১. গৌড়
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে আনুমানিক ৬৩৮ অব্দে হুয়েন সাং বাংলা দেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি কজঙ্গল (রাজমহলের নিকট), পুণ্ড্রবর্দ্ধন, কর্ণসুবর্ণ, সমতট ও তাম্রলিপ্তি এই পাঁচটি বিভিন্ন রাজ্যের উল্লেখ করিয়াছেন। উৎকল এবং কোঙ্গোদও তখন স্বাধীন রাজ্য ছিল। আৰ্য্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে উক্ত হইয়াছে যে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড়রাষ্ট্র আভ্যন্তরিক কলহ ও বিদ্রোহে ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছিল; একাধিক রাজার অভ্যুদয় হয়-তাঁহার মধ্যে কেহ এক সপ্তাহ, কেহ বা এক মাস রাজত্ব করেন; শশাঙ্কের পুত্র মানব ৮ মাস ৫ দিন রাজত্ব করেন। এই বর্ণনা সম্ভবত অনেক পরিমাণে সত্য। এই প্রকার আত্মঘাতী অন্তর্বিদ্রোহই সম্ভবত শশাঙ্কের বিশাল রাজ্যের শক্তি নষ্ট এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে।
আঃ ৬৪১ অব্দে হর্ষবর্দ্ধন মগধ জয় করেন এবং পর বৎসর তিনি উত্তাল ও কোঙ্গোদে বিজয়াভিযান করেন। এই সময়েই কামরূপরাজ ভাস্করবর্ম্মা গৌড় জয় করিয়া কর্ণসুবর্ণে তাঁহার জয়স্কন্ধাবার সন্নিবেশিত করেন। আঃ ৬৪২ অব্দে যখন হর্ষ জঙ্গল রাজ্যে অবস্থিতি করিতেছিলেন তখন ভাস্করবর্ম্মা বিশ হাজার রণহস্তী লইয়া হর্ষের সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁহার ত্রিশ হাজার রণপোতও গঙ্গা নদী দিয়া কজঙ্গলে গমন করে। এইরূপে শশাঙ্কের দুই প্রবল শত্রু তাঁহার রাজ্যের ধ্বংস সাধন করে।
৬৪৬ অথবা ৬৪৭ অব্দে হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যু হয়। ইহার পরই তাঁহার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় এবং তিব্বতরাজ কামরূপ ও পূর্ব্বভারতের কিয়দংশ অধিকার করেন। সুতরাং গৌড়ে ভাস্করবর্ম্মার অধিকার খুব বেশী দিন স্থায়ী হয় নাই। ইহার পরেই জয়নাগ নামক একজন রাজা কর্ণসুবর্ণে রাজত্ব করেন। তাঁহার মহারাজাধিরাজ উপাধি হইতে অনুমান হয় যে তিনি বেশ শক্তিশালী রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁহার রাজ্যের বিস্তৃতি অথবা তাঁহার সম্বন্ধে আর কোনো বিবরণ জানা যায় না।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্ত্তী একশত বৎসর গৌড়ের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় যুগ। এই যুগে অনেক বহিঃশত্রু এই রাজ্য আক্রমণ করে। অনেকে অনুমান করেন যে তিব্বতরাজ ও পরবর্ত্তী গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ এই রাজ্য জয় করিয়াছিলেন-কিন্তু ইহার বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ নাই। অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে শৈলবংশীয় একজন রাজা পুদেশ জয় করেন। ইহার অনতিকাল পরে কনৌজের রাজা যশোবৰ্ম্মা গৌড়রাজকে পরাভূত ও বধ করেন। কনৌজের রাজকবি বাকপতিরাজ এই ঘটনা উপলক্ষ করিয়া গৌড়বহো (গৌড় বধ) নামক প্রাকৃত ভাষায় এক কাব্য রচনা করেন। কিন্তু ইহার পরেই কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের হাতে যশোবর্ম্মার পরাজয় ঘটে এবং তাঁহার বিশাল রাজ্য ধ্বংস হয়। গৌড়রাজ ললিতাদিত্যের অধীনতা স্বীকার করেন। রাজতরঙ্গিণী নামক কাশ্মীরের ইতিহাসে গৌড় সম্বন্ধে যে একটি আখ্যান লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ললিতাদিত্য গৌড়রাজকে কাশ্মীরে আমন্ত্রণ করেন এবং বিষ্ণুমূর্ত্তি স্পর্শ করিয়া শপথ করেন যে কাশ্মীরে গেলে তাঁহার কোনো বিপদ ঘটিবে না। অথচ গৌড়রাজ কাশ্মীর যাওয়ার পরেই ললিতাদিত্য তাঁহাকে হত্যা করেন। এই ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ লইবার জন্য গৌড়রাজের কতিপয় বিশ্বস্ত অনুচর তীর্থযাত্রার ছলে কাশ্মীর গিয়া উক্ত বিষ্ণুমূর্ত্তি ভাঙ্গিবার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করে। ভুলক্রমে তাহারা অন্য একটি মূর্ত্তি ভাঙ্গিতে আরম্ভ করে এবং ইতিমধ্যে কাশ্মীরের সৈন্য আসিয়া তাহাদিগকে হত্যা করে। রাজতরঙ্গিণীর রচয়িতা ঐতিহাসিক কুতুণ এই বাঙ্গালী বীর অনুচরগণের প্রভুভক্তি ও আত্মোৎসর্গের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছেন যে উক্ত মন্দিরটি আজও শূন্য কিন্তু পৃথিবী গৌড়বীরগণের প্রশংসায় পূর্ণ। কুতুণ ললিতাদিত্যকে আদর্শ রাজা বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন কিন্তু তিনি স্বীকার করিয়াছেন যে চন্দ্রের ন্যায় ললিতাদিত্যের নির্মল চরিত্রে দুইটি দুরপনেয় কলঙ্ক ছিল এবং গৌড়রাজের হত্যা তাঁহার অন্যতম। রাজকবির এই সমুদয় উক্তি হইতে উল্লিখিত গৌড়বীরগণের কাহিনী সত্য বলিয়াই অনুমিত হয়।
কহ্লণ লিখিয়াছেন যে ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় পিতামহের অনুকরণে দিগ্বিজয়ে বাহির হন। কিন্তু তাঁহার অনুপস্থিতিতে জৰ্জ্জ কাশ্মীর রাজ্য অধিকার করে এবং জয়াপীড়ের সৈন্যগণও তাঁহাকে পরিত্যাগ করে। অতঃপর সমুদয় অনুচরগণকে বিদায় দিয়া একাকী ছদ্মবেশে ভ্রমণ করিতে করিতে তিনি পুণ্ড্রবর্দ্ধন নগরীতে উপস্থিত হন। এই প্রদেশ তখন জয়ন্ত নামক একজন সামন্ত রাজার অধীনে ছিল। জয়াপীড় জয়ন্তের কন্যাকে বিবাহ করেন এবং গৌড়ের পাঁচজন রাজাকে পরাস্ত করিয়া জয়ন্তকে তাঁহাদের অধীশ্বর করেন। এই কাহিনী কত দূর সত্য বলা যায় না। তবে গৌড় যে তখন পাঁচ অথবা একাধিক খণ্ডাজ্যে বিভক্ত ছিল, ইহা সম্ভব বলিয়াই মনে হয়।
নেপালের লিচ্ছবিরাজ দ্বিতীয় জয়দেবের শিলালিপিতে গৌড়ের আর এক বহিঃশত্রুর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫৩ সংবতে (৭৪৮ অথবা ৭৫৯ খৃষ্টাব্দ) উৎকীর্ণ এই লিপিতে নেপালরাজের শ্বশুর ভগদত্তবংশীয় রাজা হর্ষ গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ ও কোশলের অধিপতিরূপে অভিহিত হইয়াছেন। ভগদত্তবংশীয় রাজগণ কামরূপে রাজত্ব করিতেন, সুতরাং অনেকেই অনুমান করেন যে কামরূপরাজ হর্ষ গৌড় জয় করিয়াছিলেন। কিন্তু উড়িষ্যার করবংশীয় রাজগণও ভগদত্তবংশীয় বলিয়া দাবী করিতেন। সুতরাং অসম্ভব নহে যে হর্ষ করবংশীয় রাজা ছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র গৌড়াধিপ এই সম্মানসূচক পদবী হইতে কামরূপ বা উৎকলের কোনো রাজা গৌড়ে রাজত্ব করিতেন এইরূপ স্থির সিদ্ধান্ত করা যায় না-তবে সম্ভবত তিনি গৌড়ে বিজয়াভিযান করিয়া কিছু সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন।