাধিক্ষেত্র হইতে ফিরিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার দ্বারা দণ্ডিত জনৈক খোঁজা তাঁহাকে হত্যা করে; বুকাননের বিবরণীর মতে নসরৎ শাহ নিদ্রিতাবস্থায় প্রাসাদের প্রধান খোঁজার হাতে নিহত হন।

আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (দ্বিতীয়)

নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি দ্বিতীয় আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ, কারণ এই নামের আর একজন সুলতান ইতিপূর্বে ১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।

সুলতান হইবার পূর্বে ফিরোজ শাহ যখন যুবরাজ ছিলেন, তখন তাঁহার আদেশে শ্রীধর কবিরাজ নামে জনৈক কবি একখানি ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন–এইটিই প্রথম বাংলা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য, এই কাব্যটিতে শ্রীধর তাঁহার আজ্ঞাদাতা যুবরাজ “পেরোজ শাহা” অর্থাৎ ফিরোজ শাহ এবং তাঁহার পিতা নৃপতি “নসীর শাহ” অর্থাৎ নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। শ্রীধর সম্ভবত চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোক, কারণ তাঁহার ‘কালিকামঙ্গলের পুঁথি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই পাওয়া গিয়াছে। ইহা হইতে মনে হয়, নসরৎ শাহের রাজত্বকালে যুবরাজ ফিরোজ শাহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং সেই সময়েই তিনি শ্রীধর কবিরাজকে দিয়া এই কাব্যখানি লেখান।

অসমীয়া বুরঞ্জী হইতে জানা যায়, নসরৎ শাহ আসামে যে অভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা নসরতের মৃত্যুর পরেও চলিয়াছিল। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার বাহিনী আসামের ভিতর দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর বর্ষার আগমনে তাহাদের অগ্রগতি বন্ধ হয়। ১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাহারা খলাধরিতে (দরং জেলা) উপনীত হয়। অহোমরাজ বুরাই নদীর মোহনা পাহারা দিবার জন্য শক্তিশালী বাহিনী পাঠাইলেন এবং পরিখা কাটাইলেন। মুসলমানরা তখন ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে সরিয়া গিয়া সালা দুর্গ অধিকার করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু দুর্গের অধ্যক্ষ তাহাদের উপর গরম জল ঢালিয়া দিয়া তাহাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিলেন। দুই মাস ইতস্তত খণ্ডযুদ্ধ চলার পর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি বৃহৎ স্থলযুদ্ধ হইল। অহোমরা ৪০০ হাতি লইয়া মুসলমান অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিল এবং এই যুদ্ধে তাহারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হইয়া দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিল। প্রায় এই সময়েই ফিরোজ শাহ প্রায় এক বৎসর রাজত্ব করিবার পর তাঁহার পিতৃব্য গিয়াসুদ্দীন মাহমূদের হস্তে নিহত হন। অতঃপর গিয়াসুদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করেন।

গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ

‘রিয়াজ’-এর মতে গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ নসরৎ শাহের কাছে ‘আমীর’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু মাহমূদ শাহ সম্ভবত নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিলেন–মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে এই কথা মনে হয়। গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহের পূর্ব নাম আবদুল বদ্। তিনি আব্‌দ্ শাহ ও বদর শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন।

গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ শের শাহ ও হুমায়ুনের সমসাময়িক। তাঁহাদের সহিত মাহমুদ শাহের ভাগ্য পরিণামে এক সূত্রে জড়িত হইয়া পড়িয়াছিল। প্রামাণিক ইতিহাসগ্রন্থগুলি হইতে এ সম্বন্ধে যাহা জানা যায়, তাঁহার সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।

গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ বিহার প্রদেশ আফগানদের নিকট হইতে জয় করিবার পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে কুত্ত্ব খান নামে একজন সেনাপতিকে প্রেরণ করেন। শের খান সূর ইহার বিরুদ্ধে প্রথমে ব্যর্থ প্রতিবাদ জানান, তারপর অন্যান্য আফগানদের সঙ্গে মিলিয়া কুত্ত্ব খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে বধ করেন। বাংলার সুলতানের অধীনস্থ হাজীপুরের সরলস্কর মখদূম-ই-আলম (মাহমূদ শাহের ভগ্নীপতি) মাহমূদ শাহ্ ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করিয়া সুলতান হওয়ার জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে ত্রিহুতে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন; মখদূম-ই-আলম ছিলেন শের খানের বন্ধু। তিনি কুত্ত্ব খানকে সাহায্য করেন নাই, এই অপরাধে মাহমূদ শাহ তাঁহার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। এইসময়ে শের খান বিহারের অধিপতি নাবালক জলাল খান লোহানীর অমাত্য ও অভিভাবক ছিলেন। শের খানের কাছে নিজের ধনসম্পত্তি জিম্মা রাখিয়া মখদূম-ই-আলম মাহমূদ শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে গেলেন, এই যুদ্ধে তিনি নিহত হইলেন।

এদিকে জলাল খান লোহানী শের খানের অভিভাবকত্ব সহ্য করিতে না পারিয়া মাহমূদের কাছে গিয়া তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিলেন এবং তাহাকে অনুরোধ জানাইলেন শের খানকে দমন করিতে। মাহমূদ জলাল খানের সহিত কুত্ত্ব খানের পুত্র ইব্রাহিম খানকে বহু সৈন্য, হাতি ও কামান সঙ্গে দিয়া শের খানের বিরুদ্ধে পাঠাইলেন। শের খানও সসৈন্যে অগ্রসর হইলেন। পূর্ব বিহারের সূরজগড়ে দুই পক্ষের সৈন্য পরস্পরের সম্মুখীন হইল। শের খান চারিদিকে মাটির প্রাকার তৈরী করিয়া ছাউনী ফেলিলেন; ঐ ছাউনী ঘিরিয়া ফেলিয়া ইব্রাহিম খান তোপ বসাইলেন এবং মাহমূদ শাহকে নূতন সৈন্য পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন। প্রাকারের মধ্য হইতে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করিয়া শের খান ইব্রাহিমকে দূত মারফৎ জানাইলেন যে পর দিন সকালে তিনি আক্রমণ করিবেন; তারপর তিনি প্রকারের মধ্যে অল্প সৈন্য রাখিয়া অন্য সৈন্যদের লইয়া উঁচু জমির আড়ালে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সকালে ইব্রাহিম খানের সৈন্যদের প্রতি একবার তীর ছুঁড়িয়া শের খানের অশ্বারোহী সৈন্যেরা পিছু হটিল; তাহারা পলাইতেছে ভাবিয়া বাংলার অশ্বারোহী সৈন্যেরা তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিল। তখন শের খান তাঁহার লুক্কায়িত সৈন্যদের লইয়া বাংলার সৈন্যদের আক্রমণ করিলেন, তাহারা স্থিরভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত পরাজিত হইল এবং ইব্রাহিম খান নিহত হইলেন। বাংলার বাহিনীর হাতি, তোপ ও অর্থ-ভাণ্ডার সব কিছুই শের খানের দখলে আসিল। ইহার পর শের খান তেলিয়াগড়ি (সাহেবগঞ্জের নিকটে অবস্থিত) পর্যন্ত মাহমূদ শাহের অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল অধিকার করিলেন। মাহমূদ শাহের সেনাপতিরা–বিশেষত পর্তুগীজ বীর জোআঁ-দে-ভিল্লালোবোস ও জোআঁ কোরীয়া–শের খানকে তেলিয়াগড়ি ও সকরিগলি গিরিপথ পার হইতে দিলেন না। তখন শের খান অন্য এক অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত পথ দিয়া বাংলা দেশে প্রবেশ করিলেন এবং ৪০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য, ১৬,০০০ হাতি, ২০,০০০ পদাতিক ও ৩০০ নৌকা লইয়া রাজধানী গৌড় আক্রমণ করিলেন। নির্বোধ মাহমূদ শাহ তখন ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া শের খানের সহিত সন্ধি করিলেন। শের খান তখনকার মত ফিরিয়া গেলেন। ইহার পর তিনি মাহমুদ শাহেরই অর্থে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করিয়া এক বৎসর বাদে মাহমুদের কাছে “সার্বভৌম নৃপতি হিসাবে তাঁহার প্রাপ্য নজরানা বাবদ” এক বিরাট অর্থ দাবি করিলেন এবং মাহমূদ তাহা দিতে রাজী না হওয়ায় তিনি আবার গৌড় আক্রমণ করিলেন। শের খানের পুত্র জলাল খান এবং সেনাপতি খওয়াস খানের নেতৃত্বে প্রেরিত এক সৈন্যবাহিনী গৌড় নগরীর উপর হানা দিয়া নগরীটি ভস্মীভূত করিল এবং সেখানে লুঠ চালাইয়া ষাট মণ সোনা হস্ত গত করিল।

এই সময়ে হুমায়ুন শের খানকে দমন করিবার জন্য বিহার অভিমুখে রওনা হইয়াছিলেন। তিনি চুনার দুর্গ জয় করিয়াছেন, এই সংবাদ শুনিয়া শের খান বিচলিত হইলেন। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা রোটাস দুর্গ জয় করিয়াছিলেন। মাহমূদ শাহ গৌড় নগরীকে প্রাকার ও পরিখা দিয়া ঘিরিয়া আত্মরক্ষা করিতেছিলেন। শের খানের সেনাপতি খওয়াস খান একদিন পরিখায় পড়িয়া মারা গেলেন। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মোসাহেব খানকে ‘খওয়াস খান’ উপাধি দিয়া শের খান গৌড়ে পাঠাইলেন। ইনি ৬ই এপ্রিল, ১৫৩৮ খ্রী তারিখে গৌড় নগরী জয় করিলেন। তখন শের খানের পুত্র জলাল খান মাহমূদের পুত্রদের বন্দী করিলেন; মাহমূদ শাহ স্বয়ং পলায়ন করিলেন, শের খান তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করায় মাহমুদ শের খানের সহিত যুদ্ধ করিলেন এবং এই যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হইলেন। শের খান হুমায়ুনের নিকট দূত পাঠাইলেন, কিন্তু মাহমূদ হুমায়ুনের সাহায্য চাহিলেন এবং তাঁহাকে জানাইলেন যে শের খান গৌড় নগরী অধিকার করিলেও বাংলার অধিকাংশ তাঁহারই দখলে আছে। হুমায়ুন মাহমূদের প্রস্তাবে রাজী হইয়া গৌড়ের দিকে রওনা হইলেন। শের খান বকুণ্ডা দুর্গে গিয়াছিলেন; তাঁহার বিরুদ্ধে হুমায়ুন এক বাহিনী পাঠাইলেন। তখন শের খান তাঁহার বাহিনীকে রোটাস দুর্গে পাঠাইয়া স্বয়ং পার্ব্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় লইলেন। শোণ ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে আহত মাহমূদ শাহের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া হুমায়ুন গৌড়ের দিকে রওনা হইলেন। জলাল খান হুমায়ুনকে তেলিয়াগড়ি গিরিপথে এক মাস আটকাইয়া রাখিয়া অবশেষে পথ ছাড়িয়া দিলেন। এই এক মাসে শের খান গৌড় নগরের লুণ্ঠনলব্ধ ধনসম্পত্তি লইয়া ঝাড়খণ্ড হইয়া রোটাস দুর্গে গমন করেন। হুমায়ুন তেলিয়াগড়ি গিরিপথ অধিকার করিবার পরেই গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের মৃত্যু হইল। অতঃপর হুমায়ুন বিনা বাধায় গৌড় অধিকার করেন (জুলাই, ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বাংলার সৈন্যবাহিনী আসামে যে অভিযান শুরু করিয়াছিল, মাহমূদ শাহের রাজত্বকালে তাহা ব্যর্থতার মধ্য দিয়া সমাপ্ত হয়। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার বাহিনী অসমীয়া বাহিনীকে পরাস্ত করিয়া সালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য করিয়াছিল। অসমীয়া বুরঞ্জী হইতে জানা যায়, ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার মুসলমানরা জল ও স্থলে তিন দিন তিন রাত্রি অবিরাম আক্রমণ চালাইয়াও সালা দুর্গ অধিকার করিতে পারে নাই। ইহার পর অসমীয়া বাহিনী বুরাই নদীর মোহনায় মুসলমান নৌবাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করে। মুসলমানরা আর একবার সালা জয় করিবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হয়। ইহার পর তাহারা দুইমুনিশিলার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়; তাহাদের ২০টি জাহাজ অসমীয়ারা জয় করে এবং মুসলমানদের অন্যতম সেনাপতি ও ২৫০০ সৈন্য নিহত হয়।

ইহার পর হোসেন খানের নেতৃত্বে একদল নূতন শক্তিশালী সৈন্য যুদ্ধে যোগ দেয়। ইহাতে মুসলমানরা উৎসাহিত হইয়া অনেকদূর অগ্রসর হয়। কিছুদিন পরে ডিকরাই নদীর মোহনায় দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হইল; তাহাদের মধ্যে অনেকে নিহত হইল; অনেকে শত্রুদের হাতে ধরা পড়িল। ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে হোসেন খান অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া ভরালি নদীর কাছে অসমীয়া বাহিনীকে দুঃসাহসিকভাবে আক্রমণ করিতে গিয়া নিহত হইলেন, তাঁহার বাহিনীও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।

আসাম-অভিযানে ব্যর্থতার পরে মুসলমানরা পূর্বদিক হইতে অসমীয়াদের এবং পশ্চিম দিক হইতে কোচদের চাপ সহ্য করিতে না পারিয়া কামরূপও ত্যাগ করিতে বাধ্য হইল।

গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের রাজত্বকালেই পর্তুগীজরা বাংলা দেশে প্রথম বাণিজ্যের ঘাঁটি স্থাপন করে। পর্তুগীজ বিবরণগুলি হইতে জানা যায় যে, ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে গোঁয়ার পর্তুগীজ গভর্নর নুনো-দা-কুনহা খাজা শিহাবুদ্দীনকে সাহায্য করিবার ও বাংলায় বাণিজ্য আরম্ভ করিবার জন্য মারতিম-আফসো-দে-মেলোকে পাঠান। পাঁচটি জাহাজ ও ২০০ লোক লইয়া চট্টগ্রামে পৌঁছিয়া দে-মেলো বাংলার সুলতানকে ১২০০ পাউণ্ড মূল্যের উপহার পাঠান। সদ্য ভ্রাতুষ্পুত্ৰ-হত্যাকারী মাহমূদ শাহের মন তখন খুব খারাপ। পর্তুগীজদের উপহারের মধ্যে মুসলমানদের জাহাজ হইতে লুট করা কয়েক বাক্স গোলাপ জল আছে আবিষ্কার করিয়া তিনি পর্তুগীজদের বধ করিতে মনস্থ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি পর্তুগীজ দূতদের বধ করিয়া বন্দী করেন। অন্যান্য পর্তুগীজদের বন্দী করিবার জন্য তিনি চট্টগ্রামে একজন লোক পাঠান। এই লোকটি চট্টগ্রামে আসিয়া আফলো-দে-মেলো ও তাঁহার অনুচরদের নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করিল। ভোজসভায় একদল সশস্ত্র মুসলমান পর্তুগীজদের আক্রমণ করিল। দে-মেলো বন্দী হইলেন। তাঁহার ৪০ জন অনুচরের অনেকে যুদ্ধ করিয়া নিহত হইলেন, অন্যেরা বন্দী হইলেন; যাঁহারা নিমন্ত্রণে আসেন নাই, তাহারা সমুদ্রতীরে শূকর শিকার করিতেছিলেন। অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হইয়া তাঁহাদের কেহ নিহত, কেহ বন্দী হইলেন। পর্তুগীজদের এক লক্ষ পাউণ্ড মুল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া হতাবশিষ্ট ত্রিশজন পর্তুগীজকে লইয়া মুসলমানরা প্রথমে অন্ধকূপের মত ঘরে বিনা চিকিৎসায় আটক করিয়া রাখিল, তাঁহার পর সারারাত্রি হাঁটাইয়া মাওয়া নামক স্থানে লইয়া গেল এবং তাঁহার পর তাহাদের গৌড়ে লইয়া গিয়া পশুর মত ব্যবহার করিয়া নরক-তুল্য স্থানে আটক করিয়া রাখিল।

পর্তুগীজ গর্ভনর এই কথা শুনিয়া ক্রুদ্ধ হইলেন। তাঁহার দূত আন্তোনিও-দে সিভা-মেনেজেস ৯টি জাহাজ ও ৩৫০ জন লোক লইয়া চট্টগ্রামে আসিয়া মাহমূদ শাহের কাছে দূত পাঠাইয়া বন্দী পর্তুগীজদের মুক্তি দিতে বলিলেন; না দিলে যুদ্ধ করিবেন বলিয়াও জানাইলেন; মাহমূদ ইহার উত্তরে গোঁয়ার গভর্নরকে ছুতার, মণিকার ও অন্যান্য মিস্ত্রী পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন, বন্দীদের মুক্তি দিলেন না। মেনেজেসের দূতের গৌড় হইতে চট্টগ্রামে ফিরিতে মাসাধিককাল দেরী হইল; ইহাতে অধৈর্য হইয়া মেনেজেস চট্টগ্রামের এক বৃহৎ অঞ্চলে আগুন লাগাইলেন এবং বহু লোককে বন্দী ও বধ করিলেন। তখন মাহমূদ মেনেজেসের দূতকে বন্দী করিতে আদেশ দিলেন, কিন্তু দূত ততক্ষণে মেনেজেসের কাছে পৌঁছিয়া গিয়াছে।

ঠিক এই সময়ে শের খান সূর বাংলা আক্রমণ করেন। তাঁহার ফলে মাহমুদ শাহ গৌড়ের পর্তুগীজ বন্দীদের বধ না করিয়া তাহাদের কাছে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাহিলেন। ইতিমধ্যে দিয়াগো-রেবেলো নামে একজন পর্তুগীজ নায়ক তিনটি জাহাজসহ গোয়া হইতে সপ্তগ্রামে আসিয়া মাহমূদ শাহকে বলিয়া পাঠাইলেন যে পর্তুগীজ বন্দীদের মুক্তি না দিলে তিনি সপ্তগ্রামে ধ্বংসকাণ্ড বাধাইবেন। মাহমূদ তখন অন্য মানুষ। তিনি পর্তুগীজ দূতকে খাতির করিলেন এবং রেবেলোকে খাতির করিবার জন্য সপ্তগ্রামের শাসনকর্ত্তাকে বলিয়া পাঠাইলেন। গোঁয়ার গভর্নরের কাছে দূত পাঠাইয়া তিনি শের খানের বিরুদ্ধে সাহায্য চাহিলেন এবং তাঁহার বিনিময়ে বাংলায় পর্তুগীজদের কুঠি ও দুর্গ নির্মাণ করিতে দিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। রেবেলোর কাছে তিনি ২১ জন পর্তুগীজ বন্দীকে ফেরৎ পাঠাইলেন এবং আফন্সে-দে-মেলোর পরামর্শ প্রয়োজন বলিয়া তাঁহাকে রাখিয়া দিলেন। মাহমূদ ও দে-মেলো উভয়ের নিকট হইতে পত্র পাইয়া পর্তুগীজ গভর্নর মাহমূদকে সাহায্য পাঠাইয়া দিলেন। শের খানের বিরুদ্ধে জোআঁ দে ভিল্লাললাবোস ও জোআঁ কোরীআর নেতৃত্বে দুই জাহাজ পর্তুগীজ সৈন্য যুদ্ধ করিল, তাহারা শের খানকে “গরিজ” (‘গড়ি’ অর্থাৎ তেলিয়াগড়ি) দুর্গ ও “ফারানডুজ” (পাণ্ডুয়া?) শহর অধিকার করিতে দিল না। শের খানের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইলেও মাহমূদ পর্তুগীজদের বীরত্ব দেখিয়া খুশী হইলেন। আফসো-দে-মেলোকে তিনি বিস্তর পুরস্কার দিলেন। তাঁহার নিকট হইতে পর্তুগীজরা অনেক জমি ও বাড়ী পাইল এবং কুঠি ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমতি পাইল। চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে তাহারা দুইটি শুল্কগৃহ স্থাপন করিল। চট্টগ্রামেরটি বড় শুল্কগৃহ, অপরটি ছোট। পর্তুগীজরা স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীদের কাছে খাজনা আদায়ের অধিকার এবং আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভ করিল। সুলতান পর্তুগীজদের এত সুবিধা ও ক্ষমতা দিতেছেন দেখিয়া সকলেই আশ্চর্য হইল। বলা বাহুল্য ইহার ফল ভাল হয় নাই। কারণ বাংলা দেশে এইরূপ শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করিবার পরেই পর্তুগীজরা বাংলার নদীপথে ভয়াবহ অত্যাচার করিতে সুরু করে।

পর্তুগীজরা ঘাঁটি স্থাপনের পর দলে দলে পর্তুগীজ বাংলায় আসিতে লাগিল। কিন্তু কাম্বের সহিত পর্তুগীজদের যুদ্ধ বাধায় পর্তুগীজ গভর্নর আফসো-দে মেলোকে ফেরৎ চাহিলেন এবং মাহমূদকে বলিলেন যে এখন তিনি বাংলায় সাহায্য পাঠাইতে পারিতেছেন না, পরের বৎসর পাঠাইবেন। মাহমূদ পাঁচজন পর্তুগীজকে সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতির জামিন স্বরূপ রাখিয়া দে-মেলো সমেত অন্যান্যদের ছাড়িয়া দিলেন। ইহার ঠিক পরেই শের শাহ আবার গৌড় আক্রমণ ও অধিকার করেন। পর্তুগীজ গভর্নর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাহমূদকে সাহায্য করিবার জন্য ৯ জাহাজ সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু এই নয়টি জাহাজ যখন চট্টগ্রামে পৌঁছিল, তাঁহার পূর্বেই মাহমূদ শের খানের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া পরলোকগমন করিয়াছেন।

গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ নিষ্ঠুরভাবে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে বধ করিয়া সুলতান হইয়াছিলেন। তিনি যে অত্যন্ত নির্বোধও ছিলেন, তাহা তাঁহার সমস্ত কার্যকলাপ হইতে বুঝিতে পারা যায়। ইহা ভিন্ন তিনি যৎপরোনাস্তি ইন্দ্রিয়পরায়ণও ছিলেন; সমসাময়িক পর্তুগীজ বণিকদের মতে তাঁহার ১০,০০০ উপপত্নী ছিল।

মাহমূদ শাহের কর্মচারীদের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বিখ্যাত পদকর্ত্তা কবিশেখর-বিদ্যাপতি যে মাহমূদ শাহের কর্মচারী ছিলেন, তাহা ‘বিদ্যাপতি’ নামাঙ্কিত একটি পদের ভণিতা হইতে অনুমিত হয়।

০৭. বাংলার মুসলিম রাজত্বের প্রথম যুগের রাজ্যশাসনব্যবস্থা (১২০৪-১৫৩৮ খ্রী)

সপ্তম পরিচ্ছেদ – বাংলার মুসলিম রাজত্বের প্রথম যুগের রাজ্যশাসনব্যবস্থা (১২০৪-১৫৩৮ খ্রী)

১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলা দেশে প্রথম মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় হইতে ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা কার্যত স্বাধীন থাকে, যদিও বখতিয়ার ও তাঁহার কোন কোন উত্তরাধিকারী দিল্লির সুলতানের নামমাত্র অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। এই সময়কার শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এইটুকু মাত্র জানা যায় যে, বাংলার এই মুসলিম রাজ্যের দ উল্-মুলক (রাজধানী) ছিল কখনও লখনৌতি, কখনও দেবকোট এবং এই রাজ্য কতকগুলি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এই অঞ্চলগুলিকে ‘ইক্তা’ বলা হইত এবং এক একজন আমীর এক একটি ইক্তা’র ‘মোক্তা অর্থাৎ শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইতেন। রাজ্যটি লখনৌতি’ নামে পরিচিত ছিল। এই সময়ের মধ্যে বোধ হয়। আলী মর্দানই প্রথম নিজেকে সুলতান বলিয়া ঘোষণা করেন এবং নিজের নামে খুত্ব পাঠ করান। তাঁহার পরবর্তী সুলতান গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ মুদ্রাও উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন। তাঁহার মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। সে সব-মুদ্রায় সুলতানের নামের সঙ্গে বাগদাদের খলিফার নামও উত্তীর্ণ আছে।

১২২৭ হইতে ১২৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত লখনৌতি রাজ্য মোটামুটিভাবে দিল্লির সুলতানের অধীন ছিল, যদিও মাঝে মাঝে কোন কোন শাসনকর্ত্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন। এই সময়ে সমগ্র লখনৌতি রাজ্যই দিল্লির অধীনে একটি ‘ইক্তা’ বলিয়া গণ্য হইত।

বলবন তুঘিল খাঁর বিদ্রোহ দমন করিয়া তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। (১২৮০ খ্রী)। ১২৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান স্বাধীন হন। লখনৌতি রাজ্যের এই স্বাধীনতা ১৩২২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। এই সময়ে সমগ্র লখনৌতি রাজ্যকে ‘ইকলিম লখনৌতি’ বলা হইত এবং উহা অনেকগুলি ‘ইক্তা’য় বিভক্ত ছিল। পূর্ববঙ্গের যে অংশ এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহাকে ‘অহ্ বঙ্গালহ্’ বলা হইত। এই সময়ে কোন কোন আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তা অত্যন্ত ক্ষমতাবান হইয়া উঠিয়াছিলেন।

১৩২২ খ্রীষ্টাব্দে মুহম্মদ তুগলক বাংলা দেশ অধিকার করিয়া উহাকে লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও-এই তিনটি ইক্তায় বিভক্ত করেন।

১৩৩৮ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার দ্বিশতবর্ষব্যাপী স্বাধীনতা সুরু হয় এবং ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার অবসান ঘটে। সমসাময়িক সাহিত্য, শিলালিপি ও মুদ্রা হইতে এই সময়ের শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

এই সময় হইতে বাংলার মুসলিম রাজ্য ‘লখনৌতি’র পরিবর্তে ‘বঙ্গালহ্’ নামে অভিহিত হইতে সুরু করে। এই রাজ্যের সুলতানরা ছিলেন স্বাধীন এবং সর্বশক্তিমান। প্রথম দিকে বাঁহারা খলিফার আনুষ্ঠানিক আনুগত্য স্বীকার করিতেন; জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ কিন্তু নিজেকেই ‘খলীফৎ আল্লাহ্’ (আল্লার খলিফা) বলিয়া ঘোষণা করেন এবং তাঁহার পরবর্তী কয়েকজন সুলতান এ ব্যাপারে তাহাকে অনুসরণ করেন।

সুলতান বাস করিতেন বিরাট রাজপ্রাসাদে। সেখানেই প্রশস্ত দরবার-কক্ষে তাঁহার সভা অনুষ্ঠিত হইত। শীতকালে কখনও কখনও উন্মুক্ত অঙ্গনে সুলতানের সভা বসিত। সভায় সুলতানের পাত্রমিত্রসভাসদরা উপস্থিত থাকিতেন। চীনা বিবরণী শিং-ছা-শ্যং-লান’ এবং কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনীতে বাংলার সুলতানের সভার মনোরম বর্ণনা পাওয়া যায়।

সুলতানের প্রাসাদে সুলতানের হাজিব’, ‘সিলাহ্দার’, শরাবদার’, ‘জমাদার, ‘দরবান’ প্রভৃতি কর্মচারীরা থাকিতেন। হাজিব’রা সভার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন; “সিলাদার’রা সুলতানের বর্ম্ম বহন করিতেন; শরাবদার’রা সুলতানের সুরাপানের ব্যবস্থা করিতেন; জমাদার’রা ছিলেন তাঁহার পোশাকের তত্ত্বাবধায়ক এবং ‘দরবান’রা প্রাসাদের ফটকে পাহারা দিত। ইহা ভিন্ন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে ছত্রী’ উপাধিধারী এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়; ইঁহারা সম্ভবত সভায় যাওয়ার সময় সুলতানের ছত্র ধারণ করিতেন; মালাধর বসু (গুণরাজ খান), কেশব বসু (কেশব খান) প্রভৃতি হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে ছত্রীর পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। সুলতানের চিকিৎসক সাধারণত বৈদ্য-জাতীয় হিন্দু হইতেন; তাঁহার উপাধি হইত ‘অন্তরঙ্গ। কয়েকজন সুলতানের হিন্দু সভাপণ্ডিতও ছিল। সুলতানের প্রাসাদে অনেক ক্রীতদাস থাকিত। ইহারা সাধারণত খোঁজা অর্থাৎ নপুংসক হইত।

সুলতানের অমাত্য, সভাসদ ও অন্যান্য অভিজাত রাজপুরুষগণ আমীর মালিক প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত হইতেন। ইঁহাদের ক্ষমতা নিতান্ত অল্প ছিল না, বহুবার ইহাদের ইচ্ছায় বিভিন্ন সুলতানের সিংহাসনলাভ ও সিংহাসনচ্যুতি ঘটিয়াছে। কোন সুলতানের মৃত্যুর পর তাঁহার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারীর সিংহাসনে আরোহণের সময়ে আমীর, মালিক ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন আবশ্যক হইত।

রাজ্যের বিশিষ্ট পদাধিকারিগণ উজীর’ আখ্যা লাভ করিতেন। উজীর’ বলিতে সাধারণত মন্ত্রী বুঝায়, কিন্তু আলোচ্য সময়ে অনেক সেনানায়ক এবং আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তাও ‘উজীর’ আখ্যা লাভ করিয়াছেন দেখিতে পাওয়া যায়। যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে বাংলার সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করা হইত; তাঁহাদের উপাধি ছিল লস্কর-উজীর,; কখনও কখনও তাহারা শুধুমাত্র ‘লস্কর’ নামেও অভিহিত হইতেন। সুলতানের প্রধান মন্ত্রীরা (অন্তত কেহ কেহ) ‘খান-ই-জহান’ উপাধি লাভ করিতেন। প্রধান আমীরকে বলা হইত ‘আমীর-উল-উমারা’।

সুলতানের মন্ত্রী, অমাত্য ও পদস্থ কর্মচারিগণ খান মজলিস’, ‘মজলিস-অল আলা’, ‘মজলিস-আজম’, ‘মজলিস-অল-মুআজ্জম’, মজলিস-অল-মজালিস’, মজলিস-বারবক’ প্রভৃতি উপাধি লাভ করিতেন।

সুলতানের সচিব (সেক্রেটারী)-দের বলা হইত ‘দবীর। প্রধান সেক্রেটারীকে ‘দবীর খাস’ (দবীর-ই-খাস) বলা হইত।

‘বঙ্গালহ্’ রাজ্য আলোচ্য সময়ে কতকগুলি ‘ইকলিম’-এ বিভক্ত ছিল।

প্রতিটি ইকলিম’-এর আবার কতকগুলি উপবিভাগ ছিল, ইহাদের বলা হইত ‘অসহ’। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে রাজ্যের উপবিভাগগুলিকে ‘মুলুক’ এবং তাহাদের শাসনকর্ত্তাদিগকে ‘মুলুক-পতি’ ও ‘অধিকারী’ বলা হইয়াছে। মুলুক’ ও ‘অসহ্’ সম্ভবত একার্থক, কিংবা হয়ত ‘অসহ্’র উপবিভাগের নাম ছিল মুলুক’ (মুল)। কোন কোন প্রাচীন বাংলা গ্রন্থে (যেমন, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে)মুলুক এর একটি উপবিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁহার নাম তকসিম।

আলোচ্য যুগে দুর্গহীন শহরকে বলা হইত কাহ্’ এবং দুর্গযুক্ত শহরকে বলা হইত ‘খিটাহ’। সীমান্তরক্ষার ঘটিকে বলা হইত ‘থানা’। বঙ্গালহ্’ রাজ্যটি অনেকগুলি রাজস্ব-অঞ্চলে বিভক্ত ছিল; এই অঞ্চলগুলিকে ‘মহল’ বলা হইত; কয়েকটি মহল’ লইয়া এক একটি ‘শিক’ গঠিত হইত; ‘শিকদার’ নামক কর্মচারীরা ইহাদের ভারপ্রাপ্ত হইতেন। রাজস্ব দুই ধরণের হইত-গনীমাহ্’ অর্থাৎ লুণ্ঠনলব্ধ অর্থ এবং খরজ’ অর্থাৎ খাজনা। সাধারণত যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে সৈন্যেরা লুঠ করিয়া যে অর্থ সংগ্রহ করিত, তাঁহার চারি-পঞ্চমাংশ সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বণ্টিত হইত এবং এক-পঞ্চমাংশ রাজকোষে যাইত, ইহাই ‘গনীমাহ্। খরজ’ এক বিচিত্র পদ্ধতিতে সংগৃহীত হইত। সুলতান বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির উপর ঐ অঞ্চলের খরজ’ সংগ্রহের ভার দিতেন-যেমন হোসেন শাহ দিয়াছিলেন হিরণ্য ও গোবর্ধন মজুমদারকে। ইঁহারা সপ্তগ্রাম মুলুকের জন্য বিশ লক্ষ টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া হোসেন শাহকে বার লক্ষ টাকা দিতেন এবং বাকী আট লক্ষ টাকা নিজেদের আইনসঙ্গত প্রাপ্য হিসাবে গ্রহণ করিতেন। সুলতানের প্রাপ্য অর্থ লইয়া যাইবার জন্য রাজধানী হইতে যে কর্মচারীরা আসিত, তাহাদের ‘আরিন্দা বলা হইত। সুলতানের রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারীর উপাধি ছিল ‘সর-ই গুমাশতাহ’; জলপথে যে সব জিনিস আসিত, সুলতানের কর্মচারীরা তাহাদের উপর শুল্ক আদায় করিতেন, যে সব ঘাটে এই শুল্ক আদায় করা হইত, তাহাদের বলা হইত কুতঘাট’। বিভিন্ন শহরে ও নদীর ঘাটে সুলতানের বহু কর্মচারী রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত ছিল। সে যুগে হাটকর’, ‘ঘাটকর’, ‘পথকর’ প্রভৃতি করও ছিল বলিয়া মনে হয়। অনেক জিনিস অবাধে বাহির হইতে বাংলায় লইয়া আসা বা বাংলা হইতে বাহিরে লইয়া যাওয়া যাইত না, যেমন চন্দন। আলোচ্য সময়ে বাংলায় অমুসলমানদের নিকট হইতে ‘জিজিয়া কর আদায় করা হইত বলিয়া কোন প্রমাণ মিলে না।

রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুলতান স্বয়ং। বিভিন্ন অভিযানের সময়ে যে সব বাহিনী প্রেরিত হইত, তাহাদের অধিনায়কদিগকে ‘সর-ই-লস্কর’ বলা হইত।

সৈন্যবাহিনী চারি ভাগে বিভক্ত ছিল–অশ্বারোহী বাহিনী, গজারোহী বাহিনী, পদাতিক বাহিনী এবং নৌবহর। বাংলার পদাতিক সৈন্যদের বিশিষ্ট নাম ছিল ‘পাইক’, ইহারা সাধারণত স্থানীয় লোক হইত এবং খুব ভাল যুদ্ধ করিত।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত বাংলার সৈন্যেরা প্রধানত তীর-ধনুক দিয়াই যুদ্ধ করিত। ইহা ভিন্ন তাহারা বর্শা, বল্লম ও শূল প্রভৃতি অস্ত্রও ব্যবহার করিত। শর ও শূল ক্ষেপণের যন্ত্রের নাম ছিল যথাক্রমে “আরাদা” ও “মালিক”। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক হইতে বাংলার সৈন্যেরা কামান চালনা করিতে শিখে এবং ১৫২৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই কামান-চালনায় দক্ষতার জন্য দেশবিদেশে খ্যাতি অর্জন করে।

বাংলার সৈন্যবাহিনীতে দশ জন অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া এক একটি দল গঠিত হইত। তাহাদের নায়কের উপাধি ছিল ‘সর-ই-খেল। বুঘরা খান তাঁহার পুত্র কায়কোবাদকে বলিয়াছিলেন, প্রত্যেক খানের অধীনে দশজন মালিক, প্রত্যেক মালিকের অধীনে দশজন আমীর, প্রত্যেক আমীরের অধীনে দশজন সিপাহ্-সলার, প্রত্যেক সিপাহ্-সলারের অধীনে দশজন সর-ই-খেল এবং প্রত্যেক সর-ই-খেলের অধীনে দশজন অশ্বারোহী সৈন্য থাকিবে। এই নীতি ঠিকমত পালিত হইত কিনা, তাহা বলিতে পারা যায় না।

বাংলার নৌবহরের অধিনায়ককে বলা হইত ‘মীর বহর। বাংলার সৈন্যবাহিনীর শক্তি জোগাইত রণহস্তীগুলি। সে সময়ে বাংলার হস্তীর মত এত ভাল হস্তী ভারতবর্ষের আর কোথাও পাওয়া যাইত না।

সৈন্যেরা তখন নিয়মিত বেতন ও খাদ্য পাইত। সৈন্যবাহিনীর বেতনদাতার উপাধি ছিল আরিজ-ই-লস্কর।

আলোচ্য সময়ের বিচার-পদ্ধতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কাজীরা বিভিন্ন স্থানে বিচারের জন্য নিযুক্ত ছিলেন এবং তাঁহারা ঐস্লামিক বিধান অনুসারে বিচার করিতেন, এইটুকুমাত্র জানা যায়। কোন কোন সুলতান স্বয়ং কোন কোন মামলার বিচার করিতেন। অপরাধীদের জন্য যে সব শাস্তির ব্যবস্থা ছিল, তাহাদের মধ্যে প্রধান ছিল বংশদণ্ড দিয়া প্রহার ও নির্বাসন। রাজদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইত। কোন মুসলমান হিন্দুর দেবতার নাম করিলে তাহাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হইত এবং কখনও কখনও বিভিন্ন বাজারে লইয়া গিয়া তাহাকে বেত্রাঘাত করা হইত। সুলতানদের “বন্দিঘর”-ও ছিল, কখনও কখনও হিন্দু জমিদারদিগকে সেখানে আটক করা হইত।

স্বাধীন সুলতানদের আমলে শুধু মুসলমানরা নহে, হিন্দুরাও শাসনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করিতেন। এমন কি, তাঁহারা বহু মুসলমান কর্মচারীর উপরে ‘ওয়ালি’ (প্রধান তত্ত্বাবধায়ক)-ও নিযুক্ত হইতেন। বাংলার সুলতানের মন্ত্রী, সেক্রেটারী, এমনকি সেনাপতির পদেও বহু হিন্দু নিযুক্ত হইয়াছিলেন।

 ০৮. হুমায়ুন ও আফগান রাজত্ব

অষ্টম পরিচ্ছেদ – হুমায়ুন ও আফগান রাজত্ব

হুমায়ুন

গৌড়ে প্রবেশের পর হুমায়ুন এই বিধ্বস্ত নগরীর সংস্কারসাধনে ব্রতী হন। তিনি ইহার রাস্তাঘাট, প্রাসাদ ও দেওয়ালগুলি মেরামত করিয়া এখানেই কয়েকমাস অবস্থান করেন। গৌড় নগরীর সৌন্দর্য এবং এখানকার জলহাওয়ার উৎকর্ষ দেখিয়া হুমায়ুন মুগ্ধ হইলেন। বাংলার রাজধানীর “গৌড়” নামের অর্থ ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে হুমায়ুন অবহিত ছিলেন না। তিনি ভাবিলেন যে ঐ শহরের নাম “গোর” (অর্থাৎ ‘কবর’)। এইজন্য তিনি “গৌড়” নগরীর নাম পরিবর্তন করিয়া জন্নতাবাদ’ (স্বর্গীয় নগর) রাখিলেন। অবশ্য এ নাম বিশেষ চলিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। অতঃপর হুমায়ুন বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশ তাঁহার কর্মচারীদের জায়গীর দান করিয়া এবং বিভিন্ন স্থানে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করিয়া বিলাসব্যসনে মগ্ন হইলেন।

কিন্তু ইহার অল্পকাল পরেই আফগাননায়ক শের খান সূর দক্ষিণ বিহার অধিকার করিয়া লইলেন এবং কাশী হইতে বহরাইচ পর্যন্ত যাবতীয় মোগল অধিকারভুক্ত অঞ্চলে বারবার হানা দিতে লাগিলেন। তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্যরা গৌড় নগরীর আশপাশের উপরেও হানা দিতে লাগিল এবং ঐ নগরীর খাদ্য সরবরাহ-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করিতে লাগিল। ইয়াকুব বেগের অধীন ৫০০০ মোগল অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনীকে তাহারা পরাস্ত করিল, কিন্তু শেখ বায়াজিদ তাহাদিগকে বিতাড়িত করিলেন। হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের আর্দ্র জলবায়ু এবং ভোগবিলাসের ফলে ক্রমশ অকর্মণ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। এদিকে হুমায়ুনের ভ্রাতা মির্জা হিন্দাল আগ্রায় বিদ্রোহ করিলেন। হুমায়ুনের অপর ভ্রাতা আসকারি হুমায়ুনের কাছে ক্রমাগত বাংলার মসলিন, খোঁজা এবং হাতি চাহিয়া চাহিয়া বিরক্ত করিতে লাগিলেন এবং আসকারির অধীন কর্মচারী ও সেনানায়কেরা বর্ধিত বেতন, উচ্চতর পদ এবং নগদ অর্থ প্রভৃতির দাবি জানাইতে লাগিলেন। হুমায়ুনের অমাত্য ও সেনানায়কেরাও খুবই দুর্বিনীত হইয়া উঠিয়াছিলেন। ইহাদের অন্যতম জাহিদ বেগকে যখন হুমায়ুন বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন, তখন জাহিদ বেগ তাহা প্রত্যাখ্যান করেন।

শেষপর্যন্ত হুমায়ুন জাহাঙ্গীর কুলী বেগকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন এবং স্বয়ং গৌড় ত্যাগ করিলেন। মুঙ্গেরে তিনি আসকারির অধীনস্থ বাহিনীর সহিত মিলিত হইলেন এবং গঙ্গার তীর ধরিয়া মুঙ্গেরে গেলেন। চৌসায় হুমায়ুনের সহিত শের খানের যে যুদ্ধ হইল, তাহাতে হুমায়ুন পরাজিত হইলেন এবং কোন রকমে প্রাণ বাঁচাইয়া পলায়ন করিলেন (১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দ)।

শের শাহ

হুমায়ুনের সহিত যুদ্ধে সাফল্য লাভ করিবার পর আফগান বীর শের খান সূর বাংলার দিকে রওনা হইলেন এবং অবিলম্বেই গৌড় পুনরধিকার করিলেন। হুমায়ুন কর্ত্তৃক নিযুক্ত গৌড়ের শাসনকর্ত্তা জাহাঙ্গীর কুলী বেগ শের খানের পুত্র জলাল খান এবং হাজী খান বটনী কর্ত্তৃক পরাজিত ও নিহত হইলেন (অক্টোবর, ১৫৩৯ খ্রী)। বাংলা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মোতায়েন মোগল সৈন্যদেরও শের খানের সৈন্যেরা পরাজিত করিল এবং ঐ সমস্ত অঞ্চল অধিকার করিল। চট্টগ্রাম অঞ্চল তখনও গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহের কর্মচারীদের হাতে ছিল এবং ইহাদের মধ্যে দুইজন-খোদা বখশ খান ও হামজা খান (পর্তুগীজ বিবরণে কোদাবস্কাম এবং আমরু-আঁকাও নামে উল্লিখিত) চট্টগ্রামে অধিকার লইয়া বিবাদ করিতেছিলেন। ইহাদের বিবাদের সুযোগ লইয়া “নোগাজিল” (?) নামে শের খানের একজন সহকারী চট্টগ্রাম অধিকার করিলেন, কিন্তু পর্তুগীজ কুঠির অধ্যক্ষ নুনো ফার্নান্দেজ ফ্রীয়ার তাঁহাকে বন্দী করিলেন। “নোগাজিল” কোনক্রমে মুক্তিলাভ করিয়া পলায়ন করিলেন। চট্টগ্রাম তথা ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল আর কখনও শের খানের অধিকারভুক্ত হয় নাই। ইহার কিছুদিন পর আরাকানরাজ চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং ১৬৬৬ খ্রী পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানরাজের অধীনেই থাকে।

বিহার ও বাংলা অধিকার করিবার পরে শের খান ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ে ফরিদুদ্দীন আবুল মুজাফফর শের শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। প্রায় এক বৎসরকাল গৌড়ে বাস করিয়া এবং বাংলা দেশ শাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া শের শাহ হুমায়ুনের সহিত সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হইলেন এবং হুমায়ুনকে কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত করিয়া (১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দ) ভারতবর্ষ ত্যাগ করিতে বাধ্য করিলেন। এই সব যুদ্ধ বাংলার বাহিরে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল বলিয়া এখানে তাহাদের বিবরণ দান নিষ্প্রয়োজন। অতঃপর শের শাহ ভারতবর্ষের সম্রাট হইলেন এবং দিল্লিতে তাঁহার রাজধানী স্থাপিত করিলেন। পাঁচ বৎসর রাজত্ব করিবার পর ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ কালিঞ্জর দুর্গ জয়ের সময়ে অগ্নিদগ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে যে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহাদের অধিকাংশেরই বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। ১৫৪১ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ জানিতে পারেন যে তাঁহারই দ্বারা নিযুক্ত শাসনকর্ত্তা খিজুর খান গৌড়ের শেষ সুলতান গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের এক কন্যাকে বিবাহ করিয়া স্বধীন সুলতানের মত আচরণ করিতেছেন এবং সিংহাসনের তুল্য উচ্চাসনে বসিতেছেন এই সংবাদ পাইয়া শের শাহ ত্বরিতে পঞ্জাব হইতে রওনা হইয়া গৌড়ে চলিয়া আসেন এবং খিজুর খানকে পদচ্যুত করিয়া কাজী ফজীলৎ বা ফজীহৎকে গৌড়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করেন।

শের শাহের রাজত্বকালে বাংলা দেশ অনেকগুলি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত হইয়াছিল এবং প্রতি খণ্ডে একজন করিয়া আমীর শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তার বিদ্রোহ বন্ধ করিবার জন্যই পন্থা গৃহীত হইয়াছিল। শের শাহ ভারতবর্ষের শাসনপদ্ধতির সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন এবং রাজস্ব আদায়ের সুবন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। সমগ্র রাজ্যকে ১১৬০০টি পরগণায় বিভক্ত করিয়া তিনি প্রতিটি পরগণায় পাঁচজন করিয়া কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, বাংলা দেশও তাঁহার শাসন-সংস্কারের সুফল ভোগ করিয়াছিল। শের শাহ সিন্ধুনদের তীর হইতে পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করান*। [* এই রাজপথের মধ্যের অংশ শের শাহের বহু পূর্ব হইতেই বর্তমান ছিল।] ব্রিটিশ আমলে ঐ রাজপথ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত হয়। তবে ঐ রাজপথের সোনারগাঁও হইতে হাওড়া পর্যন্ত অংশ অনেকদিন পূর্বেই বিলুপ্ত হইয়াছে।

শের শাহের বংশধরগণ

শের শাহের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র জলাল খান সূর ইসলাম শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হন এবং আট বৎসর কাল রাজত্ব করেন (১৫৪৫-৫৩ খ্রীষ্টাব্দ)। কালিদাস গজদানী নমে একজনা বাইস বংশীয় রাজপুত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া সুলেমান খান নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইনি ইসলাম শাহের রাজত্বকালে বাংলা দেশে আসেন এবং পূর্ববঙ্গের অংশবিশেষ অধিকার করিয়া সেখানকার স্বাধীন রাজা হইয়া বসেন। ইসলাম খান তাঁহাকে দমন করিবার জন্য তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দুইজন সেনানায়ককে প্রেরণ করেন। ইহারা তুমুল যুদ্ধের পরে সুলেমান খানকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই সুলেমান আবার বিদ্রোহ করেন। তখন তাজ খান ও দরিয়া খান আবার সৈন্যবাহিনী লইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং সুলেমানকে সাক্ষাৎকারে আহ্বান করিয়া বিশ্বাসঘাতকতার সহিত তাঁহাকে হত্যা করেন। অতঃপর সুলেমান খানের দুইটি পুত্রকে তাঁহারা তুরানী বণিকদের কাছে বিক্রয় করিয়া দেন।

অসমীয়া বুরঞ্জীর মতে ইসলাম শাহের রাজত্বকালে সিকন্দর সূরের ভ্রাতা কালাপাহাড় কামরূপ আক্রমণ করেন এবং হাজো ও কামাখ্যার মন্দিরগুলি বিধ্বস্ত করেন।

ইসলাম শাহের মৃত্যুর পরে তাঁহার দ্বাদশবর্ষীয় পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু মাত্র কয়েকদিন রাজত্ব করার পরেই শের শাহের ভ্রাতুষ্পুত্র মুবারিজ খান কর্ত্তৃক নিহত হন। মুবারিজ খান মুহম্মদ শাহ আদিল নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার নিষ্ঠুর আচরণের ফলে আফগান নায়কদের মধ্যে অনেকেই তাঁহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আফগানদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কলহ চরমে উঠে; অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারা প্রকাশ্য সগ্রামে লিপ্ত হন এবং অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দুর্বল মুহম্মদ শাহ আদিল ইহাদের কোন মতেই দমন করিতে পারিলেন না।

রাজনীতিক গোলযোগ

এই সময়ে (১৫৫৩ খ্রী) বাংলার আফগান শাসনকর্ত্তা ছিলেন মুহম্মদ খান। তিনি এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন এবং শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহ গাজী নাম গ্রহণ করিয়া বাংলার সুলতান হইলেন। অতঃপর তিনি একদিকে আরাকানের উপর হানা দিলেন এবং অপরদিকে জৌনপুর অধিকার করিয়া আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু তাঁহাকে ছাপরঘাটের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিলেন (১৫৫৫ খ্রী)। এই বিজয়ের পর মুহম্মদ শাহ আদিল শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন।

শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজুর খান পিতার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ঝুসিতে (এলাহাবাদের পরপারে অবস্থিত) গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ নাম গ্রহণ করিয়া নিজেকে সুলতান বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং শাহবাজ খানকে পরাভূত করিয়া এই দেশের অধিপতি হইলেন (১৫৫৬ খ্রী)।

ইতিমধ্যে হুমায়ুন আফগান সুলতান সিকন্দর শাহ সূরকে পরাজিত করিয়া দিল্লি ও পঞ্জাব পুনরধিকার করিয়াছিলেন এবং তাঁহার অল্প পরেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন (২৬শে জানুয়ারী, ১৫৫৬ খ্রী)। ইহার কয়েক মাস পরে হুমায়ুনের বালক পুত্র ও উত্তরাধিকারী আকবর এবং তাঁহার অভিভাবক বৈরাম খানের সহিত মুহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমুর পাণিপথ প্রাঙ্গণে সংগ্রাম হইল এবং তাহাতে হিমু পরাজিত ও নিহত হইলেন (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রী)। মুহম্মদ শাহ আদিল স্বয়ং পরাজিত হইয়া পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করিলেন, কিন্তু (সূরজগড়ের ৪ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত) ফতেহপুরে বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া পরাজিত ও নিহত করিলেন।

অতঃপর বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু অযোধ্যায় অবস্থিত মোগল সেনাপতি খান-ই-জামান তাঁহাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার শিবির লুণ্ঠন করিলেন। তখন গিয়াসুদ্দীন স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন এবং বাংলা ও ত্রিহুতের অধিপতি থাকিয়াই সন্তুষ্ট রহিলেন। ইহার পরবর্তী কয়েক বৎসর তিনি শান্তিতেই কাটাইলেন এবং খান-ই-জামানের সহিত পরিপূর্ণ বন্ধুত্ব রক্ষা করিলেন। তবে পূর্ব-ভারতের এখানে সেখানে ছোটখাট স্থানীয় ভূস্বামীদের অভ্যুত্থান তাঁহাকে দুই একবার বিব্রত করিয়াছিল। ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়।

গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা জলালুদ্দীন দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হইলেন (১৫৬০ খ্রী)। মোগল শক্তির সহিত তিনি বন্ধুত্ব রক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু এই সময়ে কররানী-বংশীয় আফগানরা দক্ষিণ-পূর্ব বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেকখানি অংশ অধিকার করিয়া দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীনের নিকট স্থায়ী অশান্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীনের মৃত্যু হয় এবং তাঁহার পুত্র তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হন। এই পুত্রের নাম জানা যায় না; ইনি কয়েক মাস রাজত্ব করার পরে এক ব্যক্তি ইহাকে হত্যা করেন এবং তৃতীয় গিয়াসুদ্দীন নাম লইয়া সুলতান হন। ইহার এক বৎসর বাদে কররানী-বংশীয় তাজ খান তৃতীয় গিয়াসুদ্দীনকে নিহত করিয়া বাংলার অধিপতি হন।

কররানী বংশ

১। তাজ খান কররানী : কররানীরা আফগান বা পাঠান জাতির একটি প্রধান শাখা। তাহাদের আদি নিবাস বঙ্গাশে (আধুনিক কুররম)। শের খানের প্রধান প্রধান অমাত্য ও কর্মচারীদের মধ্যে কররানী বংশের অনেকে ছিলেন; তন্মধ্যে তাজ খান অন্যতম। ইনি মুহম্মদ শাহ আদিলের সিংহাসনে আরোহণের পরে তাঁহার রাজধানী ছাড়িয়া পলাইয়া যান এবং বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গাঙ্গেয় অঞ্চলের একাংশ অধিকার করেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহ আদিল তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ছিব্রামাউ-য়ের (ফরাক্কাবাদের ১৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত) যুদ্ধে তাঁহাকে পরাজিত করেন। তখন তাজ খান কররানী খওয়াসপুর টাণ্ডায় পলাইয়া আসিয়া তাঁহার ভ্রাতা ইমাদ, সুলেমান ও ইলিয়াসের সহিত মিলিত হন। ইহারা এই অঞ্চলের জায়গীরদার ছিলেন। ইহার পর এই চারি ভ্রাতা জনসাধারণের নিকট হইতে রাজস্ব আদায় করিতে থাকেন এবং সন্নিহিত অঞ্চলের গ্রামগুলি লুটপাট করিতে থাকেন। মুহম্মদ শাহ আদিলের এক শত হাতি ইহারা অধিকার করিয়া লন। বহু আফগান বিদ্রোহী ইহাদের দলে যোগদান করে। কিন্তু চুনারের নিকটে মুহম্মদ আদিল খানের সেনাপতি হিমু ইহাদিগকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন (১৫৫৪ খ্রী)। তখন তাজ খান ও সুলেমান বাংলা দেশে পলাইয়া আসেন এবং দশ বৎসর ধরিয়া অনেক জোরজবরদস্তি ও জাল-জুয়াচুরি করার পরে তাঁহারা দক্ষিণ-পূর্ব বিহার ও পশ্চিম বঙ্গের অনেকাংশ অধিকার করেন। ইহার পর তাজ খান তৃতীয় গিয়াসুদ্দীনকে নিহত করিয়া বাংলার অধিপতি হইলেন (১৫৬৪ খ্রী)। কিন্তু ইহার এক বৎসরের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করিলেন এবং তাঁহার ভ্রাতা সুলেমান তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন।

২। সুলেমান কররানী : সুলেমান কররানী অত্যন্ত দক্ষ ও শক্তিশালী শাসনকর্ত্তা ছিলেন। তাঁহার রাজ্যের সীমাও ক্রমশ দক্ষিণে পুরী পর্যন্ত, পশ্চিমে শোন নদ পর্যন্ত পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। সূর বংশের বিভিন্ন শাখা বিধ্বস্ত হইয়া যাওয়ার ফলে আফগানদের মধ্যে সুলেমানের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী এই সময়ে কেহ ছিল না। দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র, এলাহাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল মোগলদের হাতে পড়ার ফলে হতাবশিষ্ট আফগান নায়কদের অধিকাংশই বাংলাদেশে সুলেমান কররানীর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের পাইয়া সুলেমান বিশেষভাবে শক্তিশালী হইলেন। ইহা ভিন্ন তাঁহার সহস্রাধিক উৎকৃষ্ট হস্তী ছিল বলিয়াও তাঁহার সামরিক শক্তি অপরাজেয় হইয়া উঠিয়াছিল।

বাংলা দেশের অধিপতি হইয়া সুলেমান এই রাজ্যে শান্তি স্থাপন করিলেন। ইহার ফলে তাঁহার রাজস্বের পরিমাণ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাইল। সুলেমান ন্যায়বিচারক হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি মুসলমান আলিম ও দরবেশদের পৃষ্ঠপোষণ করিতেন। এদেশে তিনি শরিয়তের বিধান কার্যকরী করিয়াছিলেন। তিনি নিজে এই বিধান নিষ্ঠার সহিত অনুসরণ করিতেন।

শোন নদ ছিল মোগল অধিকার ও সুলেমানের অধিকারের সীমারেখা। সুলেমান মোগল সম্রাট আকবর এবং তাঁহার অধীনস্থ (সুলেমানের রাজ্যের প্রতিবেশী অঞ্চলের) শাসনকর্ত্তা খান-ই-জমান আলী কুলী খান ও খান-ই-খানান মুনিম খানকে উপহার দিয়া সন্তুষ্ট রাখিতেন। তিনি দুই একবার ভিন্ন আর কখনও প্রকাশ্যে মোগল শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করেন নাই, তবে ভিতরে ভিতরে অনেকবার মোগল-বিরোধীদের সাহায্য করিয়াছেন। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে খান-ই-জমান আলী কুলী খান আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং হাজীপুরে অবস্থান করিয়া আত্মরক্ষা করিতে থাকেন। তিনি সুলেমান কররানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আকবর সুলেমানকে আলী কুলী খানের সহিত যোগদান না করিতে অনুরোধ জানাইবার জন্য হাজী মুহম্মদ খান সীস্তানী নামে একজন দূতকে প্রেরণ করেন। কিন্তু এই দূত সুলেমানের নিকট পৌঁছিতে পারেন নাই; তিনি রোটাস দুর্গের নিকটে পৌঁছিলে একদল বিদ্রোহী আফগান তাঁহাকে বন্দী করিয়া আলী কুলী খানের নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর সুলেমান কররানী আলী কুলী খানের সহিত যোগ দিয়া রোটাস দুর্গ জয়ের জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। রোটাস দুর্গের পতন আসন্ন হইয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে সংবাদ আসিল যে আকবরের বাহিনী আসিতেছে। তখন সুলেমান রোটাস হইতে তাঁহার সৈন্যবাহিনী সরাইয়া লইলেন। ইহার পর আলী কুলী খান, হাজী মুহম্মদ সীস্তানী ও খান-ই-খানান মুনিম খানের মধ্যস্থতায় আকবরের সহিত সন্ধিস্থাপন করেন। সন্ধিস্থাপনের পূর্বাহ্ন পর্যন্ত সুলেমান কররানীর অন্যতম সেনাপতি কালাপাহাড় আলী কুলী খানের নিকট উপস্থিত ছিলেন। ইহার পর ১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে আলী কুলী খান আবার আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আকবর কর্ত্তৃক পরিচালিত বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত হন। তখন আলী কুলী খান কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত জমানীয়া নগরের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আসাদুল্লাহ্ সুলেমান কররানীর নিকটে লোক পাঠাইয়া জমানীয়া নগর সুলেমানকে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব করেন। সুলেমান এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং জমানীয়া নগর অধিকারের জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে খান-ই-খানান মুনিম খান দূত প্রেরণ করিয়া আসাদুল্লাহকে বশীভূত করেন; তখন সুলেমানের সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়। সুলেমানের প্রধান উজীর লোদী খান এই সময়ে শোন নদের তীরে উপস্থিত ছিলেন; তিনি খান-ই-খানানের সহিত সন্ধি করিলেন। ইহার পর সুলেমান কররানী খান-ই খানান মুনিম খানের সহিত পাটনার নিকটে দেখা করিলেন এবং আকবরের নামে মুদ্রাঙ্কন করাইতে ও খুৎবা পাঠ করাইতে প্রতিশ্রুত হইলেন। এই প্রতিশ্রুতি সুলেমান বরাবর পালন করিয়াছিলেন। সুলেমানের সহিত যখন মুনিম খান সাক্ষাৎ করেন, তিনি তাঁহার লোকজন লইয়া পাটনার ৫/৬ ক্রোশ দূরে পৌঁছিলে সুলেমান স্বয়ং গিয়া তাঁহাকে স্বাগত জানান এবং তাঁহার সহিত আলিঙ্গনবদ্ধ হন। অতঃপর মুনিম খান সুলেমানকে নিজের শিবিরে নিমন্ত্রণ করিয়া এক ভোজ দেন। পরদিন তিনি সুলেমানের শিবিরে যান। এই সময়ে কোন কোন আফগান নায়ক মুনিম খানকে বন্দী করিতে পরামর্শ দেন, কিন্তু লোদী খানের পরামর্শ অনুসারে সুলেমান এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন; অতঃপর লোদী খান ও সুলেমানের পুত্র বায়াজিদ মুনিম খানের শিবিরে যান। ইহার পর মুনিম খান জৌনপুরে এবং সুলেমান বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। সুলেমান ইহার পর আর কখনও আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন নাই। তিনি সিংহাসনে বসেন নাই, যদিও ‘আলা হজরৎ’ উপাধি লইয়াছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে রাজার মতই আচরণ করিতেন। বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত প্রধান উজীর লোদী খানের পরামর্শের দরুণই সুলেমান কূটনৈতিক ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন এবং কোন বিপজ্জনক অভিযানে প্রবৃত্ত হন নাই। সুলেমানের আমলে গৌড় নগরী অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হইয়া পড়ায় সুলেমান টাণ্ডাতে তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন।

এই সময়ে বাংলার প্রতিবেশী হিন্দু রাজ্য উড়িষ্যা একের পর এক শক্তিহীন রাজার সিংহাসনে আরোহণ এবং অমাত্য ও সেনানায়কদের আভ্যন্তরীণ কলহের ফলে দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। হরিচন্দন মুকুন্দদেব নামে একজন মন্ত্রী এই সময়ে খুব শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। চক্রপ্রতাপ দেব ও নরসিংহ জেনা নামে দুইজন রাজা অল্পকাল রাজত্ব করিয়া নিহত হইবার পর মুকুন্দদেব রঘুরাম জেনা নামে একজন রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসাইলেন। কিন্তু ১৫৬০-৬১ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দদেব নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করিলেন এবং রাজ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করিলেন। ইব্রাহিম সূর নামে মুহম্মদ শাহ আদিলের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী উড়িষ্যায় আশ্রয় লইয়াছিলেন। মুকুন্দদেব তাঁহাকে জমি দিয়াছিলেন এবং বাংলার সুলতানের নিকট তাঁহাকে সমর্পণ করিতে রাজী হন নাই। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দদেব আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং আকবরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সুলেমান কররানী যদি আকবরের শত্রুতা করেন, তবে তিনি ইব্রাহিম সূরকে দিয়া বাংলা আক্রমণ করাইবেন। মুকুন্দদেব নিজে একবার পশ্চিমবঙ্গের সাতগাঁও পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং গঙ্গার কূলে একটি ঘাট নির্মাণ করেন।

১৫৬৭-৬৮ খ্রীস্টাব্দের শীতকালে আকবর যখন চিতোর আক্রমণে লিপ্ত সেই সময়ে সুলেমান তাঁহার পুত্র বায়াজিদ এবং ভূতপূর্ব মোগল সেনাধ্যক্ষ সিকন্দর উজবকের নেতৃত্বে উড়িষ্যায় এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। ইহারা ছোটনাগপুর ও ময়ূরভঞ্জের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইলেন। ইহাদের প্রতিরোধ করিবার জন্য মুকুন্দদেব ছোট রায় ও রঘুভঞ্জ নামক দুই ব্যক্তির অধীনে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন, কিন্তু দুই ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহারই বিরুদ্ধতা করিল। মুকুন্দদেব তখন কটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন এবং অর্থ দ্বারা বায়াজিদের অধীন একদল সৈন্যকে বশীভূত করিলেন। অতঃপর মুকুন্দদেবের সহিত বিশ্বাসঘাতকদের যুদ্ধ হইল এবং এই যুদ্ধে মুকুন্দদেব ও ছোট রায় নিহত হইলেন। লায়ঙ্গগড়ের সৈন্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র ভঞ্জ (বা দুর্গা ভঞ্জ) উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করিলেন, কিন্তু সুলেমান বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাকে বন্দী ও বধ করিলেন। এইভাবে তিনি ইব্রাহিম সূরকেও প্রথমে আত্মসমর্পণ করিতে বলিয়া তাঁহার পর হাতের মুঠার মধ্যে পাইয়া বধ করিলেন।

জাজপুর অঞ্চল হইতে সুলেমানের অন্যতম সেনাপতি কালাপাহাড়ের* অধীনে একদল অশ্বারোহী আফগান সৈন্য পুরীর দিকে অসম্ভব দ্রুতগতিতে রওনা হইল এবং অল্পকালের মধ্যেই তাঁহারা একরূপ বিনা বাধায় পুরী অধিকার করিল। তাহারা জগন্নাথ-মন্দিরের ভিতর সঞ্চিত বিপুল ধনরত্ন অধিকার করিল, মন্দিরটি আংশিকভারে বিধ্বস্ত করিল এবং মূর্ত্তিগুলিকে খণ্ড খণ্ড করিয়া নোংরা স্থানে নিক্ষিপ্ত করিল। বহু সোনার মূর্ত্তি সমেত অনেক মণ সোনা তাহারা হস্তগত করিল। মোটের উপর, অল্প কিছু কালের মধ্যেই সমগ্র উড়িষ্যা সুলেমান কররানীর অধিকারভুক্ত হইল। এই প্রথম উড়িষ্যা মুসলমানের অধীনে আসিল।

——

[*সুলেমান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় হিন্দু রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান এবং হিন্দুদের মন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করার জন্য ইতিহাসে খ্যাত হইয়া আছেন। ইনি প্রথম জীবনে হিন্দু ও ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে মুসলমান হইয়াছিলেন বলিয়া, কিংবদন্তী আছে। কিন্তু এই কিংবদন্তীর কোন ভিত্তি নাই। আবুল ফজলের আকবর নামা’, বদাওনীর নন্তখ-উৎ তওয়ারিখ এবং নিয়ামতুল্লাহর মখজান-ই-আফগানী’ হইতে প্রামাণিকভাবে জানিতে পারা যায় যে, কালাপাহাড় জন্ম-মুসলমান ও আফগান ছিলেন। তিনি সিকন্দর সুরের ভ্রাতা ছিলেন; তাঁহার নামান্তর “রাজু”, শেষোক্ত বিষয়টি হইতে অনেকে কালাপাহাড়কে হিন্দু মনে করিয়াছেন কিন্তু “রাজু” নাম হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। এই কালাপাহাড় ইসলাম শাহের রাজত্বকাল হইতে সুরু করিয়া দাউদ কররানীর রাজত্বকাল পর্যন্ত বাংলার সৈন্যবাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন। দাউদ কররানীর মৃত্যুর সাত বৎসর পরে ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মোগল রাজশক্তির সহিত বিদ্রোহী মাসুম কাবুলীর যুদ্ধে কালাপাহাড় মাসুমের হইয়া সংগ্রাম করেন এবং তাহাতেই নিহত হন। ইনি ভিন্ন আরও একজন কালাপাহাড় ছিলেন, তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে বর্তমান ছিলেন। তিনি বাহ্লােল লোদী ও সিকন্দর লোদীর সমসাময়িক এবং তাঁহাদের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ রাজপদসমূহে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কেন এই দুইজনের “কালাপাহাড়” নাম হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারা যায় না। ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীন’-এর মতে কালাপাহাড় বাবরের অন্যতম আমীর ছিলেন এবং আকবরের সেনাপতিরূপে উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন : এই সব কথা একেবারে অমুলক। দুর্গাচরণ সান্যাল তাঁহার ‘বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে কালাপাহাড় সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সত্যের বিন্দুবাষ্পও তাঁহার মধ্যে নাই।]

——–

সুলেমান কররানীর রাজত্বকালের প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে কোচবিহারে এক নূতন রাজবংশের অভ্যুদয় হইয়াছিল। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ অত্যন্ত শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন এবং “কামতেশ্বর” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু বাংলার সুলতান ও অহোম রাজার সহিত তিনি মৈত্রীর সম্পর্ক রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণ (রাজত্বকাল আনুমানিক ১৫৩৮-৮৭ খ্রী) ও তৃতীয় পুত্র শুক্লধ্বজ (নামান্তর “চিলা রায়”) এই নীতি অনুসরণ করেন নাই। তাহারা অহোমরাজকে কয়েকবার আক্রমণ করিয়া পরাজিত করিলেন এবং অবশেষে সুলেমান কররানীর রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কিন্তু সুলেমানের বাহিনী তাহাদের পরাজিত করিল এবং শুক্লধ্বজকে বন্দী করিল। অতঃপর সুলেমানের বাহিনী কোচবিহার আক্রমণ করিল এবং সুদূর তেজপুর পর্যন্ত হানা দিল, কিন্তু কোচবিহার ও কামরূপে স্থায়ী অধিকার স্থাপন না করিয়া তাহারা কেবলমাত্র হাজো, কামাখ্যা ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলি ধ্বংস করিয়া ফিরিয়া আসিল। কিংবদন্তী অনুসারে কালাপাহাড় এই অভিযানে নেতৃত্ব করিয়াছিলেন। সুলেমান স্বয়ং কোচবিহারে রাজধানী অবরোধ করিয়া প্রায় জয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু উড়িষ্যার এক অভ্যুত্থানের সংবাদ পাইয়া তিনি অবরোধ প্রত্যাহার করিয়া ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হন। কয়েক বৎসর বাদে লোদী খানের পরামর্শে সুলেমান শুক্লধ্বজকে মুক্ত করিয়া দেন। এই সময়ে মোগলদের বাংলা আক্রমণ আসন্ন হইয়া উঠিতেছিল; কোচবিহারকে খুশী রাখিতে পারিলে হয়তো এই আক্রমণে তাঁহার সাহায্য পাওয়া যাইবে–এইরূপ চিন্তাই শুক্লধ্বজকে মুক্তি দেওয়ার কারণ বলিয়া মনে হয়। যাহা হউক, সুলেমানের জীবদ্দশায় মোগলেরা বাংলা আক্রমণ করে নাই। সুলেমান ১৫৭২ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই অক্টোবর তারিখে পরলোকগমন করেন।

৩। বায়াজিদ কররানী : সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়াজিদ তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন। কিন্তু বায়াজিদ তাঁহার উদ্ধত আচরণ ও কর্কশ ব্যবহারের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই অমাত্যদের নিকট অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। ফলে একদল অমাত্য–ইহাদের মধ্যে লোহানীরাই প্রধানতাঁহার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করিলেন। সুলেমানের ভাগিনেয় ও জামাতা হনসু (বা হাঁসু) ইঁহাদের সঙ্গে যোগ দিয়া বায়াজিদকে হত্যা করিলেন; কিন্তু তিনি স্বয়ং লোদী খান ও অন্যান্য বিশ্বস্ত অমাত্যদের হাতে বন্দী হইয়া নিহত হইলেন। বায়াজিদ কররানী স্বল্পকালীন রাজত্বের মধ্যেই আকবরের অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন।

৪। দাউদ কররানী : হসুকে বধ করিয়া অমাত্যের সুলেমানের দ্বিতীয় পুত্র দাউদকে সিংহাসনে বসাইলেন। তরুণবয়স্ক দাউদ কররানী অত্যন্ত নির্বোধ ও উত্তপ্তমস্তিষ্ক প্রকৃতির ছিলেন; উপরন্তু তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় দুশ্চরিত্র ও মদ্যপ। অমাত্যদের অপমান করিয়া এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাতিদিগকে বিশ্বাসঘাতকতার সহিত হত্যা করিয়া তিনি অনতিবিলম্বেই বহু শত্রু সৃষ্টি করিলেন। কুত্ত্ব খান শুজুর কররানী প্রভৃতি স্বার্থপর অমাত্যদের কুমন্ত্রণায় দাউদ লোদী খানের মত সুযোগ্য ও বিশ্বস্ত মন্ত্রীর প্রতি অপ্রসন্ন হইলেন এবং লোদী খানের জামাতা (তাজ খানের পুত্র) য়ুসুফকে হত্যা করিলেন। দাউদও বায়াজিদের মত আকবরের অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজের নামে খুবা পাঠ ও মুদ্রা উত্তীর্ণ করাইলেন।

দাউদ বাংলার সিংহাসনে বসিবার পর আফগানদের প্রধান সেনাপতি গুজ্বর খান বায়াজিদের পুত্রকে বিহারের সিংহাসনে বসাইলেন। এ কথা শুনিয়া দাউদ বিহার নিজের দখলে আনিবার জন্য লোদী খানের অধীনে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী বিহারে পাঠাইলেন; ইতিমধ্যে আকবরও বিহার অধিকার করিবার জন্য খান-ই খানান মুনিম খানকে প্রেরণ করিয়াছিলেন; এই সংবাদ পাইয়া লোদী খান ও গুজুর খান নিজেদের বিরোধ মিটাইয়া ফেলিলেন এবং মুনিম খানকে অনেক উপহার দিয়া ও আনুগত্যে শপথ গ্রহণ করাইয়া শান্ত করিলেন।

তখন দাউদ লোদী খানের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে দমন করিবার জন্য স্বয়ং এক সৈন্যবাহিনী লইয়া বিহারে গেলেন; কোন কোন বিরোধিপক্ষীয় লোককে তিনি দমনও করিলেন। ইতিমধ্যে আকবর তাঁহার গুজরাট অভিযান সমাপ্ত করিয়া মুনিম খানকে আরও অনেক সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। ইহাদের পাইয়া মুনিম খান যুদ্ধযাত্রা করিলেন এবং ত্রিমোহনী (আরার ১২ মাইল উত্তরে অবস্থিত) পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। তখন দাউদ কুলু লোহানী ও গুজর খানের এবং শ্রীহরি নামে একজন হিন্দুর পরামর্শে লোদী খানের কাছে খুব করুণ ও বিনীতভাবে আবেদন জানাইয়া বলিলেন যে তাঁহার বংশের প্রতি আনুগত্য যেন তিনি ত্যাগ না করেন; লোদী খানকে তাঁহার শিবিরে আসিবার জন্য তিনি বিনীত অনুরোধ জানাইলেন। কিন্তু লোদী খান তাঁহার শিবিরে আসিলে দাউদ তাঁহাকে বধ করিলেন। ইহার ফলে আফগানদের মধ্যে বিরাট ভাঙন ধরিল। এদিকে মোগল বাহিনী সাবধানতার সহিত সুশৃঙ্খলভাবে অগ্রসর হইয়া পাটনার নিকটে পৌঁছিল। পাটনায় দাউদ প্রতিরক্ষা-ব্যুহ রচনা করিয়া অবস্থান করিতেছিলেন।

অতঃপর আকবর স্বয়ং বহু কামান ও বিশাল রণহস্তী সমেত এক নৌবহর লইয়া বিহারে আসিয়া মুনিম খানের সহিত যোগ দিলেন (৩রা আগস্ট, ১৫৭৪ খ্রী)। আকবর দেখিলেন যে পাটনার (গঙ্গার) ওপারে অবস্থিত হাজীপুর দুর্গ অধিকার করিতে পারিলে পাটনা অধিকার করা সহজসাধ্য হইবে। তাই তিনি ৬ই আগষ্ট কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর হাজীপুর দুর্গ অধিকার করিলেন এবং তাহাতে আগুন লাগাইয়া দিলেন। ইহাতে দাউদ অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেলেন এবং সেই রাত্রই সদলবলে জলপথে বাংলায় পলাইয়া গেলেন; পলাইবার সময় অনেক আফগান জলে ডুবিয়া মরিল। দাউদের সৈন্যদের লইয়া সেনাপতি গুজর খান স্থলপথে বাংলায় গেলেন। মোগলেরা পরদিন সকালে পাটনার পরিত্যক্ত দুর্গ অধিকার করিল। তারপর আকবর স্বয়ং মোগল বাহিনীর নেতৃত্ব করিয়া এক দিনেই দরিয়াপুরে (পাটনা ও মুঙ্গেরের মধ্যপথে অবস্থিত) পৌঁছিলেন। ইহার পর আকবর ফিরিয়া গেলেন, কিন্তু মুনিম খান ১৩ই আগস্ট তারিখে ২০,০০০ সৈন্য লইয়া বাংলার দিকে রওনা হইলেন এবং বিনা বাধায় সূরজগড়, মুঙ্গের, ভাগলপুর ও কলহগাঁও অধিকার করিয়া তেলিয়াগড়ি গিরিপথের পশ্চিমে গৌছিলেন। দাউদ এখানে প্রতিরোধ-ব্যুহ রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার সেনাপতি খান-ই-খানান ইসমাইল খান সিলাহদার মোগল বাহিনীকে সাময়িকভাবে প্রতিহত করিলেন। কিন্তু মজনূন খান কাকশালের নেতৃত্বে মোগল অশ্বারোহী বাহিনী স্থানীয় জমিদারদের সাহায্যে রাজমহল পর্বতমালার মধ্য দিয়া তেলিয়াগড়িকে দক্ষিণে ফেলিয়া রাখিয়া চলিয়া গেল। তখন আফগানরা যুদ্ধ না করিয়াই পলাইয়া গেল এবং মুনিম খান বিনা বাধায় বাংলার রাজধানী টাণ্ডায় প্রবেশ করিলেন (২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৫৭৪ খ্রী)।

দাউদ কররানী তখন সাতগাঁও হইয়া উড়িষ্যায় পলায়ন করিলেন। মুনিম খান রাজা তোড়রমল্ল ও মুহম্মদ কুলী খান বরলাসকে তাঁহার পশ্চাদ্ধাবনে নিযুক্ত করিলেন। অন্যান্য আফগান নায়কেরা উত্তর-পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গে গিয়া সমবেত হইলেন; কালাপাহাড়, সুলেমান খান মনক্লী ও বাবুই মনক্লী ঘোড়াঘাটে গেলেন; তাঁহাদের দমন করিবার জন্য মুনিম খান মজনূন খান কাকশালকে ঘোড়াঘাটে পাঠাইলেন; মজনূন খান সুলেমান খান মনক্লীকে নিহত এবং অন্যান্য আফগানদের পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া ঘোড়াঘাট অধিকার করিলেন; পরাজিত আফগানরা কোচবিহারে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ইমাদ খান কররানীর পুত্র জুনৈদ খান কররানী ইতিপূর্বে মোগলদের দলে যোগদান করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন তিনি বিদ্রোহী হইলেন এবং ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া রায় বিহারমলু ও মুহম্মদ খান গখরকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। এদিকে মাহমূদ খান ও মুহম্মদ খান নামে দুইজন আফগান নায়ক সরকার মাহমূদাবাদের অন্তর্গত সেলিমপুর নগর অধিকার করিয়াছিলেন। রাজা তোড়রমল কর্ত্তৃক প্রেরিত একদল সৈন্য মাহমূদ খানকে পরাজিত ও মুহম্মদ খানকে নিহত করিয়া সেলিমপুর অধিকার করিল। তখন জুনেদ খান আবার ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

এদিকে মোগল সৈন্যাধ্যক্ষ মুহম্মদ কুলী খান বরলাস সাতগাঁওয়ের ৪০ মাইল দূরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন আফগানরা সাতগাঁও ছাড়িয়া পলায়ন করিল। মোগল বাহিনী সাতগাঁও অধিকার করিবার পর সংবাদ আসিল যে দাউদের অন্যতম প্রধান কর্মচারী ও পরামর্শদাতা শ্রীহরি (প্রতাপাদিত্যের পিতা) “চতর” (যশোর) দেশের দিকে পলায়ন করিতেছেন; তখন মুহম্মদ কুলী খান শ্রীহরির পশ্চাদ্ধাবন করিলেন, কিন্তু তাঁহাকে বন্দী করিতে পারিলেন না। রাজা তোড়রমন্ত্র বর্ধমান হইতে রওনা হইয়া মান্দারণে উপস্থিত হইলেন; দাউদ ইহার ২০ মাইল দূরে দেবরাকসারী গ্রামে শিবির ফেলিয়াছিলেন। তোড়মল্ল মুনিম খানের নিকট হইতে সৈন্য আনাইয়া মান্দারণ হইতে কোলিয়া গ্রামে গেলেন। দাউদ তখন হরিপুর (দাঁতনের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবিস্থত) গ্রামে চলিয়া গেলেন। তখন তোড়রমল্ল মেদিনীপুরে গেলেন। এখানে মুহম্মদ কুলী খান বরলাস দেহত্যাগ করিলেন, ফলে মোগল সৈন্যেরা খুব হতাশ ও বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িল। তখন তোড়রমল্ল বাধ্য হইয়া মান্দারণে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এই সংবাদ পাইয়া মুনিম খান নূতন একদল সৈন্য লইয়া বর্ধমান হইতে রওনা হইলেন, তোড়রমলুও মান্দারণ হইতে সসৈন্যে রওনা হইলেন, চেতোতে মুনিম খান ও তোড়মল্ল মিলিত হইলেন। তাঁহাদের কাছে সংবাদ আসিল যে, দাউদ হরিপুরে পরিখা খনন, প্রতিরোধ প্রাচীর নির্মাণ, এবং বনময় পথের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি অবরুদ্ধ করিয়া প্রস্তুত হইয়া আছেন। মোগল সৈন্যেরা এই কথা শুনিয়া ভগ্নমনোরথ হইয়া পড়িল এবং আর যুদ্ধ করিতে চাহিল না। মুনিম খান ও হোড়রমল্ল তাহাদের অনেক করিয়া বুঝাইয়া যুদ্ধে উৎসাহিত করিলেন এবং স্থানীয় লোকদের সাহায্যে জঙ্গলের মধ্য দিয়া একটি ঘুর-পথ আবিষ্কার করিলেন। এই পথ চলাচলের উপযুক্ত করিয়া লইবার পর মোগল বাহিনী ইহা দিয়া দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হইল এবং নানজুর (দাঁতনের ১১ মাইল পূর্বে অবস্থিত) গ্রামে পৌঁছিল। এখন দাউদকে পশ্চাৎ দিক হইতে আক্রমণের সুযোগ উপস্থিত হইল। দাউদ ইতিপূর্বে তাঁহার পরিবারবর্গকে কটকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি এখন উপায়ান্তর না দেখিয়া মোগল বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করিলেন। সুবর্ণরেখা নদীর নিকটে তুকরোই (দাঁতনের ৯ মাইল দূরে অবস্থিত) গ্রামের প্রান্তরে ৩রা মার্চ, ১৫৭৫ খ্রী তারিখে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে দাউদের বাহিনীই প্রথমে আক্রমণ চালাইয়া আশাতীত সাফল্য অর্জন করিল। তাহারা খান-ই-জহানকে নিহত করিল ও মুনিম খানকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করিল। কিন্তু দাউদের নির্বুদ্ধিতার ফলে তাঁহার বাহিনী শেষপর্যন্ত পরাজিত হইল। তাঁহার প্রধান সেনাপতি গুজ্বর খান যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্যসমেত নিহত হইলেন। পরাজিত হইয়া দাউদ পলাইয়া গেলেন। তাঁহার বাহিনীও ছত্রভঙ্গ হইয়া পলাইতে লাগিল। মোগল সৈন্যেরা তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া বিনা বাধায় বেপরোয়া হত্যা ও লুণ্ঠন চালাইতে লাগিল এবং বহু আফগানকে বন্দী করিল। পরের দিন ৮২ বৎসর বয়স্ক মোগল সেনাপতি মুনিম খান অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সহিত সমস্ত আফগান বন্দীকে বধ করিয়া তাহাদের ছিন্নমুণ্ড সাজাইয়া আটটি সুউচ্চ মিনার প্রস্তুত করিলেন।

তোড়রমল দাউদের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। দাউদ কোথাও দাঁড়াইতে না পারিয়া শেষপর্যন্ত কটকে গিয়া সেখানকার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাফল্যলাভের কোন সম্ভাবনা নাই দেখিয়া তিনি ১২ই এপ্রিল তারিখে কটকের দুর্গ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং মুনিম খানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ২১শে এপ্রিল তারিখে মুনিম খান দাউদকে উড়িষ্যায় জায়গীর প্রদান করিয়া টাণ্ডায় ফিরিয়া আসিলেন।

দাউদ খান নতি স্বীকার করিলেও ইতিমধ্যে ঘোড়াঘাটে মোগল বাহিনীর শোচনীয় বিপর্যয় ঘটিয়াছিল; মুনিম খানের রাজধানী হইতে অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া কালাপাহাড় ও বাবুই মনক্লী প্রভৃতি আফগান নায়কেরা কুচবিহার হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘোড়াঘাটে অবস্থিত মোগলদের পরাজিত ও বিতাড়িত করিছিল। এই সংবাদ পাইয়া মুনিম খান সৈন্যবাহিনী লইয়া ঘোড়াঘাটের দিকে রওনা হইলেন। কিন্তু ঘোড়াঘাটে পৌঁছিবার পূর্বে তিনি গৌড় জয় করিলেন। বর্ষার সময় টাণ্ডার জলো জমিতে থাকার অসুবিধা হইত বলিয়া মুনিম খান ভাবিয়াছিলেন গৌড় জয় করিয়া সেখানেই রাজধানী স্থাপন করিবেন। কিন্তু গৌড় নগরী বহুকাল পরিত্যক্ত হইয়া পড়িয়াছিল বলিয়া সেখানকার ঘরবাড়ীগুলি অস্বাস্থ্যকর হইয়া উঠিয়াছিল। সেখানে কয়েকদিন থাকার ফলে মুনিম খানের লোকেরা অসুস্থ হইয়া পড়িল এবং কয়েক শত লোক মারা গেল। ফলে মুনিম খানের আর ঘোড়াঘাটে যাওয়া হইল না, তিনি টাণ্ডায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। প্রত্যাবর্তনের দশদিন পরে ২৩শে অক্টোবর, ১৫৭৫ খ্রী তারিখে মুনিম খান পরলোকগমন করিলেন। তাঁহার ফলে মোগলদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। তাহাদের ঐক্যও নষ্ট হইয়া গেল। তখন শত্রুরা চারিদিক হইতে আক্রমণ করিতে লাগিল। বেগতিক দেখিয়া মোগলরা সকলে গৌড়ে সমবেত হইল এবং সেখান হইতে বাংলা দেশ ছাড়িয়া সকলেই ভাগলপুর চলিয়া গেল। সেখানে গিয়া তাহারা দিল্লি ফিরিবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।

এই সময়ে আকবর হাসান কুলী বেগ ওরফে খান-ই-জহানকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। তিনি ভাগলপুরে পৌঁছিয়া কিছু মুস্কিলে পড়িলেন। তিনি শিয়া বলিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী সৈন্যাধ্যক্ষেরা তাঁহার কথা শুনিতে চাহিত না। তোড়মল্ল মধ্যস্থ হইয়া মিষ্ট বাক্য, চতুর ব্যবহার এবং অকৃপণ অর্থদানের দ্বারা তাহাদের বশীভূত করিলেন।

খান-ই-জহান সংবাদ পাইলেন যে দাউদ কররানী আবার বিদ্রোহ করিয়াছেন এবং ভদ্রক, জলেশ্বর প্রভৃতি মোগল অধিকারভুক্ত অঞ্চল জয় করার পরে সমগ্র বাংলা দেশ পুনরধিকার করিয়াছেন; ঈশা খান পূর্ববঙ্গের নদীপথ হইতে শাহ বরদী কর্ত্তৃক পরিচালিত মোগল নৌবহরকে বিতাড়িত করিয়াছেন; জুনৈদ কররানী দক্ষিণ-পূর্ব বিহারে দৌরাত্ম করিতেছেন এবং গজপতি শাহ ডাকাতি করিতেছেন, কেবলমাত্র হাজীপুরে মুজাফফর খান তুরবতী অনেক কষ্টে মোগল ঘাঁটি রক্ষা করিতেছেন।

যুদ্ধ করিতে অনিচ্ছুক সৈন্যাধ্যক্ষদের তোড়রমল্লের সাহায্যে অনেক কষ্টে বুঝাইবার পরে খান-ই-জহান তাঁহাদের লইয়া বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। তেলিয়াগড়ি তাঁহারা সহজেই অধিকার করিলেন এবং এখানকার আফগান সৈন্যাধ্যক্ষকে তাঁহারা বধ করিলেন। দাউদ পশ্চাদপসরণ করিয়া রাজমহলে গিয়া সেখানে পরিখা খনন করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। খান-ই-জহান তাঁহার মুখোমুখি হইয়া অনেকদিন রহিলেন, কিন্তু আক্রমণ করিতে পারিলেন না। তখন আকবর বিহারের সৈন্যবাহিনীকে খান-ই-জহানের সাহায্যে যাইতে বলিলেন এবং খান-ই-জহানকে কয়েক নৌকা বোঝাই অর্থ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠাইলেন। গজপতির ডাকাতির ফলে মোগলদের যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হইতেছিল, আকবর তাঁহাকে দমন করিবার জন্য তাঁহার অন্যতম সভাসদ শাহবাজ খানকে প্রেরণ করিলেন।

১০ই জুলাই, ১৫৭৬ খ্রী তারিখে বিহারের মোগল সৈন্যবাহিনী রাজমহলে খান-ই-জহানের সহিত যোগ দিল। ১২ই জুলাই মোগলদের সহিত আফগানদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হইল। বহুক্ষণ যুদ্ধ করিবার পরে আফগানরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হইল। এই যুদ্ধে জুনৈদ কররানী গোলার আঘাতে নিহত হইলেন, উড়িষ্যার শাসনকর্ত্তা জহান খানও মারা পড়িলেন, কালাপাহাড় ও কুলু লোহানী আহত অবস্থায় পলায়ন করিলেন। দাউদ কররানী বন্দী হইলেন। খান-ই-জহান তাঁহার প্রাণ রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু আমীরদের নিবন্ধে তিনি দাউদকে সন্ধিভঙ্গের অপরাধে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। দাউদের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া আকবরের নিকট পাঠানো হইল।

অতঃপর খান-ই-জহান সপ্তগ্রামে গেলেন এবং যে সব আফগান সেখানে তখনও গোলযোগ বাধাইতেছিল, তাহাদের দমন করিলেন। দাউদের সম্পদ ও পরিবারের জিম্মাদার মাহমুদ খান খাস-খেল ওরফে “মাটি” তাঁহার নিকট পর্যদস্ত হইলেন। তখন আফগানদের নিজেদের মধ্যেই বিরোধ বাধিল এবং তাহাদের অন্যতম নেতা জমশেদ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতেই নিহত হইলেন। অবশেষে দাউদের জননী নৌলাখা ও দাউদের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা খান-ই-জহানের কাছে আত্মসমর্পণ করিলেন। “মাটি” আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়া খান-ই জহানের আজ্ঞায় নিহত হইলেন।

বাংলার প্রথম আফগান শাসক শের শাহ এবং শেষ আফগান শাসক দাউদ কররানী। আফগানরা সাঁইত্রিশ বৎসর এদেশ শাসন করিয়াছিলেন। ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে দাউদের পরাজয় ও নিধনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার ইতিহাসের আফগান যুগ সমাপ্ত হইল। অবশ্য দাউদের মৃত্যুর পরেও বাংলা দেশের অনেক অংশে আফগান নায়কেরা নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদের সম্পূর্ণভাবে দমন বা বশীভূত করিতে মোগল শক্তির অনেক সময় লাগিয়াছিল।* [* বর্তমান পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য জৌহরের ‘তজকিরৎ-উল্ ওয়াকৎ’, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’, আবদুল্লাহর ‘তারিখ-ই-দাউদী’ প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত হইয়াছে।]

০৯. মুঘল (মোগল) যুগ

নবম পরিচ্ছেদ – মুঘল (মোগল) যুগ

মুঘল শাসনের আরম্ভ ও অরাজকতা

১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে দাউদ খানের পরাজয় ও নিধনের ফলে বাংলাদেশে মুঘল সম্রাটের অধিকার প্রবর্তিত হইল। কিন্তু প্রায় কুড়ি বত্সর পর্যন্ত মুঘলের রাজ্যশাসন এদেশে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বাংলাদেশে একজন মুঘল সুবাদার ছিলেন এবং অল্প কয়েকটি স্থানে সেনানিবাস স্থাপিত হইয়াছিল। কিন্তু কেবল রাজধানী ও এই সেনানিবাসগুলির নিকটবর্তী জনপদসমূহ মুঘল শাসন মানিয়া চলিত; অন্যত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছিয়াছিল। দলে দলে আফগান সৈন্য লুটতরাজ করিয়া ফিরিত–মুঘল সৈন্যেরাও এইভাবে অর্থ উপার্জন করিত। বাংলার জমিদারগণ স্বাধীন হইয়া “জোর যার মুল্লুক তার” এই নীতি অনুসরণপূর্বক পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করিতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। এক কথায় বাংলা দেশে আটশত বৎসর পরে আবার মাৎস্য-ন্যায়ের আবির্ভাব হইল।

দাউদ খানকে পরাজিত ও নিহত করিবার পরে, তিন বৎসরের অধিককাল দক্ষতার সহিত শাসন করিবার পর খান-ই-জহানের মৃত্যু হইল (১৯শে ডিসেম্বর, ১৫৭৮ খ্রী)। পরবর্তী সুবাদার মুজাফফর খান এই পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন। এই সময় সম্রাট আকবর এক নূতন শাসননীতি মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রচলিত করেন–সমগ্র দেশ কতকগুলি সুবায় বিভক্ত হইল এবং প্রতি সুবায় সিপাহসালার বা সুবাদার ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের প্রধান অধ্যক্ষগণ দিল্লি হইতে নির্বাচিত হইয়া আসিল। রাজস্ব আদায়েরও নূতন ব্যবস্থা হইল। এতদিন পর্যন্ত প্রাদেশিক মুঘল কর্মচারিগণ যে রকম বেআইনী ক্ষমতা যথেচ্ছ পরিচালনা ও অন্যান্য রকমে অর্থ উপার্জন করিতেন তাহা রহিত হইল। ফলে সুবে বাংলা ও বিহারের মুঘল কর্মচারিগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করিল। আকবরের ভ্রাতা, কাবুলের শাসনকর্ত্তা মীর্জা হাকিম একদল ষড়যন্ত্রকারীর প্ররোচনায় নিজে দিল্লির সিংহাসনে বসিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। তাঁহার দলের লোকেরা বিদ্রোহীদের সাহায্য করিল। মুজাফফর খান বিদ্রোহীদের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইলেন। বিদ্রোহীরা তাঁহাকে বধ করিল (১৯শে এপ্রিল, ১৫৮০ খ্র.)। মীর্জা হাকিম সম্রাট বলিয়া বিঘোষিত হইলেন। বাংলায় নূতন সুবাদার নিযুক্ত হইল। মীর্জা হাকিমের পক্ষ হইতে একজন উকিল রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। এইরূপে বাংলা ও বিহার মুঘল সাম্রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইল। ইহার ফলে আবার অরাজকতা উপস্থিত হইল। আফগান বা পাঠানরা আবার উড়িষ্যা দখল করিল।

এক বৎসরের মধ্যেই বিহারের বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হইল। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আকবর খান-ই-আজমকে সুবাদার নিযুক্ত করিয়া বাংলায় পাঠাইলেন। তিনি তেলিয়াগড়ির নিকট যুদ্ধে মাসুম-কাবুলীর অধীনে সম্মিলিত পাঠান বিদ্রোহীদিগকে পরাজিত করিলেন (২৪ এপ্রিল, ১৫৮৩ খ্রী)। কিন্তু বিদ্রোহ একেবারে দমিত হইল না। মাসুম কাবুলী ঈশা খানের সঙ্গে যোগ দিলেন। পরবর্তী সুবাদার শাহবাজ খান বহুদিন যাবৎ ঈশা খানের সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু তাঁহাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া রাজধানী টাণ্ডায় ফিরিয়া গেলেন। সুযোগ বুঝিয়া মাসুম ও অন্যান্য পাঠান নায়কেরা মালদহ পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। উড়িষ্যায় পাঠান কুলু খান লোহানী বিদ্রোহ করিয়া প্রায় বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন কিন্তু পরাজিত হইয়া মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (জুন, ১৫৮৪ খ্রী)।

১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় বিদ্রোহ দমন করিবার জন্য আকবর অনেক নূতন ব্যবস্থা করিলেন, কিন্তু বিশেষ কোন ফল হইল না। অবশেষে শাহবাজ খান যুদ্ধের পরিবর্তে তোষণ-নীতি অবলম্বন ও উৎকোচ প্রদান দ্বারা বহু পাঠান বিদ্রোহী নায়ককে বশীভূত করিলেন। ঈশা খান ও মাসুম কাবুলী উভয়েই মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (১৫৮৬ খ্রী)। কিন্তু পাঠান নায়ক কুলু উড়িষ্যায় নিরুপদ্রবে রাজ্য করিতে লাগিলেন। তিনিও বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন না-শাহবাজ খানও তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন না। সুতরাং ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় মুঘল আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইল। ১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে বাংলা দেশে অন্যান্য সুবার ন্যায় নূতন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইল। শাসন-সংক্রান্ত সমস্ত কার্য কতকগুলি বিভাগে বিভক্ত হইল এবং প্রত্যেক বিভাগ নির্দিষ্ট একজন কর্মচারীর অধীনস্থ হইল। সর্বোপরি সিপাহসালার (পরে সুবাদার নামে অভিহিত) এবং তাঁহার অধীনে দিওয়ান (রাজস্ব বিভাগ), বশী সৈন্যবিভাগ), সদর ও কাজী (দিওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার), কোতোয়াল (নগর রক্ষা) প্রভৃতি অধ্যক্ষগণ নিযুক্ত হইলেন।

নূতন ব্যবস্থা অনুসারে ওয়াজিব খান প্রথম সিপাহসালার নিযুক্ত হইলেন–কিন্তু অনতিকাল মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হইলে (আগস্ট, ১৫৮৭ খ্রী) সৈয়দ খান ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার সুদীর্ঘ শাসনকাল (১৫৮৭-১৫৯৪ খ্রী) বাংলা দেশে আবার পাঠানরা ও জমিদারগণ শক্তিশালী হইয়া উঠিল।

মানসিংহ ও বাংলা দেশে মুঘল রাজ্যের গোড়াপত্তন

১৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজা মানসিংহ বাংলাদেশের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন। পাঁচ হাজার মুঘলসৈন্যকে বাংলাদেশে জায়গীর দিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হইল। রাজধানী টাণ্ডায় পৌঁছিয়াই তিনি বিদ্রোহীদিগকে দমন করিবার জন্য চতুর্দিকে সৈন্য পাঠাইলেন। তাঁহার পুত্র হিম্মৎসিংহ ভূষণা দুর্গ দখল করিলেন (এপ্রিল, ১৫৯৫ খ্রী)। ১৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর মানসিংহ রাজমহলে নূতন এক রাজধানীর পত্তন করিয়া ইহার নাম দিলেন আকবরনগর। শীঘ্রই এই নগরী সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। অতঃপর তিনি ঈশা খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন এবং পাঠানদিগকে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে আশ্রয় লইতে বাধ্য করিলেন। ঈশা খানের জমিদারীর অধিকাংশ মুঘল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। অন্যান্য স্থানেও বিদ্রোহীরা পরাজিত হইল। ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দের বর্ষাকালে মানসিংহ ঘোড়াঘাটের শিবিরে গুরুতররূপে পীড়িত হন। এই সংবাদ পাইয়া মাসুম খান ও অন্যান্য বিদ্রোহীরা বিশাল রণতরী লইয়া অগ্রসর হইল। মুঘলদের রণতরী না থাকায় বিদ্রোহীরা বিনা বাধায় ঘোড়াঘাটের মাত্র ২৪ মাইল দূরে আসিয়া পৌঁছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে জল কমিয়া যাওয়ায় তাহারা ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইল। মানসিংহ সুস্থ হইয়াই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। তাহারা বিতাড়িত হইয়া এগারসিন্দুরের (ময়মনসিংহ) জঙ্গলে পলাইয়া আত্মরক্ষা করিল।

অতঃপর ঈশা খান নূতন এক কূটনীতি অবলম্বন করিলেন। শ্রীপুরের জমিদারবারো ভূঞার অন্যতম কেদার রায়কে ঈশা খান আশ্রয় দিলেন। কোচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ মুঘলের পক্ষে ছিলেন। তাঁহার জ্ঞাতি ভ্রাতা রঘুদেবের সঙ্গে একযোগে ঈশা খান কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ মানসিংহের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে মানসিংহ সৈন্য লইয়া অগ্রসর হওয়ায় ঈশা খান পলায়ন করিলেন। কিন্তু মুঘলসৈন্য ফিরিয়া গেলে আবার রঘুদেব ও ঈশা খান কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। ইহার প্রতিরোধের জন্য মানসিংহ তাঁহার পুত্র দুর্জনসিংহের অধীনে ঈশা খানের বাসস্থান কাভু দখল করিবার জন্য স্থলপথে ও জলপথে সৈন্য পাঠাইলেন। ১৫৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর ঈশা খান ও মাসুম খানের সমবেত বিপুল রণতরী মুঘল রণতরী ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্জনসিংহ নিহত হইলেন এবং অনেক মুঘলসৈন্য বন্দী হইল। কিন্তু চতুর ঈশা খান বন্দীদিগকে মুক্তি দিয়া এবং কোচবিহার আক্রমণ বন্ধ করিয়া মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার পূর্বক সন্ধি করিলেন। ইহার দুই বৎসর পর ঈশা খানের মৃত্যু হইল (সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ খ্রী)।

ভূষণা-বিজেতা মানসিংহের বীর পুত্র হিম্মৎসিংহ কলেরায় প্রাণত্যাগ করেন। (মার্চ, ১৫৯৭ খ্রী)। ছয় মাস পরে দুর্জনসিংহের মৃত্যু হইল। দুই পুত্রের মৃত্যুতে শোকাতুর মানসিংহ সম্রাটের অনুমতিক্রমে বিশ্রামের জন্য ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে আজমীর গেলেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎসিংহ তাঁহার স্থানে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে আগ্রায় তাঁহার মৃত্যু হইলে তাঁহার বালক পুত্র মহাসিংহ মানসিংহের অধীনে বাংলার শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হইলেন। এই সুযোগে বাংলা দেশে পাঠান বিদ্রোহীরা আবার মাথা তুলিল এবং একাধিকবার মুঘলসৈন্যকে পরাজিত করিল। উড়িষ্যার উত্তর অংশ পর্যন্ত পাঠানের হস্তগত হইল।

এই সমুদয় বিপর্যয়ের ফলে মানসিংহ বাংলায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহীরা গুরুতররূপে পরাজিত হইল (ফেব্রুয়ারী, ১৬০১ খ্রী)। পরবর্তী বৎসর মানসিংহ ঢাকা জিলায় শিবির স্থাপন করিলেন। শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায় বশ্যতা স্বীকার করিলেন। মানসিংহের পৌত্র মালদহের বিদ্রোহীদিগকে পরাস্ত করিলেন। এদিকে উড়িষ্যার পরলোকগত পাঠান নায়ক কুলু খানের ভ্রাতুষ্পুত্র উসমান ব্ৰহ্মপুত্র নদী পার হইয়া মুঘল থানাদারকে পরাজিত করিয়া ভাওয়ালে আশ্রয় লইতে বাধ্য করিলেন। মানসিংহ তৎক্ষণাৎ ভাওয়াল যাত্রা করিলেন এবং উসমান গুরুতররূপে পরাজিত হইলেন। অনেক পাঠান নিহত হইল এবং বহুসংখ্যক পাঠান রণতরী ও গোলাবারুদ মানসিংহের হস্তগত হইল। ইতিমধ্যে কেদার রায় বিদ্রোহী হইয়া ঈশা খানের পুত্র মুসা খান, কুলু খানের উজীরের পুত্র দাউদ খান এবং অন্যান্য জমিদারগণের সহিত যোগ দিলেন। মানসিংহ ঢাকায় পৌঁছিয়াই ইহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিলেন। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত তাহারা ইছামতী নদী পার হইতে না পারায় মানসিংহ স্বয়ং শাহপুরে উপস্থিত হইয়া নিজের হাতি ইছামতীতে নামাইয়া দিলেন। মুঘল সৈনিকেরা ঘোড়ায় চড়িয়া তাঁহার অনুসরণ করিল। এইরূপ অসম সাহসে নদী পার হইয়া মানসিংহ বিদ্রোহীদিগকে পরাস্ত করিয়া বহুদূর পর্যন্ত তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন (ফেব্রুয়ারী, ১৬০২ খ্রী)।

এই সময় আরাকানের মগ জলদস্যুরা জলপথে ঢাকা অঞ্চলে বিষম উপদ্রব সৃষ্টি করিল এবং ডাঙ্গায় নামিয়া কয়েকটি মুঘল ঘাঁটি লুঠ করিল। মানসিংহ তাহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইয়া বহুকষ্টে তাহাদিগকে পরাস্ত করিলেন এবং তাহারা নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। কেদার রায় তাঁহার নৌবহর লইয়া মগদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং শ্রীনগরের মুঘল ঘাঁটি আক্রমণ করিলেন। মানসিংহও কামান ও সৈন্য পাঠাইলেন। বিক্রমপুরের নিকট এক ভীষণ যুদ্ধে কেদার রায় আহত ও বন্দী হইলেন। তাঁহাকে মানসিংহের নিকট লইয়া যাইবার পূর্বেই তাঁহার মৃত্যু হইল (১৬০৩ খ্রী)। তাঁহার অধীনস্থ বহু পর্তুগীজ জলদস্যু ও বাঙালী নাবিক হত হইল।

অতঃপর মানসিংহ মগ রাজাকে নিজ দেশে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য করিলেন। তারপর তিনি উসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করিলেন। উসমান পলাইয়া গেলেন। এইরূপে বাংলাদেশে অনেক পরিমাণে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিল।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বের প্রারম্ভে বাংলা দেশের অবস্থা

মুঘল সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন (১৬০৫ খ্রী)। এই সময় শের আফগান ইস্তলজু নামক একজন তুর্কী জায়গীরদার বর্ধমানে বাস করিতেন। তাঁহার পত্নী অসামান্য রূপবতী ছিলেন। কথিত আছে, জাহাঙ্গীর তাহাকে বিবাহের পূর্বেই দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সম্ভবত এই নারীর হস্তগত করিবার জন্যই মানসিংহকে সরাইয়া জাহাঙ্গীর তাঁহার বিশ্বস্ত ধাত্রী-পুত্র কুলুদ্দীন খান কোকাকে বাংলা দেশের সুবাদার নিযুক্ত করিলেন। কুলুদ্দীন খান বর্ধমানে শের আফকানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে বচসা ও বিবাদ হয় এবং উভয়েই নিহত হন (১৬০৭ খ্র)। শের আফকানের পত্নী আগ্রায় মুঘল হারেমে কয়েক বৎসর অবস্থান করার পর জাহাঙ্গীরের সহিত তাঁহার বিবাহ হয় এবং পরে নূরজাহান নামে তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হন।

কুলুদ্দীনের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর কুলী খান বাংলা দেশের সুবাদার হইয়া আসেন। কিন্তু এক বৎসরের মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হয় এবং তাঁহার স্থলে ইসলাম খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইয়া ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে কার্যভার গ্রহণ করেন। তাঁহার কার্যকাল মাত্র পাঁচ বৎসর–কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মানসিংহের আরব্ধ কার্য সম্পূর্ণ করিয়া বাংলা দেশে মুঘলরাজের ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ইসলাম খানের সুবাদারীর প্রারম্ভে বাংলা দেশ নাম ত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্ত ভুক্ত হইলেও প্রকৃতপক্ষে রাজধানী রাজমহল, মুঘল ফৌজদারদের অধীনস্থ অল্প কয়েকটি থানা অর্থাৎ সুরক্ষিত সৈন্যের ঘাটি ও তাঁহার চতুর্দিকে বিস্তৃত সামান্য ভূখণ্ডেই মুঘলরাজের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। ইহার বাহিরে অসংখ্য বড় ও ছোট জমিদার এবং বিদ্রোহী পাঠান নায়কেরা প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজ্য পরিচালনা করিতেন। মুঘল থানার মধ্যে করতোয়া নদীর তীরবর্তী ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর জিলা), আলপসিং ও সেরপুর অতাই (ময়মনসিংহ), ভাওয়াল (ঢাকা), ভাওয়ালের ২২ মাইল উত্তরে অবস্থিত টোক এবং পদ্মা, লক্ষ্যা ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বর্তমান নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী ত্রিমোহানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

যে সকল জমিদার মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেও সুযোগ ও সুবিধা পাইলেই বিদ্রোহী হইতেন, তাঁহাদের মধ্যে ইঁহারা সমধিক শক্তিশালী ছিলেন।

১। পূর্ব্বোক্ত ঈশা খানের পুত্র মুসা খান : বর্তমান ঢাকা ও ত্রিপুরা জিলার অর্ধেক, প্রায় সমগ্র মৈমনসিংহ জিলা এবং রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জিলার কতকাংশ তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলা দেশের তৎকালীন জমিদারগণ বারো ভূঞা নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন, যদিও সংখ্যায় তাঁহারা ঠিক বারো জন ছিলেন না। মুসা খান ছিলেন ইহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও অনেকেই তাহাকে নেতা বলিয়া মানিত। এই সকল সহায়ক জমিদারের মধ্যে ভাওয়ালের বাহাদুর গাজী, সরাইলের সুনা গাজী, চাটমোহরের মীর্জা মুমিন (মাসুম খান কাপুলীর পুত্র), খলসির মধু রায়, চাঁদ প্রতাপের বিনোদ রায়, ফতেহাবাদের (ফরিদপুর) মজলিস কুত্ত্ব এবং মাতঙ্গের জমিদার পলওয়ানের নাম করা যাইতে পারে।

২। ভূষণার জমিদার সত্রাজিৎ এবং সুসঙ্গের জমিদার রাজা রঘুনাথ : উঁহারা সহজেই মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধে মুঘল সৈন্যের সহায়তা করেন। সত্রাজিতের কাহিনী পরে বলা হইবে।

৩। রাজা প্রতাপাদিত্য : বর্তমান যশোহর, খুলনা ও বাখরগঞ্জ জিলার অধিকাংশই তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বর্তমান যমুনা ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থলে ধূমঘাট নামক স্থানে তাঁহার রাজধানী ছিল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে তাঁহার শক্তি, বীরত্ব ও দেশভক্তির যে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার অধিকাংশেরই কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।

৪। বাখরগঞ্জ জিলার অন্তর্গত বাকলার জমিদার রামচন্দ্র : ইনি রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতিবেশী ও সম্পর্কে জামাতা ছিলেন। ইনি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। কবিবর রবীন্দ্রনাথ “বৌঠাকুরাণীর হাট” নামক উপন্যাসে তাঁহার যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও অনৈতিহাসিক।

৫। ভুলুয়ার জমিদার অনন্তমাণিক্য : বর্তমান নোয়াখালি জিলা তাঁহার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইনি লক্ষণমাণিক্যের পুত্র।

৬। আরও অনেক জমিদার : তাঁহাদের কথা প্রসঙ্গক্রমে পরে বলা হইবে।

৭। বিদ্রোহী পাঠান নায়কগণ : বর্তমান শ্রীহট্ট (সিলেট) জিলাই ছিল ইঁহাদের শক্তির প্রধান কেন্দ্রস্থল। ইঁহাদের মধ্যে বায়াজিদ কররানী ছিলেন সর্বপ্রধান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক পাঠান নায়কই তাহাকে নেতা বলিয়া স্বীকার করিত। তাঁহার প্রধান সহযোগী ছিলেন খাজা উসমান। বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ইহাকে অমর করিয়া গিয়াছেন। উসমানের পিতা খাজা ঈশা উড়িষ্যার শেষ পাঠান রাজা কুলু খানের ভ্রাতা ও উজীর ছিলেন এবং মানসিংহের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন। সন্ধির পূর্বেই কুলু খানের মৃত্যু হইয়াছিল। খাজা ঈশার মৃত্যুর পর পাঠানেরা আবার বিদ্রোহী হইল। মানসিংহ তাহাদিগকে পরাজিত করিলেন। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য তিনি উসমান ও অন্য কয়েকজন পাঠান নায়ককে উড়িষ্যা হইতে দূরে রাখিবার জন্য পূর্ব বাংলায় জমিদারি দিলেন; পরে উড়িষ্যার এত নিকটে তাহাদিগকে রাখা নিরাপদ মনে করিয়া এই আদেশ নাকচ করিলেন। ইহাতেই বিদ্রোহী হইয়া তাহারা সাতগাঁওয়ে লুঠপাট করিতে আরম্ভ করিল, সেখান হইতে বিতাড়িত হইয়া ভূষণা লুঠ করিল এবং ঈশা খানের সঙ্গে যোগ দিল। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে বর্তমান মৈমনসিংহ জিলার অন্তর্গত বোকাই নগরে উসমান দুর্গ নির্মাণ করিলেন। তিনি আজীবন ঈশা খান ও মুসা খানের সহায়তায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছেন। পাঠান নায়ক পূর্ব্বোক্ত বায়াজিদ, বানিয়াচঙ্গের আনওয়ার খান ও শ্রীহট্টের অন্যান্য পাঠান নায়কদের সঙ্গে উসমানের বন্ধুত্ব ছিল। এইরূপে উড়িষ্যা হইতে বিতাড়িত হইয়া পাঠান শক্তি ব্রহ্মপুত্রের পূর্বভাগে প্রতিষ্ঠিত হইল।

বাংলা দেশের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজধানী রাজমহল হইতে পূর্বে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিকাংশই মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধবাদী বিদ্রোহী নায়কদের অধীন ছিল। রাজমহলের দক্ষিণে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে তিনজন বড় জমিদার ছিলেন–মল্লভূম ও বাঁকুড়ার বীর হাম্বীর, ইঁহার দক্ষিণ পশ্চিমে পাঁচেতে শাম্স্ খান এবং ইহার দক্ষিণ-পূর্বে হিজলীতে সেলিম খান। ইহারা মুখে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিতেন, কিন্তু কখনও সুবাদার ইসলামের খানের দরবারে উপস্থিত হইতেন না।

ইসলাম খানের কার্যকলাপ-বিদ্রোহী জমিদারদের দমন

সুবাদার ইসলাম খান রাজমহলে পৌঁছিবার অল্পকাল পরেই সংবাদ আসিল যে পাঠান উসমান খান সহসা আক্রমণ করিয়া মুঘল থানা আলপসিং অধিকার করিয়াছেন ও থানাদারকে বধ করিয়াছেন। ইসলাম খান অবিলম্বে সৈন্য পাঠাইয়া থানাটি পুনরুদ্ধার করিলেন এবং বাংলাদেশে মুঘল প্রভুত্বের স্বরূপ দেখিয়া ইহা দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে মনস্থ করিলেন।

ইসলাম খান প্রথমেই মুসা খানকে দমন করিবার জন্য একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও ব্যাপক আয়োজন করিলেন। রাজা প্রতাপাদিত্য মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিয়া কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে উপঢৌকনসহ ইসলাম খানের দরবারে পাঠাইলেন। স্থির হইল তিনি সৈন্যসামন্ত ও যুদ্ধের সরঞ্জাম লইয়া স্বয়ং আলাইপুরে গিয়া ইসলাম খানের সহিত সাক্ষাৎ এবং মুসা খানের বিরুদ্ধে অভিযানে যোগদান করিবেন। জামিন স্বরূপ সঞ্জামাদিত্য ইসলাম খানের দরবারে রহিল। বর্ষা শেষ হইলে ইসলাম খান এবং বৃহৎ সৈন্যদল, বহুসংখ্যক রণতরী ও বড় বড় ভারবাহী নৌকায় কামান বন্দুক লইয়া রাজমহল হইতে ভাটি অর্থাৎ পূর্ব বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। মালদহ জিলায় গৌড়ের নিকট পৌঁছিয়া ইসলাম খান পশ্চিম বাংলার পূর্ব্বোক্ত তিনজন জমিদারের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। বীর হাম্বীর ও সেলিম খান বিনা যুদ্ধে এবং শাম্স্ খান পক্ষাধিক কাল গুরুতর যুদ্ধ করার পর মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। মালদহ হইতে দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জিলার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়া ইসলাম খান পদ্মা নদী পার হইলেন এবং রাজশাহী জিলার অন্তর্গত পদ্মা-তীরবর্তী আলাইপুরে পৌঁছিলেন (১৬০৯ খ্রী)। নিকটবর্তী পুঁটিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার পীতাম্বর, ভাতুড়িয়া রাজ-পরগণার অন্তর্গত চিলাজুয়ারের জমিদার অনন্ত ও আলাইপুরের জমিদার ইলাহ্ বখশ ইসলাম খানের বশ্যতা স্বীকার করিলেন।

আলাইপুরে অবস্থানকালে ইসলাম খান ভূষণার জমিদার রাজা সত্রাজিতের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। সত্রাজিতের পিতা মুকুন্দলাল পার্শ্ববর্তী ফতেহাবাদের (ফরিদপুর) মুঘল ফৌজদারের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রগণকে হত্যা করিয়া উক্ত স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। মানসিংহের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিলেও তিনি স্বাধীন রাজার ন্যায় আচরণ করিতেন। তিনি ভূষণা দুর্গ সুদৃঢ় করিয়াছিলেন। মুঘলসৈন্য আক্রমণ করিলে সত্রাজিৎ প্রথমে বীরবিক্রমে তাহাদিগকে বাধা দিলেন কিন্তু পরে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন এবং ইসলাম খানের সৈন্যের সঙ্গে যোগ দিয়া পাবনা জিলার কয়েকজন জমিদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিলেন।

পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত রাজা প্রতাপাদিত্য আত্রাই নদীর তীরে ইসলাম খানের শিবিরে উপস্থিত হইলেন। স্থির হইল তিনি নিজ রাজ্যে ফিরিয়াই চারশত রণতরী পাঠাইবেন। পুত্ৰ সংগ্ৰামাদিত্যের অধীনে মুঘল নৌ-বহরের সহিত একত্র মিলিত হইয়া তাহারা যুদ্ধ করিবে। তারপর ইসলাম খান যখন পশ্চিমে ঘোড়াঘাট হইতে মুসা খানের রাজ্য আক্রমণ করিবেন, সেই সময় প্রতাপাদিত্য আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় দিয়া ২০,০০০ পাইক, ১০০০ ঘোড়সওয়ার এবং ১০০ রণতরী লইয়া ঈশা খানের রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শ্রীপুর ও বিক্রমপুর আক্রমণ করিবেন।

বর্ষাকাল শেষ হইলে ইসলাম খান প্রধান মুঘল বাহিনীসহ করতোয়ার তীর দিয়া দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইয়া পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থল কাটাসগড়ে উপস্থিত হইলেন-মুঘল নৌ-বাহিনীও তাঁহার অনুসরণ করিল। ইহার নিকটবর্তী যাত্রীপুরে ইছামতীর তীরে মুসা খানের এক সুদৃঢ় দুর্গ ছিল। এই দুর্গ আক্রমণ করাই মুঘল বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু মুসা খানকে বিপথে চালিত করিবার জন্য ক্ষুদ্র একদল সৈন্য ও রণতরী ঢাকা নগরীর দিকে পাঠানো হইল।

মুসা খান যাত্রীপুর রক্ষার বন্দোবস্ত করিয়া তাঁহার বিশ্বস্ত ১০/১২ জন জমিদারের সঙ্গে ৭০০০ রণতরী লইয়া কাটাসগড়ে মুঘলের শিবির আক্রমণ করিলেন। প্রথম দিন যুদ্ধের পর মুসা খান রাতারাতি নিকটবর্তী ডাকচেরা নামক স্থানে পরিখাবেষ্টিত একটি সুরক্ষিত মাটির দুর্গ নির্মাণ করিলেন এবং পর পর দুই দিন প্রভাতে এই দুর্গ হইতে বাহির হইয়া ভীমবেগে মুঘলসৈন্যদিগকে আক্রমণ করিলেন। গুরুতর যুদ্ধে উভয় পক্ষেই বহু সৈন্য হতাহত হইল। অবশেষে মুসা খান ডাকচেরা ও যাত্রীপুর দুর্গে আশ্রয় লইলেন। মুঘলসৈন্য পুনঃ পুনঃ ডাকচেরা দুর্গ আক্রমণ করিয়াও অধিকার করিতে পারিল না। কিন্তু যখন মুসা খান ডাকচেরা রক্ষায় ব্যাপৃত তখন অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া ইসলাম খান যাত্রীপুর দুর্গ দখল করিলেন। তারপর অনেকদিন যুদ্ধের পর বহু সৈন্য ক্ষয় করিয়া ডাকচেরা দুর্গও দখল করিলেন। এই দুর্গ দখলের ফলে মুসা খানের শক্তি ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট হ্রাস পাইল। ঢাকা নগরীও মুঘল বাহিনী দখল করিল। ইসলাম খান ঢাকায় পৌঁছিয়া শ্রীপুর ও বিক্রমপুর আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠাইলেন। মুসা খান রাজধানী রক্ষার ব্যবস্থা করিয়া লক্ষ্যা নদীতে তাঁহার রণতরী সমবেত করিলেন। এই নদীর অপর তীরে শক্রদলের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন থাকিবার পর মুঘলসৈন্য রাত্রিকালে অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া মুসা খানের পৈত্রিক বাসস্থান কাভু এবং পর পর আরও কয়েকটি দুর্গ দখল করায় মুসা খান পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন এবং তাঁহার রাজধানী সোনারগাঁও সহজেই মুঘলের করতলগত হইল। মুসা খান ইহার পরও মুঘলদের কয়েকটি থানা আক্রমণ করিলেন, কিন্তু পরাস্ত হইয়া মেঘনা নদীর একটি দ্বীপে আশ্রয় হইলেন। তাঁহার পক্ষে জমিদারেরাও একে একে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন।

অতঃপর ইসলাম খান ভুলুয়ার জমিদার অনন্তমাণিক্যের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। আরাকানের রাজা অনন্তমাণিক্যকে সাহায্য করিলেন। অনন্তমাণিক্য একটি সুদৃঢ় দুর্গের আশ্রয়ে থাকিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিলেন। মুঘলসৈন্য ঐ দুর্গ দখল করিতে না পারিয়া উৎকোচদানে ভুলুয়ার একজন প্রধান কর্মচারীকে হস্তগত করিল। ফলে অনন্তমাণিক্যের পরাজয় হইল। তিনি আরাকান রাজ্যে পলাইয়া গেলেন। এখন তাঁহার রাজ্য ও সম্পদ সকলই মুঘলের হস্তগত হইল।

অনন্তমাণিক্যের পরাজয়ে মুসা খান নিরাশ হইয়া মুঘলের নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। ইসলাম খান মুসা খান ও তাঁহার মিত্রগণের রাজ্য তাহাদিগকে জায়গীর রূপে ফিয়াইয়া দিলেন। কিন্তু মুঘলসৈন্য এই সকল জায়গীর রক্ষায় নিযুক্ত হইল, জায়গীরদারদের রণতরী মুঘল নৌ-বহরের অংশ হইল এবং সৈন্যদের বিদায় করিয়া দেওয়া হইল। মুসা খানকে ইসলাম খানের দরবারে নজরবন্দী করিয়া রাখা হইল। এইরূপে এক বৎসরের (১৬১০-১১ খ্রী) যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে মুঘলের প্রধান শত্রু দূরীভূত হইল।

মুসা খানের সহিত যুদ্ধ শেষ হইবার পরেই ইসলাম খান পাঠান উসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। উসমান পদে পদে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও মুঘল বাহিনী তাঁহার রাজধানী বোকাইনগর দখল করিল (নভেম্বর, ১৬১১ খ্রী)। উসমান শ্রীহট্টের পাঠান নায়ক বায়াজিদ কররানীর আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য বিদ্রোহী পাঠান নায়কেরাও মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিল। কিন্তু পাঠান বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করা আপাতত স্থগিত রাখিয়া ইসলাম খান যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করিতে অগ্রসর হইলেন।

প্রতাপাদিত্য ইসলাম খানকে কথা দিয়াছিলেন যে তিনি স্বসৈন্যে অগ্রসর হইয়া মুসা খানের বিরুদ্ধে যোগ দিবেন। কিন্তু তিনি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। সুতরাং ইসলাম খান তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করিলেন। মুসা খান ও অন্যান্য জমিদারদের পরিণাম দেখিয়া প্রতাপাদিত্য ভীত হইলেন এবং ৮০টি রণতরীসহ পুত্ৰ সংগ্ৰামাদিত্যকে ক্ষমা প্রার্থনা করিবার জন্য ইসলাম খানের নিকট পাঠাইলেন। কিন্তু ইসলাম খান ইহাতে কর্ণপাত না করিয়া উক্ত রণতরীগুলি ধ্বংস করিলেন।

প্রতাপাদিত্য খুব শক্তিশালী রাজা ছিলেন; সুতরাং ইসলাম খান এক বিরাট সৈন্যদলকে তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের জামাতা বাকলার রাজা রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। এই সময় চিলাজুয়ারের জমিদার অনন্ত ও পীতাম্বর বিদ্রোহ করায় যশোহর-অভিযানে কিছু বিলম্ব ঘটিল। কিন্তু ঐ বিদ্রোহ দমনের পরেই জলপথে ও স্থলপথে মুঘলসৈন্য অগ্রসর হইল। মুঘল নৌবাহিনী পদ্মা, জলঙ্গী ও ইছামতী নদী দিয়া বনগাঁর দশ মাইল দক্ষিণে যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলের নিকট শালকা (বর্তমান টিবি নামক স্থানে) পৌঁছিল। এইখানে প্রতাপাদিত্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র উদয়াদিত্য একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করিয়া তাঁহার সৈন্যের অধিকাংশ, বহু হস্তী, কামান এবং ৫০০ রণতরী সহ। অপেক্ষা করিতেছিলেন। তিনি সহসা মুঘলের রণতরী আক্রমণ করিয়া ইহাকে বিপর্যস্ত করিয়া তুলিলেন। কিন্তু ইছামতীর দুই তীর হইতে মুঘল বাহিনীর গোলা ও বাণ বর্ষণে উদয়াদিত্যের নৌবহর বেশী দূর অগ্রসর হইতে পারিল না এবং ইহার অধ্যক্ষ খাজা কামালের মৃত্যুতে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। উদয়াদিত্য শালকার দুর্গ ত্যাগ করিয়া পালন করিলেন। অধিকাংশ রণতরী, গোলাগুলি প্রভৃতি মুঘলের হস্তগত হইল।

ইতিমধ্যে বাকলার বিরুদ্ধে অভিযান শেষ হইয়াছিল। বাকলার অল্পবয়স্ক রাজা রামচন্দ্রের মাতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুঘল বাহিনীর সহিত সাতদিন পর্যন্ত একটি দুর্গের আশ্রয়ে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। মুঘলেরা ঐ দুর্গ অধিকার করিলে রামচন্দ্রের মাতা পুত্রকে বলিলেন মুঘলের সঙ্গে সন্ধি না করিলে তিনি বিষ পান করিবেন। রামচন্দ্র আত্মসমর্পণ করিলেন। ইসলাম খান তাঁহাকে ঢাকায় বন্দী করিয়া রাখিলেন এবং বাকলা মুঘল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। বাকলার যুদ্ধ শেষ করিয়া মুঘল বাহিনী পূর্বদিক হইতে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইল।

এই নূতন বিপদের সম্ভাবনায়ও বিচলিত না হইয়া প্রতাপাদিত্য পুনরায় রাজধানীর পাঁচ মাইল উত্তরে কাগরঘাটায় একটি দুর্গ নির্মাণ করিয়া মুঘলবাহিনীকে বাধা দিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু মুঘল সেনানায়কগণ অপূর্ব সাহস ও কৌশলের বলে এই দুর্গটিও দখল করিল। প্রতাপাদিত্য তখন মুঘলের নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। স্থির হইল যে মুঘল সেনাপতি গিয়াস খান নিজে তাঁহাকে ইসলাম খানের নিকট লইয়া যাইবেন, এবং যতদিন ইসলাম খান কোন আদেশ না দেন, ততদিন পর্যন্ত মুঘল বাহিনী কাগরঘাটায় এবং উদয়াদিত্য রাজধানী ধূমঘাটে থাকিবেন। ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যকে বন্দী এবং তাঁহার রাজ্য দখল করিলেন। প্রবাদ এই যে, প্রতাপাদিত্যকে ঢাকায় একটি লোহার খাঁচায় বন্ধ করিয়া রাখা হইয়াছিল এবং পরে বন্দী অবস্থায় দিল্লি পাঠান হয়, কিন্তু পথিমধ্যে বারাণসীতে তাঁহার মৃত্যু হয়।

প্রতাপাদিত্য যথেষ্ট শক্তি ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং শেষ অবস্থায় মুঘলদের সহিত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁহাকে যে প্রকার বীর ও স্বাধীনতাপ্রিয় দেশভক্তরূপে চিত্রিত করা হইয়াছে, উল্লিখিত কাহিনী তাঁহার সমর্থন করে না।

এক মাসের মধ্যেই (ডিসেম্বর, ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দ–জানুয়ারী, ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ) যশোহর ও বাকলার যুদ্ধ শেষ হইল। কিন্তু শ্রীপুর, বিক্রমপুর ও ভুলুয়া ছাড়িয়া মুঘল বাহিনী চলিয়া আসায় সুযোগ পাইয়া আরাকানের মগ দস্যুগণ এই সমুদয় অঞ্চল আক্রমণ করিয়া বিধ্বস্ত করিল। ইসলাম খান তাহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। কিন্তু সৈন্য পৌঁছিবার পূর্বেই তাহারা পলায়ন করিল।

অতঃপর ইসলাম খান পাঠান উসমানের বিরুদ্ধে এক বিপুল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করিলেন। শ্রীহট্টের অন্তর্গত দৌলম্বাপুরে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে উসমানের অপূর্ব বীরত্ব ও রণকৌশলে মুঘল বাহিনী পরাস্ত হইয়া নিজ শিবিরে প্রস্থান করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উসমান এই যুদ্ধে নিহত হন এবং রাত্রে তাঁহার সৈন্যেরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে (১২ই মার্চ, ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ)। উসমানের পুত্র ও ভ্রাতাগণ প্রথমে যুদ্ধ চালাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু পাঠান নায়কদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের ফলে তাহা হইল না–তাঁহারা মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ইসলাম খান উসমানের রাজ্য দখল করিলেন এবং তাঁহার ভ্রাতা ও পুত্রগণকে বন্দী করিয়া রাখিলেন। শ্রীহট্টের অন্যান্য পাঠান নায়কদের বিরুদ্ধেও ইসলাম খান সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রথমে মুঘল বাহিনীকে বাধা দিয়াছিলেন, কিন্তু উসমানের পরাজয় ও মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া বশ্যতা স্বীকার করিলেন। শ্রীহট্ট সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হইল এবং প্রধান প্রধান পাঠানদের বন্দী করিয়া রাখা হইল। অতঃপর ইসলাম খান কাছাড়ের রাজা শত্রুদমনের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিলেন। শত্রুদমন কিছুদিন যুদ্ধ করার পর বশ্যতা স্বীকার করিলেন এবং মুঘল সম্রাটকে কর দিতে স্বীকৃত হইলেন (১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ)।

এইরূপে ইসলাম খান সমগ্র বাংলা দেশে মুঘল শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। এই সমুদয় অভিযানের সময় ইসলাম খান অধিকাংশ সময় ঢাকা নগরীতেই বাস করিতেন, কারণ তিনি নিজে কখনও সৈন্য চালনা অর্থাৎ যুদ্ধ করিতেন না। মানসিংহও প্রায় দুই বৎসর ঢাকায় ছিলেন (১৬০২-৪ খ্রীষ্টাব্দ) এবং ইহাকে সুরক্ষিত করিয়াছিলেন। ইসলাম খান ঢাকায় একটি নূতন দুর্গ ও ভাল ভাল রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন। ওদিকে গঙ্গানদীর স্রোত পরিবর্তন রাজধানী রাজমহলে আর বড় বড় রণতরী যাইতে পারিত না। আরাকানের মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যও ঢাকা রাজমহল অপেক্ষা অধিকতর উপযোগী স্থান ছিল। এই সমুদয় বিবেচনা করিয়া ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইসলাম খান রাজমহলের পরিবর্তে ঢাকায় সুবে বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এই নগরীর নূতন নাম রাখিলেন জাহাঙ্গীরনগর।

বাংলা দেশে মুঘল রাজ্য দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়া ইসলাম খান অতঃপর কামরূপ রাজ্য জয়ের আয়োজন করিলেন। কামরূপে পূর্বে যে মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, পরে কোচবিহারের হিন্দু রাজা উহা দখল করেন। কোচবিহার রাজবংশের এক শাখা কামরূপে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। ইহা পশ্চিমে সঙ্কোশ হইতে পূর্বে বরা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইহার অধিপতি পরীক্ষিৎ নারায়ণের বহু সৈন্য, হস্তী ও রণতরী ছিল। কোচবিহার রাজ কি কারণে মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করেন এবং কিরূপে তাঁহার প্ররোচণায় ও সাহায্যে ইসলাম খান কামরূপ রাজ্য আক্রমণ ওজয় করেন তাহা দ্বাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে।

ইহাই ইসলাম খানের শেষ বিজয়। কামরূপ জয়ের অনতিকাল পরেই ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালে তাঁহার মৃত্যু হয় (আগস্ট, ১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ)। মাত্র পাঁচ বৎসরের মধ্যে ইসলাম খান সমগ্র বাংলা দেশে মুঘল রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি–শৃঙ্খলা ও সুশাসনের প্রবর্তন করিয়া অদ্ভুত দক্ষতা, সাহস ও রাজনীতিজ্ঞানের পরিচয় দিয়াছিলেন। আকবরের সময় মুঘলেরা বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলা জয়ের গৌরব ইসলাম খানেরই প্রাপ্য এবং তিনিই বাংলা দেশের মুঘল সুবাদারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। অবশ্য ইহাও সত্য যে মানসিংহই তাঁহার সাফল্যের পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন।

সুবাদার কাশিম খান ও ইব্রাহিম খান

ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাশিম খান তাঁহার স্থানে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠের বুদ্ধি ও যোগ্যতার বিন্দুমাত্রও তাঁহার ছিল না। তিনি স্বীয় কর্মচারী ও পরাজিত রাজাদিগের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করিতেন। কোচবিহার ও কামরূপের দুই রাজাকে ইসলাম খান যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন তাহা ভঙ্গ করিয়া কাশিম খান তাহাদিগকে বন্দী করিলেন। ইহার ফলে উভয় রাজ্যেই বিদ্রোহ উপস্থিত হইল এবং তাহা দমন করিতে কাশিম খানকে বেগ পাইতে হইল। অতঃপর কাশিম খান কাছাড়ের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। সম্ভবতঃ কাছাড়ের রাজা শত্রুদমন মুঘলের অধীনতা অস্বীকার করিয়া বিদ্রোহী হইয়াছিলেন। কিন্তু সেখান হইতে মুঘলসৈন্য ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া আসিল-শত্রুদমন বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিলেন। বীরভূমের জমিদারগণও সম্ভবতঃ মুঘলের অধীনতা অস্বীকার করিয়াছিলেন। কাশিম খান তাঁহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন, কিন্তু বিশেষ কোন ফল লাভ হইল না। আরাকানের মগ রাজা ও সন্দীপের অধিপতি পর্তুগীজ জলদস্যু সিবাষ্টিয়ান গোঞ্জালেস একযোগে আক্রমণ করিয়া ভুলুয়া প্রদেশ বিধ্বস্ত করিলেন (১৬১৪ খ্রীষ্টাব্দ)। পর বৎসর আরাকানরাজ পুনরায় আক্রমণ করিলেন, কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে মুঘলের হস্তে বন্দী হইলেন এবং নিজের সমস্ত লোকজন ও ধনসম্পত্তি মুঘলদের হাতে সমর্পণ করিয়া মুক্তিলাভ করিলেন।

কাশিম খান আসাম জয় করিবার জন্য একদল সৈন্য পাঠাইলেন। তাহারা অহোম্রাজ কর্ত্তৃক পরাস্ত হইল। চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে প্রেরিত মুঘল বাহিনীও পরাস্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল। এইরূপে কাশিম খানের আমলে (১৬১৪-১৭ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলায় মুঘল শাসন অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িল।

পরবর্তী সুবাদার ইব্রাহিম খান ফতেজঙ্গ ত্রিপুরা দেশ জয় করিয়া ত্রিপুরার রাজাকে সপরিবারে বন্দী করেন। এদিকে আরাকানরাজ মেঘনার তীরবর্তী গ্রামগুলি আক্রমণ করেন কিন্তু ইব্রাহিম তাঁহাকে তাড়াইয়া দেন। মোটের উপর ইব্রাহিম খানের আমলে বাংলা দেশে সুখ ও শান্তি বিরাজ করিত এবং মুঘলরাজের শক্তি ও প্রতিপত্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

কিন্তু এই সময়ে এক অদ্ভুত ব্যাপারে বাংলা দেশের সুবাদার ইব্রাহিম খান এক জটিল সমস্যায় পড়িলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিলেন এবং পরাজিত হইয়া বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। শাহজাহান বাংলার পুরাতন বিদ্রোহী মুসা খানের পুত্র এবং শত্রু আরাকানরাজ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তায় বাংলায় স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। ইব্রাহিম প্রভু-পুত্রের সহিত বিবাদ করিতে প্রথমত ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অবশেষে শাহজাহান রাজমহল দখল করিলে দুই পক্ষে যুদ্ধ হইল। ইব্রাহিম পরাজিত ও নিহত হইলেন এবং শাহজাহান রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর অধিকার করিয়া স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতে লাগিলেন (এপ্রিল, ১৬২৪ খ্রীষ্টাব্দ)। তিনি পূর্বেই উড়িষ্যা অধিকার করিয়াছিলেন। এবার তিনি বিহার ও অযোধ্যা অধিকার করিলেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বাদশাহী ফৌজের হস্তে পরাজিত হইয়া তিনি বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া গেলেন (অক্টোবর, ১৬২৪ খ্রী)। ইহার চারি বৎসর পরে পিতার মৃত্যুর পর শাহজাহান সম্রাট হইলেন।

সম্রাট শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে বাংলা দেশের অবস্থা

সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনে আরোহণ (১৬২৮ খ্রী) হইতে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু (১৭০৭ খ্রী) পর্যন্ত বাংলা দেশে মুঘল শাসন মোটামুটি শান্তিতেই পরিচালিত হইয়াছিল। এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে তিনজন সুবাদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (১) শাহজাহানের পুত্র শুজা (১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রী), (২) শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৮৮ খ্রী) এবং (৩) ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমুস্সান (১৬৯৮-১৭০৭ খ্রী)। এই যুগে বাংলার কোন স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল না। ইহা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসেরই অংশে পরিণত হইয়াছিল এবং ইহার শাসনপ্রণালীও মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য সুবার ন্যায় নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হইত।

শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম ভাগে হুগলি বন্দর হইতে পর্তুগীজদিগকে বিতাড়িত করা হয় (১৬৩২ খ্রী)। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হইবে। অহহাদিগের সহিতও পুনরায় যুদ্ধ হয়। ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে মুঘলসৈন্য অহোম রাজার হস্তে পরাজিত হয়। কামরূপের রাজা পরীক্ষিত্নারায়ণ কাশিম খানের হস্তে বন্দী হওয়ায় যে বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পূর্বেই উক্ত হইয়াছে। ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যুর পর চাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিনারায়ণ মুঘল-বিজয়ী অহোম রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহার ফলে অহোরাজ ও বাংলার মুঘল সুবাদারের মধ্যে বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলে। বলিনারায়ণ মুঘলসৈন্যদের পরাজিত করিয়া কামরূপের ফৌজদারকে বন্দী করেন। বহুদিন যুদ্ধের পর অবশেষে মুঘলদেরই জয় হইল। মুঘলেরা কামরূপ জয় করিয়া অহোম রাজার সহিত সন্ধি করিল (১৬৩৮ খ্রী)। উত্তরে বরা নদী ও দক্ষিণে অসুরালি দুই রাজ্যের সীমানা নির্দিষ্ট হইল।

অতঃপর শুজার সুদীর্ঘ শান্তিপূর্ণ শাসনের ফলে বাংলা দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি হয় (১৬২৯-৫৯ খ্রী)। কিন্তু সিংহাসন লাভের জন্য ভ্রাতা ঔরঙ্গজেবের সহিত বিবাদের ফলে শুজা খাজুয়ার যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া পলায়ন করেন (জানুয়ারী, ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে)। মুঘল সেনাপতি মীরজুমলা তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ঢাকা নগরী দখল করেন (মে, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)। শুজা আরাকানে পলাইয়া গেলেন। দুই বৎসর পরে আরাকানরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগে তিনি নিহত হইলেন।

অতঃপর মীরজুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন (জুন, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)। শুজা যখন ঔরঙ্গজেবের সহিত যুদ্ধ করিতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন সুযোগ বুঝিয়া কোচবিহারের রাজা কামরূপ ও অহোম্রাজ গৌহাটি অধিকার করিলেন (মার্চ, ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দ)। তারপর এই দুই রাজার মধ্যে বিবাদের ফলে অহোরাজ কোচবিহাররাজকে বিতাড়িত করিয়া কামরূপ অধিকার করেন (মার্চ, ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ)।

মীরজুমলা সুবাদার নিযুক্ত হইয়াই কোচবিহার ও কামরূপের বিরুদ্ধে এক বিপুল অভিযান প্রেরণ করিলেন (১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দ)। কোচবিহাররাজ পলায়ন করায় বিনা যুদ্ধে মীরজুমলা এই রাজ্য অধিকার করিলেন এবং অহোম্রাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। অহোরাজও পলায়ন করিলেন এবং তাঁহার রাজধানী মীরজুমলার হস্তগত হইল (মার্চ, ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দ)। বর্ষা আসিলে সমস্ত দেশ জলে ডুবিয়া যাওয়ায় মুঘল ঘাঁটিগুলি পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল এবং খাদ্য সরবরাহেরও কোন উপায় রহিল না। মুঘল শিবির জলে ডুবিয়া গেল, খাদ্যভাবে বহু অশ্ব মারা গেল, সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিল এবং বহু সৈন্যের মৃত্যু হইল। সুযোগ বুঝিয়া অহোম্ সৈন্য পুনঃপুনঃ মুঘল শিবির আক্রমণ করিল। অবশেষে বর্ষার শেষ হইলে এই দুঃখকষ্টের অবসান হইল। মীরজুমলা সৈন্যসহ অহোম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু অকস্মাৎ তিনি গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হইয়া পড়িলেন। তখন অহোম্রাজের সহিত সন্ধি করিয়া মুঘলসৈন্য বাংলা দেশে ফিরিয়া আসিল। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছিবার পূর্বে মাত্র কয়েক মাইল দূরে তাঁহার মৃত্যু হইল (মার্চ, ১৬৬৩ খ্রী)। এই সমুদয় গোলযোগের মধ্যে কোচবিহারের রাজা তাঁহার রাজ্য পুনরুদ্ধার করিলেন।

মীরজুমলার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রায় এক বৎসর যাবৎ বাংলা দেশের শাসনকার্যে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে শায়েস্তা খান বাংলা দেশের সুবাদার হইয়া আসিলেন। মাঝখানে এক বৎসর বাদ দিয়া মোট ২২ বৎসর তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। শায়েস্তা খান রাজোচিত ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকের সহিত নিরুদ্বেগে জীবন কাটাইতেন এবং সম্রাটকে বহু অর্থ পাঠাইয়া খুশি রাখিতেন। বলা বাহুল্য নানা উপায়ে প্রজার রক্ত শোষণ করিয়াই এই টাকা আদায় হইত। একচেটিয়া ব্যবসায়ের দ্বারাও অনেক টাকা আয় হইত। সমসাময়িক ইংরেজদের রিপোর্টে শায়েস্তা খানের অর্থগৃধনুতার উল্লেখ আছে। তাঁহার সুবাদারীর প্রথম ১৩ বৎসরে তিনি ৩৮ কোটি টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাঁহার দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা আর ব্যয় ছিল এক লক্ষ টাকা।

বৃদ্ধ শায়েস্তা খান নিজে যুদ্ধে যাইতেন না এবং হারেমে আরামে দিন কাটাইতেন কিন্তু উপযুক্ত কর্মচারীর সাহায্যে তিনি কঠোর হস্তে ও শৃঙ্খলার সহিত দেশ শাসন করিতেন। তিনি কুচবিহারের বিদ্রোহী রাজাকে তাড়াইয়া পুনরায় ঐ রাজ্য মুঘলের অধীনে আনয়ন করিলেন এবং ছোটখাট বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করিলেন। তাঁহার শাসনকালের প্রধান ঘটনা চট্টগ্রাম বিজয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন এবং ইহা মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। ইহারা বাংলা দেশ হইতে বহু লোক বন্দী করিয়া নিত, তাহাদের হাতে ছিদ্র করিয়া তাঁহার মধ্য দিয়া বেত চালাইয়া, অনেককে এক সঙ্গে বাধিয়া নৌকার পাটাতনের নীচে ফেলিয়া রাখিত–প্রতিদিন উপর হইতে কিছু চাউল তাহাদের আহারের জন্য ফেলিয়া দিত। পর্তুগীজরা ইহাদিগকে নানা বন্দরে, বিক্রী করিত–মগেরা তাহাদিগকে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীর ন্যায় ব্যবহার করিত। শায়েস্তা খান প্রথমে সন্দীপ অধিকার করিলেন (নভেম্বর, ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সময় চট্টগ্রামে মগ ও পর্তুগীজদের মধ্যে বিবাদ বাধিল এবং শায়েস্ত খান অর্থ ও আশ্রয় দান করিয়া পর্তুগীজদিগকে হাত করিলেন। প্রধানতঃ তাহাদের সাহায্যেই তিনি চট্টগ্রাম জয় করিলেন (জানুয়ারী, ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ঔরঙ্গজেবের আজ্ঞায় চট্টগ্রামের নূতন নামকরণ হইল ইসলামাবাদ এবং এখানে একজন মুঘল ফৌজদার নিযুক্ত হইলেন। নানা কারণে ইংরেজ বণিকদের সহিত শায়েস্তা খানের বিবাদ হয়। ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে জুন মাসে তাঁহার সুবাদারী শেষ হয়।

শায়েস্তা খানের নাম বাংলা দেশে এখনও খুব পরিচিত। তাঁহার সময় বাংলা দেশে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যাইত। ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশের চাউলের দাম ছিল টাকায় পাঁচ মণ। পূর্ববঙ্গে বহু চাউল উৎপন্ন হয় সুতরাং ঢাকায় চাউল আরও সস্তা হইবার কথা। এই চাউলের দামের কথা স্মরণ রাখিলে শায়েস্তা খানের দৈনিক আয় দুই লক্ষ আর দৈনিক ব্যয় এক লক্ষ টাকার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যাইবে। এই এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের পশ্চাতে যে দালান-ইমারত নির্মাণ, জাঁকজমক, দান-দক্ষিণা, আশ্রিত-পোষণ প্রভৃতি ছিল তাহাই সম্ভবত শায়েস্তা খানের লোকপ্রিয়তার কারণ।

শায়েস্তা খানের পর ঔরঙ্গজেবের ধাত্রীপুত্র অপদার্থ খান-ই-জহান বাহাদুর বাংলার সুবাদার হইলেন। এক বৎসর পরেই এই অপদার্থকে পদচ্যুত করা হইল। কিন্তু তিনি যাওয়ার সময় দুই কোটি টাকা লইয়া গেলেন। তাঁহার পর আসিলেন ইব্রাহিম খান। ইহার শাসনকালের প্রধান ঘটনা মেদিনীপুর জিলার অন্তর্গত ঘাটালের চন্দ্রকোণা বিভাগের একজন সাধারণ জমিদার শোভাসিংহের বিদ্রোহ। রাজা কৃষ্ণরাম নামে একজন পাঞ্জাবী বর্ধমান জিলার রাজস্ব আদায়ের ইজারা লইয়া ছিলেন। শোভসিংহ পার্শ্ববর্তী স্থানে লুঠতরাজ আরম্ভ করিলে কৃষ্ণরাম তাঁহাকে বাধা দিতে গিয়া নিহত হন (জানুয়ারী, ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং শোভারাম বর্ধমান দখল করেন। এইরূপে অর্থসংগ্রহ করিয়া শোভসিংহ অনুচরের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং রাজা উপাধি ধারণ করেন। উড়িষ্যার পাঠান সর্দার রহিম খান তাঁহার সহিত যোগদান করায় তাঁহার শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে হুগলির উত্তর ও দক্ষিণে ১৮০ মাইল বিস্তৃত ভূখণ্ড তাঁহার হস্তগত হয়। সুবাদার ইব্রাহিম খান এই বিদ্রোহের ব্যাপারে কোনরূপ গুরুত্ব আরোপ না করিয়া পশ্চিম বাংলার ফৌজদারকে বিদ্রোহ দমন করিতে আদেশ দিলেন। উক্ত ফৌজদার প্রথমে হুগলি দুর্গে আশ্রয় লইলেন, পরে বেগতিক দেখিয়া একরাত্রে পলায়ন করিলেন। শোভাসিংহের সৈন্য হুগলিতে প্রবেশ করিয়া শহর লুঠ করিল। ওলন্দাজ বণিকেরা পলায়মান ফৌজদার ও হুগলির লোকদের কাতর প্রার্থনায় একদল সৈন্য পাঠাইলে শোভসিংহ হুগলি ত্যাগ করিয়া বর্ধমানে গেলেন। তিনি রাজা কৃষ্ণরামের কন্যার উপর বলাৎকার করিতে উদ্যত হইলে এই তেজস্বিনী নারী প্রথমে ছুরিকা দ্বারা শোভসিংহকে হত্যা করেন–তারপর নিজের বুকে ছুরি বসাইয়া প্রাণত্যাগ করেন। শোভাসিংহের পর তাঁহার ভ্রাতা হিম্মৎসিংহ দলের কর্ত্তা হইলেন, কিন্তু সৈন্যেরা রহিম খানকেই নায়ক মনোনীত করিল। রহিম খান রহিম শাহ নাম ধারণ করিয়া নিজেকে রাজপদে অভিষিক্ত করিলেন। চারিদিক হইতে নানা শ্রেণীর লোক দলে দলে আসিয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দিল এবং ক্রমে তিনি দশ সহস্র ঘোড়সওয়ার ও ৬০,০০০ পদাতিক সংগ্রহ করিয়া নদীয়ার মধ্য দিয়া মখসুদাবাদ (বর্তমান মুর্শিদাবাদ) অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। পথে একজন জায়গীরদার ও পাঁচ হাজার মুঘলসৈন্যকে পরাজিত করিয়া তিনি মখসুদাবাদ লুণ্ঠন করিলেন এবং রাজমহল ও মালদহ অধিকার করিলেন। তাঁহার অনুচরেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া চারিদিকে লুঠপাট করিয়া ফিরিতে লাগিল (১৬৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ)।

এই সংবাদ পাইয়া ঔরঙ্গজেব ইব্রাহিম খানকে পদচ্যুত করিয়া পরবর্তীকালে আজিমুসসান নামে পরিচিত নিজের পৌত্র আজিমুদ্দীনকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করিলেন এবং রহিম খানের পুত্র জবরদস্ত খানকে অবিলম্বে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আদেশ দিলেন। জবরদস্ত খান বিদ্রোহী রহিম শাহকে পরাজিত করিয়া রাজমহল, মালদহ, মখসুদাবাদ, বর্ধমান প্রভৃতি স্থান অধিকার করিলেন। রহিম শাহ পলাইয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইলেন।

আজিমুসসান বাংলা দেশে পৌঁছিয়া জবরদস্ত খানের কৃতিত্বের সম্মান করা দূরে থাকুক, তাঁহার প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাইলেন। ইহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়া জবরদস্ত খান বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। ফলে রহিম শাহ জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আবার লুঠপাট আরম্ভ করিলেন এবং বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হইয়া সন্ধির প্রস্তাব আলোচনার ছলে সুবাদারের প্রধান মন্ত্রীকে হত্যা করিলেন। তখন আজিমুসসান তাঁহার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। এই বাহিনীর সহিত যুদ্ধে রহিম শাহ পরাজিত ও নিহত হইলেন। বিদ্রোহীদের দল ভাঙ্গিয়া গেল। (অগস্ট, ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে বাংলা (ও অন্যান্য) সুবার শাসনপ্রণালীর কিরূপ অবনতি হইয়াছিল, তাহা বুঝাইবার জন্য শোভাসিংহের বিদ্রোহ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইল। আর একটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। এই বিদ্রোহের সময় কলিকাতা, চন্দননগর উঁচড়ার ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ বণিকেরা সুবাদারের অনুমতি লইয়া নিজেদের বাণিজ্য-কুঠিগুলি দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত করিল এবং এই সমস্ত স্থানই এই ঘোর দুর্দিনে বাঙালীর একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হইয়া উঠিল। বাংলার ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ইহার প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হইয়াছিল।

আজিমুসসান ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ছিলেন। শেষ দশ বৎসর তিনি বিহারেরও সুবাদার ছিলেন এবং ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে পাটনায় বাস করিতেন। তিনি জানিতেন যে বৃদ্ধ সম্রাটের মৃত্যু হইলেই সিংহাসন লইয়া যুদ্ধ বাধিবে এবং এই জন্যই তিনি নানা অবৈধ উপায়ে এবং অনেক সময় প্রজাদের উৎপীড়ন করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতেন। কিন্তু দিওয়ান মুর্শিদকুলী খান খুব দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মচারী ছিলেন। তিনি আজিমুসসানের অবৈধ অর্থ সংগ্রহের পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া আজিমুসসান মুর্শিদকুলী খানকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিলেন। ইহা ব্যর্থ হইল, কিন্তু মুর্শিদকুলী খান সমস্ত ব্যাপার সম্রাটকে জানাইয়া অবিলম্বে দিওয়ানী বিভাগ মখসুদাবাদে সরাইয়া নিলেন। বহু বৎসর পরে সম্রাটের অনুমতিক্রমে মুর্শিদকুলীর নাম অনুসারে এই নগরীর নাম হয় মুর্শিদাবাদ।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ সম্রাট হইলেন (১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দ)। পুত্র আজিমুসসানের প্ররোচনায় সম্রাট মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যের দিওয়ান করিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু বাংলার নতুন দিওয়ান বিদ্রোহী সেনার হস্তে নিহত হওয়ায় মুর্শিদকুলী খান পুনরায় বাংলার দিওয়ান নিযুক্ত হইলেন (১৭১০ খ্রীষ্টাব্দ)।

১০. নবাবী আমল

দশম পরিচ্ছেদ – নবাবী আমল

মুর্শিদকুলী খান

১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান বাংলার সুবাদার বা নবাব নিযুক্ত হইলেন। এই সময়ে দিল্লির অকর্মণ্য সম্রাটগণের দুর্বলতায় ও আত্মকলহে মুঘল সাম্রাজ্য চরম দুর্দশায় পৌঁছিয়াছিল। সুতরাং এখন হইতে বাংলার সুবাদারেরা প্রায় স্বাধীন ভাবেই কার্য করিতে লাগিলেন এবং বংশানুক্রমে সুবাদার বা নবাবের পদ অধিকার করিতে লাগিলেন। ইহার ফলে বাংলায় নবাবী আমল আরম্ভ হইল। কিন্তু বাংলা হইতে দিল্লি দরবারে রাজস্ব পাঠান হইত এবং বাদশাহী সনদের বলেই সুবাদারী পদে নূতন নিয়োগ হইত।

মুর্শিদকুলী খান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বাল্যকালে একজন মুসলমান তাঁহাকে ক্রয় করিয়া পুত্রবৎ পালন করে এবং পারস্য দেশে লইয়া যান। সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া মুর্শিদকুলী খান বহু উচ্চ পদ অধিকার করেন এবং অবশেষে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদকুলী বহুকাল সুযোগ্যতার সহিত দিওয়ানী কার্য করিয়াছিলেন, সুতরাং সুবাদার হইয়াও রাজস্ব-বিভাগের দিকে তিনি খুব বেশি ঝোঁক দিতেন। পরে এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হইবে। তাঁহার সময়ে দেশে শান্তি বিরাজ করিত এবং ছোটখাট বিদ্রোহ সহজেই দমিত হইত। এইরূপ ঘটনার মধ্যে সীতারাম রায়ের সহিত যুদ্ধই প্রধান। ইহাও পরে আলোচিত হইবে। মুর্শিদকুলী খানের শাসনকালে আর কোনও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে নাই।

শুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান

মুর্শিদকুলী খানের কোন পুত্র-সন্তান ছিল না। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার জামাতা শুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান মুর্শিদকুলীর দৌহিত্র ও মনোনীত উত্তরাধিকারী সরফরাজ খানকে না মানিয়া নিজেই বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদে অধিষ্ঠিত হইলেন (জুন, ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দ)। হাজী আহমদ এবং আলীবর্দী নামক দুই ভ্রাতা, রাজস্ব বিভাগের বিচক্ষণ কর্মচারী আলমচাঁদ এবং বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠ ফতোদ তাঁহার সভায় খুব প্রতিপত্তি লাভ করিলেন।

শুজাউদ্দীনের অনেক গুণ ছিল, কিন্তু তিনি বিলাসী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হওয়ায় ক্রমে রাজকার্য বিশেষ কিছু দেখিতেন না এবং উপরোক্ত চারিজনের উপরই নির্ভর করিতেন। দিল্লির বাদশাহও প্রাদেশিক ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতেন না। সুতরাং নবাবের অনুগ্রহভাজন বিশ্বস্ত কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থ সাধন করার প্রচুর সুযোগ পাইলেন এবং ইহার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিলেন। নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য ইহারা নবাবের সহিত তাঁহার পুত্রদ্বয়ের কলহ ঘটাইতেন।

১৭৩৩ খ্রীস্টাব্দে বিহার প্রদেশ বাংলা সুবার সহিত যুক্ত হইল। তখন শুজাউদ্দীন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়া পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর বাংলার কতক অংশের শাসনভার নিজের হাতে রাখিলেন; পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর বাংলায় অবশিষ্ট অংশের জন্য ঢাকায় একজন এবং বিহার ও উড়িষ্যা শাসনের জন্য আরও দুইজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত হইলেন। আলীবর্দী খান বিহারের প্রথম নায়েব নাজিম হইলেন। মীর হবীর গ্রামে ঢাকার নায়েব নাজিমের একজন দক্ষ কর্মচারী ত্রিপুরার রাজপরিবারের অন্তর্কলহের সুযোগ লইয়া সহসা ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়া রাজধানী চণ্ডগড় ও রাজ্যের অন্যান্য অংশ দখল ও বহু ধনরত্ন লুণ্ঠন করিয়া আনিলেন। বীরভূমের আফগান জমিদার বদিউজ্জমান বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন। শুজাউদ্দীনের শাসনকালে ঢাকায় চাউলের দর আবার টাকায় আট মণ হইয়াছিল।

সরফরাজ খান

শুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সরফরাজ খান বাংলার নবাব হইলেন (মার্চ, ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দ)। সরফরাজ একেবারে অপদার্থ এবং নবাবী পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন এবং অধিকাংশ সময়েই হারেমে কাটাইতেন। সুতরাং শাসন কার্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল এবং নানা প্রকার ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি হইল। হাজী আহ্মদ ও আলীবর্দী খান এই সুযোগে বাংলা দেশে প্রভুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। হাজী আহমদ মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে তাঁহাকে স্তে কিবাক্যে তুষ্ট রাখিলেন–ওদিকে আলীবর্দী খান পাটনা হইতে সসৈন্যে বাংলার দিকে যাত্রা করিলেন (মার্চ, ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ)। হাজী আহমদ মিথ্যা আশ্বাসে নবাবকে ভুলাইয়া অবশেষে সপরিবারে আলীবর্দীর সঙ্গে যোগ দিলেন।

সরফরাজ খান সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া বর্তমান সুতীর নিকটে গিরিয়াতে পৌঁছিলেন। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল গিরিয়াতে দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হইলেন। দুই তিন দিন পরে আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ অধিকার করিলেন। তিনি মৃত নবাবের পরিবারবর্গের প্রতি খুব সদয় ব্যবহার করিলেন এবং তাঁহারা যাহাতে যথোচিত মর্যাদার সহিত জীবন যাপন করিতে পারেন, তাঁহার ব্যবস্থা করিলেন। আলীবর্দী তাঁহার উপকারী প্রভুর পুত্রকে হত্যা করিয়া মহাপাপ করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। তিনিও তাহা স্বীকার করিয়া সরফরাজের আত্মীয় স্বজনের নিকট দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করিলেন। তাঁহার দুষ্কর্মের জন্য তাঁহার প্রতি জনসাধারণের বিরাগ ও অশ্রদ্ধা দূর করিতে তিনি সকলের সহিত সদয় ব্যবহার ও অনেককে অর্থ দিয়া তুষ্ট করিলেন। দিল্লির বাদশাহ এবং তাঁহার প্রধান সভাসদগণকে প্রচুর উৎকোচ প্রদান করিয়া তিনি সুবাদারী পদের বাদশাহী সনদ পাইলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের যে কতদূর অবনতি ঘটিয়াছিল ইহা হইতেই তাহা বুঝা যায়।

আলীবর্দী খান

আলীবর্দী খানও সুখে বা শান্তিতে বাংলার নবাবী করিতে পারেন নাই। নবাব শুজাউদ্দীনের জামাতা রুস্তম জং উড়িষ্যার নায়েব নাজিম ছিলেন–তিনি সসৈন্যে কটক হইতে বাংলা দেশ অভিমুখে যাত্রা করিলেন (ডিসেম্বর, ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী নিজে তাঁহার বিরুদ্ধে অগ্রসর হইয়া বালেশ্বরের অনতিদূরে ফলওয়ারির যুদ্ধে তাঁহাকে পরাজিত করিলেন (মার্চ, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করিয়া মুর্শিদাবাদে ফিরিলেন। কিন্তু এই নূতন নায়েব নাজিমের অযোগ্যতা ও দুর্ব্যবহারে প্রজাগণ অসন্তুষ্ট হওয়ায় রুস্ত ম জং একদল মারাঠা সৈন্যের সাহায্যে পুনরায় উড়িষ্যা দখল করিলেন। নূতন নায়েব নাজিম সপরিবারে বন্দী হইলেন (অগস্ট, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী আবার উড়িষ্যায় গিয়া রুস্তম জংয়ের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করিলেন (ডিসেম্বর, ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। মুর্শিদাবাদ ফিরিবার পথে আলীবর্দী সংবাদ পাইলেন যে নাগপুর হইতে ভেঁসলারাজের মারাঠা সৈন্য বাংলা দেশের অভিমুখে আসিতেছে।

মারাঠা সৈন্য পাঁচেকের মধ্য দিয়া বর্ধমান জিলায় পৌঁছিয়া লুঠপাট আরম্ভ করিল। নবাব দ্রুতগতিতে বর্ধমানে পৌঁছিলেন (এপ্রিল, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ), কিন্তু অসংখ্য মারাঠা সৈন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। তাঁহার সঙ্গে ছিল মাত্র তিন হাজার অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক–বাকী সৈন্য পূর্বেই মুর্শিদাবাদে ফিরিয়া গিয়াছিল। আলীবর্দী বর্ধমানে অবরুদ্ধ হইয়া রহিলেন এবং মারাঠারা তাঁহার রসদ সরবরাহ বন্ধ করিয়া ফেলিল। অবশেষে কোন মতে মারাঠা ব্যুহ ভেদ করিয়া বহু কষ্টে তিনি কাটোয়ায় পৌঁছিলেন। মারাঠা বাহিনীর নায়ক ভাস্কর পণ্ডিত ফিরিয়া যাইতে মনস্থ করিলেন, কিন্তু পরাজিত ও বিতাড়িত রুস্তম জংয়ের বিচক্ষণ নায়েব মীর হবীবের পরামর্শ ও সাহায্যে পুনরায় যুদ্ধ চালাইলেন। একদল মারাঠা নবাবের পশ্চাদ্ধাবন করিল-বাকী মারাঠারা চতুর্দিকে গ্রাম জ্বালাইয়া ধনসম্পত্তি লুঠ করিয়া ফিরিতে লাগিল। মীর হবীরের সহায়তায় মারাঠা নায়ক ভাস্কর পণ্ডিত এক রাত্রির মধ্যে ৭০০ অশ্বারোহী সৈন্যসহ ৪০ মাইল পার হইয়া মুর্শিদাবাদ শহর আক্রমণ করিয়া সারাদিন লুঠ করিলেন–পরদিন সকালে (৭ই মে, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ) আলীবর্দী মুর্শিদাবাদে পৌঁছিলে, মারাঠা সৈন্য কাটোয়া অধিকার করিল এবং ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রাজমহল হইতে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড মারাঠাদের শাসনাধীন হইল। এই অঞ্চলে মারাঠারা অকথ্য অত্যাচার করিতে লাগিল। ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্প পোপ পাইল। লোকেরা ধন, প্রাণ ও মান রক্ষার জন্য দলে দলে ভাগীরথীর পূর্ব দিকে পলাইতে লাগিল। সমসাময়িক ইংরেজ ও বাঙালী লেখকরা এই বীভৎস অত্যাচারের যে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহা চিরদিন মারাঠা জাতির ইতিহাসে কলঙ্কের বিষয় হইয়া থাকিবে। বাঙালীরা মারাঠা সৈন্যদিগকে ‘বর্গী’ বলিত। বাংলা দেশে মারাঠা সৈন্যদের মধ্যে এক শ্রেণীর নাম ছিল শিলাদার। ইহারা নিজেদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করিত। নিম্নশ্রেণীর যে সমুদয় সৈন্যদের অশ্ব ও অস্ত্র মারাঠা সরকার দিতেন তাহাদের নাম ছিল বার্গীর! বর্গী এই বার্গীরেরই অপভ্রংশ। বর্গীদের অত্যাচার সম্বন্ধে সমসাময়িক গঙ্গারাম কর্ত্তৃক রচিত মহারাষ্ট্র পুরাণ হইতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি :

ছোট বড় গ্রামে জত লোক ছিল।
বরগির ভএ সব পলাইল ॥
চাইর দিগে তোক পলাঞ ঠাঞি ঠাঞি।
ছত্তিস বর্ণের লোক পলাএ তার অন্ত নাঞি ॥
এই মতে সব লোক পলাইয়া জাইতে।
আচম্বিতে বরগি ঘেরিলা আইসা সাথে ॥
মাঠে ঘেরিয়া বরগি দেয় তবে সাড়া।
সোনা রূপা লুটে নেএ আর সব ছাড়া ॥
কারূ হাত কাটে কারূ নাক কান।
একি চোটে কারা বধএ পরাণ ॥
ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত ধইরা লইয়া জাএ।
অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।
একজনে ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে ॥
এই মতে বরগি কত পাপ কৰ্ম্ম কইরা।
সেই সব স্ত্রীলোকে জত দেয় সব ছাইড়া ॥
তবে মাঠে লুটিয়া বরগি গ্রামে সাধাএ।
বড় বড় ঘর আইসা আগুনি লাগাএ।
বাঙ্গালা চৌআরি জত বিষ্ণু মোণ্ডব।
ছোট বড় ঘরে আদি পোড়াইল সব ॥
এই মতে জতসব গ্রাম পোড়াইয়া।
চতুর্দিগে বরগি বেড়াএ লুটিয়া ॥
কাহুকে বাঁধে বরগি দিআ পিঠ মোড়া।
চিত কইরা মারে লাথি পাএ জুতা চড়া ॥
রূপি দেহ দেহ বোলে বারে বারে।
রূপি না পাইয়া তবে নাকে জল ভরে ॥
কাহুকে ধরিয়া বরগি পখইরে ডুবা।
ফাঁকর হইঞা তবে কারু প্রাণ জাএ।

–মহারাষ্ট্র পুরাণ, চিন্তয়সী সংস্করণ, ১৩৭৩

আলীবর্দী নিশ্চিত ছিলেন না। বর্ষাকালে পাটনা ও পূর্ণিয়া হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া বর্ষাশেষে তিনি কাটোয়া আক্রমণ করিলেন। মারাঠা লুঠপাটের টাকায় খুব ধুমধামের সহিত দুর্গা পূজা করিতেছিল–কিন্তু সারারাত্রি চলিয়া ঘোরাপথে আসিয়া আলীবর্দীর সৈন্য সহসা নবমী পূজার দিন সকালবেলা নিদ্রিত মারাঠা সৈন্যকে আক্রমণ করিল। মারাঠারা বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল। ভাস্কর পণ্ডিত পলাতক মারাঠা সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মেদিনীপুর অঞ্চল লুঠিতে লাগিলেন এবং কটক অধিকার করিলেন। আলীবর্দী সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া কটক পুনরধিকার করিলেন এবং মারাঠারা চিল্কা হ্রদের দক্ষিণে পলাইয়া গেল (ডিসেম্বর, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।

ইতিমধ্যে দিল্লির বাদশাহ মারাঠারাজ সাহুকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চৌথ আদায় করিবার অধিকার দিবেন এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন এবং সাহু নাগপুরের মারাঠারাজ রঘুজী ভোসলাকে ঐ অধিকার দান করিয়াছিলেন। কিন্তু দিল্লির বাদশাহ এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পেশোয়া বালাজী রাওর সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। বালাজী ও রঘুজীর মধ্যে বিষম শত্রুতা ছিল। সুতরাং বালাজী অভয় দিলেন যে ভোঁসলার মারাঠা সৈন্যদের তিনি বাংলা দেশ হইতে তাড়াইয়া দিবেন (নভেম্বর, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।

১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে রঘুজী ভেসলা ভাস্কর পণ্ডিতকে সঙ্গে লইয়া বাংলা দেশ অভিমুখে অগ্রসর হইলেন এবং মার্চ মাসে কাটোয়ায় পৌঁছিলেন। ওদিকে পেশোয়া বালাজী রাও বিহারের মধ্য দিয়া বাংলা দেশের দিকে যাত্রা করিলেন। সারা পথ তাঁহার সৈন্যেরা লুঠপাট ও ঘর-বাড়ী-গ্রাম জ্বালাইতে লাগিল–যাঁহারা পেশোয়াকে টাকা-পয়সা বা মূল্যবান উপঢৌকন দিয়া খুশী করিতে পারিল তাহারাই রক্ষা পাইল।

ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বহরমপুরের দশ মাইল দক্ষিণে নবাব আলীবর্দী ও পেশোয়া বালাজী রাওয়ের সাক্ষাৎ হইল (৩০শে মার্চ, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। স্থির হইল যে বাংলার নবাব মারাঠারাজ সাহুকে চৌথ দিবেন এবং বালাজী রাওকে তাঁহার সামরিক অভিযানের ব্যয় বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দিবেন। পেশোয়া কথা দিলেন যে ভেসলার অত্যাচার হইতে বাংলা দেশকে তিনি রক্ষা করিবেন।

রঘুজী ভেসলা এই সংবাদ পাইয়া কাটোয়া পরিত্যাগ করিয়া বীরভূমে গেলেন। বালাজী রাও তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এবং রঘুজীকে বাংলা দেশের সীমার বাহিরে তাড়াইয়া দিলেন। এই উপলক্ষে কলিকাতার বণিকগণ ২৫,০০০ টাকা চাঁদা তুলিয়া কলিকাতা রক্ষার জন্য মারাঠা ডিচ’ নামে খ্যাত পয়ঃপ্রণালী কাটাইয়াছিলেন। ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাস হইতে পরবর্তী ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বাংলা দেশ মারাঠা উৎপীড়ন হইতে রক্ষা পাইল।

ইতিমধ্যে মারাঠারাজ সাহু ভোসলা ও পেশোয়াকে ডাকাইয়া উভয়ের মধ্যে গোলমাল মিটাইয়া দিলেন (৩১শে অগস্ট, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। বাংলার চৌথ আদায়ের বাঁটোয়ারা হইল। বিহারের পশ্চিম ভাগ পড়িল পেশোয়ার ভাগে, আর বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহারের পূর্বভাগ পড়িল ভেসলার ভাগে। স্থির হইল যে, উভয়ের নিজেদের অংশে যথেচ্ছ লুঠতরাজ করিতে পারিবেন। একজন অপরজনকে বাধা দিতে পারিবেন না।

এই বন্দোবস্তের ফলে ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় মেদিনীপুরে প্রবেশ করিলেন (মার্চ, ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দ)। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া আলীবর্দী প্রমাদ গণিলেন। বালাজী রাওকে যে উদ্দেশ্যে তিনি টাকা দিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইল এবং আবার মারাঠাদের অত্যাচার আরম্ভ হইল। এদিকে তাঁহার রাজকোষ শূন্য; পুনঃ পুনঃ বর্গীর আক্রমণে দেশ বিধ্বস্ত এবং সৈন্যদল অবসাদগ্রস্ত; তখন নবাব আলীবর্দী ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’ এই নীতি অবলম্বন করিলেন। তিনি চৌথ সম্বন্ধে একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিবার জন্য ভাস্কর পণ্ডিতকে তাঁহার শিবিরে আমন্ত্রণ করিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের তাঁবুতে পৌঁছিলে তাঁহার ২১ জন সেনানায়ক ও অনুচর সহ তাঁহাকে হত্যা করা হইল (৩১শে মার্চ, ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দ)। অমনি মারাঠা সৈন্য বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।

নবাব আলীবর্দীর অধীনে ৯০০০ অশ্বারোহী ও কিছু পদাতিক আফগান সৈন্য ছিল। এই সৈন্যদলের অধ্যক্ষ গোলাম মুস্তাফা খান নবাবের অনুগত ও বিশ্বাসভাজন ছিলেন এবং তাঁহারই পরামর্শে ও সাহায্যে ভাস্কর পণ্ডিতকে নবাবের তাঁবুতে আনা সম্ভবপর হইয়াছিল। ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইতস্তত করিলে মুস্তাফা কোরানের শপথ করিয়া তাঁহাকে অভয় দেন এবং সঙ্গে করিয়া নবাবের তাঁবুতে আনিয়া হত্যা করেন। নবাব অঙ্গীকার করিয়াছিলেন যে মুস্তাফা ভাস্কর পণ্ডিত ও মারাঠা সেনানায়কদের হত্যা করিতে পারিলে তাহাকে বিহার প্রদেশের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিবেন। নবাব এই প্রতিশ্রুতি পালন না করায় মুস্তাফা বিহারে বিদ্রোহ করেন (ফেব্রুয়ারী, ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দ) এবং রঘুজী ভোসলাকে বাংলা দেশ আক্রমণ করিতে উত্তেজিত করেন। মুস্তাফা পাটনার নিকট পরাজিত হন কিন্তু রঘুজী বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হন।

বর্ধমানে রাজকোষের সাত লক্ষ টাকা লুঠ করিয়া রঘুজী বীরভূমে বর্ষাকাল যাপন করেন এবং সেপ্টেম্বর মাসে বিহারে গিয়া বিদ্রোহী মুস্তাফার সঙ্গে যোগ দেন। নবাবের সৈন্য যখন বিহারে তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন, তখন উড়িষ্যার ভূতপূর্ব নায়েব মীর হবীরের সহযোগে মারাঠা সৈন্য মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে (২১শে ডিসেম্বর, ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দ)। আলীবর্দী বহু কষ্টে দ্রুতগতিতে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করিলে রঘুজী কাটোয়ায় প্রস্থান করেন ও আলীবর্দীর হস্তে পরাজিত হন। পরে তিনি নাগপুরে ফিরিয়া যান কিন্তু মীর হবীর মারাঠা সৈন্যসহ কাটোয়াতে অবস্থান করেন। পরে আলীবর্দী তাহাকেও পরাজিত করেন (এপ্রিল, ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সব গোলমালের সময় আলীবর্দীর আরও দুইজন আফগান সেনানায়ক মারাঠাদের সহিত গোপনে ষড়যন্ত্র করায় নবাব তাঁহাদিগকে পদচ্যুত করিয়া বাংলা দেশের সীমানার বাহিরে বিতাড়িত করেন।

বিতাড়িত আফগান সৈন্যের পরিবর্তে নূতন সৈন্য নিযুক্ত করিয়া আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনরধিকার করিবার জন্য সেনাপতি মীর জাফরকে প্রেরণ করেন। মীর জাফর মীর হবীরের এক সেনানায়ককে মেদিনীপুরের নিকট পরাজিত করেন (ডিসেম্বর, ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু বালেশ্বর হইতে মীর হবীর একদল মারাঠা সৈন্য সহ অগ্রসর হইলে মীর জাফর বর্ধমানে পলাইয়া যান। অতঃপর মীর জাফর ও রাজমহলের ফৌজদার নবাব আলীবর্দীকে গোপনে হত্যা করিবার চক্রান্ত করেন এবং নবাব উভয়কেই পদচ্যুত করেন। তারপর ৭১ বৎসরের বৃদ্ধ নবাব স্বয়ং অগ্রসর হইয়া মারাঠা সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করিলেন এবং বর্ধমান জিলা মারাঠাদের হাত হইতে উদ্ধার করিলেন (মার্চ, ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর মারাঠাদের হস্তে রহিল।

১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দের আরম্ভে আফগান অধিপতি আহম্মদ শাহ দুররাণী পঞ্জাব আক্রমণ করেন। এই সুযোগে আলীবর্দীর পদচ্যুত ও বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদল তাহাদের বাসস্থান দ্বারভাঙ্গা জিলা হইতে অগ্রসর হইয়া পাটনা অধিকার করে। আলীবর্দীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাজী আহমদের পুত্র জৈনুদ্দীন আহমদ (ইনি আলীবর্দীর জামাতাও) বিহারের নায়েব নাজিম ছিলেন। বিদ্রোহী আফগানেরা জৈনুদ্দীন ও হাজী আহমদ উভয়কেই বধ করে এবং আলীবর্দীর কন্যাকে বন্দী করে। দলে দলে আফগান সৈন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। উড়িষ্যা হইতে মীর হবীরের অধীনে একদল মারাঠা সৈন্যও পাটনার দিকে অগ্রসর হয়। আলীবর্দী অগ্রসর হইয়া ভাগলপুরের নিকটে মীর হবীরকে এবং পাটনার ২৬ মাইল পূর্বে গঙ্গার তীবরর্তী কালাদিয়ারা নামক স্থানে আফগানদের ও তাহাদের সাহায্যকারী মারাঠা সৈন্যদের পরাজিত করিয়া পাটনা অধিকার করেন এবং বন্দিনী কন্যাকে মুক্ত করেন (এপ্রিল, ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে আলীবর্দী উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং এক প্রকার বিনা বাধায় তাহা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তিনি ফিরিয়া আসিলেই মীর হবীরের মারাঠা সৈন্যরা পুনরায় উহা অধিকার করে।

অতঃপর উড়িষ্যা হইতে মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য আলীবর্দী স্থায়িভাবে মেদিনীপুরে শিবির সন্নিবেশ করিলেন (অক্টোবর, ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও মীর হবীর পরবর্তী ফেব্রুয়ারী মাসে আবার বাংলাদেশে লুঠপাট আরম্ভ করিলেন এবং রাজধানী মুর্শিদাবাদের নিকটে পৌঁছিলেন। নবাব সেদিকে অগ্রসর হইলেই মীর হবীর পলাইয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইলেন-আলীবর্দী মেদিনীপুরে ফিরিয়া গেলেন (এপ্রিল, ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ) এবং সেখানে স্থায়িভাবে বসবাসের বন্দোবস্ত করিলেন। ইতিমধ্যে সংবাদ আসিল যে মৃত জৈনুদ্দীনের পুত্র এবং নবারের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লা পাটনা দখল করিবার জন্য সেখানে পৌঁছিয়াছেন। আলীবর্দী পাটনায় ছুটিয়া গেলেন, এবং গুরুতররূপে পীড়িত হইয়া মুর্শিদাবাদে ফিরিলেন। কিন্তু মারাঠা আক্রমণের ভয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হইবার পূর্বেই আবার তাঁহাকে কাটোয়া যাইতে হইল (ফেব্রুয়ারী, ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দ)।

বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া মুর্শিদাবাদের সিংহাসন অধিকার করার পর হইতেই উড়িষ্যার আধিপত্য লইয়া ভূতপূর্ব নবাবের জামাতা রুস্তম জঙ্গের সহিত আলীবর্দীর সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। মারাঠা আক্রমণকে তাঁহার অবান্তর ফল বলা যাইতে পারে, কারণ রুস্তম জঙ্গের নায়েব মীর হবীরের সাহায্য ও সহযোগিতার ফলেই তাহারা নির্বিঘ্নে মেদিনীপুরের মধ্য দিয়া বাংলা দেশে আসিত। সুতরাং বিগত দশ বৎসর যাবৎ আলীবর্দীকে মীর হবীর ও মারাঠাদের সঙ্গে যে অবিশ্রাম যুদ্ধ করিতে হয়, তাহা তাঁহার পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত বলা যাইতে পারে। অবশ্য আলীবর্দী যে অপূর্ব সাহস, অধ্যবসায় ও রণকৌশলের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা সর্বথা প্রশংসনীয়। কিন্তু ৭৫ বৎসরের বৃদ্ধ আর যুদ্ধ চালাইতে পারিলেন না। মারাঠারাও রণক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নলিখিত তিনটি শর্তে এক সন্ধি হইল।

১। মীর হবীর আলীবর্দীর অধীনে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম হইবেন–কিন্তু এই প্রদেশের উদ্বৃত্ত রাজস্ব মারাঠা সৈন্যের ব্যয় বাবদ রঘুজী ভোঁসলে পাইবেন।

২। ইহা ছাড়া চৌথ বাবদ বাংলার রাজস্ব হইতে প্রতি বৎসর ১২ লক্ষ টাকা রঘুজীকে দিতে হইবে।

৩। মারাঠা সৈন্য কখনও সুবর্ণরেখা নদী পার হইয়া বাংলা দেশে প্রবেশ করিতে পারিবে না।

সন্ধি হইবার এক বৎসর পরেই জনোজী ভেঁসলের মারাঠা সৈন্যরা মীর হবীরকে বধ করিয়া রঘুজীর এক সভাসদকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম পদে বসাইল (২৪শে অগস্ট, ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ)। সুতরাং উড়িষ্যা মারাঠা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেল।

বাংলা দেশে আবার শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। কিন্তু দিল্লির বাদশাহী হইতে স্বাধীনতার প্রথম ফলস্বরূপ বিগত দশ বারো বৎসরের যুদ্ধ বিগ্রহ ও অন্ত দ্বন্দ্বে বাংলার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। আলীবর্দী শাসনসংক্রান্ত অনেক ব্যবস্থা করিয়াও বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তারপর ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার এক দৌহিত্র ও পর বৎসর তাঁহার দুই জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মৃত্যু হইল। আশী বৎসরের বৃদ্ধ নবাব এই সকল শোকে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তাঁহার মৃত্যু হইল।

বাংলায় ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে পর্তুগীজদেশীয় ভাস্কো-দা-গামা আফ্রিকার পশ্চিম ও পূর্ব উপকূল ঘুরিয়া বরাবর সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আসিবার পথ আবিষ্কার করেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই পর্তুগীজ বণিকগণ বাংলা দেশের সহিত বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করেন। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহারা চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে বাণিজ্য কুঠি তৈরী করিবার অনুমতি পায়। ১৫৭৯-৮০ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবর ভাগীরথী-তীরে হুগলি নামক একটি নগণ্য গ্রামে পর্তুগীজদিগকে কুঠি তৈরী করিবার অনুমতি দেন এবং ইহাই ক্রমে একটি সমৃদ্ধ সহর ও বাংলায় পর্তুগীজদের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠে। ইহা ছাড়া বাংলায় হিজলী, শ্রীপুর, ঢাকা, যশোহর, বরিশাল ও নোয়াখালি জিলার বহুস্থানে পর্তুগীজদের বাণিজ্য চলিত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে চট্টগ্রাম ও ডিয়াঙ্গা এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমে সন্দ্বীপ, দক্ষিণ শাহবাজপুর প্রভৃতি স্থান পর্তুগীজদের অধিকারভুক্ত হয়। কিন্তু বাংলায় পর্তুগীজদের প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। কারণ পর্তুগীজদের বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও দুইটি জিনিষ বাংলায় আমদানি হয়-খ্রীষ্টীয় ধর্মপ্রচারক এবং জলদস্যু। এই উভয়ই বাঙালীর আতঙ্কের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। আরাকানের রাজা ডিয়াঙ্গা পর্তুগীজদের হত্যা করিয়া সন্দ্বীপ অধিকার করেন। পর্তুগীজদের আগ্নেয় অস্ত্র ও নৌবহর কেবল বাংলার নহে মুঘল বাদশাহেরও ভয়ের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল, কারণ এই দুই শক্তির বলে তাহারা দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়া স্বাধীন জাতির ন্যায় আচরণ করিত। শাহ্জাহান যখন বিদ্রোহী হইয়া বাংলা দেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন পর্তুগীজরা প্রথমে নৌবহর লইয়া তাঁহাকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হয়; কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাকে ত্যাগ করে। ফিরিবার পথে তাহারা শাহ্জাহানের বেগম মমতাজমহলের দুইজন বাদীকে ধরিয়া অকথ্য অত্যাচার করে। এই সমুদয় কারণে শাহজাহান সম্রাট হইয়া কাশিম খানকে বাংলা দেশের সুবাদার নিযুক্ত করার সময় এই নির্দেশ দিলেন যে অবলিম্বে হুগলি দখল করিয়া পর্তুগীজ শক্তি সমূলে ধ্বংস করিতে হইবে এবং যাবতীয় শ্বেতবর্ণ পুরুষ, স্ত্রী, শিশু ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত অথবা ক্রীতদাসরূপে সম্রাটের দরবারে প্রেরিত হইবে। ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে কাশিম খান হুগলি অধিকার করিলেন। ৪০০ ফিরিঙ্গি স্ত্রী-পুরুষকে বন্দী করিয়া আগ্রায় পাঠানো হইল। তাহাদিগকে বলা হইল যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলে তাহারা মুক্তি পাইবে, নচেৎ আজীবন ক্রীতদাসরূপে বন্দী হইয়া থাকিতে হইবে। অধিকাংশই মুসলমান হইতে আপত্তি করিল এবং আমরণ বন্দী হইয়াই রহিল। হুগলির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে পর্তুগীজ প্রাধান্যের শেষ হইল।

পর্তুগীজদের পরে আরও কয়েকটি ইউরোপীয় বণিকদল বাংলাদেশে বাণিজ্য বিস্তার করে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম হইতেই ওলন্দাজেরা বাংলায় বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করে। ১৬৫৩ খ্রীষ্টাব্দে হুগলির নিকটবর্তী কুঁচুড়ায় তাহাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁহার অধীনে কাশিমবাজার ও পাটনায় আরও দুইটি কুঠি স্থাপিত হয়। দিল্লির বাদশাহ ফারুখশিয়র ওলন্দাজদিগকে শতকরা সাড়ে তিন টাকার পরিবর্তে আড়াই টাকা শুল্ক দিয়া বাণিজ্য করিবার অধিকার প্রদান করে। ফরাসী বণিকেরাও সম্রাটকে ৪০,০০০ টাকা এবং বাংলার নবাবকে ১০,০০০ টাকা ঘুষ দিয়া ঐ সুবিধা লাভ করেন। কিন্তু ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে তাঁহারা বাংলায় বাণিজ্যের সুবিধা করিতে পারেন নাই। হুগলির নিকটবর্তী চন্দননগরে তাঁহাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল।

ইংরেজ বণিকেরা প্রথমে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ বণিকদের প্রতিযোগিতায় বাংলা দেশে বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। ১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহারা নবাবের নিকট হইতে বাংলা দেশে বাণিজ্য করিবার সনদ পান এবং পরবর্তী বৎসর হুগলিতে কুঠি স্থাপন করেন। ১৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকা এবং অনতিকাল পরেই রাজমহল এবং মালদহেও তাহাদের কুঠি স্থাপিত হয়। এই সমুদয় অঞ্চলে শুজা ইংরেজদিগকে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করিবার অধিকার দেন। কিন্তু বাংলার মুঘল কর্মচারীরা নানা অজুহাতে এই সুবিধা হইতে ইংরেজদিগকে বঞ্চিত করে। ইংরেজ বণিকগণ শায়েস্তা খান ও সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নিকট হইতেও ফরমান আদায় করেন; কিন্তু তাহাতেও কোন সুবিধা হয় না। ইংরেজরা তখন নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির দ্বারা আত্মরক্ষা করিতে সচেষ্ট হইলেন। ইতিমধ্যে হুগলির মুঘল শাসনকর্ত্তা ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইংরেজদের কুঠি আক্রমণ করিলেন। ইংরেজরা বাধা দিতে সমর্থ হইলেও ইংরেজ এজেন্ট জব চার্ণক সেখানে থাকা নিরাপদ মনে না করিয়া, প্রথমে সুতানুটি (বর্তমান কলিকাতার অন্তর্গত), পর হিজলীতে তাহাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপিত করিলেন এবং তাঁহাদের ক্ষতির প্রতিশোধস্বরূপ বালেশ্বর সহরটি পোড়াইয়া দিলেন। মুঘলসৈন্য হিজলী অবরোধ করিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হইল এবং ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা সুতানুটিতে ফিরিয়া গেলেন (সেপ্টেম্বর, ১৬৮৯ খ্রী)। কিন্তু লণ্ডনের কর্তৃপক্ষ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলায় একটি সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত স্থান অধিকার দ্বারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করিতে মনস্থ করিলেন। জব চার্ণকের আপত্তি সত্ত্বেও ইংরেজরা সুতানুটি হইতে বাণিজ্যকেন্দ্র উঠাইয়া, সমস্ত ইংরেজ অধিবাসী ও বাণিজ্য-দ্রব্য জাহাজে বোঝাই করিয়া জলপথে চট্টগ্রাম আক্রমণ করিলেন। কিন্তু ব্যর্থ মনোরথ হইয়া মাদ্রাজে (১৬৮৮ খ্রী) ফিরিয়া গেলেন। আবার উভয় পক্ষে সন্ধি হইল। বাংলার সুবাদার বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজদিগকে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিতে অনুমতি দিলেন। ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের অগস্ট মাসে ইংরেজরা আবার সুতানুটিতে ফিরিয়া আসিয়া সেখানে ঘরবাড়ী নির্মাণ করিলেন। ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে শোভাসিংহের বিদ্রোহ উপলক্ষে কলিকাতার দুর্গ দৃঢ় করা হইল এবং ইংলণ্ডের রাজার নাম অনুসারে ইহার নাম রাখা হইল ফোর্ট উইলিয়ম। বার্ষিক ১২,০০০ টাকায় সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর, এই তিনটি গ্রামের ইজারা লওয়া হইল। ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে মাদ্রাজ হইতে পৃথকভাবে বাংলা একটি স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্সীতে পরিণত হইল। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকগণের প্রতিনিধি সুরম্যানকে সম্রাট ফারুখশিয়র এই মর্মে এক ফরমান প্রদান করেন যে ইংরেজগণ শুল্কের পরিবর্তে মাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকা দিলে সারা বাংলায় বাণিজ্য করিতে পারিবেন, কলিকাতার নিকটে জমি কিনিতে পারিবেন এবং যেখানে খুশী বসবাস করিতে পারিবেন। বাংলার সুবাদার ইহা সত্ত্বেও নানারকমে ইংরেজ বণিকগণের প্রতিবন্ধকতা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তথাপি কলিকাতা ক্রমশই সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। ইহার ফলে মারাঠা আক্রমণের সময় দলে দলে লোক কলিকাতায় নিরাপদ আশ্রয় লাভ করিয়াছিল। ইহাও কলিকাতার উন্নতির অন্যতম কারণ।

কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরে যখন মুর্শিদকুলী খান স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতে লাগিলেন তখন নবাব ও তাঁহার কর্মচারীরা সমৃদ্ধ ইংরেজ বণিকদিগের নিকট হইতে নানা উপায়ে অর্থ আদায় করিতে লাগিলেন। নবাবদের মতে ইংরেজদের বাণিজ্য বহু বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তাঁহাদের কর্মচারীরাও বিনা শুঙ্কে বাণিজ্য করিতেছে, সুতরাং তাহাদের বার্ষিক টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। ইহা লইয়া প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ হইত আবার পরে গোলমাল মিটিয়া যাইত। কারণ বাংলার নবাব জানিতেন যে ইংরেজের বাণিজ্য হইতে তাঁহার যথেষ্ট লাভ হয়-ইংরেজরাও জানিতেন যে নবাবের সহিত শত্রুতা করিয়া বাণিজ্য করা সম্ভব হইবে না। সুতরাং কোন পক্ষই বিবাদ-বিসংবাদ চরমে পৌঁছিতে দিতেন না। নবাব কখনও কখনও টাকা না পাইলে ইংরেজদের মাল বোঝাই নৌকা আটকাইতেন। ১৭৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এইরূপ একবার নৌকা আটকানো হয়। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা ৫৫,০০০ টাকা দিলে নবাব নৌকা ছাড়িয়া দেন।

নবাব আলীবর্দী ইউরোপীয় বণিকদের সহিত সদ্ভাব রক্ষা করিয়া চলিতেন এবং তাঁহাদের প্রতি যাহাতে কোন অন্যায় বা অত্যাচার না হয় সেদিকে লক্ষ্য। রাখিতেন। কারণ ইহাদের ব্যবসায় বজায় থাকিলে যে বাংলা সরকারের বহু অর্থাগম হইবে, তাহা তিনি খুব ভাল করিয়াই জানিতেন। তবে অভাবে পড়িলে টাকা আদায়ের জন্য তিনি অনেক সময় কঠোরতা অবলম্বন করিতেন। মারাঠা আক্রমণের সময়ে তিনি ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ বণিকদের নিকট হইতে টাকা আদায় করেন। ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে সৈন্যের মাহিনা বাকী পড়ায় তিনি ইংরেজদের নিকট হইতে ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবী করেন এবং তাহাদের কয়েকটি কুঠি আটক করেন। পরে অনেক কষ্টে ইংরেজরা মোট প্রায় চারি লক্ষ টাকা দিয়া রেহাই পান। ইংরেজরা বাংলার কয়েকজন আর্মেনিয়ান ও মুঘল বণিকের জাহাজ আটকাইবার অপরাধে আলিবর্দী তাঁহাদিগকে ক্ষতিপূরণ করিতে আদেশ দেন ও দেড় লক্ষ টাকা জরিমানা করেন।

দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ ও ফরাসী বণিকেরা যেমন স্থানীয় রাজাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হইতেছিলেন, বাংলা দেশ যাহাতে সেরূপ না হইতে পারে সে দিকে আলীবর্দীর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তিনি ফরাসী, ইংরেজি ও ওলন্দাজ বণিকগণকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন যে তাঁহার রাজ্যের মধ্যে যেন তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ না হয়। তিনি ইংরেজ ও ফরাসীদিগকে বাংলায় কোন দুর্গ নির্মাণ করিতে দিতেন না, বলিতেন “তোমরা বাণিজ্য করিতে আসিয়াছ, তোমাদের দুর্গের প্রয়োজন কি? তোমরা আমার রাজ্যে আছ, আমিই তোমাদের রক্ষা করিব।” ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দিনেমার (ডেনমার্ক দেশের অধিবাসী) বণিকগণকে শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করিতে অনুমতি দেন।

সিরাজউদ্দৌলা

নবাব আলীবর্দীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁহার তিন কন্যার সহিত তাঁহার তিন ভ্রাতুষ্পুত্রের (হাজী আহম্মদের পুত্র) বিবাহ হইয়াছিল। এই তিন জামাতা যথাক্রমে ঢাকা, পূর্ণিয়া ও পাটনার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। আলীবর্দীর জীবদ্দশায়ই তিন জনের মৃত্যু হয়। জ্যেষ্ঠা কন্যা মেহের উন্-নিসা ঘসেটি বেগম নামেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁহার কোন পুত্র সন্তান ছিল না কিন্তু বহু ধন-সম্পত্তি ছিল এবং স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ঢাকা হইতে আসিয়া মুর্শিদাবাদে মতিঝিল নামে সুরক্ষিত বৃহৎ প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া সেখানেই থাকিতেন। মধ্যমা কন্যার পুত্র শওকৎ জঙ্গ পিতার মৃত্যুর পর পূর্ণিয়ার শাসনকর্ত্তা হন।

কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মাতামহের কাছে থাকিতেন। তাঁহার জন্মের পরেই আলীবর্দী বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। সুতরাং এই নবজাত শিশুকেই তাঁহার সৌভাগ্যের মূল কারণ মনে করিয়া তিনি ইহাকে অত্যধিক স্নেহ করিতেন। তাঁহার আদরের ফলে সিরাজের লেখাপড়া কিছুই হইল না, এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দুর্দান্ত, স্বেচ্ছাচারী, কামাসক্ত, উদ্ধত, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর যুবকে পরিণত হইলেন। কিন্তু তথাপি আলীবর্দী সিরাজকেই নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিলেন। আলীবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজ বিনা বাধায় সিংহাসনে আরোহণ করিলেন।

ঘসেটি বেগম ও শওকত্সঙ্গ উভয়েই সিরাজের সিংহাসনে আরোহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। নবাব-সৈন্যের সেনাপতি মীরজাফর আলী খানও সিংহাসনের স্বপ্ন। দেখিতেন। আলীবর্দীর ন্যায় মীরজাফরও নিঃস্ব অবস্থায় ভারতে আসেন এবং আলীবর্দীর অনুগ্রহেই তাঁহার উন্নতি হয়। মীরজাফর আলীবর্দীর বৈমাত্রেয় ভগিনীকে বিবাহ করেন এবং ক্রমে সেনাপতি পদ লাভ করেন। আলীবর্দী প্রতিপালক প্রভুর পুত্রকে হত্যা করিয়া নবাবী লাভ করিয়াছিলেন। মীরজাফরও তাঁহারই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সিরাজকে পদচ্যুত করিয়া নিজে নবাব হইবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ করিতেন।

ঘসেটি বেগমের সহিত সিরাজের বিরোধিতা আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই আরম্ভ হইয়াছিল। তাঁহার স্বামী ঢাকার শাসনকর্ত্তা ছিলেন, কিন্তু তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য ও অতিশয় দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন, বুদ্ধিশুদ্ধিও তেমন ছিল না। সুতরাং ঘসেটি বেগমের হাতেই ছিল প্রকৃত ক্ষমতা এবং তিনিই তাঁহার অনুগ্রহভাজন দিওয়ান হোসেন কুলী খানের সাহায্যে দেশ শাসন করিতেন। হোসেন কুলীর শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধিতে সিরাজ ভীত হইয়া উঠিলেন এবং একদিন প্রকাশ্য দরবারে আলীবর্দীর নিকট অভিযোগ করিলেন যে হোসেন কুলী তাঁহার (সিরাজের) প্রাণনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করিতেছে। আলীবর্দী প্রিয় দৌহিত্রকে কোনমতে বুঝাইয়া প্রকাশ্যে কোন হঠকারিতা করিতে নিরস্ত করিলেন। ঘসেটি বেগমের সহিত হোসেন কুলীর অবৈধ প্রণয়ের কথাও সম্ভবত সিরাজ ও আলীবর্দী উভয়ের কানে গিয়াছিল। সম্ভবত সেইজন্যই আলীবর্দী সিরাজকে তাঁহার দুরভিসন্ধি হইতে একেবারে নিবৃত্ত করেন নাই। মাতামহের উপদেশ সত্ত্বেও সিরাজ প্রকাশ্য রাজপথে হোসেন কুলী খানকে বধ করিলেন (এপ্রিল, ১৭৫৪ খ্রী)। অতঃপর ঘসেটি বেগম রাজবল্লভ নামে বিক্রমপুরের একজন হিন্দুকে দিওয়ান নিযুক্ত করিলেন। রাজবল্লভ সামান্য কেরানীর পদ হইতে নিজের যোগ্যতার বলে নাওয়ারা (নৌবহর) বিভাগের অধ্যক্ষপদে উন্নীত হইয়াছিলেন। হোসেন কুলীর মৃত্যুর পর তিনিই ঘসেটির দক্ষিণ হস্ত এবং ঢাকায় সর্বেসর্বা হইয়া উঠিলেন। সিরাজ উহাকে ভালচক্ষে দেখিতেন না। সুতরাং ঘসেটি বেগমের স্বামীর মৃত্যুর পরই সিরাজ রাজবল্লভকে তহবিল তছরূপের অপরাধে বন্দী করিলেন এবং তাঁহার নিকট হিসাব-নিকাশের দাবী করিলেন (মার্চ, ১৭৫৬ খ্রী)। বৃদ্ধ আলীবর্দী তখন মৃত্যুশয্যায়, তথাপি তিনি রাজবল্লভকে তখনই বধ না করিয়া হিসাব-নিকাশ পর্যন্ত তাঁহার প্রাণ রক্ষার আদেশ করিলেন। সিরাজ রাজবল্লভকে কারাগারে রাখিলেন এবং রাজবল্লভের পরিবারবর্গকে বন্দী ও তাঁহার ধনসম্পত্তি লুঠ করিবার জন্য রাজবল্লভের বাসভূমি রাজনগরে (ঢাকা জিলায়) একদল সৈন্য পাঠালেন। সৈন্যদল রাজনগরে পৌঁছিবার পূর্বেই রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস সপরিবারে সমস্ত ধনরত্নসহ পুরীতে তীর্থযাত্রার নাম করিয়া জলপথে কলিকাতায় পৌঁছিলেন এবং কলিকাতার গভর্নর ড্রেককে ঘুষ দিয়া কলিকাতা দুর্গে আশ্রয় লইলেন। সম্ভবত ঘসেটি বেগমের ধনরত্নও এইরূপে কলিকাতায় সুরক্ষিত হইল।

ঘসেটি বেগম ও মীরজাফর উভয়েই আলীবর্দীর মৃত্যুর পর শওকৎ জঙ্গকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়া মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করিতে উৎসাহিত করিলেন। কিন্তু এই উৎসাহ বা প্ররোচনার আবশ্যক ছিল না। শওকৎ জঙ্গ আলীবর্দীর মধ্যমা কন্যার পুত্র, সুতরাং কনিষ্ঠা কন্যার পুত্র সিরাজ অপেক্ষা সিংহাসনে তাঁহারই দাবি তিনি বেশি মনে করিতেন এবং তিনি দিল্লিতে বাদশাহের দরবারে তাঁহার নামে সুবেদারীর ফরমানের জন্য আবেদন করিলেন।

সিরাজ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই তাঁহার অবস্থা উপলব্ধি করিতে পারিলেন। মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের কথা সম্ভবত তিনি জানিতেন না। ঘসেটি বেগম ও শওকৎ জঙ্গকেই প্রধান শত্রু জ্ঞান করিয়া তিনি প্রথমে ইহাদিগকে দমন করিবার ব্যবস্থা করিলেন। মতিঝিল আক্রমণ করিয়া সিরাজ ঘসেটি বেগমকে বন্দী করিলেন ও তাঁহার ধনরত্ন লুঠ করিলেন। তারপর তিনি সসৈন্যে শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। কিন্তু দুইটি কারণে ইংরেজদের প্রতিও তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথমত, তাহারা রাজবল্লভের পুত্রকে আশ্রয় দিয়াছে। দ্বিতীয়ত, তিনি শুনিতে পাইলেন ইংরেজরা তাঁহার অনুমতি না লইয়াই কলিকাতা দুর্গের সংস্কার ও আয়তনবৃদ্ধি করিতেছে। শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্ৰা করিবার পূর্বে তিনি কলিকাতার গভর্নর ড্রেকের নিকট নারায়ণ দাস নামক একজন দূত পাঠাইয়া আদেশ করিলেন যেন তিনি অবিলম্বে নবাবের প্রজা কৃষ্ণদাসকে পাঠাইয়া দেন। কলিকাতার দুর্গের কি কি সংস্কার ও পরিবর্তন হইতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবার জন্যও দূতকে গোপনে আদেশ দেওয়া হইল।

১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই মে সিরাজ মুর্শিদাবাদ হইতে সসৈন্যে শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। ২০শে মে রাজমহলে পৌঁছিয়া তিনি সংবাদ পাইলেন যে তাঁহার প্রেরিত দূত গোপনে কলিকাতা সহরে প্রবেশ করে, কিন্তু কলিকাতার কর্তৃপক্ষের নিকট দৌত্যকার্যের উপযুক্ত দলিল দেখাইতে না পারায় গুপ্তচর মনে করিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই অজুহাতটি মিথ্যা বলিয়াই মনে হয়। কলিকাতার গর্ভনর ড্রেক সাহেব ঘুষ লইয়া কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়াছিলেন এবং তাঁহার বিশ্বাস ছিল পরিণামে ঘসেটি বেগমের পক্ষই জয়লাভ করিবে। এই জন্যই তিনি সিরাজের বিরুদ্ধাচরণ করিতে ভরসা পাইয়াছিলেন।

কলিকাতার সংবাদ পাইয়া সিরাজ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন এবং ইংরেজদিগকে সমুচিত শাস্তি দিবার জন্য তিনি রাজমহল হইতে ফিরিয়া ইংরেজদিগের কাশিমবাজার কুঠি লুঠ ও কয়েকজন ইংরেজকে বন্দী করিলেন। ৫ই জুন তিনি কলিকাতা আক্রমণের জন্য যাত্রা করিলেন এবং ১৬ই জুন কলিকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছিলেন। কলিকাতা দুর্গের সৈন্যসংখ্যা তখন খুবই অল্প ছিল-কার্যক্ষম ইউরোপীয় সৈন্যের সংখ্যা তিন শতেরও কম ছিল এবং ১৫০ জন আর্মেনিয়ান ও ইউরেশিয়ান সৈন্য ছিল। সুতরাং নবাব সহজেই কলিকাতা অধিকার করিলেন। গভর্নর নিজে ও অন্যান্য অনেকেই নৌকাযোগে পলায়ন করিলেন এবং ফলতায় আশ্রয় লইলেন। ২০শে জুন কলিকাতার নূতন গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করিলেন এবং বিজয়ী সিরাজ কলিকাতা দুর্গে প্রবেশ করিলেন।

সিরাজের সৈন্যরা ইউরোপীয় অধিবাসীদের বাড়ী লুঠ করিয়াছিল; কিন্তু কাহারও প্রতি অত্যাচার করে নাই। সিরাজও হলওয়েলকে আশ্বস্ত করিয়াছিলেন। সন্ধ্যার সময় কয়েকজন ইউরোপীয় সৈন্য মাতাল হইয়া এ-দেশী লোককে আক্রমণ করে। তাহারা নবারের নিকট অভিযোগ করিলে নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, এইরূপ দুবৃত্ত মাতাল সৈন্যকে সাধারণত কোথায় আটকাইয়া রাখা হয়? তাহারা বলিল, অন্ধকূপ (Black Hole) নামক কক্ষে। সিরাজ হুকুম দিলেন যে, ঐ সৈন্যদিগকে সেখানে রাত্রে আটক রাখা হউক। ১৮ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রশস্ত এই কক্ষটিতে ঐ সমুদয় বন্দীকে আটক রাখা হইল। পরদিন প্রভাতে দেখা গেল দম বন্ধ হইয়া অথবা আঘাতের ফলে তাহাদের অনেকে মারা গিয়াছে।

এই ঘটনাটি অন্ধকূপ হত্যা নামে কুখ্যাত। প্রচলিত বিবরণ মতে মোট কয়েদীর সংখ্যা ছিল ১৪৬, তাঁহার মধ্যে ১২৩ জনই মারা গিয়াছিল। এই সংখ্যাটি যে অতিরঞ্জিত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সম্ভবত ৬০ কি ৬৫ জনকেই ঐ কক্ষে আটক করা হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে কত জনের মৃত্যু হইয়াছিল, তাহা সঠিক জানিবার উপায় নাই। কিন্তু ২১ জন যে বাঁচিয়াছিল, ইহা নিশ্চিত।

ইতিমধ্যে শওকৎ জঙ্গ বাদশাহের উজীরকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়া সুবাদারীর ফরমান এবং সিরাজকে বিতাড়িত করিবার জন্য বাদশাহের অনুমতি পাইয়াছিলেন। সুতরাং তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। সিরাজও কলিকাতা জয় সমাপ্ত করিয়া ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের শেষে সসৈন্যে পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। ১৬ই অক্টোবর নবাবগঞ্জের নিকট মনিহারী গ্রামে দুই দলে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে শওকৎ জঙ্গ পরাজিত ও নিহত হইলেন।

অল্পবয়স্ক হইলেও সিরাজ মাতামহের মৃত্যুর ছয়মাসের মধ্যেই ঘসেটি বেগম, ইংরেজ ও শওকৎ জঙ্গের ন্যায় তিনটি শত্রুকে ধ্বংস করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন ইহা তাঁহার বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সাফল্যলাভের পর তাঁহার সকল উদ্যম ও উৎসাহ যেন শেষ হইয়া গেল।

কলিকাতা জয়ের পর ইহার রক্ষার জন্য উপযুক্ত কোন বন্দোবস্ত করা হইল না। ইংরেজের সঙ্গে শত্রুতা আরম্ভ করিবার পর যাহাতে তাহারা পুনরায় বাংলা দেশে শক্তি ও প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিতে না পারে, তাঁহার সুব্যবস্থা করা অবশ্য কর্তব্য ছিল; কিন্তু তাহাও করা হইল না। ইংরেজ কোম্পানী মাদ্রাজ হইতে ক্লাইবের অধীনে একদল সৈন্য ও ওয়াটসনের অধীনে এক নৌবহর কলিকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠাইল। নবাবের কর্মচারী মাণিকচাঁদ কলিকাতার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ক্লাইব ও ওয়াটসন বিনা বাধায় ফলতায় উদ্বাস্তু ইংরেজদের সহিত মিলিত হইলেন (১৫ই ডিসেম্বর, ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর ইংরেজ সৈন্য ও নৌবহর কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিল। নবাবের বজবজে একটি ও তাঁহার নিকটে আরও একটি দুর্গ ছিল। মাণিকচাঁদ এই দুইটি দুর্গ রক্ষার্থে অগ্রসর হইতেছিলেন-পথে ক্লাইবের সৈন্যের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। সহসা আক্রমণের ফলে ইংরেজদের কিছু সৈন্য মারা গেল। কিন্তু মাণিকাদের পাগড়ীর পাশ দিয়া একটি গুলি যাওয়ার শব্দে ভীত হইয়া তিনি পলায়ন করিলেন। ইংরেজরা বজবজ দুর্গ ধ্বংস করিল এবং বিনা যুদ্ধে কলিকাতা অধিকার করিল (২রা জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। ইংরেজরা যে পূর্বেই ঘুষ দিয়া মাণিকচাঁদকে হাত করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। মাণিকচাঁদের সহিত ক্লাইবের পত্র বিনিময় হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে কলিকাতা হইতে ইংরেজরা বিতাড়িত হইয়া ফলতায় আশ্রয় গ্রহণের পরেই মাণিকচাঁদ নবাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া গোপনে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন। অর্থের প্রভাব ছাড়া ইহার আর কোন কারণ দেখা যায় না। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে মাণিকচাঁদের পুত্রকে ইংরেজ গভর্নমেন্ট উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন–এই প্রসঙ্গে কাগজ-পত্রে লেখা আছে যে মাণিকচাঁদ ত্রিশ বৎসর যাবৎ ইংরেজের অনেক উপকার করিয়াছেন।

কলিকাতা অধিকার করিয়াই ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল (৩রা জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। ওদিকে সিরাজও কলিকাতা অধিকারের সংবাদ পাইয়া যুদ্ধযাত্রা করিলেন। ১০ই জানুয়ারী ক্লাইব হুগলি অধিকার করিয়া সহরটি লুঠ করিলেন এবং নিকটবর্তী অনেক গ্রাম পোড়াইয়া দিলেন। সিরাজ ১৯শে জানুয়ারী হুগলি পৌঁছিলে ইংরেজরা কলিকাতায় প্রস্থান করিল। ৩রা ফেব্রুয়ারী সিরাজ কলিকাতার সহরতলীতে পৌঁছিয়া আমীরাদের বাগানে শিবির স্থাপন করিলেন।

৪ঠা জুন ইংরেজরা সন্ধি প্রস্তাব করিয়া দুইজন দূত পাঠাইলেন। নবাব সন্ধ্যার সময় তাহাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিলেন, কিন্তু পরদিন পর্যন্ত আলোচনা মুলতুবী রহিল। কিন্তু ইংরেজ দূতেরা রাত্রে গোপনে নবাবের শিবির হইতে চলিয়া গেল। শেষ রাত্রে ক্লাইব অকস্মাৎ নবাবের শিবির আক্রমণ করিলেন। অতর্কিত আক্রমণে নবাবের পক্ষের প্রায় ১৩০০ লোক হত হইল, কিন্তু প্রাতঃকালে নবাবের একদল সৈন্য সুসজ্জিত হওয়ায় ক্লাইব প্রস্থান করিলেন। মনে হয়, ইংরেজ দূতেরা নবাবের শিবিরের সন্ধান লইতেই আসিয়াছিল এবং তাহাদের নিকট সংবাদ পাইয়া ক্লাইব অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া নবাবকে হত অথবা বন্দী করার জন্যই এই আক্রমণ করিয়াছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কুয়াসায় পথ ভুল করিয়া নবাবের তাঁবুতে পৌঁছিতে অনেক দেরী হইল এবং নবাব এই সুযোগে ঐ তবু ত্যাগ করিয়া গেলেন।

এই নৈশ আক্রমণের ফলে ইংরেজরা যে সব দাবি করিয়াছিল নবাব তাহা সকলই মানিয়া লইয়া তাহাদের সহিত সন্ধি করিলেন (৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ)। নবাবের সৈন্যসংখ্যা ৪৫,০০০ ও কামান ইংরেজদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তথাপি তিনি এইরূপ হীনতা স্বীকার করিয়া ইংরেজদের সহিত সন্ধি করিলেন কেন ইহার কোন সুসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তবে দুইটি ঘটনা নবাবকে অত্যন্ত বিচলিত করিয়াছিল। প্রথমত, এই সময়ে সংবাদ আসিয়াছিল যে আফগানরাজ আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি, আগ্রা, মথুরা প্রভৃতি বিধ্বস্ত করিয়া বিহার ও বাংলা দেশের দিকে অগ্রসর হইতেছে। ইহাতে নবাব অতিশয় ভীত হইলেন এবং যে কোন উপায়ে ইংরেজদের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিতে সঙ্কল্প করিলেন।

দ্বিতীয়ত, নবাবের কর্মচারী ও পরামর্শদাতারা প্রায় সকলেই সন্ধি করিতে উপদেশ দিলেন। ইহারা নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন এবং সম্ভবত নবাব তাঁহার কিছু কিছু আভাসও পাইয়াছিলেন। কারণ যাহাই হউক, এই সন্ধির ফলে নবাবের প্রতিপত্তি অনেক কমিয়া গেল এবং ইংরেজের শক্তি, প্রতিপত্তি ও ঔদ্ধত্য যে অনেক বাড়িয়া গেল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কতকটা ইহারই ফলে রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ তাহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য ষড়যন্ত্র আরম্ভ করিলেন।

সিরাজ নবাব হইয়া সেনাপতি মীরজাফর ও দিওয়ান রায়দুর্লভকে পদচ্যুত করেন এবং জগৎশেঠকে প্রকাশ্যে অপমানিত করেন। এই তিন জনই ছিলেন সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা। সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের যথেষ্ট আক্রোশের কারণ ছিল–সুতরাং তিনিও অর্থ দিয়া ইহাদের সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। উমিচাঁদ নামক একজন ধনী বণিক সিরাজের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তিনিও ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন।

এই সময় ইউরোপে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ইংরেজরা ফরাসীদের প্রধান কেন্দ্র চন্দননগর অধিকার করিয়া বাংলার ফরাসী শক্তি নির্মূল করিতে মনস্থ করিল। সিরাজউদ্দৌলা ইহাতে আপত্তি করিলেন এবং হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করিলে তাহাদিগকে বাধা দিতে আদেশ করিলেন। উমিচাঁদ ইংরেজদের পক্ষ হইতে ঘুষ দিয়া নন্দকুমারকে হাত করিলেন এবং ক্লাইব চন্দননগর অধিকার করিলেন (২৩শে মার্চ, ১৭৫৭ খ্রী)।

