- বইয়ের নামঃ বাংলা দেশের ইতিহাস – ২য় খণ্ড (মধ্যযুগ)
- লেখকের নামঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার
- প্রকাশনাঃ দিব্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০. প্রসঙ্গকথা / ভূমিকা
বাংলা দেশের ইতিহাস – দ্বিতীয় খণ্ড (মধ্যযুগ]
ভারততত্ত্ব-ভাস্কর শ্ৰীরমেশচন্দ্র মজুমদার এম-এ, পিএই-ডি, ডি-লিট্ সম্পাদিত
.
প্রসঙ্গকথা (বর্তমান সংস্করণ)
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি গৌড়রাজমালা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R. C. Majumdar) The History of Bengal Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।
এই গ্রন্থ রচনায় রমেশচন্দ্র মজুমদার একজন মেধাবি ঐতিহাসিকের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থ তিনি টিকা টিপ্পনির ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সহজবোধ্যভাবে যেন পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। অথচ তারপরেও নানা তথ্যে সমৃদ্ধ একটি অভিজাত ইতিহাস গ্রন্থই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।
আমরা দেখেছি বিশ শতক পর্যন্ত কালপরিসরের মধ্যে অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের প্রয়াস ছাড়া প্রায় সকল ইতিহাস গ্রন্থই রাজনৈতিক ইতিহাসে আটকে ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চ্চা তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। এর বড় কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার মত তথ্য সূত্রের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসূত্র অনুসন্ধানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নতুন করে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে।
অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সূত্র-সংকটের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। তাই তাঁর গ্রন্থে (বাংলাদেশের ইতিহাস) অত্যন্ত সার্থকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্পষ্টভাবেই।
ইতিহাসে একটি কথা রয়েছে যে ইতিহাস বা ইতিহাসের ঘটনা বার বার ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো বলা হয় ইতিহাসে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। শেষ সত্যে পৌঁছা যায় না, তবে নতুন নতুন তথ্যে বার বার সংস্কার করে সত্যের দিকে এগিয়ে চলা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তখন প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিজ মেধা প্রয়োগ করে তিনি অনেক বাধাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
একারণেই তাঁর গ্রন্থে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিল্পকলা সকল কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ। একজন ইতিহাস পাঠককে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানানোর জন্য যেভাবে সূচি বিন্যাস করা দরকার তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছেন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন বাংলাদেশের সাথে। নৃতাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ ধারা উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম আলোচনায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শাসকদের শাসনকালের বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার।