১. গোপাল (আ ৭৫০-৭৭০)
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর পুনঃপুন আক্রমণের ফলে বাংলার রাজতন্ত্র ধ্বংসপ্রায় হইয়াছিল। প্রায় সহস্র বৎসর পরে তিব্বতীয় বৌদ্ধ লামা তারনাথ এই যুগের বাংলার সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে সমগ্র দেশের কোনো রাজা ছিল না, প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ, এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করিতেন। ফলে লোকের দুঃখ-দুর্দশার আর সীমা ছিল না। সংস্কৃতে এইরূপ অরাজকতার নাম মাৎস্যন্যায়। পুকুরের যেমন বড় মাছ ছোট মাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে, দেশে অরাজকতার সময় সেইরূপ প্রবল অবাধে দুৰ্ব্বলের উপর অত্যাচার করে, এই জন্যই মাৎস্যন্যায় এই সংজ্ঞার উৎপত্তি। সমসাময়িক লিপিতে বাংলা দেশে মাৎস্যন্যায়ের উল্লেখ আছে-সুতরাং তারনাথের বর্ণনা মোটামুটি সত্য বলিয়াই গ্রহণ করা যায়। এই চরম দুঃখ-দুর্দশা হইতে মুক্তিলাভের জন্য বাঙ্গালী জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়াছিল, ইতিহাসে তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করিলেন যে পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদ ভুলিয়া একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করিবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাঁহার প্রভুত্ব স্বীকার করিবেন। দেশের জনসাধারণও সানন্দে এই মত গ্রহণ করিল। ইহার ফলে গোপাল নামক এক ব্যক্তি বাংলা দেশের রাজপদে নিৰ্বাচিত হইলেন। এইরূপে কেবলমাত্র দেশের মঙ্গলের দিকে চাহিয়া ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জনপূর্ব্বক সর্ব্বসাধারণে মিলিয়া কোনো বৃহৎ কাৰ্য্য অনুষ্ঠান যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না, বর্ত্তমান ক্ষেত্রে এই মহান স্বার্থত্যাগ ও ঐক্যের ফলে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন যে উন্নতি ও গৌরবের চরম শিখরে উঠিয়াছিল, তাঁহার দৃষ্টান্তও বাংলার ইতিহাসে আর নাই। ১৮৬৭ অব্দে জাপানে যে গুরুতর রাজনৈতিক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল, কাৰ্য্য, কারণ ও পরিণাম বিবেচনা করিলে তাঁহার সহিত সহস্রাধিক বৎসর পূর্ব্বে গোপালের রাজপদে নির্বাচনের তুলনা করা যাইতে পারে।
গোপালের বংশপরিচয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গোপাল ও তাঁহার বংশধরগণ সকলেই বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন। পালরাজগণের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ব্ববিদ্যাবিশুদ্ধ ছিলেন এবং গোপালের পিতা বপট শক্রর দমন এবং বিপুল কীর্তিকলাপে সসাগরা বসুন্ধরাকে ভূষিত করিয়াছিলেন। সুতরাং গোপাল যে কোনো রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এরূপ মনে হয় না। তাঁহার পিতা যুদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গোপালও সম্ভবত পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া প্রবীণ ও সুনিপুণ যোদ্ধা বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। কারণ এই সঙ্কট সময়ে বাংলার নেতাগণ যে বংশমর্যাদাহীন যুদ্ধানভিজ্ঞ তরুণ-বয়স্ক কোনো ব্যক্তিকে রাজপদে নির্বাচন করিয়াছিলেন, এরূপ সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। পরবর্ত্তীকালে পালগণ ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচিত ছিলেন। গোপালের পুত্র ধর্ম্মপাল সমসাময়িক একখানি গ্রন্থে ‘রাজভটাদিবংশ পতিত’ বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। ইহা হইতে কেহ কেহ অনুমান করেন যে পালরাজগণ খড়গবংশীয় রাজা রাজরাজভটের বংশধর। কিন্তু এখানে রাজভট শব্দ রাজসৈনিক অর্থে গ্রহণ করাই অধিকতর সমীচীন বলিয়া মনে হয়। ইহা পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থক।
গোপালের তারিখ সঠিক জানা যায় না। তবে তিনি অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজপদে নিৰ্বাচিত হইয়াছিলেন, ইহাই সম্ভবপর মনে হয়। প্রায় চারিশত বর্ষ পরে রচিত রামচরিত গ্রন্থে বরেন্দ্রভূমি পালরাজগণের ‘জনকভূ’ অর্থাৎ পিতৃভূমি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহা হইতে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে গোপাল বরেন্দ্রের অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রথমেই সমগ্র বাংলা দেশের অধিপতি নির্বাচিত হইয়াছিলেন কি না তাহা সঠিক জানা যায় না। কিন্তু তাঁহার রাজ্যকালে সমগ্র বঙ্গদেশই তাঁহার শাসনাধীন হইয়াছিল এবং বহুদিন পরে বাংলায় দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির সহিত সুখ ও শান্তি ফিরিয়ে আসিয়াছিল। ইহাই গোপালের প্রধান কীর্তি। তাঁহার রাজ্যকালের কোনো বিবরণই আমরা জানি না। কিন্তু তিনি যে শতাব্দীব্যাপী বিশৃঙ্খলার পর তাঁহার রাজ্য এমন শক্তশালী ও সুসমৃদ্ধ করিয়া যাইতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র যে সমগ্ৰ আৰ্য্যাবর্তে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, ইহাতেই তাঁহার রাজোচিত গুণাবলী ও ভূয়োদর্শনের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
.
২. ধর্ম্মপাল (আ ৭৭০-৮১০)
গোপালের মৃত্যুর পর আ ৭৭০ অব্দে তাঁহার পুত্ৰ ধৰ্ম্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্ম্মপাল বীর, সাহসী ও রাজনীতিকুশল ছিলেন। গোপালের সুশাসনের ফলে বাংলা দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধি অনেক বাড়িয়েছিল। সুতরাং ধর্ম্মপাল প্রথম হইতেই আৰ্য্যাবৰ্ত্তে এক সাম্রাজ্য স্থাপনের কল্পনায় মাতিয়া উঠিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তাঁহার এক প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত হইল। ইনি প্রতীহারবংশীয় রাজা বৎসরাজ। প্রতীহারেরা সম্ভবত গুজ্জরজাতীয় ছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে এই গুজ্জর জাতি হূণদিগের সঙ্গে বা অব্যবহিত পরে ভারতে আসিয়া পাঞ্জাব রাজপুতানা ও মালবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করে। অষ্টম শতাব্দীর শেষার্ধে মালব ও রাজপুতানার প্রতীহার রাজা বৎসরাজ বিশেষ শক্তিশালী হইয়া উঠেন। যে সময় ধর্ম্মপাল বাংলা দেশ হইতে পশ্চিম দিকে বিজয়াভিযান করেন, সেই সময় বসরাজও সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টায় পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হন। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং ধর্ম্মপাল পরাজিত হন। কিন্তু ধর্ম্মপালের সৌভাগ্যক্রমে এই সময় দক্ষিণাপথের রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব আৰ্য্যাবর্তে বিজয়াভিযান করিয়া বসরাজকে পরাজিত করেন। বসরাজ পলাইয়া মরুভূমিতে আশ্রয় লইলেন এবং তাঁহার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা দূরীভূত হইল।