এই সময় হইতে সিরাজদ্দৌলার চরিত্রে ও আচরণে গুরুতর পরিবর্তন লক্ষিত হয়। তিনি ক্লাইবকে ভয় দেখাইয়াছিলেন যে ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজরা যুদ্ধ করিলে তিনি নিজে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিবেন। ক্লাইব তাহাতে বিচলিত না হইয়া চন্দননগর আক্রমণ করিলেন। চন্দননগর আক্রমণের সময় রায়দুর্লভ, মাণিকচাঁদ ও নন্দকুমারের অধীনে প্রায় বিশ হাজার সৈন্য ছিল। তাঁহারা কোন বাধা দিলেন না এবং নবাবও ইহার জন্য কোন কৈফিয়ৎ তলব করিলেন না। তিনি নিজে তো ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেনই না, বরং চন্দননগরের পতন হইলে ক্লাইবকে অভিনন্দন জানাইলেন। তারপর ক্লাইব যখন নবাবকে অনুরোধ করিলেন যে পলাতক ফরাসীদের ও তাহাদের সমস্ত সম্পত্তি ইংরেজদের হাতে দিতে হইবে, তখন তিনি প্রথমত ঘোরতর আপত্তি করিলেন এবং কাশিমবাজারের ফরাসী কুঠির অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল সাহেবকে অনুচরসহ সাদর অভ্যর্থনা করিয়া আশ্রয় দিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তাঁহার বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের পরামর্শে জঁ ল সাহেবকে বিদায় দিলেন। সম্ভবত ইহার অন্য কারণও ছিল। সিরাজ জানিতেন যে ফরাসীরা দাক্ষিণাত্যে নিজামের রাজ্যে কর্ত্তা হইয়া বসিয়াছেন। বাংলা দেশে যাহাতে ইংরেজ বা ফরাসী কোন পক্ষই ঐরূপ প্রভুত্ব করিতে না পারে, তাঁহার জন্য তিনি ইহাদের একটির সাহায্যে অপরটিকে দমনে রাখিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। এইজন্য তিনি যখন শুনিলেন যে ফরাসী সেনাপতি বুসী দাক্ষিণাত্য হইতে একদল সৈন্য লইয়া বাংলার অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন, তখন তিনি ইংরেজ কোম্পানীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। আবার ইংরেজ যখন ফরাসীদের চন্দননগর অধিকার করিল, তখন তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া একদল সৈন্য পাঠাইলেন এবং বুসীকে দুই হাজার সৈন্য পাঠাইতে লিখিলেন। এই সময়ে (১০ই মে, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ) পেশোয়া বালাজী রাও ইংরেজ কোম্পানীর কলিকাতার গভর্নরকে লিখিলেন যে তিনি ইংরেজকে ১,২০,০০০ সৈন্য দিয়া সাহায্য করিবেন এবং বাংলা দেশকে দুই ভাগ করিয়া ইংরেজ ও পেশোয়া এক এক ভাগ দখল করিবেন। ক্লাইব সিরাজকে ইহা জানাইলে তিনি ইংরেজের প্রতি খুশী হইয়া সৈন্য ফিরাইয়া আনিলেন।

বেশ বুঝা যায় যে ইহার পূর্বেই সিরাজের বিরুদ্ধে গুরুতর ষড়যন্ত্র চলিতেছিল এবং ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজের সহায়তায় সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য তাঁহাদের স্বার্থ অনুযায়ী নবাবকে পরামর্শ দিতেছিলেন। সিরাজ কূটরাজনীতি এবং লোকচরিত্র এই উভয় বিষয়েই অনভিজ্ঞ ছিলেন। যদিও মীরজাফরকে তিনি সন্দেহ করিতেন, তথাপি তাহাকে বন্দী করিতে সাহস করিতেন না। নবাব একবার ক্রুদ্ধ হইয়া মীরজাফরকে লাঞ্ছিত করিতেন আবার তাঁহার স্তোকবাক্যে ভুলিয়া তাঁহার সহিত আপোষ করিতেন। রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রভৃতি বিশ্বাসঘাতকদের কথায় তিনি ফরাসীদের বিদায় করিয়া দিলেন অর্থাৎ একমাত্র যাহারা তাঁহাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করিতে পারিত তাহাদিগকে দূর করিয়া দিয়া তিনি চক্রান্তকারীদের সাহায্য করিলেন।

সিরাজের অস্থিরমতিত্ব, অদূরদর্শিতা, লোকচরিত্রে অভিজ্ঞতা প্রভৃতি ছাড়াও তাঁহার চরিত্রে আরও অনেক দোষ ছিল। তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য যাহারা ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, তাহাদের বিচার করিবার পূর্বে সিরাজের চরিত্রসম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী মত দেখিতে পাওয়া যায়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাঁহার চরিত্রে বহু কলঙ্ক কালিমা লেপন করিয়াছে। ইহা যে অন্তত কতক পরিমাণে সিরাজের প্রতি তাহাদের বিশ্বাসঘাতকতার সাফাই-স্বরূপ লিখিত, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেন লিখিয়াছেন যে সিরাজের চপলমতিত্ব, দুশ্চরিত্রতা, অপ্রিয় ভাষণ ও নিষ্ঠুরতার জন্য সভাসদেরা সকলেই তাঁহার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এই বর্ণনাও কতকটা পক্ষপাতদুষ্ট হইতে পারে। কিন্তু বাংলা দেশের কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁহার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে সিরাজের যে কলঙ্কময় চিত্র আঁকিয়াছেন তাহাও যেমন অতিরঞ্জিত, ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিরাজউদ্দৌলাকে যে প্রকার স্বদেশবৎসল ও মহানুভব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাও ঠিক তদ্রূপ। সিরাজের চরিত্রের বিরুদ্ধে বহু কাহিনী এদেশে প্রচলিত আছে তাহাও নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু ফরাসী অধ্যক্ষ জঁ ল সিরাজের বন্ধু ছিলেন, সুতরাং তিনি সিরাজের সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি এ-সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাঁহার সারমর্ম এই : “আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই সিরাজ অত্যন্ত দুশ্চরিত্র বলিয়া কুখ্যাত ছিলেন। তিনি যেমন কামাসক্ত তেমনই নিষ্ঠুর ছিলেন। গঙ্গার ঘাটে যে সকল হিন্দু মেয়েরা স্নান করিতে আসিত তাহাদের মধ্যে সুন্দরী কেহ থাকিলে সিরাজ তাঁহার অনুচর পাঠাইয়া ছোট ডিঙ্গিতে করিয়া তাহাদের ধরিয়া আনিতেন। লোক-বোঝাই ফেরী নৌকা ডুবাইয়া দিয়া জলমগ্ন পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুদের অবস্থা দেখিয়া সিরাজ আনন্দ অনুভব করিতেন। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বধ করিবার প্রয়োজন হইলে আলীবর্দী একাকী সিরাজের হাতে ইহার ভার দিয়া নিজে দূরে থাকিতেন, যাহাতে কোন আর্তনাদ তাঁহার কানে না যায়। সিরাজের ভয়ে সকলের অন্তরাত্মা কাঁপিত ও তাঁহার জঘন্য চরিত্রের জন্য সকলেই তাঁহাকে ঘৃণা করত।”

সুতরাং সিরাজের কলুষিত চরিত্রই যে তাঁহার প্রতি লোকের বিমুখতার অন্যতম কারণ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের অধিকাংশ প্রধানত ব্যক্তিগত কারণেই সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। এরূপ ষড়যন্ত্র নূতন নহে। সতের বৎসর পূর্বে আলীবর্দী এইরূপ ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বাংলার নবাব হইয়াছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা নিজের দুষ্কৃতি ও মাতামহের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিলেন।

সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার গোপন পরামর্শ মুর্শিদাবাদে অনেক দিন হইতেই চলিতেছিল। প্রথমে স্থির হইয়াছিল যে নবাবের একজন সেনানায়ক ইয়ার লতিফকে সিরাজের পরিবর্তে নবাব করা হইবে। লতিফ ইংরেজদের সাহায্য লাভের জন্য গোপনে দূত পাঠাইলেন। ইংরেজরা এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করিল, কারণ তাহাদের বরাবর বিশ্বাস ছিল যে সিরাজ ইংরেজের শত্রু। সিরাজ ফরাসীদের সহিত মিলিত হইয়া ইংরেজকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইবেন, ইংরেজদের সর্বদাই এই ভয় ছিল। সিরাজ তাহাদিগকে খুশি করিবার জন্য আশ্রিত জ্যাঁ ল সাহেবকে বিদায় দিয়াছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া ল সাহেবের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইল। সিরাজ ক্রোধান্ধ হইয়া ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিলেন এবং পলাশীতে একদল সৈন্য পাঠাইলেন। এই ঘটনায় ইরেজদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল যে সিরাজের রাজত্বে তাহারা বাংলায় নিরাপদে বাণিজ্য করিতে পারিবে না। সুতরাং সিরাজকে তাড়াইয়া ইংরেজের অনুগত কোন ব্যক্তিকে নবাব করিতে পারিলে তাহারা বাংলা দেশে প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিবে। ইংরেজদের এই মনোভাব জানিতে পারিয়া মীরজাফর স্বয়ং নবাব পদের প্রার্থী হইলেন। তিনি নবাবের সেনাপতি; সুতরাং তিনিই ইংরেজদিগকে বেশী সাহায্য করিতে পারিবেন, এইজন্য ইংরেজরাও তাঁহাকে মনোনীত করিল।

নবীনচন্দ্র সেন তাঁহার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের প্রথম সর্গে এই ষড়যন্ত্রের যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাঁহার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। সাত আটজন সন্ত্রাস্ত ব্যক্তি রাত্রিযোগে সম্মিলিত হইয়া অনেক বাদানুবাদের পর অবশেষে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন, ইহা সর্বৈব মিথ্যা। রানী ভবানী, কৃষ্ণচন্দ্র ও রাজবল্লভের মুখে নবীনচন্দ্র বড় বড় বক্তৃতা দিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা এ ষড়যন্ত্রে একবারেই লিপ্ত ছিলেন না। প্রধানত মীরজাফর ও জগৎশেঠ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ ওয়াটস্ সাহেবের মারফৎ কলিকাতার ইংরেজ কাউনসিলের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করেন। উমিচাঁদ আর রায়দুর্লভও ষড়যন্ত্রের বিষয় জানিতেন এবং ইহার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা মে কলিকাতার ইংরেজ কমিটি অনেক বাদানুবাদ ও আলোচনার পর মীরজাফরের সঙ্গে গোপন সন্ধি করা স্থির করিল এবং সন্ধির শর্তগুলি ওয়াটস্ সাহেবের নিকট পাঠানো হইল। সন্ধির শর্তগুলি মোটামুটি এই :

১। ফরাসীদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইতে হইবে।

২। সিরাজউদ্দৌলার কলিকাতা আক্রমণের ফলে কোম্পানীর ও কলিকাতায় অধিবাসীদের যাহা ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা পূরণ করিতে হইবে। ইহার জন্য কোম্পানীকে এক কোটি, ইংরেজ অধিবাসীদিগকে পঞ্চাশ লক্ষ ও অন্যান্য অধিবাসীদিগকে সাতাশ লক্ষ টাকা দিতে হইবে।

৩। সিরাজউদ্দৌলার সহিত সন্ধির সব শর্ত এবং পূর্বেকার নবাবদের ফরমানে ইংরেজ বণিকদিগকে যে সমুদয় সুবিধা দেওয়া হইয়াছিল, তাহা বলবৎ থাকিবে।

৪। কলিকাতার সীমানা ৬০০ গজ বাড়ানো হইবে এবং এই বৃহত্তর কলিকাতার অধিবাসীরা সর্ববিষয়ে কোম্পানীর শাসনাধীন হইবে। কলিকাতা হইতে দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত ভূখণ্ডে ইংরেজ জমিদার-স্বত্ব লাভ করিবে।

৫। ঢাকা ও কাশিমবাজারে কুঠি ইংরেজ কোম্পানী ইচ্ছামত সুদৃঢ় করিতে এবং সেখানে যত খুশী সৈন্য রাখিতে পারিবে।

৬। সুবে বাংলাকে ফরাসী ও অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোম্পানী উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য নিযুক্ত করিবে এবং তাঁহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি কোম্পানীকে দিতে হইবে।

৭। কোম্পানীর সৈন্য নবাবকে সাহায্য করিবে। যুদ্ধের অতিরিক্ত ব্যয়ভার নবাব দিতে বাধ্য থাকিবেন।

৮। কোম্পানীর একজন দূত নবাবের দরবারে থাকিবেন, তিনি যখনই প্রয়োজন বোধ করিবেন নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে পারিবেন এবং তাহাকে যথোচিত সম্মান দেখাইতে হইবে।

৯। ইংরেজের মিত্র ও শত্রুকে নবাবের মিত্র ও শত্রু বলিয়া পরিগণিত করিতে হইবে।

১০। হুগলির দক্ষিণে গঙ্গার নিকটে নবাব কোন নূতন দুর্গ নির্মাণ করিতে পারিবেন না।

১১। মীরজাফর যদি উপরোক্ত শর্তগুলি পালন করিতে স্বীকৃত হন, তবে ইংরেজরা তাঁহাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার পদে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করিবে।

সন্ধি স্বাক্ষরিত হইবার পূর্বে উমিচাঁদ বলিলেন যে মুর্শিদাবাদের রাজকোষে যত টাকা আছে তাঁহার শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁহাকে দিতে হইবে নচেৎ তিনি এই গোপন সন্ধির কথা নবাবকে বলিয়া দিবেন। তাঁহাকে নিরস্ত করার জন্য এক জাল সন্ধি প্রস্তুত হইল, তাহাতে ঐরূপ শর্ত থাকিল–কিন্তু মূল সন্ধিতে সেরূপ কোন শর্ত রহিল না। ওয়াটসন এই জাল সন্ধি স্বাক্ষর করিতে রাজী না হওয়ায় ক্লাইব নিজে ওয়াটসনের নাম স্বাক্ষর করিলেন।

যতদিন এইরূপ ষড়যন্ত্র চলিতেছিল ততদিন ক্লাইব বন্ধুত্বের ভান করিয়া নবাবকে চিঠি লিখিতেন, যাহাতে নবাবের মনে কোন সন্দেহ না হয়। কিন্তু মীরজাফর কোরান-শপথ করিয়া সন্ধির শর্ত পালন করিবেন এই প্রতিশ্রুতি পাইয়া ক্লাইব নিজ মূর্ত্তি ধারণ করিলেন। নবাবও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের বিষয় কিছু কিছু জানিতে পারিলেন এবং তাঁহাকে বন্দী করিতে মনস্থির করিয়া একদল সৈন্য ও কামানসহ মীরজাফরের বাড়ি ঘেরাও করিলেন। মীরজাফর ক্লাইবকে এই বিপদের সংবাদ জানাইয়া লিখিলেন যে তিনি যেন অবিলম্বে যুদ্ধযাত্রা করেন। মীরজাফর গোপনে ওয়াটসকে লিখিলেন তিনি যেন অবিলম্বে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। ওয়াটস্ এই চিঠি পাইয়া ১৩ই জুন অনুচরসহ মুর্শিদাবাদ হইতে চলিয়া গেলেন। ক্লাইবও মীরজাফরের চিঠি পাইয়া নবাবকে ঐ তারিখে চিঠি লিখিয়া জানাইলেন যে তাঁহার সহিত ইংরেজদের যে সকল বিষয়ে বিরোধ আছে, নবাবের পাঁচ জন কর্মচারীর উপর তাঁহার মীমাংসার ভার দেওয়া হউক এবং এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তিনি সসৈন্যে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিতেছেন। তিনি যে পাঁচজন কর্মচারীর নাম করিলেন, তাহারা সকলেই বিশ্বাসঘাতক এবং ইংরেজের পক্ষভুক্ত। এই চিঠি পাইয়া এবং ওয়ার্টসের পলায়নের সংবাদ পাইয়া সিরাজ ইংরেজের প্রকৃত মনোভাব বুঝিতে পারিলেন। এবং এতদিন পরে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইলেন। মোহনলাল, মীরমদন প্রভৃতি বিশ্বস্ত অনুচরেরা পরামর্শ দিল যে মীরজাফরকে অবিলম্বে হত্যা করা হউক। বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা নবাবকে মীরজাফরের সহিত মিটমাট করিবার উপদেশ দিলেন। এই বিষম সঙ্কটের সময় সিরাজ তাঁহার অস্থিরমতিত্ব, কূট রাজনীতিজ্ঞান ও দূরদর্শিতার অভাব এবং লোকচরিত্র সম্বন্ধে অনভিজ্ঞতার চূড়ান্ত প্রমাণ দিলেন। মীরজাফরের বাড়ি ঘেরাও করিয়া তিনি তাঁহাকে পরম শত্রুতে পরিণত করিয়াছিলেন। অকস্মাৎ তিনি ভাবিলেন যে অনুনয় বিনয় করিয়া মীরজাফরকে নিজের পক্ষে আনিতে পারা যাইবে। মীরজাফরের বাড়ির চারিদিকে তিনি যে কামান ও সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন তাহা ফিরাইয়া আনিয়া তিনি পুনঃ পুনঃ মীরজাফরকে সাক্ষাতের জন্য ডাকিয়া পাঠাইলেন। যখন মীরজাফর কিছুতেই নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না, তখন নবাব সমস্ত মানমর্যাদা বিসর্জন দিয়া স্বয়ং মীরজাফরের বাটীতে গমন করিলেন। মীরজাফর কোরান স্পর্শ করিয়া নিম্নলিখিত তিনটি শর্তে নবাবের পক্ষে থাকিতে রাজী হইলেন :

১। সমূহ বিপদ কাটিয়া গেলে মীরজাফর নবাবের অধীনে চাকুরী করিবেন না।

২। তিনি দরবারে যাইবেন না।

৩। আসন্ন যুদ্ধে তিনি কোন সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিবেন না।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সিরাজ এই সমুদয় শর্ত মানিয়া লইলেন এবং উপরোক্ত তৃতীয় শর্তটি সত্ত্বেও মীরজাফরকেই সেনাপতি করিয়া তাঁহার অধীনে এক বিপুল সৈন্যদলসহ যুদ্ধযাত্রা করিলেন। পলাশির প্রান্তরে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জুন তারিখে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইব ও নবাবের সৈন্য পরস্পরের সম্মুখীন হইল। ক্লাইবের সৈন্যসংখ্যা ছিল মোট তিন হাজার-২২০০ সিপাহী, ৮০০ ইউরোপীয়ান–পদাতিক ও গোলন্দাজ। নবাবের মোট সৈন্য ছিল ৫০,০০০ ১৫,০০০ অশ্বারোহী এবং ৩৫,০০০ পদাতিক। নবাবের মোট ৫৩টি কামান ছিল। সিষ্ট্রে নামক একজন ফরাসী সেনানায়কের অধীনেও কয়েকটি কামান ছিল। মোহনলাল ও মীরমদনের অধীনে ৫,০০০ অশ্বারোহী ও ৭,০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল। ২৩শে জুন প্রাতঃকালে যুদ্ধ অরম্ভ হইল। নবাবের পক্ষে সিনফ্রে গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। ইংরেজ সৈন্যও গোলাবর্ষণ করিল এবং আম্রকাননের অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ইহাতে উৎসাহিত হইয়া সিনফ্রে, মোহনলাল ও মীরমদন তাঁহাদের সৈন্য লইয়া ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করিলেন। মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভের অধীনস্থ বৃহং সৈন্যদল দর্শকের ন্যায় চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও নবাবের ক্ষুদ্র সেনাদলে বীরবিক্রমে অগ্রসর হইয়া ইংরেজ সৈন্যদের বিপন্ন করিয়া তুলিল। এই সময় অকস্মাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমদনের মৃত্যু হইল। ইহাতে নবাব অতিশয় বিচলিত ও মতিচ্ছন্ন হইয়া মীরজাফরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মীরজাফর প্রথমে আসেন নাই, কিন্তু পুনঃ পুনঃ আহ্বানের ফলে সশস্ত্র দেহরক্ষী সহ নবাবের শিবিরে আসিলেন। নবাব দীনভাবে নিজের পাগড়ী খুলিয়া মীরজাফরের সম্মুখে রাখিলেন এবং আলীবর্দীর উপকারের কথা স্মরণ করাইয়া নিজের প্রাণ ও মান রক্ষার জন্য মীরজাফরের নিকট করুণ নিবেদন জানাইলেন। মীরজাফর আবার কোরান স্পর্শ করিয়া নবাবকে অভয় দিলেন এবং বলিলেন “সন্ধ্যা আগতপ্রায়–আজ আর যুদ্ধের সময় নাই। আপনি মোহনলালকে ফিরিয়া আসিতে আজ্ঞা করুন। কাল প্রাতে আমি সমস্ত সৈন্য লইয়া ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করিব।” নবাব মোহনলালকে ফিরিতে আদেশ দিলেন। মোহনলাল ইহাতে অত্যন্ত আশ্চর্য বোধ করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে “এখন ফিরিয়া যাওয়া কোনক্রমেই সঙ্গত নহে। এখন ফিরিলেই সমস্ত সৈন্য হতাশ হইয়া পলাইতে আরম্ভ করিবে।” নবাবের তখন আর হিতাহিতজ্ঞান বা কোন রকম বুদ্ধি বিবেচনা ছিল না। তিনি মীরজাফরের দিকে চাহিলেন। মীরজাফর বলিলেন, “আমি যাহা ভাল মনে করি তাহা বলিয়াছি, এখন আপনার যেরূপ বিবেচনা হয় সেইরূপ করুন।” নির্বোধ নবাব মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার স্পষ্ট প্রমাণ পাইয়াও তাঁহার মতই গ্রহণ করিলেন, একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর মোহনলালের উপদেশ গ্রাহ্য করিলেন না। তিনি পুনঃ পুনঃ মোহনলালকে ফিরিবার আদেশ পাঠাইলেন। মোহনলাল অগত্যা ফিরিতে বাধ্য হইলেন। … ….

এই সমুদয় বিদ্রোহ থামিতে না থামিতেই মীরজাফরের সৈন্যদল বিদ্রোহ করিল। তাহাদের অনেক বেতন বাকী ছিল সুতরাং তাহারা পুনঃ পুনঃ ইহা পরিশোধ করিবার জন্য নবাবের নিকট আবেদন করিল। নবাব ক্রুদ্ধ হইয়া অনেক সৈন্য বরখাস্ত করিলেন। ইহার ফলে সৈন্যরা তাঁহার প্রাসাদ অবরোধ করিল। নবাবের দুর্ব্যবহারে বিহারের দুইজন জমিদার সুন্দর সিংহ ও বলবন্ত সিংহ বিদ্রোহ করিলেন।

ইতিমধ্যে আর এক গুরুতর সংকট উপস্থিত হইল। এই সময়ে দিল্লির সাম্রাজ্য নামেমাত্র পর্যবসিত হইয়াছিল। দিল্লির নামসর্বস্ব বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীর মাত্র দিল্লি ও তাঁহার চতুর্দিকে সামান্য ভূখণ্ডে রাজত্ব করিতেন কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল তাঁহার উজীরের হস্তে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আফগান সুলতান আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি আক্রমণ করিলেন এবং উজীর গাজীউদ্দীন ইমাদ্-উল-মুলক আত্মসমর্পণ করিলেন (জানুয়ারী, ১৭৫৭ খ্রী)। আবদালী রুহেলা নায়ক নাজীবউদ্দৌল্লাকে দিল্লিতে তাঁহার প্রতিনিধি হিসাবে রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে আবদালীর এই আক্রমণে ভীত হইয়াই সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদিগের সহিত ফেব্রুয়ারী মাসে সন্ধি করিয়াছিলেন।

আবদালীর প্রস্থানের পরই মারাঠাগণ দিল্লি আক্রমণ করিল (অগস্ট, ১৭৫৭ খ্রী) এবং নাজীবউদ্দৌল্লাকে সরাইয়া আবার গাজীউদ্দীনকে উজীর নিযুক্ত করিল। গাজীউদ্দীন বাদশাহ ও তাঁহার পুত্র (বাদশাহজাদা) উভয়ের সঙ্গেই খুব দুর্ব্যবহার করিতেন। তাঁহার হাত হইতে পরিত্রাণ লাভের জন্য বাদশাহজাদা দিল্লি হইতে পলায়ন করিয়া নাজীবউদ্দৌল্লার আশ্রয় গ্রহণ করিলেন (মে, ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দ)। বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীর তাঁহার পুত্রকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বাংলার নবাব পরিবর্তন এবং আভ্যন্তরিক অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সুযোগে অকর্মণ্য মীরজাফরকে পদচ্যুত করিয়া বাংলার মসনদে বাদশাহজাদাকে বসাইবার জন্য এলাহাবাদের সুবাদার মুহম্মদ কুলী খান ও অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লা বাদশাহজাদাকে সম্মুখে রাখিয়া বিহার আক্রমণ করিতে মনস্থ করিলেন। পূর্ব্বোক্ত বিহারের বিদ্রোহী জমিদার দুইজনও তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

এই আক্রমণের সংবাদে মীরজাফর অত্যন্ত বিচলিত হইলেন, কারণ তাঁহার সৈন্যেরা পূর্ব হইতেই বিদ্রোহী ছিল। শাহজাদার সংবাদ শুনিয়া জমিদারদের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সঙ্গে যোগ দিতে মনস্থ করিল। নবাব অনন্যোপায় হইয়া সোনা রূপার তৈজসপত্র বিক্রয় করিয়া সৈন্যগণের বাকী বেতন কতকটা শোধ করিলেন এবং ইংরেজ সৈন্যের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। শাহজাদাও ক্লাইবের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ইতিমধ্যে বাদশাহ উজীরের চাপে পড়িয়া শাহজাদার পরিবর্তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অন্য সুবাদার নিযুক্ত করিলেন এবং মীরজাফরকে আদেশ দিলেন যেন অবিলম্বে শাহজাদাকে আক্রমণ ও বন্দী করেন। শাহজাদা পাটনা দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন (মার্চ, ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দ)। কিন্তু ক্লাইবের হস্তে তিনি পরাজিত হইলেন। তখন শাহজাদা ইংরেজের নিকট কিছু অর্থ সাহায্য চাহিলেন। ক্লাইব তাঁহাকে দশহাজার টাকা দিলে তিনি বিহার ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। দিল্লির উজীর শাহজাদার পরাজয়ে খুশী হইয়া বাংলায় মীরজাফরের কর্তৃত্ব অনুমোদন করিলেন এবং মীরজাফরের অনুরোধে ক্লাইবকে একটি সম্মানসূচক পদবী দিলেন। মীরজাফরও ক্লাইবকে এই পদের উপযুক্ত জায়গীর প্রদান করিলেন।

এই যুদ্ধে মীরজাফরের পুত্র মীরন নবাব-সেনার নায়ক ছিলেন। মীরন কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর প্রতি দুর্ব্যবহার করায় তাঁহারা মীরনের প্রস্থানের পরই কয়েকজন জমিদারের সঙ্গে একযোগে বিদ্রোহ করিয়া শাহজাদাকে আবার বিহার আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ করিলেন। এই আমন্ত্রণ পাইয়া ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষভাগে শাহজাদা আবার বিহার আক্রমণ করিবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। শোন নদের নিকট পৌঁছিয়া তিনি সংবাদ পাইলেন যে তাঁহার। পিতা উজীর কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছেন। অমনি তিনি দ্বিতীয় শাহ আলম নামে নিজেকে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লাকে উজীর নিযুক্ত করিলেন। তিনি অভিষেকের আমোদ-উৎসবে বহু সময় কাটাইলেন। এই অবসরে পাটনায় রামনারায়ণ দুর্গ রক্ষার বন্দোবস্ত শেষ করিলেন এবং ক্যাইলোডের অধীনে একদল ইংরেজ সৈন্য পাটনায় পৌঁছিল। ইংরেজ সৈন্য পৌঁছিবার পূর্বেই রামনারায়ণ বাদশাহী ফৌজকে আক্রমণ করিয়া পরাস্ত হইলেন (৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৭৬০ খ্রী)। কিন্তু শাহ আলম পাটনার নিকট পৌঁছিলেও দুর্গ আক্রমণ করিতে ভরসা পাইলেন না এবং ২২শে ফেব্রুয়ারী ক্যাইলোডের হস্তে পরাস্ত হইয়া তিনি বিহার সহরে প্রস্থান করিলেন। অতঃপর শাহ আলম মুর্শিদাবাদ আক্রমণের জন্য কামগার খানের অধীনস্থ একদল অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়া বিষ্ণুপুর পৌঁছিলেন। এইখানে একদল মারাঠা সৈন্য তাঁহার সঙ্গে যোগ দিল। এই সময় মীরজাফরের নবাবীর শেষ অবস্থা এবং বাংলা দেশেরও চরম দুরবস্থা। সম্ভবত এই সকল সংবাদ শুনিয়াই শাহ আলম বাংলা দেশ আক্রমণ করিতে উৎসাহিত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার আশা পূর্ণ হইল না। তাঁহার কতক সৈন্য দামোদর নদ পার হওয়ার পরই ইংরেজ সৈন্যের সহিত তাহাদের একটি খণ্ডযুদ্ধ হইল (৭ই এপ্রিল, ১৭৬০ খ্রী)। শাহ আলম তখন তাড়াতাড়ি ফিরিয়া অরক্ষিত পাটনা দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু ইংরেজ সৈন্য পাটনায় পৌঁছিলে (২৮শে এপ্রিল, ১৭৬০ খ্রী) বাদশাহ পাটনা ত্যাগ করিয়া রাণীসরাই নামক স্থানে উপস্থিত হইলেন। এখানে ফরাসী অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল সাহেব তাঁহার সহিত যোগ দিলেন। কিন্তু হাজীপুরে ইংরেজ সৈন্য খাদিম হোসেনকে পরাজিত করিলে (১৯শে জুন) বাদশাহ ভগ্নমনোরথ হইয়া বিহার প্রদেশ হইতে প্রস্থান করিয়া যমুনা তীরে পৌঁছিলেন (অগস্ট, ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ)।

বাদশাহ শাহ আলমের আক্রমণের সুযোগ লইয়া মারাঠা সেনানায়ক শিবভট্ট বৃহৎ একদল সৈন্যসহ কটক আক্রমণ করিলেন। ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের আরম্ভে তিনি মেদিনীপুর অধিকার করিলেন। বীরভূমের জমিদারও তাঁহার সঙ্গে যোগ দিলেন। মীরজাফর তখন ইংরেজ সৈন্যের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ইংরেজ সৈন্য অগ্রসর হইবামাত্র শিবভট্ট বিনা যুদ্ধে বাংলা দেশ হইতে প্রস্থান করিলেন।

এই সময়ে পূর্ণিয়ার নায়েব নাজিম খাদিম হোসেন খানও বিদ্রোহী হইয়া শাহ আলমের সঙ্গে যোগ দিবার জন্য অগ্রসর হইয়াছিলেন। মীরন ও ক্যাইলোড দুই সেনাদল লইয়া তাঁহাকে বাধা দানের জন্য অগ্রসর হইলেন। ১৬ই জুন খাদিম হোসেন খান পরাজিত হইয়া পলায়ন করিলেন এবং নবাবের সৈন্য তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিল। কিন্তু ৩রা জুলাই অকস্মাৎ শিবিরে বজ্রাঘাতে মীরনের মৃত্যু হওয়ায় নবাবসৈন্য ফিরিয়া আসিল।

এইরূপে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে শাহ আলম ও শিবভট্টের আক্রমণ এবং খাদিম হোসেনের বিদ্রোহ বাংলা দেশকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইংরেজ সৈন্যের সহায়তায় মীরজাফর এই তিনটি বিপদ হইতেই উদ্ধার পাইলেন।

কিন্তু অচিরেই আর এক বিপদ উপস্থিত হইল। ইংরেজ ও ফরাসীদের ন্যায় ওলন্দাজরাও বাংলায় বাণিজ্য করিত এবং হুগলির নিকটবর্তী চুঁচুড়ায় তাহাদের বাণিজ্য-কুঠি ছিল। মীরজাফ