আসমানী আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
জাহানারা জবাব দিলেন না; আসমানী বলল, আমি খারাপ মেয়ে। এখন চিনেছেন?
জাহানারা প্ৰায় ফিসফিস করে বললেন, তুমি এখানে এসেছ কেন? কী চাও তুমি?
কথা বলতে আসছি।
কী কথা তোমার?
আপনার কি শরীর খারাপ?
আমার শরীর খারাপ না ভাল তা দিয়ে তোমার দরকার নেই! তুমি এ বাড়িতে এসেছে কেন?
আসমানী হাসি মুখে বলল, আপনার স্বামী, আপনার ছেলে যদি আমাদের বাড়িতে আসতে পারে, আমরা আসতে পারব না কেন?
চাও কী তুমি?
কথা বলতে আসছি।
কার সঙ্গে কথা বলতে এসেছ?
আপনার সাথে। আপনি ছোট সাহেবের মা। আপনার সাথেই কথা বলা দরকার।
বল কী বলবে।
ছোট সাহেব প্রায়ই আমার কাছে যায়। এইটা আপনারে জানালাম।
তার যেখানে ইচ্ছা সে সেখানে যাবে। সে যদি নরকের কৃমির সঙ্গে সময় কাটাতে চায়, কাটাবে। আমাকে বলার দরকার নেই। তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমাকে বলতে আস! জুতা দিয়ে পিটিয়ে আমি তোমাকে…
উত্তেজনায় জাহানারার কথা আটকে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বিনু চলে এসেছে। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। জাহানারা চাপা গলায় বললেন, বিনু লাথি দিয়ে এই হারামজাদি মেয়েকে রাস্তায় বের করে দাও। এত বড় সাহস!
বিনু আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলল, উনার শরীর ভাল না। তুমি বাইরে এসে বস। কী কথা বলতে এসেছ আমাকে বল।
আসমানী খুবই সহজ গলায় বলল, আমার কথা বলা শেষ। এখন আমি চলে যাব। ছোট সাহেব যদি অন্য মানুষদের মত হত, আমি কিছুই বলতে আসতাম না। নষ্ট পুরুষ মানুষ ফূর্তি করার জন্যে খারাপ পাড়ায় যাবেই। এটা নতুন কী! কিন্তু ছোট সাহেব তো অন্যদের মত না। হঠাৎ একদিন যদি বলে, আসমানী আমারে বিবাহ করা। তখন কী উপায় হব? আপনার ছেলের বউ হিসেবে আমারে ঘরে নিবেন?
জাহানারা চেঁচিয়ে বললেন, বিনু এই হারামজাদি মেয়ে এইসব কী বলছে? সে এখনো কোন যাচ্ছে না?
আসমানী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যেটা সত্য সেটা বলতেছি। কিছু সত্য কথা আছে বলতে খারাপ লাগে, কিছু শুনতে ভাল লাগে। আমারটা সেই রকম।
জাহানারা বললেন, বের হ। এই মেয়ে তুই বের হ। তুই এই মুহূর্তে বের হ। বলতে বলতে জাহানারা খাট থেকে নামতে গেলেন। বিনু এসে তাকে ধরে ফেলল। তিনি শরীর এলিয়ে বিনুর কাঁধে পড়ে গেলেন। আসমানী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে–তাকে ঘিরে যে নাটকটা তৈরি হয়েছে, সেই নাটক দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে।
জাহানারার জ্বর খুব বেড়েছে। তার মাথায় অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালা হচ্ছে— জ্বর তেমন নামছে না। বরং যতই সময় যাচ্ছে চোখ ততই লালচে হয়ে আসছে। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। অষুধপত্র দেন নি। অষুধপত্র দেবার মত কিছু হয় নি। বুক পরিষ্কার, প্রেসার নরম্যাল।
বিনুর কাছে কোনো কিছুই নরম্যাল মনে হচ্ছে না। জাহানারা একবার বললেন, শুভ্রর বাবা কি এসেছে? বিনু চমকে উঠে বলল, কী বলছেন? জাহানারা চোখ বন্ধ করতে করতে বললেন, কিছু না। হঠাৎ মনে হল শুভ্ৰর বাবা বেঁচে আছে। শুভ্ৰ এর মধ্যে বাড়িতে টেলিফোন করে নি?
বিনু বলল, না।
ও যদি টেলিফোন করে, আমার অসুখের খবর দিবে না।
জ্বি আচ্ছা।
ঐ হারামজাদি মেয়ের কথাও কিছু বলবে না।
জ্বি আচ্ছা।
যদি কিছু বল— ঐ হারামজাদিকে আমি যেভাবে জুতাপেটা করে তাড়িয়েছি, তোমাকেও সেভাবে জুতাপেটা করে তাড়াব।
জ্বি আচ্ছা।
যে চেয়ারে ঐ হারামজাদি বসেছিল, সেই চেয়ারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে বলেছিলাম, এখনো ফেলছ না কেন? আর শোন, তোমাকে না বললাম— আমার গায়ে হাত না দিতে। গায়ে হাত দিচ্ছ কেন?
টেলিফোনের রিং হচ্ছে। জাহানারা মাথা উঁচু করে বললেন, শুভ্ৰ টেলিফোন করেছে। বিনু, টেলিফোন ধর।
চবিনু টেলিফোন ধরল। শুভ্ৰই টেলিফোন করেছে। শুভ্ৰ খুশি খুশি গলায় বলল, কে, বিনু?
হ্যাঁ।
বিনু তোমার বিষয়ে আমার ইন্টারেস্টিং একটা অবজারভেশন আছে। অবজারভেশনটা হচ্ছে- টেলিফোনে তোমার গলা একেকদিন একেক রকম শোনায়।
ও।
কথাটা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?
বিশ্বাস হবে না কেন? আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবেন না।
শুধু তোমার ব্যাপার না, আমি অনেকের ব্যাপারেই লক্ষ করেছি- একই টেলিফোন সেটে কথা বলছে তারপরেও গলার স্বর সকালে এক রকম, আবার দুপুরে এক রকম।
ও।
আমার ধারণা টেলিফোন লাইনে যে ভোল্টেজ থাকে তার ওঠানামাতে এটা হয়।
আপনি কি এই কথাগুলি বলার জন্যেই টেলিফোন করেছেন?
উঁহু। মার খবর জানার জন্যে টেলিফোন করেছি। এখন জ্বর কেমন?
কম।
মা কি আমার ওপর রেগে আছে?
রেগে থাকার মত কিছু কি করেছেন?
জ্বর শুনেও মাকে দেখতে যাই নি।
দেখতে যান নি কেন?
বিনু, আসলে কী হয়েছে শোন। আমি মাকে দেখার জন্যে ঘর থেকে বের হলাম। বারান্দায় এসে ভুলে গেলাম কী জন্যে ঘর থেকে বের হয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে পড়লাম। তখন মনে পড়ল। কিন্তু তখন আর গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছা করল না। এই হল ঘটনা।
এখন আপনি কোথায়?
রাস্তায়। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি আমাকে নিয়ে শহরে ঘুরপাক খেতে। বৃষ্টি হচ্ছে তো। গাড়িতে বসে বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগছে। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি মোবাইল টেলিফোনে।
ও।
মোবাইল টেলিফোনটা আমার না। অসমানীর। ওর টেলিফোন যে পকেটে করে নিয়ে চলে এসেছি বুঝতেই পারি নি। সে বেচারি হয়ত কোথাও টেলিফোন না পেয়ে খুব টেনশন করছে। কারুক টেনশন।
বিনু শুভ্রর আনন্দময় হাসি শুনল।